ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ৩৯+৪০

0
1081

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩৯

এটা তো কাঠবিড়ালী! আমি নিচ থেকে এটাকে তুলে কোলে নিলাম। মনে হচ্ছে এই কাঠবিড়ালী টা সেই কাঠবিড়ালী যাকে সেদিন উনি নিয়ে এসেছিলেন। বাহ কাঠবিড়ালী টা দেখতে এখন বেশ মিষ্টি লাগছে। হঠাৎ করেই কেউ একজন এসে আমার বলল,

“এই তুমি আমার পিকু কে নিয়ে কি করছো! [ একটা বাচ্চার আওয়াজ ]

আমি সেই বাচ্চাটার দিকে তাকালাম। বাচ্চাটার সাথে আহিয়ানের ফোনের স্ক্রিনে তাকা বাচ্চাটার মিল আছে। ভুল না করলে একাই ইয়ান। তার মুখেও কিছুটা আহিয়ান ভাব আছে। আসলে এটা আহিয়ান ভাব না আয়ানা আপুর ভাব। আহিয়ান আর আয়ানা আপু কিছুটা মিল আছে বলে তাকেও দেখতে তার মতো লাগে।

“এটার নাম পিকু।

“হ্যাঁ , ও আমার পিকু! আহি আমার জন্য এনে দিয়েছে। তুমি কেন ওকে ধরলে।

“সরি আমি তো জানতাম না এটা তোমার, এটা আমার পায়ের কাছে এসেছিল বলে ধরলাম। নাও তুমি!

ইয়ান চট করেই আমার কোল থেকে পিকু কে তুলে নিল। পিকু নামটা এটার সাথে মানানসই মনে হচ্ছে না কিন্তু মনে হচ্ছে নামটা ইয়ান’ই রেখেছে। ইয়ান পিকু কে কোলে তুলে আদর করতে লাগল। আমি ইয়ানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলি,

“ইয়ান! তুমি এখনো জেগে আছো কেন?

ইয়ান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আমার নাম কি করে জানো?

“আমি তো আরো অনেক কিছু জানি।

“কি জানো?

“এই যে তোমার এত্তো গুলা আইসক্রিম, চকলেট এগুলো খুব পছন্দ।

“তাহলে আইসক্রিম দাও।

“আমার কাছে তো আইসক্রিম নেই

“কেন? তুমি তো জানো আমার কি পছন্দ তাহলে আনলে না কেন?

“সরি বড্ড ভুল হয়ে গেছে। পরেরবার মনে করে নিয়ে আসবো।

“তুমি আবার আসবে।

আমি ইয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। দূর থেকে আয়ানা আপু বলে,

“ইয়ান তুমি এখানে!

“আম্মু!

বলেই সে আপুর কাছে চলে যায়। আপু তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“কি করছিলে!

“কথা বলছিলাম তার সাথে।

“তুমি জানো সে কে?

ইয়ান মাথা নেড়ে না বলল। আমি হেঁটে তাঁদের কাছে গেলাম। আপু ইয়ানের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
“এটা তোমার ছোট আম্মু! তোমার আহির বউ!

ইয়ান বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আহির বউ!

আমি হেসে দিই। সে কাছে আসলেই আমি বসে পরি। সে আমার গালে হাত রেখে বলে,

“ছোট আম্মু তোমার গাল গুলো কি নরম। আমি একটা কিসি দিই।

“দাও!

সে আমার গালে একটা চুমু খেল। অতঃপর আপু তাকে ঘুমানোর জন্য নিয়ে গেল। তবে যাবার আগে আমার ঘর কোনদিকে সেটা বলে দিল।

ঘরে এসে নক করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
“ভূতনি এসো!

আমি ঘর ঢুকে দেখি উনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। উনার ঘরটা দেখতে খুব সুন্দর, সাজানো গোছানো। ঘরের একদিকে দেওয়ালে উনার আর ইয়ানের ছবি দিয়ে ভরপুর! বাকি সবাইও আছে। দুজন মামা ভাগিনা একরকম পোশাক পড়ে এক স্টাইলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। উনি বেলকনি থেকে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

“দেখেছো আমি কতো হ্যান্ডসাম।

“হতে পারে আপনি হ্যান্ডসাম তবে আপনার থেকেও ইয়ান বেশি হ্যান্ডসাম!

উনি হেসে বলেন,
“দেখা করেছিলে।

“একটু আগেই করেছি। আমাকে একটা কিসিও দিয়েছে।

“বাহ ভালো তো! ইয়ানের কাউকে বিশেষ ভাবে পছন্দ না হলে কিসি সে দেয় না।

“কাঠবিড়ালী! আচ্ছা এটা ওই কাঠবিড়ালী টা না।

“হ্যাঁ! ইয়ানের খুব পছন্দ হয়েছিল তাই সে রেখে দিয়েছে।

“ওহ আচ্ছা!

“হুম! ইয়ান হলো আমাদের চৌধুরী বাড়ির একমাত্র চোখের মনি।

“ওর আব্বু….

“ভাইয়া আছে, কাল আসবে তখন দেখতে পারবে। আসলে ইয়ানের এখানে থাকতে বেশি ভালো লাগে। তাই সে দু মাস অন্তর অন্তর এখানে এসে থাকে। দু মাস থেকে আবারো চলে যায় তার দাদু বাড়ি।

“বাহ বেশ তো!

এর মাঝেই ঘর নক করল। ওপাশ থেকে ইয়ানের আওয়াজ পাওয়া গেল। আহিয়ানের আওয়াজ পেতেই সে দৌড়ে চলে এলো। তার পিছন পিছন কাঠবিড়ালী ও এলো। ইয়ানের মুখ পুরো কাপড়ের মধ্যে ঢেকে গেছে। তার হাতে একগাদা কাপড়ের বোঝা। সে এর মাঝে থেকেই বলল,

“ছোট আম্মু দেখো আমি তোমার জন্য কত্তো শাড়ি এনেছি।

আমি হেসে ওর মুখ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বিছানায় রেখে বলি,
“তোমার পছন্দ সব।

“হুম হুম এগুলো সব আমার পছন্দ! আর আম্মুর গুলো আম্মুর কাছে।

আমি ওর গাল টেনে ধরি। সে “আহি” বলে তার কোলে চড়ে যায়। আহি তার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে,

“এখনো ঘুমাও নি কেন।

“এই তো ঘুমোতে যাবে। আহি জানো তো এটা কে?

“কে?

“তুমি জানো না এটা আমার ছোট্ট আম্মু আর তোমার বউ।

“তাই নাকি।

“কিন্তু আহি বউরা তো লালশাড়ি পড়ে কিন্তু ও কেন পড়ে নি বলো তো ‌

“ভূতনি বউ তো তাই!

সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভূতনি! তুমি ভূতের দেশ থেকে এসেছো!

আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আপু হেসে একাকার। সে শাড়ি গুলো বিছানায় রেখে বলে,
“কি সব বলছিস?

আহিয়ান বলে উঠে,
“ঠিক’ই বলছি! ইয়ান তুমি আজ থেকে ওকে ভূতনি আম্মু বলে ডাকবে ঠিক তো।

“ডান! ভূতনি আম্মু, কি মজা।

আমি মনে মনে বলি,
“বাচ্চা টাকেও ছাড়লেন না উনি।

অতঃপর মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি কাঠবিড়ালী টা বিছানায় বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখেই হেসে উঠি!

ইয়ান কে ঘুম পাড়াবে বলে আপু ওকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি জানি ইয়ান এখন আবারো বের হবে।‌ছোটাছোটি করবে। খুব চঞ্চল ও। আপু আমাকে এখান থেকে একটা শাড়ি পড়তে বলল। কাল ভার্সিটিতে যেতে না করেছে। আমি মাথা নেড়ে শাড়ি গুলো নিয়ে আলমারির কাছে গেলাম। দেখি সেখানে আগে থেকেই জায়গা করা। সেখানে শাড়ি গুলো রেখে পেছনে ফিরে দেখি উনি নেই।

গেলো কোথায়? একটু আগেও তো এখানেই ছিল। হয়তো বাইরে গেছে‌। অতঃপর আমি ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেস হবার জন্য। বের হবার পর দেখি উনি ঘরে।

“কোথায় গিয়েছিলেন!

“খাবার আনতে, খাও নি তো। নাও খেয়ে নাও।

আমি তাকিয়ে দেখি বিছানায় খাবার। বলে উঠি,

“আপনি খাবেন না।

“হুম খাবো। ক্ষিদে পেয়েছে, বসো তুমি!

অতঃপর দুজনেই একসাথে খেতে বসলাম। আমি প্লেট গুলো নিয়ে নিচে রেখে এলাম। উনি বিছানা ঠিক করছে। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে বলি,

“আপনি কি সত্যি এতো কাজের!

উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“না! আজ করছি তুমি সব শিখে নাও, কাল থেকে এসব তুমি করবে। বুঝলে!

আমি মুখ ভেংচি দিয়ে খাটে এসে বসি। বিছানার ওদিকে তাকিয়ে বলি,

“আপনি এখানে ঘুমাবেন।

“না ছাদে গিয়ে ঘুমাব।

“কি ছাদে কেন? রুম তো আরো আছে।

“ভূতনি! এটা আমার রুম।

“আপনি বলতে চান আমি আর আপনি এক খাটে এক বিছানায়!

উনি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আচ্ছা চলো টস করি!

“কেমন টস!

“দুটো ছোট কাগজের টুকরে তোমার আর আমার নাম লিখবো। যার নাম উঠবে সেই রুমে ঘুমাবে।

“আর আরেকজন!

“গেস্ট রুমে।

“তাহলে টস করার কি আছে, আমি চলে যাচ্ছি গেস্ট রুমে।

“কিন্তু হিসেবে তো এই রুম টাও তোমার, সমান অধিকার আছে আমাদের।

“এতো ভালো মানুষ কবে হলেন আপনি।

“আমি বরাবর ভাল মানুষ! আচ্ছা ওয়েট আমি কাগজ আনছি!

অতঃপর টস করে দেখা গেল আমার নাম উঠেছে। তাই হিসেব মতো আমি এই রুমে ঘুমাব। আমি হেসে উনার দিকে তাকিয়ে বলি,

“বালিশ লাগবে নাকি, দেবো।

“ঘুমাও তুমি তোমার বালিশ নিয়ে!

“আরে রাগ করছেন কেন? আইডিয়া তো আপনার। এখন হেরে গেলে আমি কি করতে পারো।

উনি রেগে বাইরে চলে গেলেন। আবার ফিরেও এলেন। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি। উনি বলেন,

“বাইরে বাবা আছেন!

“এখন কি করবেন? দেখলেই তো জিজ্ঞেস করবে।
বলেই ভ্রু নাচালাম। উনি হেঁটে আলমারির কাছে গেলেন। কিছু বালিশ আনলেন সেখান থেকে। অতঃপর বিছানার মাঝখানে দেওয়ালের মতো কিছু একটা করে ওপাশে বসে বলেন,

“ওটা তোমার রাজত্ব আর এটা আমার।

“আপনাকে বিশ্বাস কি?

উনি আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে বলেন,

“গুড নাইট! লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো!

অতঃপর লাইট নিভিয়ে আমি এপাশে শুয়ে পড়ি। শীতের একদম শেষের দিক এটা। তবুও কেমন জানি শীত শীত লাগছে। কম্বল টা ভালোমতো জরিয়ে শুয়ে আছি অথচ ঘুম আসছে না। কেমন একটা নিস্তব্ধতা। নতুন ঘর, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন। এসবের সাথে আমাকেই মিলেমিশে থাকতে হবে। মেয়েদের জীবনটাই এমন সবার সাথে তাকেই মিলেমিশে থাকতে হবে। এসবের জন্য সেই বাধ্য! তবুও সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবতী! আমার নতুন পরিবার খুব ভালো!
.
ভোরে কিছু খুঁটিনাটি আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকিয়ে দেখি উনি জুতার ফিতে বাধছে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

“গুড মর্নিং!

আমি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বলি,
“আপনি এতো সকালে!

“জগিং করতে যাচ্ছি! তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

বলেই উনি চলে গেলেন। ভাবতে অবাক লাগে এই ছেলে এতো তাড়াতাড়ি উঠে ঘুম থেকে। কিন্তু আমি আর শুয়ে থাকলাম না। উঠে গেলাম! বিছানা গুছিয়ে, গোসল করে ইয়ানের পছন্দ করা একটা শাড়ি থেকে শাড়ি বার করে পড়লাম। শাড়িটা বেশ সুন্দর, খয়েরি রঙের শাড়ির মাঝে হাতের কিছু কারুকাজ। শাড়িটা কোন ধরনের কাপড় তা জানি না। এসব জ্ঞান আমার নেই বললেই চলে!

আমি সবে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে আয়নার সামনে বসেছি, অনেকদিন পর দেখছি নিজেকে আয়নাতে। নিজেকে কেমন অচেনা অচেনা লাগছে। এর মাঝেই দরজায় নক পড়ল। আমি উঠে দরজার কাছে যেতেই দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতের ট্রেতে দু কাপ চা। তিনি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বলেন,

“তুমি উঠে গেছো ঘুম থেকে!

“জ্বি মা!

“ভালোই, চা এনেছি দুজনে বসে খেতে খেতে গল্প করবো।

আমি তার হাত থেকে ট্রে নিয়ে বলি,

“আপনি কেন চা করলেন, আমি করে দিতাম..

“ঠিক আছে, একদিন করলে কিছু হবে না।‌

বলেই উনি বেলকনিতে চলে গেলেন। আমি ট্রে নিয়ে বেলকনিতে গেলাম। বেলকনিতে কিছু বেতের চেয়ার আর একটা টি টেবিল আছে। আমি ট্রে রেখে মা’র হাতে চায়ের কাপ দিলাম। উনি নিচে তাকিয়ে আছেন। এতোক্ষণে এই বাড়ির বাগান চোখে পড়ল আমার। শীতকাল বলে বাগানে তেমন কোন ফুল নেই তবে দেখে মনে হচ্ছে ফুলের সিজনে বাগান পুরো ফুলে নিমজ্জিত থাকে। বাবা বাগানে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করছেন। মা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বাবা যতক্ষন ব্যায়াম করছিলেন ততোক্ষণ’ই গল্প করলেন। অতঃপর বাবা ঘরে ফিরতেই তিনিও চলে গেলেন।
তার আর আমার গল্প বেশিরভাগ’ই আহিয়ান আর আয়ানা আপু কে নিয়ে। তাদের ছেলেবেলার কাহিনী।

আমি বেলকনিতে’ই দাঁড়িয়ে ছিলাম। সময়টা উপভোগ করছি, তবে মনে হচ্ছে আমার এখন নিচে যাওয়া উচিত। তাই’ই করলাম। নিচে নেমে এলাম। সার্ভেন্ট সবাই সকালের খাবার বানাতে ব্যস্ত! আমিও তাঁদের সাথে হাত লাগলাম।

কাজ করতে শুরু করেছি বেশিক্ষণ হয় নি এর মাঝেই মা চলে চলেন। আমাকে টেনে বসার ঘরে এনে বলেন,

“তোমার কোন কাজ করা লাগবে না, এর জন্য মানুষ আছে বাড়িতে।

“কিন্তু মা..

“রাখো তো!

অতঃপর তিনি আমার হাত টেনে একটা বক্স থেকে চুড়ি বের করলেন। চুড়ি গুলো আমার হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলেন,

“এটা আহির দাদির। আহির বউ আর আয়ানার জন্য বানিয়েছিল। আয়ানার টা সে পড়ছে তবে এটা তোমার বুঝলে।

আমি চুড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। চুড়ি গুলো দেখতে বেশ সুন্দর! মা জিজ্ঞেস করলেন চুড়ি গুলো পছন্দ হয়েছে কি না। আমি বলে উঠি,

“খুব সুন্দর, খুব পছন্দ হয়েছে।

মা হেসে আমার মাথায় হাত রাখেন। এর মাঝেই আহিয়ান চলে আসে। মা তাকে বলেন,‌ ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে আসতে। উনি মাথা নেড়ে উপরে চলে যান। মা আমাকে উপরে যেতে বলে চলে যায়।

আমি উপরে এসে দেখি উনি ঘরে নেই। মনে হচ্ছে শাওয়ার নিতে গেছে। কিন্তু আমার এখন করণীয় কি? কি করবো! ভাবতে লাগলাম! ভাবতে ভাবতে উনার টেবিলের দিকে গেলাম। সারি সারি বই সাজানো। বই ধরছেন বলে মনে হচ্ছে না। শুধু সাজানোর জন্য’ই এনে রেখেছেন। একটা বই হঠাৎ চোখে পড়ল আমার! বইটা হাতে নিয়ে দেখি তাতে লেখা, “কৃষ্ণপক্ষ” কবি হলেন হুমায়ূন আহমেদ! হুমায়ূন আহমেদ, হ্যাঁ উনার লেখা একটা বই পড়েছিলাম। “দিনের শেষে”! গল্প টা বেশ সুন্দর ছিল। এটাও হয়তো অনেক সুন্দর হবে।

উনি বের হলেন। একটা কালো রঙের টি – শার্ট আর কালো রঙের জিন্স পড়া। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়েছেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“এই উপন্যাস টা খুব সুন্দর পড়ে দেখ।

“আপনি পড়েছেন এটা।

“হুম।

বলেই উনি বিছনায় এসে বসলেন। বইটা পড়ার জন্য খুলতেই সার্ভেন্ট এসে জানাল নিচে আমাদের ডাকছে।
.
আমরা সবাই খাবার টেবিলে বসে আছি। আহিয়ানের এক পাশে আমি আরেকপাশে ইয়ান। সে ইয়ান কে খাওয়াচ্ছে। আমার পাশেই আয়ানা আপু। মা আর বাবা বসেছে একসাথে! খাবার খেতে খেতে বাবা কিছু কথা জিজ্ঞেস করেন আহিয়ান কে।‌ আহিয়ান ও উওর দিতে থাকে। কথা গুলো এমন ছিল,

“আমি নিতি’র বাবা কে গতকাল কল করে না জানিয়ে দিয়েছে।

“হুম।

“তারা কারন জানতে চেয়েছে?

“আমি কথা বলবো?

“না দরকার নেই আমি বলেছি, তাদের দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি।

“বিয়ের কথা বলো নি।

“বলেছি! কিন্তু খোলাসা করে কিছুই বলি নি। বাসায় আসলে তখন বলবো। তুমি আর নিহা দু’জনেই এই দুদিন বাসায় থাকবে।

“আচ্ছা!

“নিহার পড়ালেখা চলবে কিন্তু!

“হুম।

“নিহার মা আর বাবা কে আজ’ই আনার ব্যবস্থা করো।

“আচ্ছা!

“নিহা!

“জ্বি বাবা!

“এখন এই বাড়ির বউ তুমি, তোমার মা বাবা এখানে থাকলে তাদের যেন কোন অসুবিধা না হয় এটা তুমিই খেয়াল রাখবে।

“জ্বি আচ্ছা!

অতঃপর আপুর সাথে অফিসের ব্যাপারে কিছু কথা বলে। খাবার শেষে উঠে চলে গেলেন। আমি বুঝতেই পারলাম না তিনি রেগে আছেন না খুশি আছেন। আয়ান আপুও অফিসের জন্য চলে গেলেন। ইয়ান কে এখনো স্কুলে ভর্তি করানো হয় নি। তাই সে ঘরেই থেকে গেল। আহিয়ান আমাকে বলল আজ বিকালে তার সব বন্ধুদের বলবে আসতে বাড়িতে। আমি বেশ বুঝতে পারছি একটা ঝড় আসতে চলেছে এই বাড়ির উপর!
.
সারাদিন ইয়ানের পিছনেই দৌড়েই কেটে গেল আমার। দুপুরে সে আর আমি বাগানে দৌড়াদৌড়ি করছি আর আমাদের সাথে পিকুও। এর মাঝে একটা গাড়ি ঢুকল বাড়িতে। গাড়িটা এতো জোরে এলো সে ইয়ান ভয় পেয়ে আমার কাছে চলে গেল। বলা হয় নি ইয়ানের বয়স সবে ৪ বছর।

আমরা দু’জনেই ঘরের ভেতর এলাম। কি হয়েছে এটা দেখার জন্য। ইয়ান কোলে পিকু কে নিয়ে আমার হাত ধরে আসছে। ভেতর এসে দেখি আহিয়ানের সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। তাকে পেছন থেকে দেখেছি আমি, আমার মনে হচ্ছে এটা নিতি। অতঃপর গলার স্বর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। নিতি বলছে,

“আহি কি শুনছি এসব, তুমি বিয়ে করে ফেলেছ? কিভাবে করতে পারো তুমি এটা।

“নিতি শান্ত হ!

“কি করে শান্ত হবো আমি। তুমি বুঝতে পারছো তুমি বিয়ে করেছো। কাকে করেছ তুমি বিয়ে? কাকে? কে সে যে আমার জায়গা নিতে চাইছে।

আহিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সি! সি ইজ মাই ওয়াইফ! আই মিন ভূতনি!

নিতি পিছনে ঘুরল। আমি আর নিতি মুখোমুখি। নিতি বলে উঠে,

“তুমি…

#চলবে….

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪০

আহিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সি! সি ইজ মাই ওয়াইফ! আই মিন ভূতনি!

নিতি পিছনে ঘুরল। আমি আর নিতি মুখোমুখি। নিতি বলে উঠে,

“তুমি…

নিতির মুখে তুমি ডাকটা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠল। নিতি হেটে আমার সামনে দাঁড়াল।‌ তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে বিশ্বাস করছে আহিয়ানের কথা। কারন সে বারবার দেখছে আমায়।
আমি নিজেও চোখ সরাতে পারছি না। নিতির দিকেই তাকিয়ে আছি,‌ কি করবে ও জানতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই নিতি হেসে বলে,

“তুমি, তুমি আহির বউ। আহি সিরিয়াসলি এই মেয়েটা তোর ওয়াইফ! এতো গর্ব করে বলছিস তুই ওর কথা!

আহি ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। নিতি আমার থিতুনি তে হাত রেখে বলল,
“তুমি! কোনদিক দিয়ে তোমাকে আহির বউ এর মতো লাগে বলো। যোগ্যতা কি তোমার, স্ট্যান্ডার কি?
বলেই চেঁচিয়ে উঠে। ইয়ান ভয়ে আমার পিছনে এসে লুকায়। আমিও কেঁপে উঠি। আহিয়ান সামনে এগিয়ে আসছে।
নিতি এবার কিছু বলতে গেলে তার আগেই আহিয়ান বলে,

“ও আহিয়ান চৌধুরী’র বউ! ব্যস এতোটুকু কথাই যথেষ্ট।

নিতি হেসে পিছনে তাকিয়ে বলে,

“ওহ্ আচ্ছা! তাই নাকি, ( আমাকে উদ্দেশ্য করে ) কি দিয়ে বস করলে ওকে। হুম বলো, তোমার পরিবার কি তোমায় এইসব শিখিয়েছে‌। এটাই শিখিয়েছে নাহ কিভাবে বড়লোকের ছেলেদেরকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা যায়। আর তুমিও তো সেটাই করেছো। যেই দেখলে আহি কে আর হাতছাড়া করলে না। তাই না!

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি‌। নিতি রাগে ফুঁসছে। আহিয়ান আমার পাশেই দাঁড়ানো। হঠাৎ করেই নিতি হাত উঠালো আমাকে মারার জন্য। আমি চমকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। পাশেই আহিয়ান দাঁড়ানো ভেবেছিলাম উনি আটকাবেন না তা হলো না। ওপাশ থেকে মা’র আওয়াজ এলো। মা’র আওয়াজ পেয়ে নিতি থেমে গেলো। মা আমাদের দিকে এগিয়ে এসছেন। আমি এতোক্ষণে বুঝলাম আহিয়ান কেন চুপ ছিল।

নিতি মা কে দেখে চুপ হয়ে গেল। মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,

“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি, চৌধুরী বাড়িতে দাঁড়িয়ে এই বাড়ির বউ”র যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছো।

নিতি মাথা নিচু করে নেয়। কিছুক্ষণ’র মাঝেই তাকে কাঁদতে দেখা যায়। নিতি কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আন্টি, আপনি এখন এই ভাবে কথা বলছেন আমার সাথে। এতোটাই পর আমি।

মা এবার রুদ্ধ স্বরে বলে,
“তোমাকে আমি নিজের মেয়ের চেয়ে কম ভালোবাসি না। কিন্তু তুমি আজ যা করছিলে তা আমার মেয়ে করলে এতোক্ষণে তাকে আমি বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। ভুলে যাবে নিহা আমার আহির বিবাহিতা স্ত্রী! আহি নিজে বিয়ে করেছে ওকে। এটা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তোলার কে?

নিতি নিঃশব্দে কাঁদছে। আমি মা কে দেখছি, উনার রূপ যে এমন হতে পারে এ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা ছিল না। মা আবারো বলেন,

“তুমি আজ যা করতে চাইছিলে তা আহির বাবা জানতে পারলে কি হবে জানো? আমি এটাই বুঝতে পারছি না তোমার এতো সাহস হয় কি করে নিতি? তুমি নিহা’র গায়ে হাত তুলতে চাইছিলে। নিজেকে এতোটা নিচ প্রমাণ করলে তুমি!

নিতি মা’র সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আই’ম সরি আন্টি, রেগে ছিলাম বুঝতে পারি নি। কিন্তু আন্টি আপনিও তো জানতেন আমি আহি কে কতোটা ভালোবাসি!

মা’র গলা এবার শীতল হলো। শীতল গলায় বলেন,
“এটা কারো অজানা নয়, কিন্তু এক তরফা ভালোবাসা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না নিতি। আমার আহি তোমাকে ভালোবাসে না। সে নিহা কে ভালোবাসে আর তাকেই বিয়ে করেছে। এই নিয়ে তাকে আমি কিছু বলতে পারি না।

মা’র কথা শুনে আমি আহিয়ানের দিকে তাকালাম। আহিয়ান ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জনের চোখেই বিস্ময়!

নিতি এবার কাঁদতে কাঁদতে মা কে জড়িয়ে ধরল। মা ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। বুঝলাম আমার শাশুড়ি যেমন রসিক আর নরম মানুষ তেমন কঠোর ও। যখন যেটার দরকার হয় তখন সেটাই করে। মা আমাকে বলেন নিতির জন্য পানি নিয়ে আসতে। অতঃপর নিতি কে নিয়ে সোফায় বসেন। আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি আহিয়ান আসছে আমার পিছু পিছু! ইয়ান এখনো আমার পিছনে শাড়ির আঁচল ধরে আছে।

আহিয়ান ইয়ান কে কোলে তুলে নিল। আহিয়ান তার সাথে কথা বলছে, ইয়ান হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। আমি পানি’র গ্লাস নিয়ে আবারো মা’র কাছে গেলাম। মা আমার থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নিতি কে খাইয়ে দিল।‌সে এখানো কাঁদছে। মা তাকে থামাচ্ছেন। আমি তাদের পাশেই বসে আছি। আহিয়ান ইয়ান কে কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে।

“আর কেঁদো না শান্ত হও।

“আন্টি কি করে শান্ত হবো।

“না চাইলেও হতে হবে, এখন আর কিছু করার নেই।

“আহিয়ান কি করে পারলো এমনটা করতে। গতকাল’ই তো মা বাবা এসে বিয়ের কথা বলল আর তখন’ই সে বিয়ে করে নিল।

“না আহিয়ান তখন বিয়ে করে নি।

নিতি কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল। অতঃপর বলল,
“তাহলে..!

“বিয়ে হয়েছে আজ তো প্রায় ১৫ দিন হয়ে গেল।

নিতি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঠিক কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। মা বলেন,
“নিতি যা হয়েছে ভুলে যাও। এখন আর কিছু করার নেই।

নিতি’র কান্না এখন থেমে গেল। আমি পাশেই বসে ছিলাম। নিতি এখন ঠিক কি ভাবছে আমি তা চিন্তা করছিলাম। এটাই তো, “কেন এতোদিন সবসময় আহিয়ান আমার সাথে থাকত। শুধু আমার জন্য তাদের সবার সাথে কেন ঝগড়া করল!” সে হয়তো দুইয়ে দুইয়ে চার করার চেষ্টা করছে। ভেবেছিলো এমন চলতে থাকলে সে আর আহিয়ান কে পাবে না তাই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এমনটা কি হতে পারে না। হুম পারে! আমার ধারনা এটাই হয়েছিলো।

হঠাৎ করেই হাতে কারো ছোঁয়া পেয়ে ঘোর কাটল। তাকিয়ে দেখি ইয়ান। আমি ওর গালে হাত রেখে বলি,

“কিছু বলবে।

ইয়ান মাথা নাড়ল। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,
“ক্ষিদে পেয়েছে।

ইয়ান আবারো মাথা নাড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো বাজে। এসময় ওর ক্ষিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবা হয়তো একটু পরেই চলে আসবে। তার সাথে নিতি’র মা আর বাবাও। তাদের দুপুরের খাবারের জন্য বাবা ইনভাইট করেছিল। নিতি হয়তো আহিয়ানের বিয়ের কথা শুনে রেগে আগেই চলে এসেছে।

বাইরে গাড়ি থামার আওয়াজ পেলাম। মা উঠে দরজার সামনে গেলেন। নিতি’র মা আর বাবা এসেছে। নিতি কে সোফায় বসে থাকতে দেখে তিনি দৌড়ে এলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারা দুজনেই তাদের মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তিত। তার সাথে মা ও। চিন্তা আমারো হচ্ছে শুধু একজন’ই চিন্তা মুক্ত আর সে হলো আহিয়ান। রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপেল খাচ্ছে আর এখানকার কান্ডকারখানা দেখছে। অদ্ভূত এক লোক বটে!

গাড়ির আওয়াজ আবারো এলো, বাবা এসেছেন! মা আমাকে বললেন ঘরে যেতে। আমি ইয়ান কে নিয়ে চলে গেলাম রান্না ঘরে। তার জন্য খাবার বেড়ে ঘরে নিয়ে এলাম। আহিয়ান সেখানেই ছিল। ইয়ান কে খাইয়ে দিলাম। অতঃপর প্লেট রান্না ঘরে রেখে আবারো তার রুমে এসে দেখি ইয়ান বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তাকে ভালোমতো শুইয়ে দিয়ে পিকু কে দেখলাম। সেও তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে।

সার্ভেন্ট এসে বলল, খাবারের জন্য ডাকছে। আমি উঠে বসার ঘরে গেলাম। মা আমাকে ধরে সোফায় আহিয়ানের পাশে বসালেন। নিতির মা আর বাবা কে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সাথে। নিতি চুপচাপ বসে আছে।
নিতির মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমার নাম কি?

“নিহারিকা নিহা!

“তোমার বাবা কি করেন নিহা!

“আমার বাবা অসুস্থ, তাই কোন কাজ করেন না।

আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি খুব অবাক হলেন। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। বাবা বলে উঠেন,

“আচ্ছা আপনারা আগে খাওয়া দাওয়া করুন। কথাবার্তা পরেও করা যাবে।

নিতির মা উঠে চলে গেলেন। কেন জানি মনে হচ্ছিল তিনি আমাকে ছোট্ট করতে চান। একে একে সবাই উঠে টেবিলে বসলেন। আহিয়ান আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“দারুন জবাব দিয়েছ! নিতির মা হলো আরেক নিতি, বুঝলে।

আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা আমাকে আর আহিয়ান কে ডাকলেন। সবাই খাবার খেতে বসেছে আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি। নিতির মা খাবার খেতে খেতে বেশ প্রশংসা করলেন। হঠাৎ তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তা নিহা! পড়ালেখা ছাড়া তুমি আর কি করেছ!

“কিছু না আন্টি!

“আমাদের নিতি কিন্তু পড়ালেখা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে বেশ ভালো।

আহিয়ান খেতে খেতে বলে,
“আমার বউ কিন্তু খুব ভালো রান্না করে আন্টি! আপনি একটু আগে খেয়ে যে প্রশংসা করলেন সেটা ওর হাতের রান্না!

নিতির মা আবারো মুখ কালো করে চুপ হয়ে গেলেন। মা কোন মতে হাসি সামলে আহিয়ানের দিকে তাকাল। আহিয়ান চুপ হয়ে খেতে লাগল। নিতির বাবা একটু চিন্তিত , তাই তিনি কোন কথা বলছেন না। নিতি খাবারের প্লেট নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“নিহা! ইয়ান কোথাও?

“ঘুমাচ্ছে বাবা! একটু আগেই খাইয়ে এসেছি।

মা বলে উঠেন,
“অনেক হয়েছে তুমিও এবার খেতে বসো।

“জ্বি!

আমি আহিয়ানের পাশে বসলাম। নিতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর রেখেছে। দু’জনের চোখাচোখি হলো আহিয়ানের কোন ধ্যান নেই। সে খাওয়াতে ব্যস্ত! খানিকক্ষণ বাদে আয়ানা আপুও চলে এলো।
.
খাওয়া দাওয়া শেষে নিতিরা সবাই চলে গেল। মা আহিয়ানের তখনকার কথার কারনে হাসতে হাসতে শেষ। বাবা পাশে বসেই চা খাচ্ছেন। তার চেহারায় কোন ভাবনা নেই। মা আর বাবা’র জুটিটা সুন্দর। একজন গম্ভীর আরেকজন চঞ্চল! আয়ানা আপু ইয়ানের কাছে। সন্ধ্যায় তার বর আসবে।

একবার দাদি’র ফোন এসেছিল। আমার সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল, খোঁজ খবর নিল। দাদি জানাল আমার সব স্টুডেনর কাছে তিনি বলে এসেছেন যে আমি আর পড়াতে আসবো না। বিয়ের কথা শুনে সবাই নাকি বেশ খুশি হয়েছে।

বিকেলে পুরো বাড়ি হইচই। সবাই এসেছে বাড়িতে শুধু নিতি বাদে। বিয়ের ব্যাপারটা প্রথমে সবাই গম্ভীর ভাবে নিলেও পরিবেশ এখন শান্ত। নাহান আর আনাফ ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিলেও টিনা আর আনিকা কিভাবে নিল বলা মুশকিল! ইতিও এসেছে, সে আমার আর মা’র সাথে রান্না ঘরে কাজে হাত লাগাচ্ছে। মা আমাদের দুজনের হাতে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে বলেন আর যেন না আসি!

আমি আর ইতি খাবার নিয়ে সবার মাঝে রাখলাম। টিনা আর আনিকা অদ্ভুত ভাবে দেখছে আমায়। মনে হচ্ছে তারা এই প্রথমবার আমাকে দেখছে। আমি এসব রেখে উঠে চলে যেতে নিলাম এর মাঝেই আহিয়ান আমার হাত ধরে ওর পাশে বসতে বলল। সবাই গোল হয়ে বসে আছি গল্প করার জন্য। এর মাঝেই হঠাৎ টিনা জিজ্ঞেস করল,

“নিহার মাঝে এমন কি ছিল আহি যে তুই ওকে বিয়ে করলি!

আহিয়ান হেসে আমার শাড়ির আঁচল ধরল। উনি এটা একবার গিট্টু দিচ্ছি আবার খুলছে। নাহান ভাইয়া জিজ্ঞেস করল এমন কেন করছে। আনিকা বলে উঠে,
“আহি প্রশ্নের উওর খুঁজছে কারন সে নিজেও কনফিউজড!

“আহিয়ান হেসে বলল,
“ঠিক বলেছিস! কারন ওর মাঝে কি আছে তা আমি নিজেও জানি না তবে নিশ্চিত কিছু আছে তাই তো আজ ও আমার পাশে!

উনার কথায় পুরো পরিবেশ থমকে গেল। আকাশ ভাইয়া প্রশ্নের উত্তরে বেশ খুশি! কিন্তু আমি এটাই বুঝলাম না উনি কি কথাটা বানিয়ে বলেছেন শুধু ওদের জবাব দেওয়ার জন্য নাকি…

সিফাত আসে নি বলে অবাক হলাম না। ভালোই হয়েছে ও আসে নি। তবে সেদিনের সেই ঘটনা আমার মাথা থেকে বের হয়ে গেছিল। আবারো এসেছে! মনে হচ্ছে এখানকার ঝামেলার কারনে আবারো চলে যাবে!
.
সন্ধ্যার দিকে আয়ানা আপুর বর এলো। কালো রঙের স্যুট তার পড়নে হয়তো অফিস থেকেই এসেছে। তিনি দেখতে বেশ সুর্দশন। শরীরের গঠন ও ভালো। ইয়ান এতোদিন পর তাকে দেখে দৌড়ে তার কোলে চড়ে গেল। দীর্ঘদিন পর ছেলে আর বাবার সাক্ষাৎ দেখে ভালোই লাগলো। মা আমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল। নতুন বউকে দেখে সে যেমন অবাক তেমনি হতভম্বিত হয়ে গেল। শেষমেষ কিছু না পেয়ে ইয়ানের জন্য আনা চকলেট আমার হাতে দিয়ে বলল,

“নতুন বউ দেখবো এটা আশা করি নি। পুরোই অপ্রস্তুত আমি। নতুন বউ কে দেখে কিছু দিব না এটা হয় না। তাই এটাই দিলাম। কিছু মনে করো না।

তার কথায় আমি হেসে মাথা নাড়লাম। তাকে এখন লাজুক মনে হচ্ছে কিন্তু তিনি রসিক মানুষ। আহিয়ানের বিপরীত মুখী বলা যেতে পারে। সে পুরোপুরি’ই গম্ভীর! তবুও তার সারে উনার খুব ভাব। দুলাভাইয়ের সাথে যেমন হওয়া দরকার ঠিক তেমন।
সবাই একসাথে বসে গল্প করছি। দুলাভাই হাসতে হাসতে বলেন,

“কখনো ভাবি নি আহি বিয়ে করবে। এটা একদম অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে!

আয়ানা আপু হেসে বলল,
“চুপ করুন, এভাবে বলবেন না।

ইয়ান বলে উঠে,
“আমার ভূতনি আম্মু কে তুমি কি বলছো।

অবাক হয়ে,
“ভূতনি আম্মু!

আপু হেসে বলে,
“এটা তোমার শ্যালকের দেওয়া নাম। নিহা কে সে ভূতনি বলে ডাকে তার সাথে এখন তোমার ছেলেও যুক্ত হয়েছে।

দুলাভাই আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“Such a unique name !

আহিয়ান একটু ভাব নিয়ে,
“আমি মানুষ টাই ইউনিক দুলাভাই!

দুলাভাই আপু আর ইয়ান কে নিয়ে চলে গেলেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ইয়ান ছিল বলে সময় চলে যেত কিন্তু এখন সে নেই। কিন্তু ইয়ান তার পিকু টা কে আমার কাছে দিয়ে গেল। যাক সময় কাটানোর জন্য একটা ভালো বন্ধু পেলাম।
.
আহিয়ান গতকাল’ই লোক পাঠিয়েছিল আম্মু আর আব্বু কে আনার জন্য। সকালের দিকেই তারা চলে এসেছে। তাদের সাথে চাচাও এসেছে। মা তাদের খুব ভালোভাবেই অ্যাপায়ন করেছেন। দেখে খুব ভালো লেগেছে উনি তাদের সাথে মিশে গেছেন।
সন্ধ্যা বেলা বাবাও তাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করলেন। তাদের যত্নের কোন ত্রুটি হতে দিলেন না। যথাসম্ভব অ্যাপায়ন করলেন। আব্বু’র‌ চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার’র সাথে কথাও বললেন। রাতে আম্মু এসে আমার পাশে বসলেন। অনেকদিন পর মা আর মেয়ে একসাথে বসেছি। গল্প করলাম বেশ অনেকক্ষণ। মা গল্প করতে করতে কেঁদে দিলেন। আব্বুর সাথে দেখা করতে রুমে গিয়ে দেখি তার বিছানার পাশে আহিয়ান বসে আছে।‌ তারা গল্প করছিল। আমি আব্বুর পাশে বসে গল্প করলাম খানিকক্ষণ!

দেখতে দেখতে একসপ্তাহ পার হয়ে গেল। গতকাল’ই আম্মু আর আব্বু চলে গেছেন। মা তাদের যেতে দিতে চাইলেন না তবুও তারা চলে গেলেন। এর মাঝে গতকাল’ই‌ আয়ানা আপুর শশুড় শাশুড়ি এসেছিলেন। তাদের সাথেও পরিচয় হলো আমার। তাদের বর্ণনা দুলাভাইয়ের ন্যায়। তারাও আমাকে বেশ সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছে। সবার এতো ভালোবাসা পেয়ে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র সুখী মানুষ শুধু’ই আমি যে কি না এতো ভালো একটা পরিবার পেয়েছি!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here