#ভালোবাসা_আমার
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০২
বাড়িতে ফিরে মাকে সামনে পেলাম। সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণের জমে রাখা কান্না সব মায়ের বুকে বিসর্জন দিতে লাগলাম। ওঁ পাশে থাকতে কখনও কোনো বাজে কথা, বাজে দৃষ্টি আমাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু আজ ওঁ আমার পাশে নেই। মা চমকালেন, কখনও তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হয়নি। বিচলিত হয়ে পড়লেন মুহূর্তেই। বারংবার বলতে লাগলেন,
“ও মৌ? কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? বল আমাকে।”
আমি থামলাম না। আমার যে বুকে অনেক কষ্ট। দীর্ঘক্ষণ পর আমি ক্লান্ত হয়ে থামলাম। মা তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। ভয় পেয়েছেন তিনি। আমি শান্ত হতে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ফ্রেশ হতে বলে চলে গেলেন। তিনি জানেন, এখন আমাকে প্রশ্ন করে করে সেঞ্চুরি পার করে ফেললেও জবাব পাবেন না। ক্লান্ত শরীর টেনে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মা খাবার নিয়ে এসেছেন। খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তাকে মানা করলাম না। খেয়ে নিলাম। মা আমাকে রেস্ট করতে বলে চলে গেলেন। গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আজ যদি ওঁ আমার পাশে থাকত তাহলে কি আমাকে এসবের মুখোমুখি হতে হতো? কিন্তু ওঁর উপর আর কতদিনই বা নির্ভরশীল থাকব আমি? ওঁ তো আর সারাজীবন আমার সাথে থাকবে না। এখন থেকেই তো দূরে চলে যাচ্ছে।
—
ভার্সিটিতে প্রবেশ করলাম খানিকটা আনমনেই। আশে পাশে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দে চমকে উঠলাম। অদূরে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ওঁ বেধড়ক মা’রধর করছে ফুয়াদ দের। নিজেও মা’র খাচ্ছে কম না। এগিয়ে যেতেই আড়ালে তিন্নি কে লুকিয়ে থাকতে দেখলাম। তার কাছে গিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললাম,
“তুমি ওঁকে আটকাচ্ছ না কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছ!”
তিন্নি বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“নিজে গিয়ে পারলে আটকান। আপনার জন্যই এসব হচ্ছে। কি সুন্দর ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিলাম, তার মধ্যে..”
তার কথায় আর কান না দিয়ে আমি ছুটলাম। মা’রামা’রির ভীষণ খারাপ অবস্থা। চেঁচালাম,
“থামো তোমরা! এই! কি করছিস তুই! মা’রামা’রি করছিস কেন এভাবে? বন্ধ কর এসব।”
ওঁ আমার কথা শুনল না। প্রচন্ড রে’গে ভয়া’নক রূপ হয়েছে ওঁর। এতো রে’গে গেল কেন? কোনো ভাবে ফুয়াদের কথা ওঁর কানে যায়নি তো? হঠাৎ দেখলাম ফুয়াদের দলের এক ছেলে পেছন থেকে হকি স্টিক নিয়ে মারতে যাচ্ছে ওঁকে। বুক কেঁপে উঠল আমার। ওঁর পুরো নাম সম্বোধন করে ছুটলাম,
“আরভিন!”
ওঁ পেছনে ফেরার আগেই আমি ওঁকে ঠেলে আড়াল করে দাঁড়ালাম। ফলস্বরূপ আ’ঘাত পড়ল আমার কপালের আড়াআড়ি বিরাট অংশজুড়ে। আর্তনাদ করে উঠলাম, কপাল চেপে ধরলাম হাতে। ওঁ থেমেছে, আমি জানি নির্বাক হয়ে এখন আমাকেই দেখছে। ফুয়াদ তার দলবল নিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেল। অসম্ভব যন্ত্রণা অনুভব করছি মাথায়। কপাল থেকে হাত সরিয়ে সামনে আনতেই সর্বাঙ্গ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। র’ক্তে ফোবিয়া আছে আমার। শুধু র’ক্তেই না অন্ধকারেও আমার ফোবিয়া আছে। অনেক দুর্বল আমি। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। পড়ে যেতে নিলেই শক্ত পোক্ত হাত আগলে নিল আমায়। চোখ বন্ধ হবার আগে শুনতে পেলাম,
“এই মৌ! তুই কেন এর মধ্যে আসতে গেলি? এই চোখ বন্ধ করবি না। মৌ!”
—
পিটপিট করে চোখ মেলতেই মাথার উপর ঘুরন্ত পাখা নজরে এলো। বিরক্তিকর আওয়াজে ঘুরে চলেছে সেটা। মুহূর্তে নাক কুঁচকে ফেললাম। ফিনাইলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। মাথাটা টনটন করছে। মাথায় চাপ প্রয়োগ না করেও বুঝতে পারলাম আমার অবস্থান। একটু নড়ে উঠতেই কানে এলো মায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর,
“তোর জ্ঞান ফিরেছে, মৌ! কই গেলেন? দেখে যান মৌ এর জ্ঞান ফিরেছে।”
বলেই কান্না শুরু করলেন। বাইরে থেকে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলেন বাবা এবং ওঁ। বাবা বিরক্ত মুখে চেয়ে বললেন,
“আবার শুরু করলে তুমি! থামো একটু। মেয়ের তো জ্ঞান ফিরেছে নাকি?”
মা একটু থামলেন। কন্ঠে অভিমান জড়িয়ে বললেন,
“আমি একটু কাঁদলেই দোষ? আর নিজে যখন চোখ লাল করে বসে ছিলেন তার বেলা?”
বাবা একটু ইতস্তত করলেন। আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন কেমন লাগছে, মা?”
মৃদু কন্ঠে জবাব দিলাম,
“ভালো।”
তিনি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। মা আমার কাছে এসে মাথায় থাকা ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে আবার কেঁদে উঠলেন। আমি এবার মুখ কুঁচকে বললাম,
“এভাবে কাঁদার কি আছে, মা? আমি কি ম’রে গিয়েছি? বাবা প্লিজ তুমি মাকে একটু বাইরে নিয়ে যাও। কান্না বন্ধ হলে তারপর আবার নিয়ে এসো।”
আমার কথা শুনে বাবা মাকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। ওঁ গেল না। দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,
“তুই আমাকে হাসপাতালে এনেছিস! এইটুকু কাঁটার জন্য হাসপাতালে কে আসে?”
ওঁ এগিয়ে এসে টুল টেনে বসল। মুখটা অপরাধীর মতো বানিয়ে বলল,
“একটু খানি কা’টা! র’ক্ত দিতে হয়েছে তোকে।”
আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“কেন র’ক্ত দিতে কে বলেছে? ম’রে যেতাম। তুই শান্তিতে গু’ন্ডাগিরি করতিস। এই আমাকে র’ক্ত দিয়েছে কে? তুই?”
ওঁ মাথা উপর নিচ নাড়াল। ক্ষেপে উঠলাম আমি,
“কোনো গু’ন্ডার র’ক্ত আমি নেব না। এক্ষুনি ডাক্তার ডাক। সব র’ক্ত বের করতে হবে।”
ওঁ অসহায় চোখে মুখ ছোট করে তাকাল। আমি অসুস্থ বলে আমার উপর আক্রোশটা ঠিক ঝাড়তে পারছে না। আমি আবার বললাম,
“পুলিশ ডাক। এক্ষুনি পুলিশ ডাক।”
“কেন?”
“কেন মানে? একজন গু’ন্ডা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া আমার নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব। জলদি ফোন দে। প্রিন্সিপালের ছেলে বলে তোকে ছেড়ে দিতে হবে নাকি?”
ওঁ মিনমিন করে বলল,
“নিজেই ফোন দিয়ে বলব নিজেকে ধরে নিয়ে যেতে? আমার মাথা ঠিক ছিল না, মৌ। ফুয়াদ তোকে ওসব বলেছে শুনেই! আমার কি দোষ?”
“কে বলেছে তোকে?”
“ছোট বলেছে। যখন ক্যান্টিনে গিয়েছিলাম। অর্ডারের জন্য ও’কে ডাকতেই ও বলল। তুই আমাকে বলিসনি কেন?”
তাচ্ছিল্য হেসে মনে মনে আওড়ালাম, “আমার কথা শোনার সময় আছে তোর?” একটু চুপ থেকে বললাম,
“দোষটা তোরই। আমাকে যে যা খুশি বলুক। তোর তাতে কি? তোর না গার্লফ্রেন্ড আছে? ও এসব মারপিট দেখে যদি ব্রেকআপ করে দেয়?”
এবার ওঁর চোয়ালটা একটু শক্ত হলো। না, একটু না। অনেকটা। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, মৌ। তোকে কেউ আজে বাজে কথা বললে আমি সহ্য করতে পারি না। আর আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি বুঝে নেব।”
সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এতোই যখন সহ্য হয় না, তাহলে পাশে থাকলেই তো পারিস। কিন্তু তোর তো অন্য দায়িত্ব আছে! চোখ খুলে শান্ত কন্ঠে বললাম,
“এই গাধা! কটা বাজে?”
“বারোটা পাঁচ।”
“বাড়ি যাব আমি। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবাকে ডাক। আর তুই চলে যা। দ্যাখ তিন্নি রাগ করে বসে আছে কিনা”
“আমি তোকে বলেছি এসব নিয়ে ভাবতে? চুপচাপ শুয়ে থাক।”
খড়খড়ে কন্ঠে বলে ওঁ বাইরের দিকে হাঁটা দিল। আমি চুপ হয়েই শুয়ে রইলাম। জানি শতবার বললেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আমি এখান থেকে নড়তে পারব না।
—
বাসায় নিয়ে এসেছে বিকেলে। আমার কাছে চরম লজ্জাজনক ব্যাপার হলো হেঁটে আসার পথটুকু আমাকে ওঁর কোলে উঠে আসতে হয়েছে। দাপাদাপি করে, মানা করেও লাভ হয়নি। মাথায় ব্যথা লেগেছে, পায়ে তো আর না। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! এত্তো জেদি মানুষ আমি দুটো দেখিনি। আমি তো সহ্য করতে পারি, তিন্নি কীভাবে সহ্য করে কে জানে? বাবা মায়ের সামনে কি একটা লজ্জার ব্যাপার! কিন্তু তারা ছিলেন ভাবলেশহীন। যেন এখানে আশ্চর্য জনক কিছুই নেই। আমাকে রুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বাইরে থেকে আওয়াজ পেলাম,
“এখন যাস না, বাবা। রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবি। কতদিন আসিস না!”
ওঁ কি জবাব দিল শোনা গেল না। মায়ের কন্ঠের জোরটা একটু বেশি ছিল। আমি শুয়ে রইলাম। আমি জানি ওঁ যাবে না। মায়ের হাতের রান্না খেয়ে একশো একটা প্রশংসা করে তবেই যাবে।
চলবে,