#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪১
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে পাশে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখের ভুল মনে করে আমি বড় বড় করে চোখ উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আহিয়ান আমার গাল টেনে বলে,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
গালে হাত দিয়ে বলি,
“এটা আসলেই আপনি।
“না ভুত আছে তোমার সামনে।
“মারলেন কেন আমায়
“কি বড় অপবাদ, কখন মারলাম তোমায়!
আমি গাল হাত দিয়ে খাট থেকে নেমে বলি,
“দেখুন সকাল সকাল আপনার সাথে ঝগড়ার করার কোন ইচ্ছা নেই আমার। নাহলে সারাদিন এই ঝগড়ার মাঝেই কাটবে।
“তোমার সাথে ঝগড়া আমার এভাবেও লাগবে এর জন্য কোন দিন টিন ঠিক করতে হবে না।
“আপনি আজ ব্যায়াম করতে যান নি, বসে আছেন কেন এখনো।
“আমি বসে নেই, একটু পরেই যাবো। আজ তুমি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছ।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আসলেই আমি তাড়াতাড়ি উঠেছি। গতকাল তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারনেই আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছি।
মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছে সামনে তাকিয়ে দেখি উনি আয়ানার দিকে তাকিয়ে চুল আচড়াচ্ছেন।
“এতো সাজগোজের কি আছে, যাচ্ছেন তো ব্যায়াম করতে
“তোমার কেন জ্বলছে সেটাই বুঝতে পারছি না।
“আজব আমার কেন জ্বলবে।
“এই একটা কথা মনে পড়ল! ( অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে ) তোমার কেন জ্বলেরে বন্ধু তোমার কেন জ্বলে!
বলেই ফিক করে হেসে দিলেন। আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তোয়ালে ছুড়ে মারি। উনি হাসতে হাসতে চলে যান। আমি উঠে বেলকনির কাছে এসে দাঁড়ালাম। উনি বের হলেন। উনার সাথে আরো দুজন আছেন। একটা সবুজ রঙের হুডি আর কালো রঙের ট্রাউজার পরা তিনি। উনি দৌড়ে বাইরে চলে যাচ্ছেন। যতক্ষন উনাকে দেখা যায় ততোক্ষণ’ই দাঁড়িয়ে দেখলাম আমি উনাকে। অতঃপর কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে গেলেন উনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলাম বেলকনি থেকে।
“কৃষ্ণপক্ষ” উপন্যাস টা নিয়ে বসেছি এর সাথে এক কাপ চা, সময়টা মন্দ নয়। গল্প পড়তে শুরু করেছি, কয়েক পৃষ্ঠা পরার পর’ই উনার গলার আওয়াজ পেলাম। ভূতনি ভূতনি বলে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন উনি। বইটাও শান্তিতে পড়তে দিবেন না। আমি উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে উনি ঘরে এলেন। দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলি,
“চেঁচামেচি করছিলেন কেন?
“আহ চেঁচামেচি কোথাও করলাম তোমাকে ডাকলাম।
“ফাজলামি করছেন। এটাকে ডাক বলে, কাকে দেখেছেন এভাবে ডাকতে।
উনি উঁকি দিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে,
“বই পড়ছিলে নাহ! এজন্য’ই আমার ডাক শুনতে পাও নি। আমি প্রথমে খুব সুন্দর করে ডেকেছিলাম। কিন্তু তুমি সাড়া দাও নি তাই জোরে জোরে ডাকলাম।
পুরো মিথ্যে কথা। সকাল টাই শুরু করলো মিথ্যে দিয়ে। উনি মোটেও আমাকে ভালোভাবে ডাকেনি। তবুও আমি বলে উঠি,
“আচ্ছা তাই! বলুন কি বলে ডাকছিলেন।
“বউ বলে ডাকছিলাম!
“ঠিকমতো মিথ্যে বলতে শিখুন।
বলেই আবার পড়তে বসলাম। উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,
“কতোটুকু পড়লেন।
“অল্পই পড়েছি, ওই যে বিয়ের পর নিজ বাড়িতে এসে অরু মুহিবের জন্য যে চিঠি লিখে সেটা অবদি।
“এতোক্ষণে এতোটুকু!
“আপনি কি মনে করেন, আপনি যাবার পর বসে ছিলাম।
“না শাওয়ার নিয়েছ, তোমার চুল এখনো ভেজা।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো পড়তে বসলাম। উনি ফ্রেস হবার জন্য ওয়াশরুম এ যেতে নিবেন তখন’ই বলে উঠি,
“এই গল্পটার মাঝে আপনার আর আমার একটা সূক্ষ্ম মিল আছে কিন্তু!
“কেমন?
“এই যে তারা পালিয়ে বিয়ে করে!
“আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম।
“না! কিন্তু পরিবার কে না জানিয়ে করেছি তেমন..
“আর আছে?
“হ্যাঁ আরেকটা আছে, বাসর রাতের দিন মুহিব যেমন মরার মতো ঘুমায় আর অরু সারারাত জেগে থাকে এখানে আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে! আপনিও বিয়ের প্রথম রাতে ট্রেনে বসে ঘুমিয়েছিলেন আর আমি সারারাত জেগে ছিলাম।
“কিন্তু অরু তোমার মতো মুহিব কে রেখে চলে যায় নি, তুমি চলে গেছো এটা বললে না।
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি ফ্রেস হয়ে এসে হুট করেই আমার বই টা কেড়ে নিলেন,
“এটা কি হলো? আমার এখনো পড়া শেষ হয় নি।
“তুমি পড়ছো না, আমাদের মাঝে মিল খোঁজার চেষ্টা করছো। এসব বাদ দাও।
“এই না দিন তো, এটা শেষ করবো।
বই নিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মেরে,
“ইস! প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কি ইন্টারেস্ট! লাস্ট কবে পড়ার বই ধরেছিলে
“এক সপ্তাহ, না আট দিন, নয় দিন।
“ভূতনি একটা। বই শেষ কবে ধরেছে তাও মনে নেই।
“এতো বড় বড় কথা কেন বলছেন। আপনি শেষ কবে নিজের বই ধরেছিলেন।
“এক্সামের সময়, আমার খুব ভালো মনে আছে।
“আপনি বই দিবেন না।
“না, একটু পর ভার্সিটির জন্য বের হবে তখন আমি নিচে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। যাও এখন থেকেই সাজগোজ করো গিয়ে।
বলেই উনি বই নিয়ে চলে গেলেন। আমিও রেগে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম। উনি জানে আমি তেমন কোন সাজগোজ করি না তবুও এই কথা কেন বললেন। জ্বালানোর জন্য আর কি? হুট করেই শাড়ির আঁচল টান খেল। আমি পিছনে ফিরতে ফিরতে বলি,
“এখন তুই আবার কেন আটকালি!
অতঃপর সামনে তাকিয়ে চমকে উঠি। দেখি উনি দাঁড়ানো। বলে উঠি,
“আপনি!
“চলে যে যাচ্ছ একবারও জানতে চেয়েছিলে তখন কেন তোমাকে ডেকেছি।
“কেন?
“ডেকেছি চা আনার জন্য। ঘন লিকার করে আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসবে।
“আর কিছু জনাব।
“না এরপর ব্রেকফাস্ট করবো, যাও এবার।
“শাড়ির আঁচলটা ছাড়ুন, আচ্ছা কথাটা কি মুখে বলতে পারতেন না, শাড়ির আঁচল ধরে বলা লাগল।
“আমি তোমাকে ডাকলেই তো তোমার কাছে মনে হয় আমি চেঁচাচ্ছি তাই এখন থেকে এটাই করবো। শাড়ির আঁচল ধরে টানবো।
“বোকা বোকা বুদ্ধি যতসব!
বলেই চলে এলাম। একদম যুক্তি ছাড়া কথাবার্তা। আর এমনসব যুক্তি দেন যা কোন যুক্তির কাতারেই পড়ে না।
.
ভার্সিটিতে যাবার জন্য আমার নাকি লেট হবে, না তা হলো না তবে উল্টোটা ঠিক’ই হলো। গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছি অথচ উনার কোন খবর নেই। এতো সাজগোজ করা লাগে উনার এমনেই তো সুন্দর। কি এতো মাখেন উনি, উনার গায়ের রং লাল ফর্সা, তবে চোখ দুটি খুব সুন্দর আমার দেখতে বেশ ভালো লাগে। এছাড়া সবার মতোই দুটি হাত আর দুটি পা আছে। বিশেষত্ব কি উনার? কেন কোন মেয়ে উনার প্রেমে পড়বে। আচ্ছা ভাবা যাক, উনার চেহারা দেখে। হ্যাঁ সেটা দেখে যে কোন মেয়েই প্রেমে পড়বে তেমনি সুদর্শন তিনি। আর! আর কি? আচ্ছা কোন মেয়ে উনার কানের নিচে ঘাড়ের কাছে তিল টা দেখে কি প্রেমে পড়বে। জানি না!
উনার স্বভাব বড়’ই অদ্ভুত! যখন কথা বলে না তো বলেই না আর যখন বলে তখন থামতেই চায় না। কোন গুরুতর বিষয় ও উনার কাছে তুচ্ছ! আর তুচ্ছ বিষয় তো আরোই তুচ্ছ! কোন মেয়ে উনার এই স্বভাবের কারনে কি উনার প্রেমে পড়বে।
অপেক্ষা করতে করতে মহারাজের দেখা পেলাম। বেশ পরিপাটি হয়েই এসেছেন। তবে হ্যাঁ আজ তার চোখে সানগ্লাস আছে। উনার এই সানগ্লাস টা নজর কাড়লো আমার। কিন্তু ব্যাপার কি আজ এতো সাজগোজ কেন?
“তাকিয়ে’ই থাকবে না গাড়িতে গিয়ে বসবে।
আমি উঠে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়া আমি। শাড়ির কারুকাজ ও বেশ হালকা। সব সময়ের মতো আজও আমি। পার্থক্য শুধু এতো টুকু আজ আমার চোখে কাজল।
উনি গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি হুট করে বলি উঠি,
“আজ এতো সাজগোজ কেন করেছেন?
“সাজগোজ কোথায় করলাম!
“এই যে সানগ্লাস!
“এটা তো আমিও পড়তাম, কেন দেখো নি কখনো!
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। হ্যাঁ উনি আগেও এটা পড়েছেন। তবে আমার কাছে কেন উনাকে এতো অন্যরকম লাগছে। আমি চুপ হয়ে বসে রইলাম আর কথা বললাম না।
ভার্সিটির আজ একমাত্র আকর্ষণ মনে হচ্ছে শুধু আমি আর আহিয়ান। সবাই এমন ভাবে দেখছে আমাদের যেন এই প্রথম’ই সবাই দেখল। আহিয়ান এক হাতে আমার হাত ধরেছেন আর অন্য হাতে উনার ফোন। ফোনে কি জানি ঘাঁটাঘাঁটি করছে। আচ্ছা আমি তো উনার পিছনেই আছি। উঁকি দিলেই তো হয়। সেই ভাবা সেই কাজ পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে গেলাম আর উনি পিছনে ফিরলেন। আমি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলাম। কে জানে কিছু বুঝতে পেরেছি কি না। না বুঝলেই বেশি ভালো হবে।
যত সামনে যাচ্ছি ততোই আমার হার্টবিট বাড়ছে, কেন জানি না। আহিয়ান খুব শক্ত ভাবে আমার হাত ধরে আছে। অস্বস্তি লাগছে আমার। হঠাৎ সামনে যেতেই চোখে পড়ল আকাশ ভাইয়া, ইতি সবাই ওরা সেখানে! নিতি আর সিফাত কেও দেখা যাচ্ছে। তাদের সামনে গিয়েই থেমে গেল আহিয়ান। নিতি হেঁটে আসলো আমাদের কাছে। অতঃপর…
#চলবে….
#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪২
নিতি আমাদের দুজনের সামনেই দাঁড়ানো। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাকে। কি বলবে সে! হঠাৎ করেই নিতি ‘র ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেল। মুচকি হাসি! সে হেসে বলল,
“দুজন কে একসাথে খুব মানিয়েছে!
আহিয়ান হেসে বলল,
“কখন এলি!
“একটু আগেই! তোদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সরি বলবো বলে!
আমি অনেকটাই অবাক হলাম। নিতি সরি বলবে! তার মানে সবকিছু সে এতো সহজে মেনে নিয়েছে। এটা আদৌও কি সম্ভব। নিতি চোখ আমি অশ্রু দেখতে পারলাম। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নি। তার চোখেই ভাসমান। সে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি! ক্ষমা করবি না আমায়।
আহিয়ান আমার হাত ছেড়ে নিতি’র মাথায় হাত রেখে বলল,
“সেসব আমি কবেই ভুলে গেছি। তুইও ভুলে যা!
বলেই সামনের দিকে গেল। আমাকে চোখের ইশারায় আসতে বলল। তখন’ই নিতি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। এখন কি বলবে এই মেয়েটা। এটাই যে আমি তোমাকে সুখে থাকতে দেবো না। আহিয়ান কে কেড়ে নেব। ভালো থাকতে দেবো ইত্যাদি ইত্যাদি! বলা বাহুল্য নিতি এসব কিছুই বলল না। সে হেসে আমার গালে হাত রেখে বলল,
“সুন্দর লাগছে তোমাকে দেখতে!
“হুম!
“হুম সুন্দর লাগছে। তোমার কাছেও আমি ক্ষমা চাইছি আমার এতোদিনের অপরাধের জন্য। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা তোমার কি মনে হচ্ছে আমি তোমাকে মিথ্যে বলছি। না মিথ্যে না সত্যি বলছি, সত্যিই আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি তাই তোমাকে সরি বলছি।
“হুম আপু।
“আচ্ছা আসো!
বলেই সবার মাঝে নিয়ে গেল আমাকে। আমার পুরো মাথা হ্যাং হয়ে আছে নিতির কান্ড দেখে। সত্যি ‘ই কি সে তার কাজের জন্য লজ্জিত! সত্যি নয়তো কি? সে কি মিথ্যে বলবে আমায়। আর মিথ্যেই বা কেন বলবে!
এসবের মাঝে চোখ পড়ল সিফাতের উপর। সে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তখন’ই মনে পড়ল সেদিনের ঘটনা। আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি সেটা আমার হেলুসিশন ছিল না। এটা বাস্তব ছিল। আমাকে জানতেই হবে কি হয়েছিল।
এই প্রথমবার আহিয়ান সহ সবার সাথে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিলাম আমরা। অতঃপর ক্লাস শুরু হওয়ায় সবাই ক্লাসে চলে গেলাম। ক্লাস শেষে বাইরে এসে দেখি আহিয়ান এখনো আসে নি। আমি আর ইতি দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। ইতি আমাকে বলে উঠে,
“আচ্ছা নিহা! আহিয়ান আর তোর বিয়ের সম্পর্ক কেমন।
“কেমন মানে?
“কেমন মানে জানতে চাইছি কি করম! ভাইয়া অনেক ভালোবাসে না তোকে!
ইতি’র কথায় আমি হেসে বলি,
“কি বললি! কি বললি তুই ভালোবাসে!
“এতে হাসার কি হলো? ভালো কি বাসা যায় না নাকি।
“আরে ধ্যাত রাখ তো। উনি আমাকে ভালোবাসেন না আর ভালোবাসবেন কেন?
“ভালোবাসার জন্য কারনের প্রয়োজন হয় না।
“জানি না সেটা। তবে উনি আমাকে ভালোবাসেন না, তোকে আমি আগেও বলেছি এটা শুধুই উনি দায়িত্ব বোধ থেকে করেছে আর কিছু না। এসব ভালোবাসা টালোবাসা কিছু নেই আমাদের মাঝে।
“কিন্তু তখন তো তোরা আলাদা থাকতি। এ কয়দিন যে এক ছাদের নিচে একসাথে থাকলি তখনও কিছু..
“আরে কিছু হয় নি। হলে কি তোকে বলতাম না। তুই জানিস আজ সকালেও উনার সাথে আমার ধাপ ঝগড়া লেগেছে।
“দেখিস তোদের প্রেমের শুরু এই ঝগড়া দিয়েই হবে, নয়তো হয়েও গেছে।
আমি হাসি থামিয়ে ইতির দিকে তাকিয়ে রইলাম। অতঃপর চোখ সরিয়ে বলি,
“ভালোবাসা! এটা খুব অদ্ভুত জিনিস ইতি! সবাই সবাইকে ভালোবাসতে পারে না। এই নিতি কেই দেখ না। বেচারা এতো বছর নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেও উনাকে পেলো না।
“তোর সাথে কথা বলেই লাভ নেই। মাঝ খানে নিয়ে এলে নিতি কে। ধ্যাত!
অতঃপর এর মাঝেই আহিয়ান ওরা সবাই চলে এলো। ইতি সবাইকে বলে ট্রিট দেবে। এখন হঠাৎ এই ট্রিট এর কথা শুনে আমরা সবাই অবাক। কীসের ট্রিট আবার! অতঃপর ইতির ট্রিটের কারন জেনে আমি হাসতে হাসতে শেষ। গত কয়েকদিনে ৩ জন ছেলে এসেছে ওকে দেখতে। পাগলি ওদের থেকে ১৫০০০ টাকা উঠিয়ে এনেছে্। সেগুলো দিয়েই ট্রিট দেবে সবাইকে।
.
আহিয়ান আর আমি গাড়ি করে বাড়িতে ফিরছিলাম। আহিয়ান হঠাৎ করে বলে উঠে,
“ভূতনি শোন।
আমি শুনেও না শোনার ভান করে বাইরে তাকিয়ে আছি। উনি আবারো ডাক দিলেন। আমিও তবুও শুনলাম না। হঠাৎ করেই উনি আমার হাতে চিমটি কেটে বলে,
“এই ভূতনি বউ!
“কি শুরু করেছেন।
“ডাকছি তোমার শুনতে পাও নি।
“কখন ডাকলেন?
“কানে সমস্যা নাকি তোমার। এতোবার ডাকলাম শুনতে পাও নি।
“পেয়েছি! কিন্তু কাকে ডেকেছেন।
“মানে? তোমাকে ডেকেছি!
“কিন্তু আমার নাম কি ভূতনি নাকি যে আমি সাড়া দেবো। সুন্দর করে বলুন নিহা!
“ভূতনি বউ!
আমি চোখ ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি হেসে বলেন,
“ঝগড়া করো না তো! ইম্পর্ট্যান্টে কথা আছে তোমার সাথে।
“কি ইম্পর্ট্যান্টে কথা শুনি!
“আচ্ছা আকাশ কে তোমার কেমন লাগে, মানে সে মানুষ টা কেমন।
“আপনার চেয়ে ভালো এটাই যথেষ্ট।
“তোমাকে বলে নি আমাকে অপমান করো।
মুখ ভেংচি দিয়ে বলি,
“এটাই সত্যি।
“আচ্ছা রাখো। শোন তোমাকে কেন জিজ্ঞেস করেছি। জিজ্ঞেস করেছি এই কারনে যে আকাশ ইতি কে ভালোবাসে!
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি আহিয়ানের দিকে। আহিয়ান বলে উঠে,
“ভালোবাসার কথা শুনলেই তোমার মুখ এমন হয়ে যায় কেন? তোমাকে কিছু বলেছি নাকি।
“যা বলেছেন তা কম কি! আকাশ ভাইয়া আর ইতি!
“কেন মানাবে না বলছো।
“বেশ লাগবে। একজন পাগল আরেকজন সুস্থ মানুষ! জুটি জমবে।
“জমবে তো তখন যখন তুমি আমাকে এটা জানাবে ইতি কাকে ভালোবাসে।
“এটা তো আমি জানি না।
আহিয়ান গাড়ি সাথে সাথে ব্রেক করল। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি বললে তুমি! তুমি জানো না ইতি কাকে ভালোবাসে! তুমি না ওর ফ্রেন্ড।
“এটা কোন ধরনের কথা, আমি যখন ইতি কখনো বলি নি তো আমি কিভাবে জানবো।
“আচ্ছা ঠিক আছে জেনে নিবা।
বলেই গাড়ি স্টার্ট দিল! অতঃপর দুজনেই একসাথে বাসায় এসে পৌঁছালাম।
.
বিকালে আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছি নিতির কথা। কি জানি ব্যাপারটা কেমন হবে। সে কি সত্যি সবকিছু মেনে নিয়েছে নাকি এটা আবার নতুন কোন শুরু!
হঠাৎ করেই টেবিলে চোখ পড়ল। আমার গল্পের বইটা এখনো টেবিলে আছে। উনি আশেপাশে নেই। এ সময়টা হাত ছাড়া করা যাবে না। দ্রুত বই টা নিতে গেলাম তখন’ই পেছন থেকে শাড়ির আঁচল আটকে গেল। আমি ভাবলাম উনি। বইটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে ঘুরে বলি,
“প্লিজ বই টা পড়তে দিন, আর অল্প’ই আছে শেষ হয়ে যাবে।
অতঃপর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ওপাশ থেকে কোন জবাব পেলাম না। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি উনি আমার সামনে নেই। শাড়ির আঁচলটা অন্য কিছুতে আটকে গেছে। এটা দেখেই আমি খুশিতে আত্নহারা। কিছুক্ষণ নাচতে ইচ্ছে করল। বইটা হাতে পেয়ে গেছি! উয়াহু! একটু নেচে সামনে তাকাতেই আমার চক্ষু ছানাবড়া। উনি সামনে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি উনাকে দেখেই বইটা পিছনে লুকিয়ে ফেলি। উনি মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে আমার সামনে আসে।
আমি পিছনে যাচ্ছি আর বলছি,
“শুনুন না।
“বেশ নাচছিলে তো, ভালোই নাচ পারো দেখছি।
“দেখুন বই টা আমাকে শেষ করতে দিন।
“তোমাকে ধরে রাখলাম কতো।
“বইটা শেষ করেই পড়তে বসবো।
বলতে বলতে উনি আমার কাছে চলে এলেন। আমি দেখতে দেখতে দেওয়ালের সাথে মিশে গেছি। আমার পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ার সাথে। আর কোন পথ নেই। উনি আমার সামনে, তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা যাচ্ছে। কিছু একটা নিশ্চিত হতে চলেছে আমি বেশ বুঝতে পারছি।
“বই দাও।
আমি আশপাশ তাকাচ্ছি।
“আশপাশ তাকিয়ে লাভ নেই আমি তোমার সামনে!
আমি দরজার দিকে তাকিয়ে বলি,
“আরে আপু তুমি!
আহিয়ান দরজার দিকে তাকাতেই আমি পাশ দিয়ে পালিয়ে গেলাম। উনি বলে উঠেন,
“আরে ভূতনি!
কে শুনে কার কথা। দুজনেই দৌড়াচ্ছি। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলাম ঘরের বাইরে। আমি দৌড়াচ্ছি আমার পিছনে উনিও দৌড়াচ্ছে। মাঝে দু’জনের কথার আওয়াজে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের কথার আওয়াজে সব সার্ভেন্ট কাজ থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
মা কি সব কাগজ ঘাটছিলেন তিনিও কাজ থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার দৌড়াতে দৌড়াতে মার পিছনে এসে দাঁড়ালাম। মা বলে উঠেন,
“কি করছিস তোরা।
“মা! মা উনাকে কিছু বলো।
“ভূতনি! তোমাকে যদি পাই আমি দেখো।
“আহি কি শুরু করলি।
“তুমি জানো ভূতনি সারাদিন কি করে, পড়ালেখার ধারে কাছেও যায় না সারাদিন শুধু গল্পের গল্পের বই করে।
“মোটেও না মা। আমার এই গল্পটার শুধু আরেকটু বাকি আছে। এটা শেষ হলেই আমি পড়তে বসবো।
“মিথ্যে কথা।
“না সত্যি কথা!
“না মিথ্যে কথা আমি বলছি।
“আমি বলছি সত্যি কথা।
“মিথ্যে কথা।
“না সত্যি কথা!
মা দুজনকেই ধমক দিয়ে বলেন,
“থাম তোরা দুজন, কানের ঝালাপালা করে দিলি তোরা দুজন।
আমি আবারো দৌড় দিলাম। আমার পিছনে উনিও। হঠাৎ করেই বাবা’র আগমন হলো তখন। অফিস থেকে সবে ফিরেছেন উনি। আমি গিয়ে বাবা’র পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনিও বাবা’র সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। বাবা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?
“বাবা দেখুন আমি বলছি গল্পটা পড়ে তখন পড়তে বসবো, কিন্তু উনি আমার কথা শুনতে চাইছে না।
“তুমি আমার বাবা’র কাছে আমার নামে বিচার দিচ্ছো!
“হ্যাঁ দিচ্ছি, বাবা কি আপনার একা নাকি, আমারও বাবা, আমিও তার মেয়ে। আমার কথা কেন শুনবে না।
আমার কথায় সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। সবার নিশ্চুপতার কারন আমি বুঝছি না। বাবা শুধু বললেন,
“নিহা যখন চাইছে পড়তে, তাহলে পড়তে দাও!
বলেই হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন। উনি আমার কাছে আসতেই বলে উঠি,
“এখন কিছু করলে বাবা’র কাছে বিচার দেবো বলে দিলাম।
উনি কিছু না বলে চলে গেলেন। মা আমাদের কান্ড দেখে হাসতে লাগলেন। আমি প্রথমে রান্না ঘরে এসে বাবা’র জন্য চা বানিয়ে মা’র দিয়ে এলাম। অতঃপর চলে এলাম নিজের ঘরে। খাটের উপর বসে কোলে একটা বালিশ নিয়ে আরাম করে পড়তে বসলাম। পুরো গল্পটা বসে পড়ে শেষ করলাম। কিন্তু শেষে বিচ্ছেদের সমাপ্তি দেখে আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমি চোখের পানি মুছতে না মুছতেই আহিয়ান বলে উঠে,
“কতো সস্তা তোমার চোখের পানি !
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বলি,
“আপনি দেখলেন শেষে মুহিব মারা গেল।
“হ্যাঁ পড়েছি, একবার না অনেকবার’ই পড়েছি। এতে এতো কাঁদার কি আছে বলো তো।
“কিছুই নি, এতোবার পড়েও আপনি কিছুই বুঝতে পারলেন না।
আমার থেকে বই টা নিয়ে বলেন,
“শেষ বই পড়া, এখন পড়তে বসো জলদি!
“যাচ্ছি যাচ্ছি, বার বার কেন বলেন বলুন তো!
উনি একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
“৭ টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি, এর মাঝেই পড়তে বসবে আর ৯ টার আগে যদি দেখি তোমায় উঠতে তখন দেখো কি করি
“এতোক্ষণ!
উনি কথার উত্তর না দিয়ে গেলেন। গেলে যাক আমার কি? উনি কি আমার সাথে বসে পাহারা দিবেন নাকি আমি কতোক্ষণ পড়লাম।একটু পড়েই উঠে যাবে। অতঃপর এই আশায় ঠিক ৭ টা বাজে পড়তে বসলাম। পড়তে পড়তে ৮ টা বেজে গেল। আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে যাবো তখন’ই পেছন থেকে উনার আওয়াজ আসলো,
“৯ টা বাজতে এখনো ১ ঘন্টা বাকি!
“কিন্তু..
“বসো!
উনার থমক খেয়ে আবারো পড়তে বসলাম। উনি চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে ফোন টিপতে টিপতে বলে,
“৯ টা বাজার আগে আমি এখান থেকে উঠছি না।
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে আবারো পড়া শুরু করলাম । উনি কাটায় কাটায় ৯ টা অবদিই বসে ছিলেন। অতঃপর উঠে চলে গেলেন ।
আমি দাঁড়িয়ে দেখি হাঁটতেই পারছি না। এতোক্ষণ বসে থাকার কারনে পা দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে। অতঃপর নিচে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ডিনার শেষে আমি এসে খাটে বসলাম। টিভি অন করলাম দেখার জন্য। একে একে চ্যানেল চেঞ্জ করছি কিন্তু কিছুই পাচ্ছি দেখার জন্য। হঠাৎ করেই কোথা থেকে উনি উদয় হলেন। এসেই আমার হাত থেকে রিমুট কেড়ে নিয়ে বলেন,
“কি দেখছ এইসব, কাজের জিনিস তো দেখো না।
“আমি চ্যানেল চেঞ্জ করছি এখনো কিছু দেখেনি।
“দেখা লাগবে না, আমি খেলা দেখবো।
“উফফ আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন বলুন তো।
“কেমন করি?
“আমার পিছনে শুধু শুধু লেগে থাকেন।
উনি টিভির দিকে তাকিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে খেলার চ্যানেল এ আনলেন। আর বলেন,
“আমার আরো কাজ আছে বুঝলে।
আমি হুট করেই উনার হাত থেকে রিমুট কেড়ে নিই। উনি আমার দিকে রেগে তাকিয়ে আছেন। আমি বলে উঠি,
“রিমুট আমি আগে ধরেছি তাই আমি দেখবো।
“কি দেখবে তুমি, এখন দেখার মতো কিছু নেই দাও এখানে।
“না আছে!
বলেই চ্যানেল চেঞ্জ করলাম। একটা ইংরেজি চ্যানেল তখন আমার সামনে এলো। আমি বলে উঠি,
“আমি এটা দেখবো।
“তুমি সত্যি এটা দেখবে।
“হ্যাঁ দেখবো।
“না দেখা লাগবে না, এর চেয়ে খেলা অনেক সুন্দর!
“বললাম তো আমি এটা দেখবো।
“তুমি রিমুট এখানে দাও তো।
বলেই রিমুট নিতে আসলো। আমি তখন’ই রিমুট লুকিয়ে ফেলি। আবারো এক দফা কাড়াকাড়ি। শেষমেষ রিমুটের এক অংশ উনার হাতে আর এক অংশ আমার হাতে। আমি বলে উঠি,
“রিমুট দিন নাহলে আমি এখন গিয়ে আবারো বাবা’র কাছে বিচার দেবো বলে দিলাম!
উনি রিমুট ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“বেশ দেখ তুমি!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোলে কুশন নিয়ে টিভির দিকে নজর দিলাম। এখানে মনে হচ্ছে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। একটা মেয়ে আসলো সাদা রঙের বড় গাউন পড়ে তার মুখে সাদা রঙের একটা উড়না দিয়ে ঢাকা। কিন্তু উড়না টা বেশ পাতলা। একজন তাকে এনে একজনের সামনে দাঁড় করালেন। সেখানে একজন ছেলে কালো সুট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে একজন পুরো লোক ইয়া বড় সাদা পোশাক পড়ে হাতে বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কিছু বকবক করলেন। এখন মনে হচ্ছে এটা খ্রিষ্টানের বিয়ে আর এটা ফাদার যে বিয়ে পড়াচ্ছে।
বিয়ে পড়ানো শেষ, চারদিক হইচই। এতো জনসম্মুখের মাঝে বর আর কনে দুজন দুজনের ঠোঁটে হঠাৎ করেই চুমু খেল। আমি সাথে সাথে অ্যাহহ বলে রিমুট ফেলে দিয়ে কুশন দিয়ে মুখ ঠেকে দিলাম। পাশে থেকে আওয়াজ আসছিল। কুশনের থেকে উঁকি দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা!
#চলবে….