#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -০৬]
#আফরোজা_আনজুম
নিঠুল ভাই যাওয়ার সাথে সাথেই পিউ লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। তারপর বললো, ” নিঠুল ভাই ছাঁদে তোকে ঐভাবে জড়িয়ে ধরে ছিলো কেন? তার সাথে তোর কী চক্কর চলছে?”
উত্তর দিলাম না আমি। পড়ে গিয়ে কোমরে আর হাতের কনুইতে ব্যাথা পেয়েছি অনেক। কনুই ছিলে রক্ত বেরোচ্ছে দেখে নিঠুল ভাই অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিয়েছে। পিউ আবারও বললো। আমি বললাম, ” কিছু চলছে না। জানিস নিঠুল ভাই মিষ্টি আপুকে ভালোবাসে। সেটা বলেছে আমায়।”
” সেটা তো আমিও জানি। বলেছিও তোকে। কিন্তু তোকে ঐভাবে জড়িয়ে ধরলো কেন? ”
” কই, জড়িয়ে ধরে নি। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। তুই ভুলভাল দেখেছিস। আমাকে কেন জড়িয়ে ধরবে! আশ্চর্য! ”
” হ্যা সেটাই। ভুল দেখেছি মনে হচ্ছে। ”
সে তখন আমায় জড়িয়ে ধরেছিল কেন সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। সে কী কোনোভাবে বুঝে গেছে যে আমি তাকে ভালোবাসি! আমার দূর্বলতার কথা জেনে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রথমে তার ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে তারপর আমার সাথে এমন করেছে। তার কাজই তো সেটা। আমাকে কষ্ট দেওয়া। কী ভেবেছে সে আমি কষ্ট পেয়ে অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াবো! নয়তো তাকে নিজের মনের কথা জানিয়ে ছোট হবো! মোটেও না। আমার মতো করে চলবো আমি। তাদের ভালোবাসায় বাঁধা হবো না। অধিকারও নেই তা করার। তার চেয়ে বরং অনুভূতিটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। একদমই ভাববো না তাকে নিয়ে। তার সামনাসামনিও হবো না।
রেবা আন্টিকে বললাম চলে যাবো। শুনে আন্টি অবাক হলেন। হঠাৎ কেন চলে যেতে চাই, ব্যাথা বেশি লাগছে না কি নানা কথা জিজ্ঞেস করে অস্থির হয়ে যান। বোরকা পরে তৈরিও হয়ে যান ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুঝিয়ে বলার পর থামলেন। বাসায় নিঠুল ভাই, আঙ্কেল কেউ ছিলো না। একরকম জোর করেই চলে আসলাম আমি আর পিউ। পিউ বেশ বিরক্ত হয় আমার উপর।
সেদিন চলে আসার পর রাতে নিঠুল ভাই অনেকবার কল দেয়। রিসিভ করছি না দেখে আম্মুর মোবাইলে দেয়। আম্মু এসে মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে এতগুলো কথা শুনিয়ে দেয় কেন নিঠুল ভাইয়ের কল রিসিভ করছি না। বাধ্য হয়ে আম্মুর সামনেই ফোন কানে নিয়ে আরো একগাদা কথা শুনি। আমার নাকি সাহস বেড়েছে, বেয়াদব হয়েছি, সামনে আসলে ঠ্যাং ভেঙে দিবে সহ নানা কথা। আমার যা ইচ্ছে তা-ই করবে তাতে তার কী! আমার সবকিছুতে নাক গলানো।
.
.
ক্লাস শেষে ঝুপড়িতে গেলাম। পিউকে ফোন করে সেখানে আসতে বললাম। সে রেগে আছে এই এক সপ্তাহ ভার্সিটি আসি নি বলে। জয় ভাইকে দেখে বেরিয়ে আসবো তখনই ডাক দিলো। ভার্সিটির সিনিয়র জয় ভাই, সাথে তূবার কাজিনও। তূবার সাথে প্রথমদিন ক্লাসে পরিচয় হয়েছে। খুব মিশুক একটা মেয়ে। সে-ই পরিচয় করিয়ে দেয় জয় ভাইয়ের সাথে।
জয় ভাইকে সালাম দিলাম সে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এই কয়দিন দেখলাম না তোমাদের। আসো নি কেন? কোনো সমস্যা হয় নি তো? ”
” আমি আসি নি শুধু। পিউ এসেছে তো। আমি অসুস্থ ছিলাম তাই আসি নি। ”
” ওহ্। পিউকেও দেখি নি। এখন সুস্থ আছো?”
” জ্বি ভাইয়া।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসলাম। জয় ভাইকে দেখলাম খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। তূবার কাছে নাকি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে আমাদের কথা। আর আমাদের সাথে দেখা হলেই যেখানে সেখানে হাই, হ্যালো করতে থাকে। আমার ধারণা সে ইচ্ছাকৃতভাবে দেখা দেয়। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি তাও হুট করে কোত্থেকে চলে আসে।
জয় ভাই তিনজনের জন্য চা অর্ডার করলো। আমি আছি ভয়ে ভয়ে। নিঠুল ভাই দেখলে সমস্যা। হয়তো বলবে খুব তো বড় হয়ে গেছিস। ঝুপড়িতে পায়ের উপর পা তুলে বসে ছেলেদের সাথে চা’ও খাস দেখি। আরও কী কী বলে আল্লাহ জানে। আসার সময় তো দেখলাম মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখেছে কিনা কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতে নিঠুল ভাইকে চোখে পড়লো। এদিকেই আসছে। উঠবো নাকি বসে থাকবো ভেবে পাচ্ছি না। নিঠুল ভাইকে দেখে জয় ভাই সালাম দিলো। জয় ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসলো সে। চোখাচোখি হলো তার সাথে। চোখ সরিয়ে ভাব নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই নিঠুল ভাইদের বলে উঠলো,
” তুই তো চা খাস না। এখানে এসে রংঢং করে ভাব নেওয়া হচ্ছে! ”
কথাটা শুনে বিষম খেয়ে মুখের চা পড়ে গেলো। ইশ! লজ্জা পেলাম জয় ভাইয়ের সামনে। চা একদমই মুখে তুলি না আমি। এতক্ষণ কী সুন্দর মুড দেখিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। জয় ভাই তার পকেট থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে দিলো। নিঠুল ভাই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। থাকলে থাকুক আমার কী!
” রোজা আপনার কী হয় নিঠুল ভাই? কথায় মনে হচ্ছে কাছের কেউ। ”
নিঠুল ভাই হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে। বললো, ” হ্যা। খুব কাছের কেউ। ”
জয় ভাইয়ার ফোন বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সে আসছি বলে বেরিয়ে গেল। নিঠুল ভাই বেঞ্চ থেকে উঠে আমার দিকে ঝুঁকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” কী প্রবলেম তোর? ”
” কই..কী প্রবলেম। ”
” জানিস না! চূড়ান্ত বেয়াদব হয়েছিস। সেদিন আম্মা, ভাবী বারণ করা সত্বেও সন্ধ্যায় চলে গেলি ;সাথে কোনো ছেলে ছিলো না। এতো সাহস কই থেকে আসে! ভাগ্যিস এরপরে আমার সামনে পড়িস নি। নয়তো এই হাতের চড় তোর মুখে পড়তো নিশ্চিত। এতোবার ফোন করলাম তাও রিসিভ করিস নি। আজ আবার মাঠে দেখেও লুকিয়ে চলে এলি। ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে খুব অহংকার বেড়েছে দেখছি।”
” আ..আমি অহংকার দেখাচ্ছি না একটুও।”
” তাহলে এসব কী ? আর জয়ের সাথে তোর কী সম্পর্ক?”
” তূবার কাজিন হয়। সেভাবেই চেনা। আর সিনিয়র ভাই। কোনো সম্পর্ক নেই। ”
” ভাইয়া, চড় কী মেরে দিয়েছো? দিলেও আমার সামনে আরেকটা দাও ফাজিল টাকে। ”
পিউর এমন কথা শুনে ভ্রু-কুচকে তাকালাম। মাত্রই এসেছে সে।ব্যাগ রেখে আমার পাশে বসে বললো, ” একদম এমন করে তাকাবি না। সেদিনের কাণ্ডের জন্য নিঠুল ভাই তোকে সামনে পেলেই চড় মেরে মাথা ঘুরিয়ে দিবে বলেছে। আর আমি কেন রেগে সেটা তো জানিস।”
” ভাইয়া, মিষ্টি আপুর বার্থডে তে অ্যাটেন্ড করতে বলছে৷ অনেকবার বলেছে। রোজার কথাও বারবার জিজ্ঞেস করছে। যাবো কী?”
” বলেছে যখন অবশ্যই যাবি।”
” আচ্ছা।”
” আমি যাবো না।”
পিউ বললো, ” কেন যাবি না?”
” ভালো লাগছে না। তুই যাস।”
নিঠুল ভাই গ্লাসটা টেনে পানি পান করলো। তারপর উঠে আমাকে বললো, ” ছোটবেলায় যখন মাদ্রাসায় না গেলে হুজুররা ধরে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাতো ; এখানে না গেলেও তেমন ধরে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবো।”
এমন কেন মানুষটা! এমন সব কথা বলে যে আমার মুখটাই বন্ধ হয়ে যায়। পিউ শব্দ করে হেসে উঠলো। ওর দিকে চোখ পাকিয়ে উঠে যেতে চাইলাম আমি। পিউ হাসি থামিয়ে স্যরি বলে বসিয়ে দিল।
নিঠুল ভাইয়ের সাথে শপিংমলে এসেছি। মিষ্টি আপুর জন্য গিফট কেনা হয় নি তার। সেজন্যই নিয়ে আসা আমাকে। কসমেটিকস শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কী দেওয়া যায় বলতো?”
আমি ভেবে বললাম, ” ফিঙ্গার রিং দিতে পারো। রিং..”
” লেডিস্ ওয়াচ দেখান তো ভাই!” আমার কথা থামিয়ে বললো নিঠুল ভাই।
আশ্চর্য! জিজ্ঞেস করলো কেন! ভালোবাসার মানুষকে দেওয়ার জন্য এরচেয়ে সুন্দর গিফট কী হতে পারে! আগ বাড়িয়ে না বললেই ভালো হতো বোধহয়। এক্সপেন্সিভ ঘড়ি নিলো একটা। সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য শো-রুমে গেলো। ঢুকার আগে নাম দেখলাম ‘ ডায়মন্ড হাউজ’। সেখানে থাকা মেয়েটাকে কী যেন বললো সে একটা গিফট বক্স বের করে দেয়। বক্স খুলতেই চোখে পড়লো ডায়মন্ড রিং। নিঠুল ভাই আমার হাত টেনে নিয়ে সেটা আঙ্গুলে পরিয়ে দেয়। নেড়েচেড়ে দেখে নিচু স্বরে পারফেক্ট বলে খুলে নেয়। এতক্ষণ আমি বোবার মতো শুধু দেখছিলাম। নিঠুল ভাইকে দেওয়া মেমোতে ১৬,৮০০ সংখ্যাটাও স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম যে এই রিংটা আগেই চুজ করে রেখেছিল। তাই আমি ঐখানে বলায় চুপ থেকেছিল। গার্লফ্রেন্ডের জন্য এতো দামী রিং নিয়েছে দেখে বিস্মিত হলাম। আবার ঘড়িও নিলো। অবশ্য তাদের জন্য এটা কিছুই নয়।একটা রেস্টুরেন্ট বুক করেছে বার্থডে সেলিব্রেশনের জন্য। সেখানে পৌঁছে দেখলাম খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। পিউ রুপম ভাইয়ার সাথে আগেই গিয়েছে। এখন গান গাইছে সে। আমাকে দেখে মিষ্টি আপু এগিয়ে এসে বললো, ” তুমি এসেছো দেখে ভীষণ খুশি হয়েছি।”
মলিন হাসলাম আমি। নিঠুল ভাই যাওয়ার পরপরই সেলিব্রেশন শুরু হলো। বন্ধু-বান্ধবরা সব ঘিরে রেখেছে। কেক কাটার পর নিঠুল ভাই আমার মুখে কেকের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়ে দিলো। হৈ-হুল্লোড়ে পরিবেশটা মেতে উঠেছে মুহূর্তেই। একটু পর নিঠুল ভাই রিংটা দিয়ে মিষ্টি আপুকে প্রপোজ করবে নিশ্চয়ই! ভালোবাসা বুঝার পর থেকে যে মানুষটাকে ভালোবেসে আসছি, আমার মনে প্রাণে সর্বদা যার বিচরণ সেই মানুষটা আমারই সামনে অন্য একজনকে ভালোবাসার কথা জানাবে এই দৃশ্যটা উপভোগ করার মতো অবস্থা নেই আমার। মনে হচ্ছে এক্ষুণি জ্ঞান হারাবো। সকলের আড়ালে বেরিয়ে আসলাম সেখান থেকে। রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে লাগলাম আনমনে। বৃষ্টি নামবে। মন খারাপের বৃষ্টি!
# চলবে…