ভালোবাসার রোজ,পর্ব:৭

0
5352

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-০৭]
#আফরোজা_আনজুম

‘ শুক্রবার ‘ দিনটা আমার কাছে ইদের দিনের মতো মনে হয়। এই দিনে বাড়ির পুরুষ মানে বড় চাচা, আব্বু, ছোট চাচা, আরমান ভাইয়া, আরিফ ভাইয়া সকলে উপস্থিত থাকে। মা- চাচীরা পোলাও, বিরিয়ানি সহ নতুন নতুন পদের খাবার রান্না করে। খাবার টেবিলে বাড়ির সব ছেলেরা যখন একত্রে খেতে বসে তখন দৃশ্যটা দেখে মনে শান্তি শান্তি লাগে। দাদা-দাদি জীবিত নেই। তাও বাবা-চাচা, মা- চাচীদের মধ্যে একতার জুড়ি নেই। এমনিতেই ঘুম থেকে দেরিতে উঠা আমার অভ্যেস আর শুক্রবার হলে তো কথাই নেই। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে শুনলাম আম্মু উঁচু গলায় বকছে। রুবার ভ্যা ভ্যা কান্নাও শোনা যাচ্ছে। একটু আগে এসে আমার মুখে এক গ্লাস পানি মেরে দিয়েছে। ঘুমের সময় কেউ বিরক্ত করলে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। আর সে তো পানি মেরেছে। তাই উঠেই চড় মেরে দিয়েছি। অন্যান্য দিনে ঘুম থেকে উঠতেই চায় না পড়ার ভয়ে। আর শুক্রবার হলে সবার আগে উঠে ঘুরঘুর করে।
আম্মুর গলার স্বর আরো স্পষ্ট হতেই চট করে উঠে পড়লাম। কাঁথা ভাজ করতে লাগলাম। আম্মু রাগী চোখে একবার তাকিয়ে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম আম্মু সোফায় বসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। নিশ্চয়ই আপুর সাথে কথা বলছে! আমি পাশে বসলাম। মনটা একটুও ভালো নেই। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আম্মু মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, ” তোর আপুর সাথে কথা বল।”

আপু দেখেই বললো, ” তোর চোখ মুখ এমন হয়ে গেছে কেন? খাওয়া দাওয়া করিস না? দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যের সব চিন্তা তোর!”

পাশ থেকে আম্মু বললো, ” একদম করছে না খাওয়া দাওয়া। সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে। অ্যাই, সকালের নাস্তা করেছিস? এতো বেলা হলো। নাস্তা না করে এখানে বসেছিস কেন? মরবি নাকি না খেয়ে খেয়ে! ”

আমার কান্না চলে আসলো। ঢোক গিলে মনে মনে বললাম, ” মরে যাবো মনে হয় আম্মু। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না একদম। তোমাদের বললে বলবে এতো ছোট মেয়ের কীসের কষ্ট এতো? আমরা কোনোকিছুর অভাবে রেখেছি তোকে! তোমরা তো জানো না এই ছোট মেয়েটার মনে কতো কষ্ট জমে আছে! ”
.
.
নাস্তা করে সোফায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম। চোখেমুখে পানির ছিটা পড়ায় চমকে উঠলাম। নিঠুল ভাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। শরীরের বেশিরভাগ অংশই ভিজে গেছে। চুল ঝেড়ে পানি ফেলেছে আমার মুখে। চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসলাম আমি। ছোট চাচার মেয়ে তিশা ‘ নিতু ভাই এসেছে, নিতু ভাই এসেছে ‘ বলে চিল্লাতে চিল্লাতে পেছন থেকে হঠাৎ ধাক্কা দেয় নিঠুল ভাইকে। নিঠুল ভাই আমার উপর পড়তে পড়তেও সোফার হাতলে ঠেস দিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। তিশার দিকে তাকালে সে খিলখিল করে হেসে উঠে। নিঠুল ভাই বললো, ” সবকটা ফাজিল। বাইরে গিয়ে দেখ কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি করছে একজন আরেকজনের গায়ে। খেয়াল রাখতে পারিস না বিচ্ছুগুলোকে। বড় বোন হয়েছিস কেন? শুধু ঘুম আর ঘুম না!
ভিজে গেছি দেখছিস না! একটা তোয়ালে আন জলদি। ”

আরমান ভাইয়া দেখে বললো, ” ভিজে কীরকম হয়েছিস! ছাতা ছিলো না?”

” ধূর! বলো না আর। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। আসার সময় ছাতা গাড়িতে রেখে নেমে পড়েছি। ” পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললো সে।

আরিফ ভাইয়া হেসে বললো, ” ভাবি কেমন আছে, ব্রো?”

নিঠুল ভাই আরমান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ” বলো ভাইয়া, ভাবি কেমন আছে? ”

আরমান ভাইয়া লাজুক হেসে চলে গেলো। বিয়ের কথা চলছে ভাইয়ার। পাত্রীও পছন্দ হয়ে গেছে। ইদের পর পরই বিয়ের সানাই বাজবে হয়তো।

” ধুর! ঐ ভাবি না। তোমার বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি।”

” কেন রে? অন্যের বলয় খবর নিতে এতো ভালো লাগে! ঝটপট গিয়ে একসেট কাপড় নিয়ে আয়।”

আরিফ ভাইয়া কীসব বলতে বলতে কাপড় আনতে গেলো। বড় চাচী নিঠুল ভাইকে এই অবস্থায় দেখে হায় হায় করছে। জ্বর আসা ঠেকাতে ঔষধও খাইয়ে দিয়েছে। তাও জ্বর ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ উনিশ-বিশ হলেই ভুগতে হয় তাকে। নিঠুল ভাই আমাকে ডেকে বললো এক কাপ কড়া লিকারে চা বানিয়ে দিতে। রান্নাঘরে সবাই ব্যস্ত আছে দেখে আমিই বানালাম। মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই ওয়াক করে ফেলে দিলো। চোখ মুখ কুঁচকে বিশ্রী চেহারা বানিয়ে বললো, ” কী এনেছিস এটা!”

” খাওয়া যাচ্ছে না? আম্মুরা ব্যস্ত তাই আমি বানিয়েছি।” কাঁচুমাচু হয়ে বললাম আমি।

” বলা লাগবে না। দেখেই বুঝেছি এটা কে বানাতে পারে।” কাপটা টেবিলে রেখে বললো।

” নিঠু, তোকে তো আজকাল দেখাই যায় না। এই ঝড়ের দিনে তোকে দেখতে পাবো ভাবিনি।” আব্বু বললো।

“দেখা যাবে কীভাবে! চুটিয়ে প্রেম করছে। অন্যদিকে মন, ধ্যান দেওয়ার সময় আছে নাকি!” মনে মনে বললাম আমি।

নিঠুল ভাই বললো, ” গ্রামে গিয়েছিলাম চাচু। বড় আব্বু অসুস্থ তাই। ”
দুজনে মেতে উঠলেন গল্পে। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম রেবা আন্টি অনেকবার কল দিয়েছে আমার মোবাইলে। রিসিভ করলে জানলাম নিঠুল ভাই ফোন ধরছে না। তারা ছাদে ছিল তাই রুবাকে দিয়ে পাঠালাম মোবাইল। অনেকক্ষণ পর রুবাকে বললাম মোবাইলটা আনতে। সে একদৌড়ে গিয়ে একদৌড়ে এসে বললো নিঠুল ভাই আমাকে যেতে বলেছে। মোবাইল তাকে দিচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মোবাইলের লক খোলা ছিল। মেসেজ চেক করেছে নাকি! আমি গিয়ে মোবাইলটা যখন চাইলাম সে রাগী চোখে তাকালো। মোবাইলটা দেখিয়ে বললো, ” তোর বন্ধু প্রয়োজন না মনের কথা বলার জন্য! জয়কে বন্ধু বানিয়ে ফেললি! সে তোকে প্রপোজ করেছে তারপরও দিব্যি চ্যাট চালিয়ে যাচ্ছিস। ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নেওয়া দেওয়া করছিস। ”

” তো কী হয়েছে? নিজে তো প্রেম করে বেড়াও আর আমি করলেই দোষ! আমি ভেবে রেখেছি কালকেই জয় ভাইয়ার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো। ”

” ভালোবাসিস একজনকে আর প্রেম করবি অন্যজনের সাথে? ”

কেঁদে উঠলাম আমি। বললাম, ” কে বলেছে তোমায় ভালোবাসি! একদম না। এসব আজগুবি কথা কই পাও? ”

নিঠুল ভাই হেসে বললো, ” আমি তো বলি নি আমাকে ভালোবাসিস। তুই নিজেই বললি মাত্র। ”

” আমি বলি নি। ”

নিঠুল ভাই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ” আমি জানি আমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ”

আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে বললাম, ” সব জেনেও কষ্ট দাও তুমি। আর সেটা করেই মজা পাও। আমার সামনে আসবে না কোনোদিন। তোমার সুইটির সাথে থাকো।”

” তোকে কে বললো সুইটিকে ভালোবাসি! আমি নিজ মুখে একবারও বলেছি?”

উত্তর দিলাম না। তাকে কাছে পেয়ে কান্না ভেঙে আসছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে কতোটা ভালোবাসি তাকে, কতোটা কষ্ট পাচ্ছি তার জন্য।

” সুইটি আমার ফ্রেন্ড হয়। এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।”

নিঠুল ভাই আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। চুলে হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললো, “একটা কথা জেনে রাখ, আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকা মেয়েটাই আমার ভালোবাসার মানুষ। সে-ই আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে। তাকে আমার জীবনে ছাড়া অন্য কারো জীবনে ভাবতে পারি না একটুও। তাকে একনজর দেখার জন্য বারবার ছুটে আসি এখানে। এই যেমন আজকে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে এলাম! তার লেখাপড়ার জন্য তাকে কখনো বলি নি, বুঝতে দিই নি। কিন্তু আড়ালে ভালোবেসেছি ঠিকই। আজকে এই বৃষ্টির সন্ধ্যামুখর মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে বলছি ‘ আমার ভালোবাসার রোজ তুই’। ”

নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিঠুল ভাইয়ের হৃৎস্পন্দন। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে আমার। আবারও কান্না পাচ্ছে। শব্দ করেই কেঁদে দিলাম। নিঠুল ভাই বললো, ” তোর চোখের, নাকের পানিতে আমার বুক ভিজিয়ে দিচ্ছিস।ছিহ্! ছাড়, ছাড়।”

কানে নিলাম না তার কথা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আজকে আমি ভীষণ ভীষণ খুশি। খুশিতে মরে যাওয়ার মতো খুশি।
.
.

রুমে অস্থির হয়ে পায়চারী করছি। সন্ধ্যায় ঐ সময়ের পর পরই চলে গিয়েছিল নিঠুল ভাই। রাতে বড় চাচীর কাছ থেকে জানলাম জ্বর এসেছে নাকি তার। ফোন করবো কিনা ভাবছি। লজ্জা লাগছে ভীষণ। আর না ভেবে কল দিয়ে দিলাম। কয়েকবার দেওয়ার পরও রিসিভ হলো না। টেনশন হচ্ছে। অবস্থা খারাপ নয় তো! মিনিট পাঁচেক পর কল এলো। সাথে সাথেই রিসিভ করলাম। নিঠুল ভাই জিজ্ঞেস করলো, ” না ঘুমিয়ে কী করছিস এতো রাত পর্যন্ত?”

তার গলার স্বর কাঁপছে। আমি বললাম, ” ঘুম আসছে না। তোমার জ্বর তো বেশি মনে হয়। সাথে কেউ নেই? ”

” আম্মু ছিলো এতক্ষণ। কিচেনে গেল মাত্র। ”

” ওহ্ “, বলে আর কিছু বললাম না আমি। নিঠুল ভাই বললো,” আমার অনেক আফসোস হচ্ছে জানিস?”

” কেন?”

” তখন চুমু খায় নি বলে। সর্দি মাখানো মুখ হলেও একটা চুমু খাওয়া উচিত ছিলো।”

এপাশ থেকে আমি লজ্জা পেলাম, সাথে রাগও হলে। তখন সে আমার মুখ তুলেছিল চুমু খাবে বলে। পরে চুমু না খেয়ে বললো চোখের পানি, নাকের পানিতে আমার মুখ ভিজে একাকার। চুমু খাওয়ার অবস্থায় নেই। যদিও মজা করে বলেছিল তাও আমি রেগে তাকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম।

আবারও শুনতে পেলাম তার কণ্ঠ, ” এ মুহূর্তে তুই কাছে থাকলে ভালো হতো।তুই একটা চুমু দিলেই আমার জ্বর সারিয়ে যেতো।”

” জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বলছো তুমি। রাখো।” বলে ধমকে উঠলাম। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। মজা করলো নাকি জ্বরে মাথা খারাপ হলো সে-ই ভালো জানে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here