ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ৪৫+৪৬

0
1000

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪৫

মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি,‌ পুরো মাথা আমার ভার হয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২ টা বাজে। এতোক্ষণে আমার ঘুমের দেশে পারি দেবার কথা কিন্তু তা না করে মেঝেতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। মাথা ব্যাথার কারনে ঘুম ও আসছে না। সামনে তিনটি চায়ের কাপ পড়ে আছে। দেখতে দেখতে তিন কাপ চা খেয়ে ফেলেছি তবুও মাথা ব্যাথা কমছে না। বুঝলাম না মাথায় আজ কি ভর করল আমার।

আমি দু হাত দিয়ে চুল মুঠ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। হঠাৎ মুখের উপর কারো গরম নিঃশ্বাস পড়াই উঠে গেলাম। তাকিয়ে দেখি আহিয়ান আমার মুখের কাছে অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,

“কি হয়েছে?

“আমার কি হবে,‌ হয়েছে তো তোমার? এভাবে পাগলের মতো বসে আছো কেন। ভূতনি কি এবার পাগলের খাতায় নাম লেখাবে।

উনার কথায় রেগে আশপাশ তাকাতে লাগলাম। চায়ের কাপ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছিল না। উনি হেসে বলে উঠে,

“ভেবো না চায়ের কাপ ছুড়ে মারবে, তাহলে চায়ের কাপ ভাঙার আওয়াজে মা আর বাবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

“?

“এমন করছো কেন?

“মাথা ব্যাথা করছো।

“এক, দুই ,তিন! তিন তিন কাপ চা খাওয়ার পরও মাথা ব্যাথা কমছে না।

“নাহ!

“তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।

“আসছে না।

“আসবে কিভাবে? এতো চা খেলে কার ঘুম আসবে।

“এই সরুন তো, মাথা ব্যাথায় কথা বলতেও মন চাইছে না আর আপনি এলেন ঝগড়া করতে।

উনি আমার চুলে হাত দিয়ে একবার উঠিয়ে আবার নামিয়ে দিয়ে বলেন,

“তেল দিয়েছ চুলে, মাথা ব্যাথা কি করে কমবে।

“আমার এখন মন চাইছে না কিছু করতে।

“আরো নাচো!

“এই ঝগড়া করবেন না তো। এটা তো বলবেন, “দাও আমি দিয়ে দিচ্ছি তোমার মাথায় তেল, মাথা ব্যাথা কমে যাবে।” আবার আসছে ঝগড়া করতে।

“তোমার সেবা করবো আমি, অ্যাহ!

“জানি জানি করবেন না। যান তো এখান থেকে। এভাবে ছিলাম তবুও মাথা ব্যাথা একটু কমছিল।

বলেই আবারো সেভাবেই শুয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার মাথায় কিছু ফেলেছে। আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখি তেল! অতঃপর আয়ানার দিকে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান। যেহেতু ডেসিন টেবিলের সামনে বসা ছিলাম তাই আয়ানায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তবুও বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাথা তাকিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি উনি খাটে বসে আমার মাথায় তেল দিচ্ছেন।

উনি আমার মাথা ধরে নিচু করে বলেন,

“চুপচাপ বসে থাকো, মাথা তুলছো কেন?

“আপনি পারেন তেল দিতে।

“হ্যাঁ পারি তো, তেলের ব্যবসা করতাম নাহ!

“আরে চেতছেন কেন?

“আজাইরা বকবক বন্ধ করো তো! চুপ থাকো, নাহলে তোমার বকবকে আমার মাথা ধরে যাবে।

অতঃপর আমি চুপচাপ বসে আছি। উনি আদৌ আমার মাথায় তেল দিচ্ছেন না কি করছেন জানি না। পুরো চুল এলোমেলো করছেন। নিজের সর্বনাশ বসে বসে আয়ানায় বেশ দেখতে পারছি। কপাল বেয়ে তেল পড়ছে আমার ঘরে। ভাগ্যিস তেলের ব্যবসা করেন নি নাহলে আমাকে তেলের মধ্যেই চুবিয়ে দিতেন।

অতঃপর উনি আমার কপালে হাত রেখে কিভাবে জানি মালিশ করতে লাগলেন। মজার ব্যাপার ছিল আমার মাথা ব্যাথা কমতে লাগলো তার সাথে ঘুম ঘুম ও পেতে লাগল। অতঃপর ঘুমের বারোটা বাজল তখন যখন উনি চুল আঁচড়াতে লাগলেন। এতো তেল দেবার কারনে জট যা পেকেছিল তা আপনা আপনি খুলে যেতে লাগল কিন্তু উনার আচড়ানোর ধরন ঠিক ছিল না।

তাও কোনমতে আচড়ালেন। অতঃপর চুল বেনুনি করতে লাগলেন কিন্তু মাথা মুন্ডু কিছুই হচ্ছে না। তবুও উনি চেষ্টা করছেন দেখতে বেশ ভালো লাগছে। আমি আয়নায় তাকিয়ে উনাকে দেখছি। বেশ টেনশনে তিনি। উনাকে দেখেই যাচ্ছি এর মাঝে উনি আয়নায় তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি?

“পারলেন করতে!

“ধ্যাত কিছুই হচ্ছে না।

আমি হাত দিয়ে দেখি একটু হয়েছে একটু হয় নি। অতঃপর আমি একটু ঘুরে বসে আয়নার সাইডে আসি। উনি এবার বেনুনি করছেন আর আমি আয়নায় তাকিয়ে উনাকে বলছি। অনেকটা হয়েছে যা বলা যায় বেনুনির মান সম্মান রক্ষা পেয়েছে।

বেনুনি শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। আহা বেচারা বেনি করতে করতে বেশ ক্লান্ত। আমি উনার দিকে ঘুরে বলি,

“এতো ভালো বেনুনি শিখলেন কার থেকে।

“ছোট বেলায় আম্মুর চুল নিয়ে এভাবে খেলাতাম। কে জানতো বেনি করা এতো ঝামেলার।

“চুলে তেল এভাবেই দিতাম।

“কেন দেওয়া হয় নি।

“হয়েছে তবে মনে হয়েছিল আপনি রীতিমতো যুদ্ধ করছেন।

বলতে বলতেই আমি খিলখিলিয়ে হেসে ফেললাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বলেন,

“ভূতনি হাসি থামিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আসো। তোমার মাথা ব্যাথা কমাতে গিয়ে আমার মাথা ধরে গেছে!

“কে বলেছিল করতে শুনি, এসেছে নিজেই এসেছেন আবার নিজেই কথা শুনাচ্ছেন।

“তোমার হেল্প করেছি, কৃতজ্ঞতা তো জানাতেই পারো

“হ্যাঁ তা ঠিক!

বলেই আমি উঠে দরজার কাছে গেলাম। উনি আমাকে আবারো খাটালেন। নিচে এসে পানি গরম করতে চুলোয় পানি বসিয়েছি। পুরো ঘর অন্ধকার, বাড়ির সবাই ঘুমে কাতর। প্রথমবার চা বানানোর সময় সার্ভেন্ট জেগে উঠে এসেছিল। আমি তাদের বলেছি চলে যেতে। এখন আওয়াজ শুনলেও আর আসবে না। কারো আসার শব্দ শুনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি উনি নিচে নামছেন। উনি এসেই চুলোয় পাশে খালি জায়গাতে বসে পড়েন। আমি তখন সবে পানিতে চায়ের পাতা দিয়েছি। উনি বলে উঠেন,

“বিস্কিটের বয়াম টা দাও তো!

আমি বিস্কিটের বয়াম টা দিলাম। উনি বয়াম থেকে বিস্কিট মুখে দিলেন। চা ততোক্ষণে হয়ে গেছে। এর মাঝেই হঠাৎ করে উনি বলে উঠেন,

“জানো তুমি আসলেই ভূতনি, আজ আমি সেটার প্রমাণ পেয়েছে।

আমি উনার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি বিস্কিট মুখে দিয়ে বলেন,

“ভূতের মতো তোমার চুল ও অনেক বড়। ছোটবেলায় শুনেছিলাম ভূতের চুল নাকি অনেক লম্বা হয়। তোমার ও সেরকম!

আমি উনার দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে চায়ের কাপ টা উনার হাতে দিয়ে চলে এলাম। উনি “ভূতনি” বলে কয়েকবার ডাকলেন। আমি কোন পাত্তা দিলাম না। সোজা এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মাথা ব্যাথা এখন নেই বললেই চলে বিধায় ঘুম ভালো হবে। বলতে বলতে বিছানায় না শুতে শুতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম!
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি বিছানায় নেই। কি ব্যাপার গেলো কোথায়? আমি চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে উঠি। দেখি বিছানার পাশে ল্যাম্বশ্যাডের পাশে একটা চিরকুট! তাতে লেখা ছিল,

“ভূতনি! কি ঘুমটাই দিচ্ছ তুমি, যাক তুমি ঘুমাও আমি জগিং করতে গেলাম। তোমার জন্য গুড নাইট!

আমি ঘুমের চোখেই হেসে হেসে সেটা বইয়ের মাঝে রাখলাম। অতঃপর ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম!
শাওয়ার নিয়ে এসে দেখি উনি এখনো ফিরে নি। বিপদে পড়ে আজ চুল গুলো শ্যাম্পু দিতে হয়েছে। আমার বালিশে পুরো তেলে চ্যাটচ্যাটে অবস্থা! মাথা মুছতে মুছতে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। উনি বাসায় আসছেন, দেখা যাচ্ছে উনাকে!

ভার্সিটিতে আজ ইতিকে বেশ ব্লাশ করতে দেখলাম। বাহ একদিনেই এতোদূর! ভেবে উঠতে পারছি না। তার থেকে শুনলাম কয়েকদিন পরেই আকাশ ভাইয়া তার মা আর বাবা কে ইতির বাড়িতে পাঠাবেন বিয়ের প্রস্তাব দেবার জন্য। যাহ ভালোই হবে একটা বিয়ের দাওয়াত পাওয়া যাবে।

ক্লাস শেষ হবার পর একাই এলাম সেই রুমে, যেখানে সিফাত আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে। কিন্তু সে এখান থেকে পালালো কি ভাবে? আমি পুরো ক্লাস আজ আবারো ঘুরতে লাগলাম। ক্লাসের বাইরেও গেলাম। এই ক্লাসের পরেই ছিল বাথরুমের সাইড! বাথরুম! এই এমনও তো হতে সিফাত আমার পিছনে আসতে আসতে আহিয়ান আর আমাকে দেখে ফেলেছিল আর তখন’ই বাথরুমের দিকে চলে গেছিল। আর আমি আর আহিয়ান যখন কথা কাটাকাটি করছিলাম তখন সুযোগ বুঝে সে পালিয়ে গেছিল। ইশ খুব সহজ ছিল এটা। আমি তখন’ই বাথরুমের দিকে এলে ঘটনাটা বুঝতে পারতাম। এই সিফাত নিশ্চিত আমার আর আহিয়ানের কথা শুনেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল আহিয়ান আমাকে বিশ্বাস করছে না আর তাই সে এখনো এতো সহজ স্বাভাবিক আমাদের সাথেই আছে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসতে লাগলাম। এতোদিনের রহস্য উদঘাটন করলাম। তখন শুধু আমার বোকামি আর ভিতুর কারনে মাথা কাজ করছিল না। তবে আজ বেশ কাজ করছে। আমি আবারো সেই রুমে এসে পুরো রুম দেখতে লাগলাম। পেছনে ঘুরতেই আবারো ভয় পেয়ে গেলাম। থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। আমার সামনে সিফাত দাঁড়ানো।

নিজেকে স্বাভাবিক করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
“তুমি এখানে?

সিফাত হেসে বলে,
“আসলে ভাবী আপনাকে দেখলাম একা একা এখানে আসতে তাই চলে এলাম।

আমি হেসে বলি,
“একা দেখেই আসতে পেরেছ সেটা আমি জানি।

“কিসব বলছেন ভাবী।

“কিছু না, সরে দাঁড়াও যেতে দাও।

“আচ্ছা যান।

বলেই সিফাত সরে দাঁড়াল। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে দরজার কাছে যেতেই সিফাত বলে উঠে,

“একটা কথা অনেক জানার ইচ্ছা ছিল ভাবী।

“কি কথা?

“এই যে কিভাবে আপনি আহিয়ান ভাইয়া কে বশ করে বিয়ে করে ফেললেন।

“তুমি এখনো আগের সেই সিফাত’ই আছো, যে কি না আমাকে এখানে একা এনে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছিলে কিন্তু তা না করতে পেরে পালিয়ে গেলে। চলে গেলে বাথরুমের দিকে। আহিয়ান আর আমার কথা কাটাকাটির মাঝে এখান দিয়ে চলে গেলে আর আড়িপাতা তোমার পুরনো অভ্যাস ঠিক বললাম তো।

“দূর থেকে দেখেই এতো কিছু বুঝে ফেললেন।

“মানুষের আচরণে তার পরিচয়, আর তোমার আচরণ আমি কখনো ভুলতে পারবো না।

“আহ ভুলবেন কেন, আমি তো চাই আপনি মনে রাখুন। আসলে কি বলুন তো আপনিই সেই প্রথম আর একমাত্র মেয়ে যাকে কিনা আমি নিজের করতে পারলাম না।

আমি সহজ ভাবেই বলি,
“ভাবতেও অবাক লাগে, ভাবী বলে সম্বোধন করছো আর আমাকে কামনাও করছো। যাই হোক এখন আর সেটা সম্ভব না, সেই আশা বাদ দাও!

বলেই আমি চলে যেতে নিলাম। তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সিফাত বলে উঠে,
“ভাগ্যে কখন কি হয় কিভাবে বলা যায় ভাবী। ভালোবাসা আর কতদিন ভালোবাসা থাকবে বলো, ছেড়ে দেবে না এর গ্যারান্টি কি! তবে হ্যাঁ সেখান দিয়ে তোমার যাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল এখানে এসো। রাস্তা আমি আজীবন খোলাই রাখবো তোমার জন্য!

“সিফাত! কি বলোতো,‌ মানুষ বেঁচে থাকে তার ইচ্ছা’র কারনে, শখের কারনে! তার জীবনে যদি শখ,‌ ইচ্ছা,আশা এসব না থাকতো তাহলে তার জীবন মূল্যহীন ! ভালোই তো তুমি আশা করছো, এই আশা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু সে আশা পূরণ হবার নয় এটা মনে রেখো।

বলেই চলে এলাম। এমন একটা নিকৃষ্ট মানুষের সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। সে কখনো শোধবার নয়। যেভাবেই হোক আহিয়ান কে সিফাতের এই রূপ দেখাতেই হবে। আমি আহিয়ান কে বললেই হবে না তাকে প্রমাণ ও দিতে হবে। কথায় আর কতোটুকু বিশ্বাস হবে।‌আর সেই বিশ্বাস ও ক্ষণস্থায়ী!

আমার শরীর বার বার শিউরে উঠছে। কিছু একটা বার বার আমাকে জ্বালাতন করছে। খুব ছটফট করছি আমি। উনি এই ড্রাইব করছেন এই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একবার জিজ্ঞেস করছে “কি হয়েছে”?
আমি বলি,
“কিছু না।

“তাহলে এমন করছো কেন?

“শীত লাগছে!

“কিন্তু এসি তো বন্ধ! আচ্ছা পানি খাবে।

“না!

বলেই চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পরি।
.
সন্ধ্যায় টেবিলে পড়তে বসে ঠিক মতো পড়তেও পাড়লাম না। চোখ সব ঘোলা হয়ে আসছিল। মাথা ঘুরতে লাগলাম। কেমন এক অস্থিরতা। তবুও গালে হাত দিয়ে টেবিলে বসে রইলাম!
রাতে সবার সাথে ডিনার করতে গিয়েও বেশি কিছু খেলাম না। অল্প খেয়েই উঠে গেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন,

“নিহা ঠিক আছো তো তুমি!

“জ্বি মা! খুব ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো আমি।

“আচ্ছা যাও!

অতঃপর আমি ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মাঝেই কি সব আজেবাজে কতো গুলো স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। অতঃপর আবারো সেই ভয়ানক স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নটা আজ আরো ভয়ানক। অন্ধকার থেকে হাত গুলো এসে আজ আমার গলা চেপে। আমি স্বপ্নের মাঝেই ঘামছি। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আমার। আমি দ্রুত ঘুম থেকে উঠে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি এখনো ঘামছি। পুরো রুম অন্ধকার! ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছি‌। পানি তৃষ্ণা পেয়েছে খুব। আমি অন্ধকারের মাঝেই পাশেই ল্যাম্পশ্যাডের কাছ থেকে পানির গ্লাস টা নিতে যাই কিন্তু ভয়ের কারনে সব গন্ডগোল পেকে যায়। গ্লাস টা পড়ে যায় আমার হাত থেকে। ভয়ে লাফিয়ে উঠি আমি। কাচুমাচু হয়ে বসে থাকি।

গ্লাস পড়ার আওয়াজে উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি আলো জ্বালিয়ে দ্রুত আমার কাছে এলেন। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি কাছে এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন,

“নিহা! নিহা তুমি ঠিক আছো।

আমি কোন কথা না বলে জরিয়ে ধরলাম উনাকে। আমার এমন কাজে উনি অবাক হলেন আবার এটাও বুঝতে পারলেন আমি ভয় পেয়ে আছি। আমার পুরো শরীর কাঁপছে! উনি আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন,

“দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে।

“হু!

“আচ্ছা শান্ত হও, এখানে আমি আছি!

আমি উনাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। অতঃপর আর কিছু মনে নেই আমার!

সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি। উনাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। কাল রাতের ঘটনা আমার মনে আছে। উনাকে জড়িয়ে ধরার পর সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো উনি আমাকে তখন বিছানায় রেখে দিলেন। কিন্তু এখন উনি কোথায়?

আমি উঠে বেলকনির কাছে যেতেই দেখি উনি বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। আজ অনেক দিন পর উনাকে সিগারেট খেতে দেখলাম।সচরাচর উনাকে সিগারেট খেতে দেখি না। তাহলে আজ কেন খাচ্ছেন।

আমি ফ্রেস হয়ে বাগানের দিকে গেলাম। আমাকে দেখে‌ বলেন,

“তুমি! ঘুয ভেঙেছে তোমার!

“হুম!

উনি সিগারেট ততক্ষণে সিগারেট খাওয়া শেষ করে তা ফেলে দিলেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বলি,

“আপনি এখনো এইসব খান।

“কেন? তুমি কি ভেবেছিলে?

“ভেবেছিলাম আপনি হয়তো এসব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু না আমি ভুল আপনি এখনো এসব খান। আর আমার থেকে লুকিয়ে খান।

“না লুকিয়ে কেন খাবো, কথা হলো যখন খাই তখন তুমি থাকো না। আর বাড়িতে আমি খুব কম খাই এসব। বাবা দেখলে আমি শেষ।

“তাহলে এসব খান কেন?

“এভাবেই!

আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ উনার চোখের দিকে চোখ পড়ল। উনার চোখে এখন খুব ঘুম। আচ্ছা উনি কি সারারাত ঘুমায় নি। তা করবে কেন? আমার জন্য! একথা জিজ্ঞেস করবো বলে ঠিক করলেও জিজ্ঞেস আর করা হলো না। এর আগেই উনি ফ্রেস হবো বলে রুমে চলে। আমি রয়ে গেলাম বাগানে।

বাগান টা ঘুরে দেখতে লাগলাম, শীত চলে গেছে বসন্ত এসে গেছে। আবারো জন্মাবে নতুন কিছু পাতা, নতুন কিছু উদ্ভিদ। প্রকৃতি উন্মেচিত হবে আবার নতুন রঙে। বসন্ত তার রঙে রাঙিয়ে তুলবে সবকিছু! কতোই না মনোমুগ্ধকর হবে সেই দৃশ্য। হায় কি ভাগ্য আমার নিজের চোখে দেখতে পারবো সেই সৌন্দর্য আমি!

#চলবে….
#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪৬

পহেলা ফাল্গুন আজ! এই উপলক্ষে ভার্সিটিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মেয়েদের দলে দলে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আলাদা আলাদা দল আলাদা আলাদা রঙের শাড়ি পড়বে। ছেলেদের ও তাই! আমাদের দলে কয়েকটা মেয়ে ছিল যাদের বাসন্তি রঙের শাড়ি পড়ে আসতে বলা হয়েছে। নিতি’রা মনে হয় হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে আসবে। উনাকে বলা হয়েছে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়তে। তার সাথে আকাশ, নাহান আর আনাফ ভাইয়াও সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়বে।

সকাল সকাল আমি উঠে গোসল করে বাসন্তি রঙের শাড়িটা পড়ে নিলাম। অতঃপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়তে লাগলাম। উনার দেখা নেই, সেই যে জগিং করতে গেছেন এখনো আসেন নি।
আমি নিচে নেমে রান্না ঘরে এসে ঢুকলাম। মা, বাবা সবার জন্য নিজের হাতে চা বানালাম। প্রতিদিন’ই চা আমিই বানাই। বাবা ইদানিং আমার হাতের চা অনেক পছন্দ করেন। মা আর বাবা দুজনেই ডয়িং রুমে বসে আছে। আজকের বিষয় ইয়ান কে নিয়ে। তাকে আজ আনতে যাবে বাবা। তার কাঠবিড়ালী টা একদিন দুলাভাই এসে নিয়ে গেছিল। পিকু টাকেও বেশ মিস করছি আমি। ভালোই হবে ওরা দুজন আসলে পুরো বাড়ি জমজমাট থাকবে।

দেখতে দেখতে উনি চলে এলেন। আমি উনাকে দেখেও বসা থেকে উঠলাম না। জানি এখন উপরে গিয়ে প্রথমে গোসল করে তৈরি হবেন উনি। আজ আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি খানিকক্ষণ পর উঠে ব্রেকফাস্ট নিয়ে রুমের দিকে গেলাম । মা আর বাবা ব্রেকফাস্ট করতে এখনো অনেক দেরি।

আমি উনার জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসে দেখি উনি অলরেডি গোসল সেড়ে পাঞ্জাবি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ব্রেকফাস্ট বিছনায় রেখে বসে বসে উনার কান্ড দেখতে লাগলাম। পাক্কা আধ ঘন্টা লাগিয়ে তৈরি হলেন উনি। ততোক্ষণে আমি খেয়ে হজমও করে ফেলেছি। অতঃপর উনি আমার কাছে এসে বলেন,

“এভাবে নজর দিচ্ছো কেন?

“কোন মেয়ে সাজতেও এতোক্ষণ লাগায় না।

“হুহ আসছে, তোমার সাজতে এখন আমার চেয়েও বেশি সময় লাগবে এটা জানো তুমি!

“না লাগবে না। আপনি যতক্ষণে ব্রেকফাস্ট শেষ করবেন তার আগেই আমি তৈরি হয়ে এসে পড়বে।

উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকান। আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। উনি গিয়ে বিছানায় বসে খেতে শুরু করলেন। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল গুলো আঁচড়ে, উনার আনা কানের দুল আর চুড়ি গুলো পড়ে চোখে কাজল আকলাম। অতঃপর শেষবারের মতো শাড়ি টা ভালোভাবে দেখে ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে উনার সামনে দাঁড়িয়ে বলি,

“নিন আমি তৈরি!

উনি জুসের গ্লাস টা মুখে দিয়ে আমার দিকে তাকান। অতঃপর গ্লাস নামিয়ে আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আমি উনাকে বলে উঠি,

“মনে হচ্ছে আপনি আমাকে নজর লাগাচ্ছেন।

উনি মুখ ভেংচি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি উনার পিছু পিছু যেতে থাকি।
.
ভার্সিটিতে আজ পুরো জমজমাট ব্যাপার। চারদিক ফুল আর বেলুন দিয়ে সবকিছু সাজানো। আর যারা ভিতরে ঢুকছে সবাইকে একটা করে গোলাপ ফুল দেওয়া হচ্ছে। সেই হিসেবে আমাদের ও দেয়া হবে। কিন্তু ফুল দেবার সময় হুট করেই ভেতর থেকে নিতি দৌড়ে এলো। সে এসে আমাকে আর আহিয়ান কে ফুল দিল। ফুল নেবার সময় তার মুখে হাসি দেখতে পেলাম। তাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। শাড়িতে বেশ মানিয়েছে তাকে। তার মুখে সাজ, ঠোঁটে রং, চুল গুলো খোঁপা করে তাতে ফুল দেওয়া। এক কথায় অসাধারণ লাগছিল তাকে।

ভেতরে এসে দেখি উনি ম্যাম স্যারদের সাথে কথা বলছেন। স্টেজ এখনো ঠিক করা হচ্ছে। মানুষের আনাগোনা তেমন নেই। উনিও তাঁদের সাথে কাজে জরিয়ে গেছেন। আমি চেয়ার পেতে একপাশে বসে সবার কাজকর্ম দেখছি। নিতি আর উনি দূরে একসাথে দাঁড়ানো। নিতির হাতে একটা কাগজ এটা দেখাতেই আহিয়ান কে ডেকেছে সে। কিন্তু নিতির দুই বান্ধবীকে এখনো দেখছি না। একটু খোঁজাখোঁজি করতেই দেখা গেল দুজনেই এক কোনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর হাসছে। টিনা আর আনিকাকেও শাড়িতে বেশ মানিয়েছে। তবে একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগলা। তাদের দু’জনের শাড়ির ফাঁক দিয়ে কোমর দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ আপত্তিকর!

নিতির দিকে তাকিয়ে দেখি তার ও কোমর দেখা যাচ্ছে কিন্তু তা শাড়ির মাঝে আড়াল হয়ে আছে। টিনা আর আনিকার শাড়িল আঁচল উঠানো বলেই কোমর দেখা যাচ্ছে! একবার ভাবলাম তাদের গিয়ে কথাটা বলবো, পরক্ষনেই ভাবলাম বলে কি লাভ। তারা স্টাইল বেশ পছন্দ করে আমি কিছু বললেই বলবে, এটা স্টাইল! এসব বলে লাভ কি!

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নাহান আর আনাফ ভাইয়াও এলেন। তাদের সাথে এলো সিফাত বজ্জাত টাও। তার কিছুক্ষণ পর এলো আকাশ আর ইতি! দু’জনকে একসাথে বেশ মানাচ্ছে। ইতির হাতে একটা গোলাপ ফুল। সে সেটা বার বার দেখছে আর হাসছে। শাড়িতে তাকেও বেশ সুন্দর লাগছে!

ইতি এসেই আমার পাশে বসল আর আকাশ ভাইয়া গেল আহিয়ানের কাছে। ইতি কে কেমন লাজুক লাজুক লাগছিল আমার কাছে। কি হয়েছে এই মেয়েটার আজ। আমি ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। গোলাপটাকে বেশ যত্নে রাখছে সে। আমি ওর হাত থেকে গোলাপ টা নিতেই সে উঠে আমার হাত থেকে ফুলটা কেড়ে নিলো। বোঝাই যাচ্ছে ফুলটা কে দিয়েছে যার কারনে তার এতো অস্থিরতা। আমি মুচকি মুচকি হেসে বলি,

“বাহ এতো ভালোবাসা! এখন’ই পর করে দিচ্ছিস আমায়।

“কি বলিস এসব, তুই তো আমার সব। তোকে কিভাবে পর করি বল।

“দে ফুলটা তাহলে দে।

“না মানে অন্য ফুল দেই এটা নিস না।

“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার।

ইতি লজ্জায় বসে থাকতে না পারে উঠে গেলো। আমি সেখানেই বসেই হাসতে লাগলাম। আমাকে হাসতে দেখে আহিয়ান আমার কাছে এসে বলে উঠে,

“কি হয়েছে? এতো হাসছো কেন?

“আরে কি হয় নি সেটা জিজ্ঞেস করেন। ইতি কে যা জ্বালালাম না, বলার মতো না!

“মেয়েটার পিছনে লেগে থাকা ছাড়া আর কি কাজ আছে তোমার বলো তো।

“আমার পিছনে লাগা!

বলেই সেখান থেকে চলে এলাম। বেশ মজা পাচ্ছি দুজনকেই জ্বালিয়ে। পেছনে ফিরে দেখি উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
.
আমি আশপাশ শুধু ঘুরছি, কি করবো বুঝতেই পারছি না। ইতি আকাশ ভাইয়ার সাথে,‌এখন‌ মনে হচ্ছে ভুল করেছি। আকাশ ভাইয়া আর ইতিকে এক করা ঠিক হয় নি। এখন আমার কোন দাম নেই। কেউ নেই আমার সাথে।
শীত যেতে না যেতেই গরমে ঘেমে একাকার আমি। এর মাঝেই মনে হচ্ছে চুল গুলো বেশ জ্বালাতন করছে। কোন দিক না পেয়ে চুল গুলো খোঁপা করে বসে রইলাম।

খালি একটা ক্লাসরুমে বসে ফোন টিপতে লাগলাম। কিছুই নেই ফোনে। একবার ভাবলাম মা’র সাথে কথা বলব। পরক্ষণেই মনে পড়ল এখানে এতো আওয়াজের মাঝে ঠিক মতো কথা বলতে পারবো না।

কি মনে করে ফোনের ক্যামেরা অপশনে ক্লিক করলাম। ফোনের স্ক্রিনে আহিয়ান কে দেখা যাচ্ছে। উনি দূরে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছে। কি জানি বুঝাচ্ছে তাকে। আমি তখনকার সেই ছবি তুলে রাখলাম। পরপর অনেকগুলো ছবি তুললাম। অতঃপর সেই ছবি আবার দেখতে লাগলাম। ৫ টা ছবির মাঝে ৪ টা ছবিই ঠিক হয় নি। একটা সুন্দর হয়েছে। আমি কি মনে করে আবারো ছবি তুলতে চাইলাম। তখন’ই দেখলাম উনার পাঞ্জাবি আমার অনেক কাছে। এটা দেখেই আমি সামনে তাকালাম। অতঃপর দেখি উনি আমার সামনে দাঁড়ানো। তাকে দেখেই আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ফোনটা রাখতে গিয়ে সেটা পড়ে গেল। বুঝতে পারছি না আমি ভয় কেন পাচ্ছি।

ফোনটা কোনমতে উঠিয়ে হাতে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছে‌। মস্তিস্ক একটা কথাই বলছে কোনভাবে যেন উনি ছবি গুলো না দেখেন।
উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কিছু স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করি,

“কি হয়েছে?

উনি হাত বাড়ালেন। কি হলো ফোন টা নিয়ে নেবেন নাকি। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি। অতঃপর বোধ হলো উনি আমার চুলের খোঁপা খুলে দিলেন। আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার অন্যহাত দিয়ে আমার কানে চুল গুলো গুঁজে দিলেন। তার সাথে মনে হলো আরো কিছু একটা গুঁজে দিলেন। এবার উনি আমার গাল টেনে হেসে বলেন,

“এখন মনে হচ্ছে সুন্দরী ভূতনি!

“কি বললেন?

উনি কিছু বলতে চাইলেন এর মাঝেই উনার ডাক পড়লেন। উনি কিছু না বলেই চলে গেলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে কানে হাত দিয়ে বুঝি কানে কোন ফুল গুঁজে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কি?
ফোনের ক্যামারা নিজের দিকে করে তাকিয়ে দেখি আমার কানে কাঠগোলাপ! তার মানে উনি কাঠগোলাপ গুজে দিলেন আমার কানে। অজান্তে হেসে ফেললাম আমি। কিন্তু আবারো সেই ভূতনি। সুন্দরী বলেও সেই ভূতনি উনি বলেই দিলেন। এই ভূতনি পিছু ছাড়ছে না আমার।
.
ইতি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লাসরুমে এসে পড়ল। আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বলি,

“প্রেম করা শেষ!

“শুরুই বা হলো কোথায়?

“ওহ আচ্ছা তাহলে এতোক্ষণ কি করছিলি।

“কোথাও আর কি করলাম? দেখাই তো পেলাম না তাহার।

“রাখ তোর বিরহ!

“তোর কাছে এটাই মনে হলো। এই তোর কানে ফুল গুঁজে দিল কে?

“কেন?

“ভাইয়া!

“এছাড়া আর কে?

“বাহ কি ভালোবাসা!

“কচু! বলে গেছেন সুন্দরী ভূতনি!

আমার কথায় বেচারা ইতির মুখে হাসি দেখা গেল।‌ খিলখিলিয়ে হাসল ও। অতঃপর দুজনেই বের হলাম!

অনুষ্ঠান শুরু হলো। মানুষজনে চারদিক ভরপুর। অতিথিরাও এসে পড়েছে।‌ শিক্ষকগণ অল্প কিছু বক্তৃতা রাখলেন। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত! একে একে কবিতা, আবৃত্তি, নৃত্য হলো। উনাকে এতোক্ষণ কোথাও দেখছিলাম না। হঠাৎ ইতি আমাকে খোঁচা মেরে বলল উনি স্টেজের কাছে। তাকিয়ে দেখি শুধু উনি না উনার সাথে আকাশ, নাহান আর আনাফ ভাইয়াও। অ্যানাউসমেন্ট হলো আহিয়ান গান গাইবে! কিহ? উনি গান গাইবে। তখনই একপ্রকার হইচই শুরু হলো। পেছন থেকে ছেলেরা হাত তালি দিতে লাগলা। কিন্তু উনি গান গাইতে পারে আর এটা আমি জানতাম না! ইতি আমাকে খোঁচা মেরে বলে,

“আগে তো জানালি না ভাইয়া গান গাইবে

“আমি নিজেই তো জানতাম না উনি গান গাইতে পারে, আমাকে কি বলছিস!

আমার পাশেই নিতি বসা ছিল। সে বলে উঠে,

“কিহ তুমি জানো না আহি গান গাইতে পারে, কখনো শোনায় নি তোমায়।

“না!

“আহি সবার জন্য গান গায় না। শুধু বিশেষ কারো জন্যই গান গায়। আর তুমি বলছো তোমার জন্য গান গায় নি। তার মানে কি!

আমি কিছু না বলে সামনে তাকালাম। এখন গান গাইবে উনি। উনার পিছনে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উনার বন্ধুরা। উনি গাইতে শুরু করেন

“ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌর
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌর
আমরা আর পাব না, আর পাব না।

তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না,
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না।”…….

গান শুনে মনে হলো আসলেই উনার গানের গলা সুন্দর! খুব ভালো গান গাইতে পারেন উনি। কিন্তু আমাকে কখনো বললেন না কেন? গান শেষ হবার পর সবাই হাত তালি দিল। উনাকে স্টেজ থেকে নামতে দেখলাম কিন্তু কোথাও গেল আর দেখতে পেলাম না! এর মাঝেই ইতি উঠে গেল। আমি উঠবো কি উঠবো না ভাবছি। ইতির চেয়ারে এসে বসল আনিকা। সে বসেই আমার সাথে গল্প জুড়ে দিল। তাও অন্যরকম গল্প যাতে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তবুও ভদ্রতার খাতিরে ওর বক বক শুনে চলছি আমি।

অনেকক্ষণ পর এপাশে তাকিয়ে দেখি নিতি নেই! এই মেয়ে আবার কখন গেলো এখান থেকে। মনটা হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠল কিন্তু কেন? উনাকে খুঁজে চলছি কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। দূরেই নাহান আর আনাফ ভাইয়া কে দেখতে পেলাম। আনিকা রীতিমতো এখনো বক বক করছে। আমি এবার উঠে পরলাম। আর শুনতে চাইছি না বকবক!

নাহান ভাইয়া কে আহিয়ানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ক্লাসরুমের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। আমিও ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু অনুষ্ঠান তো বাইরে হচ্ছে উনি ক্লাসরুমে কি করছেন। আমি এক ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যেতেই কারো সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেলাম!

সামনে তাকিয়ে দেখি ইতি! এই মেয়েটা এখানে কেন? আর এতো দৌড়াদৌড়ি করার’ই বা কি আছে। উফ আমার হাতটার বারোটা বাজিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর’ই বের হতে দেখলাম আকাশ ভাইয়া কে। তিনি আমাকে দেখে খুব লজ্জায় পরে গেলেন। এদিকে ইতিও লজ্জায় মরি মরি! আমি সেদিকে নজর না দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

“আহিয়ান কে দেখেছেন!

“আহি তো এখানেই ছিল, বলেছিলাম এখানে পাহারা দিতে শালা চলে গেল!

“পাহারা দিতে…

কিছু বলার আগেই ইতি আমাকে টেনে সামনে চলতে লাগল। পেছনে তাকিয়ে দেখি আকাশ উধাও! ব্যাপারটা কি হলো! আমি ইতির হাত ছাড়িয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলি,

“কি হলো রে?

“ককি হবে!

“তোতলাতে কে বলেছে!

ইতি কোন জবাব দিচ্ছে না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় মাথা নিচু। লজ্জার’ই কিছু কাজ করেছে। আমি ওর থিতুনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলি,

“কি হয়েছে!

“হামমম..

“কি হাম হাম করছিস!

“ধ্যাত যা সর তো!

বলেই আবারো ধাক্কা মেরে চলে গেল। আজব তো! কি পেলো আমাকে ও। যখন তখন ধাক্কা মারছে। আমি ওর পিছু পিছু গিয়ে এক পর্যায়ে ওর দুটো হাত ধরে ফেলি। অতঃপর জিজ্ঞেস করি,

“কি হয়েছে, বল!

ইতি আমার কানের কাছে এসে কিছু বলে। আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,

“চুমু খেয়েছে!

ইতি একবার এদিক তাকায় একবার ওদিক। একদিনেই এই ছেলে মেয়ে গুলো কতোদূর এসে পড়েছে। আমি কপালে হাত দিয়ে বলি,

“হয়েছে রাখ তো নাটক! এখন চল আমার সাথে।

“কোথায় যাবো

“হবু জামাইয়ের কাছে একবার গিয়েছিস এখন নিশ্চিত তার কাছে যাবি না।

ইতি চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বলে উঠি,

“আহিয়ান কে খুঁজতে, কোথাও গেলো উনি!

বলতে বলতে একটা ক্লাসরুমে এসে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে কারো কথার আওয়াজ আসছে। এটা নিতির আওয়াজ বলে মনে হচ্ছে। আমি কান খাড়া করে শুনছি সে কিছু বলছে। হঠাৎ করেই তার মুখে আহি ডাকটা শুনলাম। রুমের দরজা ভিরানো ছিল। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে দরজা খুলে ভিতরে তাকালাম। আমার সাথে ইতিও। দুজনেই দেখলাম উনার দু গালে হাত রেখে খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে নিতি। আহিয়ান নিতির সেই দু হাত ধরে রেখেছে। আমাকে দেখে আহিয়ান কে মোটেও অবাক হতে দেখলাম না। কিন্তু নিতি কে অবাক হতে দেখলাম। তার সাথে সে চিন্তিত!

আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আমার সাথে ইতিও! ইতি আমার ঘাড়ে হাত রাখল। নিতি হাত দুটো সরিয়ে নিলে আহিয়ান সেখান থেকে চলে আমার কাছে এলো। আমার হাত ধরে বাইরে যেতে নিলে আমি নিতির দিকে তাকিয়ে বলি,

“আপনি যান আমি পরে আসছি!

উনি কোন কথা না বলে হাতটা ছেড়ে চলে গেলেন। আমি এগিয়ে নিতির কাছে গেলাম। ইতি রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here