ভালোবাসা আমার পর্ব ১

0
630

নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের সামনেই অন্য কাউকে মন প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতে দ্যাখা যায়, তবে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই তা সুখকর নয়? বড্ড বেদনার, বড্ড যন্ত্রণার। হৃদপিণ্ড ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার ন্যায় ব্যথা হয় বুকে। আমি বুঝি, কেন বুঝি? কারণ আমি দেখি। আমি রোজ দেখি আমার ভালোবাসার মানুষটি তার ভালোবাসার মানুষ নিয়ে ঘুরছে, ফিরছে, হাসছে কত কি!
হ্যাঁ, সে আমার ভালোবাসার মানুষ হলেও আমি তার ভালোবাসার মানুষ নই। শুধুই বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু আমরা, বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই কলেজ লাইফ থেকে, এখন ভার্সিটির ফোর্থ ইয়ার। গলায় গলায় বন্ধুত্ব আমাদের। কেউ কেউ ভুল করে বলেই ফেলত,

“তোমরা কি কাপল?”

বন্ধুত্বের আড়ালে নতুন অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া এই আমার তখন ইতস্তত বোধ হয়। তবে ওঁ হেসে উড়িয়ে দেয়। আমার কাঁধ পেঁচিয়ে ধরে বলে,

“উই আর বেস্ট ফ্রেন্ডস্।”

আমি আবারও মিইয়ে যাই, পিছিয়ে আসি। নিজের সুপ্ত অনুভূতি কে তিরস্কার করি। ছিঃ ছিঃ! এই নিম্ন মানুষিক চিন্তা ভাবনা ও জানতে পারলে তখনই বন্ধুত্বের ইতি টেনে দেবে। দূর ছাই করে তাড়িয়ে দেবে। বলবে,

“তোর মুখও আমি কোনো দিন দেখতে চাই না। এসব ভাবলি কি করে!”

নিজের কল্পনাতেই আমি শুকনো ঢোক গিলি। বন্ধুত্ব শেষ করে দিলে তো আমি শেষ হয়ে যাব। যেখানে তাকে রোজ চোখের দ্যাখা একটু না দেখলে আমার জানই বেরিয়ে আসে, সেখানে সব শেষ হয়ে গেলে আমি বাঁচব? তারপর থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের অনুভূতি নিজের মধ্যেই চেপে রাখব। ঘুনাক্ষরেও টের পাবে না কেউ। কেউ না।

ভার্সিটি থেকে ফিরে দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। হাতড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ওঁ ফোন করেছে। নিশ্চয় আমার কলিজা জ্বা’লিয়ে দেওয়ার মতো কিছু বলবে এখন। ফোন রিসিভ করে কানে ধরলাম,

“বল।”

ওপাশ থেকে গদগদ কন্ঠে ওঁ বলল,

“শোন না মৌ? আমি ভাবছি তিন্নিকে প্রপোজ করব।”

কলিজা ছলাৎ করে উঠল আমার। তবুও তা প্রকাশ না করে শান্ত কন্ঠে বললাম,

“তুই প্রপোজ করেই রিলেশনে গিয়েছিস। এখন ছ’মাস পর আবার প্রপোজ করবি মানে?”

“আরে ওটা তো সিম্পল গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করেছিলাম। আজ ভাবছি বেশ আয়োজন করে আরও একবার প্রপোজ করব। আমি দু মিনিটে তোর বাড়ির সামনে আসছি, তুই এক মিনিটে রেডি হয়ে থাক।”

আমার জবাব না নিয়েই ফোন কে’টে দিল। কেউ বোঝে না, বোঝে না যে আমার ঠিক কতটা কষ্ট হয়। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে যেখানেই যাবে সেখানেই আমাকে তার সাথে যেতে হবে। তারা বসে প্রেমালাপ করবে আর আমি বসে বসে আমার হৃদয় পো’ড়া গন্ধ শুঁকব। না গিয়ে উপায় নেই। রেডি হয়ে আমি বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ঠিক এক মিনিট পরই ওঁ এলো। আমি কোনো কথা না বলে বাইকে উঠে বসলাম। পিঠে মাথা এলিয়ে দিলাম। ওঁ বাইক স্টার্ট দিল,

“তুই কি অসুস্থ মৌ?”

আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। এভাবে ওঁকে ছুঁয়ে থাকতে, ওঁর সুবাস নাকে শুষে নিতে যে আমার কেমন শান্তি লাগে! তা ওঁ কখনোই জানবে না। ওঁ বাইক থামাল এক রেস্টুরেন্টের সামনে। আমি নেমে গেলাম। ওঁ বাইক পার্ক করে এসে বলল,

“বুঝলি মৌ? একদম কোণের একটা টেবিল বুক করেছি। চল, দেখবি চল।”

আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। ওঁ নিজেও জানে না আরও একবার মেরে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছে।

টেবিলে ফুল টুল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে নিজে যতটা পেরেছে। আবার তিন রঙা গোলাপও এনে রেখেছে। লাল, হলুদ, সাদা। তাকে গিফট করবে বলে শাড়ি কিনেছে, সাথে জুয়েলারি, চুড়ি, গাজরা, মেকআপ সেট কত কি!

“কেমন হয়েছে বল?”

“ভালো।”

ভালো লাগছে না। আমি বসে পড়লাম। ওঁ বসল না। উত্তেজনায় পায়চারি করছে, যেন এই প্রথম প্রপোজ করবে! কিছুক্ষণ পর তিন্নি এলো। সুন্দরী একটা মেয়ে। তাকে দেখেই আমি উঠে দাঁড়ালাম,

“আমার জন্য কষ্ট করে একটা কফি অর্ডার করে দিস।”

ওদের পেছনের টেবিলে ওদের দিকে পিঠ করে বসলাম। দেখতে চাই না আমি কিছু। ওঁ কফি কখন অর্ডার করল জানি না। বসার সাথে সাথে কফি এসে হাজির। আমি তা হাতে নিয়ে অল্প অল্প চুমুক দিতে থাকলাম। পেছন থেকে সব কথা আমার কানে আসছে। ওঁ তিন্নিকে আবারও প্রপোজ করল এবং তিন্নি তা একসেপ্ট করেও নিল। কিছুক্ষণ পরই প্রেমালাপ পাল্টে গেল!

“তুমি আবারও আপুকে নিয়ে এসেছ কেন? আমি না বারন করেছিলাম?”

“ওভাবে বলছ কেন তিন্নি? মৌ সবসময় আমার সাথে থাকে। আর আজ থাকবে না?”

“না আর কখনোই থাকবে না। আমাদের তো একটা প্রাইভেসি আছে। আমার এসব ভালো লাগে না। তুমি পরের বার থেকে ওনাকে নিয়ে আসবে না।”

আমি সব শুনলাম। ওঁর জবাবের অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালাম।

“আমি বাড়িতে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে মা কল দিয়েছিল। এক্ষুনি যেতে বলেছে।”

বেরিয়ে এলাম। পেছনে ওঁ কিছু বলল, শুনলাম না। বাড়িতে এসে খুব কাঁদলাম, কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে ফেললাম, চোখ লাল করে ফেললাম। তবুও আমার অসহনীয় কষ্ট কমে না।

তারপর থেকেই ওঁ পাল্টাতে শুরু করল। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যে মানুষটা আমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত কল্পনা করতে পারত না, সেই মানুষটাই আমার খোঁজ নেয় না। শুধু ক্লাসে আসা হয় আর পাশাপাশি বসা হয়। এটাও হয়তো ওঁ বাধ্য হয়েই করে। ক্লাসের সময়টা ছটফট করে খুব, আবার ক্লাস শেষ হতেই ছুটে বেরিয়ে যায়। মনটা তো ওঁর তিন্নির কাছেই পড়ে থাকে। আমি শুধু চেয়ে দেখি। করার তো আমার কিছুই নেই। আগের মতো কথা বলে না, বাইকে করে বাড়িতেও পৌঁছে দিয়ে আসে না। এখন তো ওঁর অন্য লোক আছে। ভালোবাসার মানুষ!

রোজ রোজ আমার চোখের সামনে দিয়েই তারা ঘুরতে যায়। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না ওঁ। আর আমি? আমি মলিন হেসে সরে আসি। এছাড়া আর উপায় কি?
আজ ক্যান্টিনে বসে আছি একা। আগে আমার সাথে ও থাকত, কিন্তু গত ক’মাস ধরে এটা পরিবর্তন হয়েছে। রাতে ঘুম হয় না। মাথাটা ধরে আছে প্রচন্ড। ক্যান্টিনের ছেলেটিকে ডাকলাম,

“ছোট! এক কাপ কফি দিয়ে যেও তো।”

মাথায় হাত চেপে বসে রইলাম। ছেলেটা কিছুক্ষণ পর কফি দিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে সেটা হাতে নিতে যেতেই তা সামনে থেকে সরে গেল। আমি মাথা তুলে তাকালাম। সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ক্লাসের সব থেকে নিকৃষ্ট বখাটের দল। তাদের লিডার ফুয়াদ। ফুয়াদ ভার্সিটির শুরু থেকেই আমাকে বিরক্ত করে। তবে ওঁর জন্য তেমন সুবিধে করতে পারত না। আজ সুযোগ পেয়েছে।

“কি ব্যাপার? তুমি একা যে! তোমার ওই বিএফ কই? আই মিন বেস্ট ফ্রেন্ড!”

কেমন যেন তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল তারা। আমি জবাব দিলাম না। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে কি লাভ? আমি উঠে দাঁড়ালে আবার বলল,

“আরে! উঠলে কেন? বসো, গল্প করি। তোমার ওই বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য তো আমরা সুযোগই পেলাম না। তা আমাদের কি একটা সুযোগ দেওয়া যায়? নাকি সব স্পেশাল অফার তার?”

গা ঘিন ঘিন করে উঠল। শক্ত মুখে চেয়ে বললাম,

“আজে বাজে কথা বলবে না, ফুয়াদ। সামনে থেকে সরো।”

“ওরে বাবা! ভয় পেলাম তো।”

বলে খিক খিক করে হেসে উঠল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম। ফুয়াদ একটু এগিয়ে চাপা কন্ঠে বলল,

“বেস্ট ফ্রেন্ড কি পে করে না? সমস্যা নেই একটা সুযোগ দাও, আমি পে করব। বরং ডাবল দেব।”

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালাম। ঘৃণ্য ইঙ্গিত বুঝেই আমার সর্বাঙ্গ জ্ব’লে উঠল।

“ফুয়াদ!”

নিজেকে অসহায় বোধ করলাম। সব সময় তো আমার পাশে ওঁ ছিল, আজ নেই। ওরা আরও অনেক কথা বলল। আমি পারলাম না আর সহ্য করতে। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। পেছন থেকে শুনতে পেলাম সকলের অট্টহাসি।

#ভালোবাসা_আমার
#মোহনা_মিম
#সূচনা_পর্ব

আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here