ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ১১
* * ৩০ * *
হোটেলে ফিরেও আমার ঘোর যেন কিছুতেই কাটছিলো না। সুজাতার কথা, সুজাতার হাসি, সুজাতার চোখের জল, সুজাতার চোখে মুখের উচ্ছ্বাস সব যেন উজ্জ্বল হয়ে ভাসছিলো। মনে হচ্ছিলো আজকের দুপুরটা যে কেন শেষ হয়ে গেলো! আরো কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো হতো। আজ লুকিয়ে সুজাতার দু-তিনটে ছবি তুলেছি মোবাইলে। রেস্ট্যুরেন্টে আর ম্যাল মার্কেটে। বেচারী টেরও পায় নি। এখন রুমে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম ছবিগুলো, আর আজকের সারাদিনের ঘটনার ভীড়ে হারিয়ে গেছিলাম। হুঁশ ফিরল একটা ফোনে। মায়ের ফোন। জিজ্ঞেস করছে কাল কখন ফিরছি। কালই ফিরছি? নাকি কদিন পরে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আমার একসপ্তাহের সুজাতা অভিযানের কালই শেষ দিন। সাতদিনের জন্যই তো এসেছিলাম এখানে। কালই সেই একসপ্তাহ শেষ হবে আর আমাকে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে যেতে হবে। ইশ! আরো বেশীদিন সময় নিয়ে কেন যে এলাম না! সুজাতার সঙ্গে আরোও সময় কাটানো যেত। নিজেরই নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে, নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে! কিন্তু ক্ষতবিক্ষত আর টেকো হিরো সিনেমায় চান্স পাবে না, আর রোজগার চলে গেলে সুজাতার বাবার সামনে দাঁড়াবো কোন মুখে এসব ভেবে ক্ষান্ত হলাম। তারপর মাকে কাল সন্ধ্যেয় ফিরছি জানিয়ে ফোন রেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিজেকে ভালো করে দেখে নিজের বোকামীর জন্য নিজেই নিজেকে দু-তিনটে চড় কষালাম। গালটা জ্বলে গেলো! উফ! আমি কি বোকাআআআ!!
বোকার মত খানিকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর গালে হাত বুলতে বুলতে, বসে বসে ভাবতে লাগলাম এখন কি উপায়! সুজাতার সঙ্গে তো সময় কাটাতেই হবে। ওদিকে বাড়ীও ফিরতে হবে, অনেকদিন পর পর তো বাড়ীতে মা বাবার সঙ্গে কাটানোর সময় পাই। তার ওপর বাবা সদ্য কয়েকমাস আগে নার্সিংহোম সফর সেরে ফিরেছে। প্রেমিক হিসাবে প্রেমিকার চারপাশে থাকাও যেমন দরকার ছেলে হিসাবে বাবা মায়ের বুড়ো বয়সে তাদের পাশে থাকাও জরুরী। একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে বাবা মা। কি করি! অনেক ভেবে মজ্ঝিম পন্থা মানে মাঝামাঝি পথ নিলাম। অর্থাৎ কলকাতায় ফিরে যাবো। কিন্তু সুজাতার সঙ্গে এক মুহুর্তও বিচ্ছেদ রাখবো না। ফোন, ভিডিও কল, ইত্যাদিতে ওর সঙ্গেও সময় কাটাবো।
কিন্তু যাওয়ার আগে সুজাতাকে তো জানাতে হবে। এই ভেবে ওকে একটা কল করলাম। কিন্তু ফোন রিং হয়ে কেটে গেলো। মহারাণী ফোন ধরলেন না। আশ্চর্য। ফোন করলে ধরে না কেন কে জানে। মেসেজ করলেও রিপ্লাই দেয় কয়েক ঘন্টা পরে। আর রজত তুই ভাবছিস এই মেয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখবি? এ তো ফোনই ধরবে না। তাও দু-একবার কল করলাম। ধরল না দেখে বাধ্য হয়েই মেসেজ করলাম ফ্রি হলে বোলো। কথা আছে।
* * ৩১ * *
দুপুরটা আজ বেশ কাটলো। সুপারস্টার রজতকুমারকে যেমন ভেবেছিলাম। উনি মানুষটা সেরকম নন। বরং ডাউন টু আর্থই। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন বটে কিন্তু যেন আর পাঁচজনের মতই। কোনো সেলিব্রিটিয়ানা নেই। আমার স্কুল কলেজের গল্প শুনে নিজেরও স্কুল কলেজ জীবনের গল্প করলেন। তবে হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে যখন আমার চোখের জল বাঁধ মানছিলো না উনি যেভাবে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন আমার কেন জানিনা সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল, এখনো ওই কথাটা ভেবে আমার সারা শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। ওনার চোখ দুটো যেন তখন আমাকে ভরসা যোগাচ্ছিলো, যে ওই চোখ দুটো আমার মনটাকে আমার লুকোনো কথাগুলোকে পড়তে আর বুঝতে পারবে ওই হাতটা আমার হাত ছাড়বে না। ক্ষনিকের জন্য ওই গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আমি যেন হারিয়ে গেছিলাম। তারপর আমার মনে আমিই আমাকে বাস্তবে ফেরালো। ছি! ছি! একি ভাবছি আমি! কোথায় উনি আর কোথায় আমি। আমার মত মেয়ের পক্ষে ওনার স্বপ্ন দেখাও অন্যায়। উনিও হয়ত আবেগের বশে আমার হাতটা ধরে ফেলে অপ্রস্তুতে পড়ে গেছিলেন। তাই ব্যাপারটার ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে শপিং করার কথা বললেন। আমিও ভাবলাম এই সুযোগে ভাই আর পাপড়ীটার জন্য কিছু কেনা যাবে। ওদের কিছু দেওয়ার পর ওদের আনন্দের খুশীর মুখটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। দুজনেই কত ছোটো আর কত আদরের আমার। তাই আর দ্বিতীয়বার ভাবি নি এখানে। রাজী হয়ে গেলাম ওনার প্রস্তাবে।
তবে হসপিটাল এর থেকে ম্যালে আসার রাস্তাটুকুতে আমরা দুজনে নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। আমিও লজ্জায় কথা বলতে পারছিলাম না, আর আবেগের বসে ওরকম হাত ধরে ফেলে উনিও হয়ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। ম্যালে এসে কেনাকাটার মধ্যে আবার পুরোনো ছন্দ ফিরে পেলাম। মাঝের ওই মন খারাপটা মিলিয়ে গেলো অজান্তেই। বাবা, ভাই, পিসি, পিসেমশাই, পাপাই, সবার জন্য কেনাকাটা করতে পেরে খুশী আমি। এবার তো ওখান থেকে চলেই আসতে হবে। এখানের স্কুলগুলোতে তো অ্যাপ্লাই করতে শুরু করে দিয়েছি। দেখা যাক একটা না একটা পজেটিভ রিপ্লাই নিশ্চয়ই আসবে। আমিও কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে নিজের জায়গায় ফিরে আসবো।
আমার কেনাকাটির ফাঁকেই উনি জয়তি আন্টি, রমেন আঙ্কেল আর ওনার বোনের জন্য গিফ্ট কিনতে চাইলেন। উনি পছন্দ করতে পারছেন না দেখে আমিই পছন্দ করে দিলাম। দেখলাম আমার পছন্দগুলো ওনারো পছন্দ হলো। যাক! উনিও পাল্টা আমাকে একটা বুদ্ধ মুর্তি আর একটা সুন্দর হার কিনে দিলেন। নিতে চাইছিলাম না, কিন্তু না নিলে উনি মাইন্ড করবেন বললেন বলে নিতে বাধ্য হলাম।
ফেরার সময় আমিই ওনাকে বললাম আলাদা ফিরতে, যদিও যাবো দুজনেই হোটেলেই। তবু যেহেতু এটা আমার পরিচিত জায়গা। আর এমনিও আমার এলাকায় ওনার সঙ্গে আমাকে আজ ঘুরতে অনেকেই দেখেছে, তাই আর আমি চাই না বেশী কথা উঠুক এটা নিয়ে। কারণ আমি জানি উনি খেয়ালের বশে এইসব করেছেন। কলকাতায় ফিরে গেলে, নিজের জগতে ফিরে গেলে উনি এসব এমনকি আমাকেও ভুলে যাবেন। কিন্তু আমাকে এখানেই ফিরে আসতে হবে, এখানেই থাকতে হবে। ওনারা বড়লোক মানুষ সামান্য কটা কথা ওনাদের গায়ে লাগবে না, কিন্তু আমাদের সম্মানের প্রশ্ন এসে যেতে পারে। আমি চাই না, আমার জন্য আমার বাবাকে কথা শুনতে হোক। তাই আলাদাই ফিরলাম হোটেলে। উনি ওনার ঘরে চলে গেলেন। আমি আমার কাজে লেগে গেলাম।
রাতে সব কাজ সেরে যখন শুতে এলাম ঘরে তখন ফোনটা নিয়ে দেখি তিনটে মিসডকল আর একটা মেসেজ এসেছে ফোনে। কার? ওপেন করে দেখলাম নাম উঠেছে “মিস্টার সুপারস্টার” (ওই নামেই ফোনে সেভ করেছি নম্বরটা) অগত্যা মেসেজের জবাব দিলাম সরি কাজে ছিলাম। ফোন করেছেন বুঝতে পারিনি। বলুন। মেসেজটা পাঠানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই জবাব এলো। সারাদিন থাকো কোথায়? ফোন করলে ফোনটা ধরতে পারো না? কারুর দরকার থাকতে পারে তো! নাকি! বাপরে! এ তো খেপে আছে দেখছি! আর হবে নাই বা কেন, সুপারস্টার কাউকে তিনবার ফোন করেছে কিন্তু একবারও ফোন ধরেনি এ তো অপমানই। কি আর করা। উত্তর দিলাম মাফ করবেন, আমি দুঃখিত আপনার ফোন ধরতে পারিনি। আসলে কাজের সময় আমি ফোন ধরি না। বলুন কি বলছিলেন ? এবার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এলো ফ্রি আছো? কল করতে পারি? এত রাতে! ঘড়িতে দেখলাম পৌনে এগারোটা। কি আর করি, নিশ্চয়ই কিছু দরকারী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখলাম বেশ করুন। তারপর ফোন সাইলেন্ট করে দিলাম। এত রাতে ফোন বাজলে পাশের ঘরে বাবা আর ভাইয়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। খানিকবাদেই ফোনে ভেসে উঠল “মিস্টার সুপারস্টার কলিং” রিসিভ করলাম।
-হ্যালো।
-হ্যালো। কি করছ?
-কিছু না। এই ঘুমাবো এবার।
– বিরক্ত করলাম তবে?
-না না বলুন।
-কাল আমি চলে যাচ্ছি সুজাতা।
এটা শুনে একটু ধাক্কাই লাগলো। কই সারাদিনে একবারও তো বললেন না! যে কালই চলে যাচ্ছেন। তারপর মনে পড়ল হ্যাঁ কালই তো ওনার আসার একসপ্তাহ পুর্ণ হচ্ছে। এবার তো ওনার যাওয়ারই কথা। এদিকে আমি চুপ করে আছি দেখে উনি আবার বললেন কি হলো। হ্যালো! সুজাতা! চুপ করে আছ কেন? আমি তাড়াতাড়ী ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে বললাম
-হ্যাঁ বলুন। শুনছি।
-চুপ করে গেলে কেন? কিছু বললে না তো?
-কি বলব?
-ওহ্ কিছুই বলার নেই তোমার? বেশ। ওনার গলাটা কেমন ধরা ধরা শোনালো। আমি বললাম
-আপনিই তো কিছু বলবেন বলে ফোন করেছিলেন। এটার শোনার পর উনি চুপ করে রইলেন। ওনাকে চুপ থাকতে দেখে আবার আমি বললাম হ্যালো! আপনি শুনতে পাচ্ছেন? এবার উনি সেই ধরা গলায় বললেন
-কাল যাওয়ার আগে একবার দেখা করতে পারবে?
-কাল! কখন?
-দুপুরে বেরিয়ে যাবো কাল। সন্ধ্যের দিকে বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। তাই যাওয়ার আগে যদি…………
-বেশ! বলুন কখন কোথায় দেখা করতে চান?
-কাল বারোটায় চেক আউট করে যাবো। তারপর লাগেজ রেখে একটু মহাকাল মন্দিরে যাবো পুজো দিতে। এসে থেকে যাওয়া হয়নি। তারপর ফিরে লাঞ্চ সেরে বেরোতে বেরোতে দুটো হতে পারে।
-আমাকে কখন আর কোথায় যেতে বলছেন?
-আমি জানি সকালে ওই সময় তুমি ব্যস্ত থাকবে তাই তোমাকে আসতে হবে না। আমিই এখান থেকে গাড়ীতে উঠলে তোমায় ফোন করে দেবো। তুমি শুধু ফোনটা ধোরো।
-বেশ। তাই হবে। কোথায় দেখা করবেন?
-ঘুম স্টেশনে।
-বেশ। আমি পৌছে যাবো।
-থ্যাঙ্ক ইউ সুজাতা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। তোমার বেশী সময় নষ্ট করবো না কাল। পাঁচ মিনিটের জন্য এসো তাহলেই হবে।
– আচ্ছা বেশ। এখন রাখি? সাড়ে এগারোটা বাজে। এবার ঘুমাবো। আমার কথা শুনে উনি কেমন যেন হতাশা ভরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
-বেশ। গুড নাইট।
-গুড নাইট। বলে আমি ফোন কেটে দিলাম। কাল উনি চলে যাবেন শুনে খুব খারাপ লাগছিলো। কেন জানিনা মনের কোণে একটা কষ্টও হচ্ছিলো। ভালো লাগছিলো না কিছুই। ফোনট রাখার পরও ঘুমোতে পারলাম না। এপাশ ওপাশ করেই রাত কাটিয়ে দিলাম। শেষ রাতে কখন চোখ লেগেছে আর বুঝতে পারি নি।
* * ৩২ * *
সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমেই মনে পড়ল উনি আজ চলে যাবেন। তাড়াতাড়ী উঠে ঘরের কাজে লাগলাম। কাজের ফাঁকেই ওনার জন্য জন্য কিছু রাঁধতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু উনি কি খান সে তো ঠিক জানি না। কাল তো দেখলাম রেস্ট্যুরেন্টে গিয়ে মোমো আর থুকপা ছাড়া আর কিছুই খেলেন না। থুকপা বানানো যায় ওনার জন্য। কিন্তু সূপটা যদি নিয়ে যেতে গিয়ে পড়ে যায় ভেবে ওটা তালিকা থেকে বাদ দিলাম। মোমোটা দিতে পারি ভেবে ওনার জন্য কটা মোমো বানাতে লাগলাম। জানি না আমার হাতের বানানো খাবেন কি না। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়েই বানালাম।
দুপুর তখন দেড়টা বাজে। আমি তৈরী হচ্ছি। উনি ফোন করলেই বেরিয়ে পড়বো, এমন সময় এলো আকাঙ্খিত ফোন। উনি আসছেন। তাড়াতাড়ী ওনার জন্য বানানো কটা মোমো একটা টিফিন কৌটোয় ভরে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। ঘুম স্টেশনে পৌছে মিনিট পাঁচেক দাঁড়াতেই ওনার গাড়ীটা এসে রাস্তার ওপারে দাঁড়ালো। আমি এগোতে যাবো দেখলাম উনি নিজেই গাড়ী থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার বেশ নার্ভাস লাগছিলো। উনি এগিয়ে এসে বললেন সরি তোমায় ডিস্টার্ব করলাম।
-এমা! না না! ডিস্টার্বের কি আছে! বলুন না!
-তুমি কবে ফিরবে কলকাতায়?
-আরোও দুসপ্তাহ পর। উনি শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তাহলে কলকাতায় পৌছে আর দেখা হবে না হয়ত। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কেন?
-দুসপ্তাহ পর আমি জার্মানী চলে যাবো। নতুন প্রজেক্টের শ্যুটিং শুরু হয়ে যাবে।
-ওহ আচ্ছা। এবার আমি চুপ করে ভাবছি কি করে ওনাকে দেবো খাবারটা। উনি নেবেন কি না! উনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার উনিই নীরবতা ভাঙলেন।
-সুজাতা!
-বলুন।
-তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো দেবে?
-আমি? অবাক হয়ে বললাম! তারপর সামলে বললাম বেশ বলুন। সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দেবো। উনি মৃদু হেসে বললেন চিন্তা নেই এমন কিছু চাইবো না। শুধু একটা আবদার আছে।
-আবদার! আমার কাছে? বেশ বলুন। এবার উনি খানিক চুপ করে গেলেন। যেন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন ভেতরে ভেতরে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন
-আমি কলকাতা ফিরে গেলেও তোমায় রোজ ফোন করব, কথা বলবে তো আমার সাথে? ওনার এই আবদারে আমি একটু অবাকই হলাম। এতবড় স্টার প্রথমে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইলেন, তারপর কাল একটা গোটা দুপুর আমার সঙ্গে ঘুরে আমার অতীত জীবনের সব কথা জানলেন, দিনের শেষে ফেরার আগে আমায় নতুন বন্ধুত্বের জন্য উপহারও দিলেন। আবার আজ বলছেন রোজ ফোন করবেন। কথা বলবেন। সত্যিই ওনাকে যত দেখছি আমি অবাক হচ্ছি! কি আর বলব, আমি ওনার কথায় মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। আমার সম্মতি দেখে ওনার মুখটাও আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠলো। নাহলে তো এতক্ষণ যেন মেঘলা হয়ে ছিলো। আমিও এবার সাহস করে বললাম একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেন না তো! উনি হেসে বললেন তোমার আমাকে কোনো কথা বলতে এত সংকোচ করতে হবে না। আমরা দুজন তো এখন বন্ধু। আর বন্ধুত্বের মধ্যে আর যাই থাক সংকোচ থাকতে পারে না। আমিও ওনার কথায় ভরসা পেয়ে হাতের কৌটোটা ওনার সামনে ধরে বললাম আসলে আপনার জন্য কটা মোমো বানিয়েছি আর একটু সসও। আমি জানি না আপনি খাবেন কি না! কাল তো দেখলাম আপনি রেস্ট্যুরেন্টে মোমো খে……….. আমার কথা শেষ হবার আগেই উনি আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে টিফিন বক্সটা কেড়ে নিয়ে ঢাকনা খুলে টপাৎ করে একটা মোমো মুখের ভেতর চালান করে দিলেন। তারপর সেটা তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলেন বাচ্ছাদের মত করে। যে দেখে আমারই হাঁসি পেয়ে গেলো। উনি আমাকে হাসতে দেখে গম্ভীর হয়ে বললেন এই টিফিন বক্স আর এর ভেতরের মোমো আর সস সব আমার। কোনোটাই আর তুমি ফেরত পাবে না। পরে দেখা হলে টিফিন বক্সটা ফেরত দিতে পারি। তবে একটা শর্তে। আমি হেসে বললাম, আবার শর্ত! উনি গম্ভীর হয়ে বললেন হ্যাঁ শর্ত। এটা ফেরত পেতে পারো কিন্তু তার বদলে আবার এটা ভর্তি করে দিতে হবে অন্য কিছু বানিয়ে। বল রাজী? ওনার কথার ভঙ্গী দেখে আমি তো হো হো করে হেসে উঠলাম। তারপর হেসে বললাম বেশ, রাজী। উনিও আমার কথায় খুশী হলেন। আমি বললাম আপনার দেরী হচ্ছে না? উনি বললেন যেতে ইচ্ছা করছে না? আমি বললাম কি??? উনি করুন মুখে বললেন আচ্ছা আসি। আমি হেসে মাথা নাড়লাম। উনি তাও খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছেন অথচ পারছেন না। আমার মুখ দিয়ের হঠাৎই বেরিয়ে গেলো পৌছে জানাবেন। কেন জানি না। তবে এটা শুনে ওনার মুখটা একটু উজ্জ্বল হলো। উনি হেসে সম্মতি জানিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ীতে গিয়ে বসলেন, গাড়ী ছেড়ে দিলো। উনি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও ওনার গাড়ীটা যতদুর দেখা গেলো দাঁড়িয়ে দেখলাম তারপর ওনার গাড়ীটা দেখতে দেখতে পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেলে আমিও বাড়ী চলে এলাম মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে।
(চলবে)