ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ১৩
* * ৩৬ * *
সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় না? টেরই পাওয়া যায় না। আমিও পেলাম না কোথা দিয়ে দুটো মাস চলে গেলো। বর্ষা এসে গেছে বাঙালীর দরজায়। কলকাতায় বর্ষা একরকম। কাদা প্যাচপ্যাচে। কিন্তু আমাদের পাহাড়ে বর্ষা সম্পূর্ন অন্য। প্রকৃতি যেন গরমের সব রুক্ষতাকে বৃষ্টির জলে স্নান করিয়ে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। বর্ষার পাহাড়কে খুব মিস করি। কিন্তু কি আর করা যাবে এখন তো আর বাড়ী যেতে পারবো না! এই দু-মাস আগে ঘুরে এসেছি। আবার সেই পুজোয় যাবো। এসব ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে ফিরতি পথে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায়। বৃষ্টি পড়ছে। মুষলধারায় না হলেও নাগাড়ে হয়ে চলেছে। এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন সুজাতা! বলে ডেকে উঠলো। ফিরে দেখি কুহেলী! ওমা ও এখানে! অবাক বিস্ময়েই হাসি মুখে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। আমিই বললাম
-কিরে তুই এখানে?
-হ্যাঁ রে! কাছেই তো আমরা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। এই একমাস হলো।
-ওমা তাই! কোথায়?
-এই তো সামনেই। আয় না!
-এই আজ না রে! পিসি চিন্তা করবে। তুই এড্রেসটা আমাকে দিস, আমি সময় করে চলে যাবো।
-আচ্ছা আমি তোকে এড্রেসটা মেসেজ করে দিচ্ছি। কিন্তু তোকে আসতেই হবে কিন্তু।
-আরে অবশ্যই আসবো। তোরা কেমন আছিস? পলাশের কোনো চাকরী……
-হ্যাঁ রে। রজতদা যে অফিসে দেখা করতে বলেছিলো সেই অফিসেই হয়েছে চাকরীটা। আমি এখনোও চেষ্টা করছি।
-রজতদা! মানে? আমার প্রশ্নে কুহেলী গলাটা একটু চেপে বলল আরে তোর রজতকুমার। ওনাকে আমরা তো রজতদা ই বলি। মানে উনিই বলেছিলেন বলতে। শিলিগুড়িতে যখন ওনার বাড়ীতে ছিলাম তখন। আমি অবাক হয়েই বললাম
-ও। আচ্ছা। কুহেলী বলে চলল
-সত্যিই রে! তুই আর রজতদা যদি সেদিন না থাকতিস আমাদের যে কি হতো! ভাবতেই পারছি না! উনি তো মাঝে দু-একবার ফোন করেছিলেন। আমরা কেমন আছি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে। আমি এটা শুনে অবাক চোখে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি পলাশ কুহেলীকে ফোনও করেছেন। কই বলেন নি তো! আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে কুহেলী বলল কেন তোকে কিছু বলেন নি? আমি মাথা নেড়ে বললাম না। তারপর বললাম আচ্ছা আজ আসি রে। পরে আসবো তোর ফ্ল্যাটে। কুহেলী হঠাৎ বলে উঠলো রজতদা কে নিয়ে আসিস। উনিও তো দেখেননি আমাদের ফ্ল্যাট। আমি চমকে উঠলাম! বললাম উনি ব্যস্ত সেলিব্রিটি মানুষ। আমি বললেই বা আসবেন কেন বল? কুহেলী আমার কথায় একটা সন্দেহজনক হাসি দিয়ে বলল, আসলে একমাত্র তোর কথাতেই আসবে। আর এলেও তোর সঙ্গেই আসবে। আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু ওর এই হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না। আনমনে বলে উঠলাম, আচ্ছা আসি। পরে দেখা হবে। কুহেলী আর কিছু না বলে হেসে মাথা নাড়লো এবার। আমি ওকে পেছনে ফেলে বাস ধরবো বলে টলমল পায়ে এগিয়ে গেলাম।
কুহেলীর কথা শুনে মনে একরাশ অভিমান এসে জড়ো হচ্ছিলো। মনের ভেতরে প্রবল আলোড়ন চলছিলো, কেন জানি না। খালি মনে হচ্ছিলো উনি প্রায় রোজই আমাকে ফোন করেন, কথা বলেন। কই কখনও তো বলেন নি! যে পলাশদের সঙ্গে কথা হয় ওনার। আমারই বন্ধুদের কথা আমাকে বললেন না উনি! কেন? কেন এই লুকোচুরি? তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অদ্ভুত রাগ আর দুঃখের মিশ্র অনুভুতি মনকে যেন ক্রমশ ভারাক্রান্ত করে তুলছিলো। নিজের মনের দ্বন্দ্বে যখন নিজে জেরবার হচ্ছি হঠাৎ একটা বড় গাড়ী আমার ঠিক সামনে এসে আচমকা ব্রেক চেপে দাঁড়ালো। একে মন মেজাজ ভালো নেই তার ওপর কোন বড় লোকের ব্যাটা অসভ্যের মত সামনে এসে গাড়ী দাঁড়া করালো। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো। আর ঠিক তখনই গাড়ীর কাঁচ নামিয়ে ভেতর থেকে এক অতি পরিচিত কন্ঠ বলে উঠলো বাড়ী যাচ্ছো তো?
* * ৩৭ * *
আজ একটা কাজে একটু বারাসাতের দিকে যেতে হয়েছিলো। ফেরার পথে ভাবলাম মা বাবার সঙ্গে একটু দেখাটা করেই যাই। তাই গাড়ীটা ঘুরিয়ে নিলাম নিউটাউনের দিকে। দমদমের কাছে এসে দেখতে পেলাম তাকে, মানে সুজাতাকে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, তাই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। চকিতে মনের মধ্যে খেলে গেলো! আরে! এইখানেই তো কোথায় যেন সুজাতার স্কুলটা। ওহ! তারমানে বাড়ী ফেরার জন্য বাসের বা গাড়ীর অপেক্ষা করছে। এইসময় আমার অবস্থা পুরো আচমকাই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। যাক্ কতদিন পরে মহারাণীর দর্শন পেলাম। গলার স্বর তো রোজই শুনি। আজ সাক্ষাৎ দর্শনও হয়ে গেলো। একই পথে যখন যাবো তখন ওকে ডেকেই নি। রাস্তাটা একসাথে সময়ও কাটানো যাবে, এই ভেবেই গাড়ীটা ওর ঠিক সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালাম। ওভাবে একদম সামনে একটা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়াতে বেচারী একটু ঘাবড়েই গেছিলো। আমি তাড়াতাড়ী গাড়ীর কাঁচটা নামিয়ে গাড়ীর ভেতর থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে হাঁসলাম। ও আমাকে দেখে যে চমকে গেছিলো সে আর বলার অবকাশ রাখে না। আমি হেসে বললাম বাড়ী যাচ্ছ তো? ও প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে বলল আপনি! এখানে? আমি হেসে বললাম বারাসাতে একটা কাজে গেছিলাম। ফেরার পথে মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি এখন। তুমি বাড়ী ফিরছ তো? ও কিছু না বলে নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। আমি একটু উৎসাহিত হয়ে বললাম তাহলে গাড়ীতে উঠে এসো, চলো একসাথেই যাই। এবার দেখলাম ও গম্ভীর ভাবে বলল না, আমি বাসে চলে যাবো। যাহ বাব্বা! কি হলো ব্যাপারটা! রেগে গেলো নাকী! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম কেন? এক যাত্রায় পৃথক বাহন হয়ে কি লাভ। এসো না। কিন্তু ম্যাডাম সেই এক! জেদে অনড়। না, বললাম তো আমি বাসে চলে যাবো। কি জ্বালা! বেগতিক দেখে বললাম রেগে আছ আমার ওপর? ও দেখলাম কোনো উত্তর দিলো না। চুপ করে যেন কিছু ভাবছে। আবার বললাম, কি হলো ম্যাডাম? রেগে আছো আমার ওপর? এবার ও মাথা নেড়ে জানালো না। আমি একটু সাহস পেয়ে বললাম তাহলে আমার সাথে যেতে সমস্যা কোথায়? এবার ও গম্ভীর হয়ে বলল আমি বাসেই যাতায়াত করি। আমি বাসেই ফিরবো। এ তো আচ্ছা গোঁয়ার আর জেদী মেয়ে! তার মানে তুমি আমার ওপর রেগেই আছো। বুঝেছি। কিন্তু কেন? এবার আমার কথা শুনে ম্যাডাম চোখ পাকিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন বললাম না আমি আপনার ওপর রেগে নেই। আমি দেখলাম এই সুযোগ। এই অবসরে ওকে একটু তাতিয়ে দিলেই যদি রাগের মাথায়ই গাড়ীতে এসে বসে, তাহলেই কেল্লা ফতে! তাই হেসে বললাম রেগে যদি নাই থাকো তাহলে গাড়ীতে এসে বসো। এবার উনি আরোও খেপে গিয়ে বললেন বললাম তো বসবো না আপনার গাড়ীতে। ব্যাস! আমার কাছে পরিষ্কার! মহারাণী কোনো কারণে খেপে ফায়ার হয়ে আছেন। যদিও সে কারণটা আমি না অন্যকেউ সেটা ঠার করতে পারলাম না। আগুণটা উসকে দিতে বললাম বেশ তার মানে ধরেই নিলাম তুমি আমার ওপর রেগে আছ।
-আমি বললাম তো আপনার ওপর রেগে নেই আমি।
-তাহলে প্রমাণ করো যে রেগে নেই।
-কি প্রমাণ?
-আমার গাড়ীতে বসে প্রমাণ করো যে আমার ওপর রেগে নেই।
-আমি বসবো না বললাম তো।
-তাহলে বুঝলাম রেগে আছো।
-না নেই।
-আছো।
-না নেই।
-আছো।
-নেই নেই নেই। এবার আরো রাগছে। রাগলে মহারাণীকে তো দারুণ লাগে! বড় বড় চোখদুটো আরো বড় বড় হয়ে যায়, নাকের পাটা ফুলতে থাকে, আর ঠোট দুটো তিরতির করে কাঁপে! আমি আরোও রাগানোর জন্য বললাম
-আছো, আছো, আছো।
-নেই বললাম তো!
-আছো আমি জানি।
-কি চান কি বলুন তো।
-প্রমাণ যে তুমি আমার ওপর রেগে নেই। গাড়ীতে বোসো আর প্রমাণ করো। এবার মহারাণী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে যে কজন লোকছিলো ওর দিকেই তাকিয়ে দেখছিলো। আমি গাড়ীর কালো কাঁচের ভেতরে বলে আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিলো না। ও মাথা নীচু করে দাড়িয়ে রইলো। বুঝতে পারছে সবাই ওকে দেখছে। ও যে অপ্রস্তুতে পড়ে গেছে বুঝতে পেরেই আমি বললাম কি হলো? প্রমাণ করো! বসো গাড়ীতে! এবার রাগের মাথায় দুমদাম দরজা খুলে গাড়ীর ভেতরে এসে বসলেন মহারাণী। মিশন সাকসেসফুল! কিন্তু রাগের চোটে আমার গাড়ীর দরজাই ভেঙে ফেলতো আরেকটু হলে। বাপরে! কি রাগ! আমি ওর রাগ দেখে হেসে ফেললাম। আমাকে হাসতে দেখে ও আরোও খেপে গিয়ে বলল বসলাম তো গাড়ীতে। এবার চলুন। আমি কোনো মতে হাসি চেপে বললাম সীট বেল্ট বাঁধো। ম্যাডাম সীটবেল্ট বেঁধে গোমড়া মুখ করে বসে রইলেন। আমিও ছোট্ট করে বিজয়ীর হাসি হেসে গাড়ী স্টার্ট করলাম।
ম্যাডামের এত রাগ সামলানো বেশ চাপের। কিন্তু রজত মিত্তিরও কম যায় না ম্যাডাম। তোমার রাগকে কি করে কাজে লাগাতে হয় আমি শিখে গেছি। এবার রাগের কারণ যেনে ম্যাডামকে শান্ত করার পালা। এটাও পারবো। চল ব্যাটা রজত, প্রেয়সীর মানভঞ্জন কর। কিন্তু মিনিট কুড়ি হয়ে গেলো ম্যাডাম যাকে বলে একেবারে স্পিকটি নট! আমি একবার করে লুকিং গ্লাস দিয়ে ম্যাডামকে দেখছি, আর গুনগুন করে গান করছি। ম্যাডাম তখনও গোঁজ হয়ে বসে আছে। নাহ্ উনি নিজে কিছুই বলবেন না দেখছি। আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। তাই নীরবতা ভঙ্গ করে আমিই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আমাকে কি বলা যায় না? ম্যাডাম উত্তর না দিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে রইল। আমি আরেকটু খোঁচাতে বললাম তাহলে এতদিন আমি ভুলই ভাবতাম। একজন আমাকে বন্ধু বলে ভাবেই না। নইলে আমাকে নিজের মনের কথা বলত। এবার একদম ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত আমার দিকে ফিরে কটমট করে তাকালো। তারপর খানিক চুপ থেকে বলল আপনি সব কথা বলেন? আপনি আদৌ আমায় বন্ধু মানেন? আমি তো অবাক! ওর কথা শুনে ঘ্যাঁচ করে গাড়ীর ব্রেকটা কষে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম না আমি আবার কি করলাম! জিজ্ঞেস করলাম মানে! আমি আবার কি করলাম? কি কথা গোপন করলাম? এবার নিস্পলক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি সব কথা বলেন আমাকে? আমাকে বন্ধু বলে সত্যিই মনে করেন? আমি অবাক হয়ে বললাম। হ্যাঁ! অবশ্যই মনে করি। আর আমি তোমার থেকে কোনো কথাই লুকাই না। এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ধীরে ধীরে বলল পলাশ আর কুহেলীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে আমাকে বলেন নি কেন? এতক্ষণে খানিক তল পাওয়া গেলো মহারাণীর রাগের। আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমায় কে বলল? ও মাথা নীচু করে গলা নামিয়ে বলল, কুহেলী! এতক্ষণে পরিষ্কার হলো সবটা। হেসে বললাম হ্যাঁ দু একবার কথা হয়েছে। দমদমের এখানেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমাকে আসতে নেমন্তন্নও করেছে। কাজের চাপের জন্য যাওয়া হয়নি। এবার আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল একথা আমাকে এতদিন বলেন নি কেন? আমি হেসে বললাম তাই জন্য এত রাগ, এত অভিমান? একটু কড়া গলায় বলল আমি মিথ্যে কথা বলা পছন্দ করি না! আমি তো অবাক! বিস্মিত হয়ে বললাম আমি তো মিথ্যে বলিনি তোমায়! এবার ও বলল সত্য গোপন করাও একরকম মিথ্যেই বলা। আমি হেসে মাথা হেঁট করে হাত জোর করে বললাম আচ্ছা ম্যাডাম! আমার ঘাট হয়েছে। আর আমি কোনোদিন আপনার কাছে ‘সত্য গোপন’ করবো না। যখন যা হবে সব বলবো। এবার কি আমার অপরাধ ক্ষমা করা যাবে?
-হুহ! নিজের বাড়ীতে বাবা মাকেই যে সত্যি গোপন করে সে আর আমাকে কি জানাবে?
-মানে??? অবাক হয়ে বললাম।
-আপনি যে দার্জিলিং-এ গিয়ে আমাদের হোটেলেই ছিলেন, এসব বলেন নি কেন বাড়ীতে?
-বাব্বা! এখবরও পেয়ে গেছো?
-_____
-আচ্ছা বাবা। জানাবো বাড়ীতে। এবার তো রাগটা কমাও।
-আমি রাগী নি।
-তাহলে হেসে দেখাও।
-খামোখা হাসতে যাবো কেন?
-আমি বলছি তাই।
-আপনি আমার কে, যে আপনার কথা শুনবো? ওর এই কথা শুনে আমি চুপ করে ওর দিকে তাকালাম। মনের মধ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলাম তোমায় ভালোবাসি, তোমায় জীবনসঙ্গী হিসাবে চাই। এইটা কি কিছুই নয়? কিন্তু মুখ দিয়ে এর এক বর্নও বেরোলো না। শুধু বললাম আমি তোমার বন্ধু। তাই তুমি আমার কথা শুনবে। এবার ও আমার দিকে তাকালো। সেই প্রশ্ন ভরা চোখে। যেমনটা দার্জিলিং-এ দেখেছিলাম। সেই দুপুরে। আবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি ওর চোখে। রাস্তার অন্য গাড়ীর আওয়াজে হুশ ফিরতেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম এবার যাওয়া যাক? মহারাণী সেই গোমড়া মুখেই বলল আমি কি বারণ করেছি যেতে? আপনিই তো গাড়ী থামিয়ে বকবক করছেন। পাগলী একটা। এই সামান্য কারণে এত অভিমান? আমি হেসে গাড়ীতে স্টার্ট দিলাম।
কিন্তু বাকী রাস্তাও মহারাণী কোনো কথা বললেন না, যদিও রাগ আর নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ অভিমান আছে। আর ওটা আমি যে ঠিক ম্যানেজ করে নেবো, তাতে সন্দেহ নেই। তবে আজকের ঘটনায় আমার একটা ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে। আমি ওকে কথা লুকিয়েছি বলে ও এত রাগ কেন করল? ও কি আমার জন্য কিছু ফিল করে? আমার সব কথা ওকে জানানো, না জানানো ওর কাছে ম্যাটার করে?হে ভগবান! এটা যদি সত্যি হয়…….!!!! উফ্! আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু না এখনই এত লাফাবো না। আরোও কদিন দেখি। পুরো কনফার্ম হয়ে গেলেই আমার মনের কথাটাও ওকে বলে দেবো। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ীর কাছাকাছি যখন পৌছে গেছি সুজাতা আমাকে গম্ভীর ভাবে বলল গাড়ীটা থামান। আবার কি হলো? আমি রাস্তায় সাইড করে গাড়ী থামাতে থামাতে বললাম কি হলো? এখানে থামাতে বললে কেন? ও বলল এখান থেকে এইটুকু আমি হেঁটে চলে যাবো। আমি চমকে উঠলাম। মানে? আবার আমি কি করলাম। এবার সুজাতা একটু নরম কিন্তু দৃঢ় স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখান থেকে এইটুকু আমি হেঁটে যেতে পারবো। আর স্যোসাইটিতে আপনার গাড়ী থেকে আমি নামলে অনেক কথা উঠবে। আমি চাই না, আমাদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে লোকে কথা বলুক এতে আমার বা আমার পরিবারের সম্মান নষ্ট হতে পারে। হায় ভগবান! আমি এতক্ষণ কত কি ভাবছিলাম। আর সুজাতা কি বলল! সামান্য বন্ধুত্বকেই সমাজের সামনে প্রকাশ করতে ওর এত কুন্ঠা! তাহলে ভালোবাসা প্রকাশ করবে কি ভাবে? আর কিসের এত কুন্ঠা ওর? আমি কি এতই বাজে! এতই অযোগ্য ওর? যে লোকের সামনে পরিচয়ও দেওয়া যায় না। মুডটা খারাপ হয়ে গেলো। এতক্ষণ ওর রাগ ভাঙালেও এখন রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছিলো। কিন্তু ও সেসবের তোয়াক্কা না করে গাড়ী থেকে নেমে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালো। আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গাড়ীতেই বসে রইলাম।
* * ৩৮ * *
সেদিনের পর আরোও দুমাস কেটে গেছে। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে এই দুমাসে। আমাদের জীবনেও অনেক জল গড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস! পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। আমিও ব্যস্ত পুজোর নতুন সিনেমা রিলিজ নিয়ে। টিজার লঞ্চ, প্রোমো শ্যুট লেগেই আছে। এরমাঝেও এই মাসটা আমার জীবনে একটু স্পেশাল। কারণ এই মাসের একুশ তারিখ আমার শুভ আবির্ভাব দিবস। ওই দিন আমার ধরাধামে আবির্ভাব উপলক্ষে প্রতি বছরই একটা পার্টি দিতে হয়। অ্যারেঞ্জমেন্টস বাবা মা ই করে। এবার ঠিক হয়েছে পার্টিটা গ্ৰীনভিলার ব্যাঙ্কোয়েট হলেই হবে।
সুজাতার সঙ্গে সম্পর্কটা উন্নতি হয়েছে না একই আছে তা আমার মাথায় ঢুকছে না। মানে সেদিন ও ওরকম চলে যাওয়ার পর আমার খুব রাগ হয়েছিলো। তিনদিন রাতে ওকে ফোন করি নি রাগের চোটে। কিন্তু ম্যাডাম তাই বলে নিজে থেকে ফোন বা মেসেজ করেননি। মনের অস্থিরতায় আর শেষমেশ থাকতে না পেরে চতুর্থদিনের দিন ফোন করেই ফেল্লাম। কিন্তু ম্যাডামের গলায় কোনো অনুতাপ নেই সেদিনের জন্য। আশ্চর্য মেয়ে বটে! তবে তারপর থেকেই ভাবছিলাম কি করে ওর মনের অনুভূতিটা জানা যায়। রোজই কথা হয়। কিন্তু কখনও মনে হয় অগ্ৰগতি ইতিবাচক, কখনও মনে হয় নেতিবাচক। মানে কখনও মনে হয় ও-ও আমার জন্য ফিল করে, আমার সামান্য শরীর খারাপ হলেও এমন করে যেন আমাকে নিয়ে কত কনসার্ন। আবার মিট করা, দেখা করার কথা বললেই এমন সমাজ-পরিবারের মালা জপতে থাকে যেন আমি ওর জীবনে কেউ না, সমাজ আর ওর পরিবারই ওর সব। মাঝে মাঝে মনে হয় আর কবে বুঝবে ও আমার মনের কথা? অধৈর্য লাগে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। ওটা মনে করে নিজেকে সান্তনা দিই ডিয়ার রজত, হ্যাভ পেশেন্স বলে।
এর মধ্যে পল্লবীর উৎপাতও বেড়েছে। ফিমেল কো-ওয়ার্কার বলে কিছু বলতে পারি না। বেকার ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে। আর এ আপদ সেটাকেই আমার গুড সিগনাল ধরে নিচ্ছে। কি জ্বালা। যাকে চাইছি, সে পাত্তা দিচ্ছে না! আর যাকে চাইছি না, সে চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মিডিয়াও রসালো গল্প ছাপাচ্ছে সেসব নিয়ে। এরই মধ্যে কাল পল্লবীর বার্থ ডে ছিলো। সেখানে আমাকে সপরিবারে নেমন্তন্ন করেছিলো ওর পার্টিতে। গেছিলাম। ওর বাবার সঙ্গে আমার বাবা মায়ের আলাপ করালো। মিডিয়াকেও ডেকেছিলো, মিডিয়ার সামনে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিডিয়ার সামনে কিছু করতে পারলাম না। যদিও এতদিন এই লাইনে থেকে এটা জানি কালকের নিউজে এটা ব্রেকিং নিউজ হতে চলেছে। সুজাতা আবার এসবে আমাকে ভুল না বুঝে বসে।
(চলবে)