ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১১

0
479

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

11.

পুরো একটা দিন পার হয়ে গেল তবুও আরিশ ভাইয়া কোন খোঁজ খবরই নিলেন না। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুখন আগে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। অন্য দিনের মতো আজকে আর ভিজতে ইচ্ছে করছে না কারন আজকে তো আর আমাকে কেও বৃষ্টিতে না ভেজার জন্য থ্রে/ড দিচ্ছেন না। যে বৃষ্টিতে ভিজতে ওনার থেকে পারমিশন নিয়ে হাজারো ধমক সহ্য করে ভিজতে হয় সেই বৃষ্টিতে ভিজতে আমার আনন্দ লাগে। আজ বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু ভিজতে যাবো তার পারমিশন দেওয়ার জন্য উনি নেই। আমার বিছানাটা জানালার ধারে তাই বৃষ্টি পড়লেই জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে সহজেই বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করা যায়।
সামনে বই খাতা খুলে বসে আছি আমি। আজকে আমার প্রি টেস্ট এক্সাম দেওয়ার কথা ছিল ওনার কাছে। উনি কি সত্যিই আসবেন না?
আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে মেইন গেটের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। উনি আসলেই আমি অতি সহজেই ওনাকে দেখতো পাবো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আম্মু এসে উঁকি মেরে গেছে যে ঘরে আছি নাকি বৃষ্টিতে ভিজছি তা দেখার জন্য। কিন্তু বারবার এসে উঁকি দেওয়াতে আমাকে রুমে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে আম্মুর কেবল একটাই রিয়েকশান,
‘কিরে শরীর টরীর ঠিক আছে তো? ‘

আমি সহজ ভাবে বললাম হ্যাঁ ঠিক আছি। কিছুখন পর পুনরায় এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘বৃষ্টি হচ্ছে, আরিশ নেই তবুও ভিজতে গেলি না যে। ‘

আমি তখন রাগী চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম
‘মশকরা করছো আমার সাথে? ‘

আম্মু মুখ টিপে হেসে চলে গেল আর যাওয়ার আগে বলে গেল,
‘আচ্ছা একটা শাস্তি হয়েছে তোর, ছেলেটাকে জ্বালানোর। ‘

কথাটা বলে হেসে চলে গেল। আমার চারিপাশের জগত আর সেই জগতের মানুষগুলো দিনকে দিন তিলে তিলে আমাকে আত্মনির্ভর না হয়ে ওনার ওপর নির্ভর হতে শেখাচ্ছে আর তাতে আমার এক মস্ত অভিযোগ।

হাতে থাকা পেনসিলটা নিয়ে জানালার গ্ৰিলে অন্যমনস্ক হয়ে টঙটঙ করে আওয়াজ করছি। চারিপাশে কি হচ্ছে তাতে যেন আমার ধ্যান জ্ঞান নেই। জানালার দিকে থেকেও দৃষ্টি টা সরে গেল।
কিছুখন পর আরিশ ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনতেই আমি চমকে উঠলাম আর খানিকটা শিওরেও উঠলাম। ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি চুলটা হাত দিয়ে ঝাড়া দিয়ে জল ঝাড়ছেন। ওনাকে এরুপ অবস্থায় দেখে আমি থ হয়ে রইলাম কিছুখন। আমি ওনার দিকে অনবরত তাকিয়ে আছি। কেন জানি না ওনার এমন সাধারন কাজকর্ম দেখতেও যেন আমার ভালো লাগছে। উনি আমাকে এভাবে লক্ষ করেও কিছু বললেন না। উনি আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলেন আর আমার সামনে এসে বসতেই আমার ঘোর কাটলো। বাইরের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখতেই দেখলাম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। উনিও ভিজে গেছেন বেশ অনেকটা। আমি তা ভেবে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলাম,

‘ভাইয়া আপনি তো ভিজে গেছেন। ওয়েট আমি আম্মুর কাছ থেকে আপনার জন্য পোশাক নিয়ে আসি। ‘

উনি আমার কথাতে সাই দিলেন না যেন ওনার এভাবেই বসে থাকতে ভালো লাগছে। উনি আমার প্রি টেস্ট এর প্রশ্নটা আমার সামনে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘জলদি শেষ করো। টাইম এক ঘন্টা। ‘

প্রশ্নটা দেখতেই এবার যেন আর চোখ এর সামনে শরিশার ফুল দেখলাম না। সবকিছুর উত্তর যেন আমার চোখে ভাসছে। অন্যবারের থেকে এইবার এমন ব্যাতিক্রম কেন?
উত্তর লেখার জন্য কাগজে পেন ঠিকিয়ে ওনার দিকে একটা বার তাকালাম আমি তারপর আর কিছু না ভেবে লিখতে শুরু করলাম। ওনার কাছে এক ঘন্টা মানে কেবল এক ঘন্টায়। এক সেকেন্ড বেশি বা কম নয়।
সময় চলছে আর আমার হাতের গতি বাড়ছে। সবকিছু র উত্তর কতো অনায়াসেই দিয়ে ফেলছি আমি। অন্যবার এমনটা হয় না। অন্যবার এক একটা প্রশ্নের উত্তর ভাবতেই আমি এক দুই মিনিট কাটিয়ে দিই। একঘন্টার আগেই খাতাটা ওনার সামনে জমা দিলাম। অন্যবার উত্তর শেষ হয়না তাই আমার খাতা দিতেও মন চাইনা। তবে এবারও উনি অবাক হলেন না।
উনি খাতা চেক করছেন আর আমি কেবল একবার খাতার দিকে আর একবার ওনার তাকাচ্ছি। ওনার গলার নীচের তিলটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম আমি। পুরুষ মানুষের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য মেয়েদেরকে বড্ড আকৃষ্ট করে আর তার মধ্যে একটি হলো তিল। আমি বাইরের মুষলধারা বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলাম। এবার আমার ভিষনরকম ভিজতে ইচ্ছা করছে, ভীষনরকম মানে ভীষনরকম। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম সেই সময়ে উনি আমার সামনে খাতাটা রেখে বললেন,
‘চেক ইট! ‘

আমি দেখলাম যে উনি খাতা দিয়েছেন আর কতো পেয়েছি। কিন্তু তার থেকেও বেশি আগ্ৰহ জাগলো বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে। আমি খাতার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম না বিন্দুমাত্র। উনার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া একটু ভিজি?’

ওনার চাহনি দেখেও ওনার মনের খবর জানতে পারলাম না যে উনি হ্যাঁ বলছেন নাকি না। আমি পুনরায় চোখ মুখ কাচুমাচু করে ওনার দিকে বাচ্চাদের মতো ইশারা করে বললাম,
‘একটুই ভিজবো সত্যি বলছি! ‘

হঠাৎ ওনার মনের মাঝে কি পির আউলিয়ার মতো আমার প্রতি দরদ উতলে পড়লো আমার জানা নেই তবে উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘হমম। ‘

শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বিছানা থেকে ঝটপট করে নেমে বললাম,
‘আপনি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন? ‘

উনি জবাব দিলেন না, সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন আর যাওয়ার আগে বললেন ওনার পিছন পিছন আসতে। আমি কৌতুহলী হয়ে ওনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। উনি দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছেন। ছাদের দরজার মুখোমুখি যেতেই উনি হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করলেন যাওয়ার জন্য। আমি দ্রুত পা ফেলে ছাদে গিয়ে ভিজতে লাগলাম। দু বাহু প্রসারিত করে বৃষ্টির প্রত্যেকটা বিন্দু উপভোগ করছি। আমার শরীরের মাঝে এক ভালোলাগার শিহরন বয়ে যাচ্ছে। গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছা করছে ওই গানটা,
‘এক গুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে। ‘

কিন্তু উনি কি আদতেও আমার সাথে ভিজবেন? কথাটা ভাবতে ভাবতে ওনার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।

বৃষ্টির মাঝে ওনার দিকে তাকালাম, সবকিছু বেশ ঘোলাটে লাগছে বৃষ্টির ছটায়। উনি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। আমি বৃষ্টি ছেড়ে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার উপস্থিতিকেও যেন গুরুত্ব দিলেন না, আমি বেশ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম শীতে। আমার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে শিতে।কম্পিত কন্ঠে ওনাকে প্রশ্ন করলাম,
‘আরিশ ভাইয়া আমি কতো পেয়েছি বললেন না তো। ‘

উনি বৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করে বললেন,
‘দেখার জন্য খাতা চেক করতে দিয়েছিলাম তোমাকে। ‘

আমি বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আর ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি কি আজ প্রশ্ন সোজা করেছেন নাকি আমি ভালো করে পড়াশোনা করেছি বলে সব পেরেছি সেটা নিয়েই ভাবছি আমি। ‘

উনি আমার দিকে এবার তাকালেন। ওনার দৃষ্টি শান্ত শীতল আর হয়তো ওনার শরীরটাও। উনি আচমকা আমার থুতনিতে থাকা তিলটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম তাতে। উনি উত্তর দিলেন না। নিজে চলে গেলেন ছাদের মাঝে। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে গেল ওনার শরীর। আমার ভীষন রকম হিংসা হলো বৃষ্টির ফোঁটা গুলোর ওপর। আজ যদি আমিও বৃষ্টির বিন্দু হতাম তাহলে কতো সহজেই ওনাকে ছুঁয়ে দিতাম আর চাইলেও উনি আমাকে ধমক দিয়ে ওনাকে ছোঁয়া থেকে আটকাতে পারতেন না। আমি ওনার পাশে গিয়ে নিরবে দাঁড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘পঞ্চাশে সাড়ে উনপঞ্চাশ পেয়েছো। ‘

আমি অবাক আর খুশি দুইয় হলাম তবে ওনার কথাতে তোয়াক্কা না করে বললাম,
‘আপনি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন? ‘

উনি আকস্মিক ভাবে বললেন,
‘তুমিই আমার বৃষ্টিবিলাসী। ‘

আমি কেঁপে উঠলাম ওনার এমন কথাতে। আচমকা চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম উনি সত্যিই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজছেন আর কল্পনায় মত্ত ছিলাম আমি।

আজকাল উনি আমার কল্পনাতেও ছেয়ে গেছেন।
আচমকা ওনাকে আমি আর দেখলাম না তবে পায়ে শীতল কিছুর ছোঁয়া পেতেই শিউরে উঠলাম। উনি আমার পায়ে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছেন যেন। উনি পায়ে হাত দিচ্ছেন দেখে সরে আসতে নিলেই এক পায়ের নূপুর ঝমঝম করে বেজে উঠলো আর উনি রাসভারী কন্ঠে ডেকে উঠলেন,
‘এই মেয়ে! এতো চঞ্চল কেন তুমি?একবিন্দু কি চুপ করে দাঁড়ানো যায় না? ‘

আমি থমকে গেলাম। উনি আর এক পায়ে নূপূর পরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আর রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘ এতোখন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিলে? কতবার ডেকেছি ডু ইউ নো? ‘

আমি থতমত খেয়ে বললাম,
‘ আমি তো! ‘

উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন।
‘নো মোর ওয়ার্ডস। আর ইউ হ্যাপি নাও? ‘

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘কেন? ‘

উনি কপালে টোকা মেরে বললেন,
‘স্টুপিড। ‘

কথাটা বলে উনি চলে যেতে নিলেই আমি দৌড়ে ওনার পিছু নিতে গেলেই পায়ে নূপূরের ঝমঝম আওয়াজ হতেই থেমে গেলাম আমি, জোর গলায় ওনাকে ডেকে উঠলাম,
‘আরিশ ভাই! ‘

‘কি হয়েছে মিস ড্রামা কুইন? পছন্দ হয়নি?

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম।
‘আপনার মনে আছে এটার কথা? ‘

উনি ফিরে এলেন, আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
‘ মনে না থাকলে তো কুরুক্ষেত্র বাধাতে তাই মনে রাখাই ইজি চয়েজ দ্যান ওয়ার। ‘

আমি ওনার সামনেই পা নাচিয়ে ঝমঝম আওয়াজ করে বললাম।
‘আমি বলেছিলাম যে যেদিন আমি প্রি টেস্ট এ ফুল মার্কস পাবো সেদিন আপনি নুপুর কিনে দেবেন। এই জন্যই তো আপনাকে আমার আলাদিন বলি হাহ!’

উনি কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই আমি পিছু ডেকে বললাম,
‘আপনি সত্যিই রেগে নেই তো? রেগে থাকলেও কিন্তু আমি রাগ ভাঙাতে পারবো না হুহ! ‘

উনি পিছন ফিরে তাকিয়ে বললেন,
‘ নীচে গিয়ে যদি কফি না পাই তো তোমার খবর আছে বলে রাখলাম। জলদি নাচানাচি কমপ্লিট করে নীচে এসে কফি দিয়ে যা খুশি করো। আর আনলিমিটেড ভেজার প্ল্যান করলে তা মাথা থেকে বাদ দাও আর যদি জ্বর আসে তো প্যারাসিটামল এর সাথে দুটো থা/প্পড় ফ্রি! আর উইথআউট ড্রামা। বাই। ‘

কথাটা বলে উনি নীচে নেমে গেলেন। আমার সব মন খারাপ যেন বৃষ্টির সাথে মুছে গেল। কল্পনার থেকেও বাস্তবও যে এতো সুখের আর আনন্দের হতে পারে তা আজকের দিনটা না এলে হয়তো আমি কখনো জানতেই পারতাম না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে উপরওয়ালাকে স্বরন করে বললাম,
‘তোমাকে অনেক অনেক শুকরিয়া এরকম একটা অভদ্র আর আলাদীনকে আমার জীবনে পাঠানোর জন্য। ‘

নুপূর টা পরে বেশ কয়েকবার ঝমঝম করতেই নীচ থেকে ডাক এলো,
‘এই মেয়ে জলদি আসো নয়তো থা/প্পড় খাবে উইথ এক্সট্রা বকাঝকা। ‘

ওনার এই ধমক শুনে আর নাচানাচি করা যায়! অভদ্র একটা!?

#চলবে,,,,

Suraiya Aayat

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here