ভালোবাসা আমার পর্ব ৪

0
417

#ভালোবাসা_আমার
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৪

দীর্ঘক্ষণ ভেজার ফলে ভয়ানক জ্বরে পড়লাম। বাবা মা অস্থির হয়ে উঠলেন। আমি তাদের আস্বস্ত করলাম, চিন্তার কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাব আমি। জ্বর কত আসে, কত যায়! তবুও তাদের চিন্তার শেষ নেই। বাবা দিনে রাতে পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে ওষুধ নিয়ে আসছেন। অথচ জ্বর কমছে না। জ্বর কমবে কি করে? না আমি ওষুধ খাই আর না আমি সুস্থ হতে চাই। সুযোগ বুঝে জানালা দিয়ে ওষুধ ফেলে দিই। মুখে রুচি নেই বলে খাবার এড়িয়ে যাই। আবার রাতে তাদের জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়ে আমি আবার শাওয়ারের নিচে যেয়ে বসে থাকি। কারণ আমি রুমে কাঁদতে পারি না। শাওয়ারের নিচে বসে কাঁদলে আমার চোখের জল আমিও দেখতে পাই না। তাই তো আমার এমন পদক্ষেপ।

দেখতে দেখতে দেখতে চারটা দিন কেটে গেল। জ্বর আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। বেহুঁশ হয়ে আছি আমি। না কথা বলতে পারি আর না চলতে। শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছি এক প্রকার। বাবা মা এবার হাল ছাড়লেন। আমাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তারের চোখ কপালে। আমি এখনও কীভাবে বেঁচে আছি সেটা হয়তো বুঝতে পারছেন না। তৎক্ষণাৎ আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। সেলাইন চলল দিন রাত। এবার আর আমার ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। ডাক্তার নার্স ক্ষণে ক্ষণে এসে আমার খবর নিচ্ছে। বার বার বলছে ‘কপালের জোরে বেঁচে গেলে’। আমি হাসি। কে বাঁচতে চেয়েছিল? মা শুধু মুখে আঁচল চেপে কাঁদেন। আমি তার একমাত্র মেয়ে। আমার কিছু হয়ে গেলে তারা বাঁচবেন কি নিয়ে? ভাবনাটা আমার মনে গভীর দাগ কাটল। থাক আর শাওয়ারের নিচে যাবার দরকার নেই। চোখের জল তো শুকিয়েই গিয়েছে।
বাবা ওঁকে জানাতে চেয়েছিলেন। আমি বারন করলাম। তার স্পেশাল সময় গুলোতে ব্যাঘাত ঘটানোর কোনো মানেই হয় না।
মোটামুটি সুস্থ হয়ে আমি বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফিরলাম। জ্বর এখনও হালকা আছে, যায়নি পুরোপুরি। তবে ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নেই। বাড়িতে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাব। সব ভালো হলেও আমার বুকের ব্যথাটা ঠিক হলো না। এটা কি ডাক্তারকে বলা উচিত ছিল?

আজ শুক্রবার। ওঁর বিয়ে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর আমার গোপন ভালোবাসা, তার বিয়ে। নিশ্চয়ই ওঁ নিজের ভালোবাসাকে নিজের পেয়ে খুব খুশি? হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। এই সন্ধ্যা বেলা আবার কে এলো? বাবা আসেন রাতে। পাশের বাড়ির আন্টি হতে পারে। ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলাম। শরীর দুর্বল এখনও। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সামনের ব্যক্তিকে চোখে পড়তেই থমকে গেলাম। যখন ক্লান্ত মুখে রক্তিম দৃষ্টি দৃষ্টিতে মেলাল তখন আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। বারবার মনে হলো, কিছু একটা হয়েছে। ওঁ আমাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। গলা উঁচিয়ে মাকে ডাকল,

“আন্টি! কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।”

মা ঘর থেকে বেরিয়ে ওঁকে দেখে অবাক হলেন। দ্রুত চলে গেলেন রান্নাঘরে। ওঁ ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। আমি অবাক চোখে চেয়ে রইলাম। পরনে বিয়ের শেরোয়ানি। তবে কি বিয়ে শেষ করে এসেছে? কিন্তু কেন এসেছে? আমার ভাবনার মাঝেই আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করে বলল,

“গ্রাম থেকে ফিরেছিস কবে?”

আমি জবাব দিতে পারলাম না। তবে বুঝলাম ধরা পড়ে গিয়েছি। মা এসে ঠান্ডা পানি দিলেন। ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ওঁ উঠে দাঁড়াল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি তোমাদের নিতে এসেছি, আন্টি। আজ তো আমার বিয়ে। তোমাদের ছাড়া কীভাবে হয় বলো তো?”

মা অবাক হলেন। আমি ওঁর বিয়ের কথা তাকে বলিনি। মা ইতস্তত করে বললেন,

“তোর আঙ্কেল তো বাড়িতে নেই। এখন কীভাবে..”

তাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে ওঁ বলল,

“আঙ্কেলকে আমি আগেই ফোন করে দিয়েছি। অফিস থেকে সরাসরি সেন্টারে চলে যাবেন। এখন তোমরা চলো।”

“কিন্তু রেডি..”

“রেডি হতে হবে না। এভাবেই চলো। বৌভাতে নাহয় ইচ্ছে মতো সেজো।”

এক টেনেই বাড়ির পোশাক পরা অবস্থায় আমাদের নিয়ে গেল। কমিউনিটি সেন্টার মানুষে গিজগিজ করছে। তবে কেমন যেন শান্ত। বাবা আগেই চলে এসেছেন। স্মিত হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা এগোলাম। আশে পাশে তিন্নিকে দেখতে পেলাম না। তবে ও কি এখনও আসেনি? হঠাৎ হাতে টান পড়ায় থেমে গেলাম। ওঁ আমার হাত ধরে থামিয়েছে। জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চমকে উঠে পিছিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্তু আমি আটকে আছি। ওঁর দিকে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বললাম,

“কি করছিস তুই? লোকে দেখছে। ওঠ।”

ওঁ উঠল না। ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তুলল। হৃদয়স্থলে তীব্র কম্পন অনুভব করলাম। ওঁ বলতে শুরু করল,

“আমি কিন্তু সাজিয়ে কিছু বলতে পারি না। তোর ভাষায় আমি গাধা। যতটুকু পারি বলছি। তোর সাথে আমার সেই কলেজ না তার আগে থেকে বন্ধুত্ব। কত বছর হলো বন্ধুত্বের বয়স? প্রায় ছয় বছর। তুই খুব চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে ছিলি। আর আমি ছিলাম চঞ্চল। কীভাবে যেন আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি ছাড়া তোর আর কোনো বন্ধু ছিল না। এমনকি ভার্সিটিতে উঠেও না। আমি সব সময় তোর সাথে থাকতাম, তোর পাশে থাকতাম। কিন্তু তিন্নির জন্য আমাদের দূরত্ব বাড়তে লাগল। আমি তো সব সময় বলতাম তিন্নিকে ভালোবাসি আমি। কিন্তু ভালোবাসা কি এতোই সোজা? এক দুই দিন দেখেই ভালোবাসা হয়ে যায়? আমি তো তিন্নিকে দু একদিন দেখেই ও’কে প্রপোজ করে বসেছিলাম। আমার মস্তিষ্ক হয়তো ওর বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল। তবে আমার মন? তুই যখন আমার সাথে থাকতি তখন আমার অদ্ভুত এক অনুভূতি হতো, যা তিন্নির সাথে থাকতে হতো না। তোর মুখের হাসি দেখলে আমার হৃদস্পন্দন থেমে যেত, যা তিন্নির হাসি দেখলে হতো না। তোর গায়ে একটা টোকা লাগলে আমি পাগল হয়ে যেতাম, কিন্তু তিন্নির বেলায় হতো না। তোকে কেউ কিছু বললে আমার মাথায় রক্ত উঠে যেত, তিন্নিকে কেউ কিছু বললে আমার গায়েই লাগত না। তোকে একদিন না দেখলে আমার কি হাল হয় জানিস? অথচ! এবার তুই বল কাকে ভালোবাসি আমি? কার বাস আমার হৃদয়ে?”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ওঁ! ওঁ কি বলছে এসব? একটু হেসে ওঁ আবার বলল,

“ভালোবাসি তোকে রে পাগলি! এই মৌ? আমার বউ হবি? পড়ালেখা টা শেষ হলেই বিয়েটা হতে পারত। কিন্তু আমি তোকে হারাতে চাই না। পড়ালেখা শেষ হতে হতে যদি তোকে কেউ নিয়ে নেয়? এই মৌ? এই গাধাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিবি?”

দুর্বল শরীর নিয়ে ওঁর সামনে বসে পড়লাম। কম্পনরত কন্ঠে বললাম,

“হুহ! কোনো গাধাকে মানুষ করতে পারব না আমি। আমি তোকে রিজেক্ট করছি।”

হেসে উঠল শব্দ করে। কপালে টোকা দিয়ে বলল,

“রিজেক্ট শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই, সুন্দরী। তোর বাবা মাকে আগে থেকেই পটিয়ে ফেলেছি। বিয়ে না করে যাবি কোথায়? ভালোই ভালোই রাজি হয়ে যা। নয়তো জোর করে বিয়ে করব।”

চোখে জল নিয়েই হেসে ফেললাম আমি। বললাম,

“রাজি। কিন্তু গাধাকে মানুষ করতে পারব না।”

মুহূর্তে আমাকে বুকে ভরে নিল। চারপাশ মুখোরিত হয়ে উঠল তালির বর্ষণে। কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হলো এভাবেই। পরপরই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। মৃদু কন্ঠে বললাম,

“ছাড়, সবাই দেখছে।”

তার নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর,

“দেখুক।”

ওঁর বাবা এগিয়ে এলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“সবাই অপেক্ষা করছে। বিয়েটা আগে সেরে নে। বাকি সব পরে হবে।”

লজ্জায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম। নিজে উঠে আমাকে ধরে স্টেজে নিয়ে বসাল। আমার পাশে বসে বলল,

“মা, ওর মাথায় ওড়নাটা দিয়ে দাও। তাহলেই হবে।”

কথা মতো আন্টি মাথায় লাল রঙা ভারী ওড়না চাপিয়ে দিলেন। বুকের মধ্যে এখনও কম্পন অনুভব করছি। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। আমার বাবা মায়ের এতে কোনো আপত্তি নেই। ছয়টা বছর ধরে যে ছেলেকে চেনেন, তার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে দ্বিধা কীসের? যেখানে তারা অবগত তাদের মেয়ে ভালো থাকতে, সুখে থাকবে এবং সুরক্ষিত থাকবে। বাবা একটু আমতা আমতা করলেও ওঁর পাগলামির কাছে হার মেনেছেন। কাজী কবুল বলতে বললে ওঁ দেরি করল না। তোতাপাখির মতো বলে দিল। যেন কত তাড়া! এবার আমাকে বলতে বলা হলো। আমি একবার বাবা মায়ের দিকে তাকালাম। তাদের মুখে হাসি। খুশি তারা। ওঁ আমার হাতের উপর হাত রাখল যেন আশ্বাস দিয়ে বলল, “চিন্তা কীসের? আমি সারাজীবন থাকব তোর পাশে।” কবুল বলে দিলাম। এতো দিনের বেস্ট ফ্রেন্ডের পরিচয় নতুন রূপ নিল। আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী।

ভালোবাসার মানুষটিকে পেলেও বাবা মা কে ছেড়ে যাবার কষ্টে কেঁদে কেঁদে দুর্বল শরীরে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কীভাবে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে জানি না। আন্টি আমাকে খাইয়ে দিয়ে গেলেন। আগেই ফ্রেশ হয়ে গায়ে শাড়ি জড়িয়েছি। চুপচাপ বসে আছি ওঁর আসার অপেক্ষায়। কিন্তু ক্লান্তিতে আর শেষ পর্যন্ত যেতে পারলাম না। বিছানায় শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ জানি না। ওঁর ডাকে আমার ঘুম হালকা হয়ে এলো।

“মৌ! এই মৌ ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

আমার রাগ হলো। দেখতেই তো পাচ্ছে যে ঘুমিয়ে পড়েছি। এভাবে ডেকে কেউ জিজ্ঞেস করে? বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললাম,

“না ঘুমাই নি। কাবাডি খেলছি। তুই খেলবি?”

ওঁ মুখ ছোট করে বলল,

“আচ্ছা তুই ঘুমা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

চলে গেল। কানে এলো শুধু ধুপ ধাপ পায়ের শব্দ। আবারও যখন চোখ লেগে এসেছিল, তখন আবার ডাকল,

“মৌ, তুই কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

আমি চোখ টেনে মেললাম। দেখলাম মুখের উপর ঝুঁকে আছে। ভেজা চুল থেকে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে আমার মুখে। তেজী কন্ঠে বললাম,

“চুল মুছিস নি কেন? মুছে নে।”

ওঁ দুষ্টু হেসে মুখের উপর চুল ঝাড়া দিল। মৃদু চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘুম আমার পুরোপুরি ভেঙে গেল। চোখ রাঙিয়ে বললাম,

“কি করছিস তুই? ঘুমাতে দিবি না নাকি?”

ধপ করে শুয়ে পড়ল। এক হাত ধরে টান দিয়ে বলল,

“আজ রাত কি ঘুমানোর জন্য নাকি? জানিস না আজ কি?”

চোখে ওঁর দুষ্টুমি। অনুভব করলাম গাল ভারি হয়েছে। ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

“ছিঃ ছিঃ! আমি না তোর বন্ধু? এসব কথা মাথায় কীভাবে নিয়ে আসতে পারিস?”

ওঁ আমাকে জাপ্টে ধরল। কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমি যে ঠিক কি কি ভাবতে পারি, তা তোকে আজই প্রাকটিক্যালি দেখিয়ে দিতাম। কিন্তু তুই অসুস্থ আর ক্লান্ত বলে চুপ করে আছি। তবে ভবিষ্যতে ছেড়ে দেব, এটা ভুলেও কল্পনা করিস না। এখন ঘুমা।”

চলবে,
জানি অনেকেরই মন মতো হয়নি। তবে কিছুই করার নেই, দুঃখিত। আমি গল্পটা এভাবেই সাজিয়ে ছিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here