#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#সূচনা_পর্ব
বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম ২ মাস আগে। আমি মূলত কাউকে চিনতাম এখানে, তবুও অনেক সাহস নিয়ে এসেছিলাম। আসবার ও কারন আছে। বিয়েটাতে আমার অমতে ছিল তবুও আমি রাজি ছিলাম। আমি নিহারিকা নিহা, একটা ছোট গ্রামে থাকতাম। সুখ ছিল না তবে বেশ ভালো ছিলাম। থাকতাম সৎ মার কাছে, তবুও দুঃখ ছিল না। সারাদিন বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি করে, গাছে চড়ে, মার বকুনি খেয়ে, ঘরের কাজ করে দিন চলে যেতো। তবে সৎ মা হলেও একটা জিনিস আমার সাথে খুব ভালো করেছিলেন। সেটা ছিল লেখাপড়া! এটাতে তিনি কখনো হস্তক্ষেপ করে নি। আর করতেও পারতেন না কারন ছিল আমার বাবা। আমার সৎ মা আমাকে দেখতে না পেলেও বাবা কে খুব ভালোবাসত। যার কারনে আমি এতো কষ্টের মাঝেও বেশ ছিলাম। বাবা’র খুব শখ ছিল আমি যেন পড়ালেখা করতাম আর সেটা করার চেষ্টা করতাম। আমার জীবন টা ছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো, যেখানে মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বয়ে যেতো। কিন্তু ওই যে বললাম, সুখ ছিল না তবুও ভালো ছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির পরই আগমন হলো এক ঝড়ের আর সেই ঝড় তোলপাড় করে দিল আমার সবকিছুর!
তখন আমি সবে আমার কলেজ থেকে আমার শেষ পরিক্ষা টা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি আমার অসুস্থত বাবা কে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে আমার ভাবী! আমার বাবা ক্যান্সার হয়েছিল এরপর থেকেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে মা আমার বড় ভাইয়ের হাত পা ধরে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তারা কেউই সেটা বুঝতে চাইছে না। এক পর্যায়ে আমার অসুস্থ বাবা কে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন ভাবী। আমি দৌড়ে বাবা কে গিয়ে ধরি। মা কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাবতেও কষ্ট হয় নিজের সন্তান হয়ে আমার বড় ভাই কিভাবে তার মা বাবার সাথে এ ওইমনটা করতে পারে। এখন বৃদ্ধ বলে কি তারা মূল্যহীন হয়ে গেছে। কিন্তু একসময় এই দুজনের ছায়ায় বেড়ে উঠেছে সে। তাদের জন্য’ই আজ সে এতো বড় হয়েছে তবুও তাদের প্রতি কোন দায়িত্ব নেই তার। মানুষ এতোটাও বিবেকহীন হয় কিভাবে? বড় লোকরা তো পারে তাদের মা বাবা দের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে কিন্তু দরিদ্র দের পক্ষে তো সেটা আর সম্ভব না। তাই বলে কি তাদের এভাবে অগ্রাহ্য করতে হবে।
অনেক ইচ্ছে করছিল চেঁচিয়ে কথা গুলো বলি কিন্তু পারলাম না। মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। অসুস্থ বাবা ও না পেরে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছে না। আমি তাকে ধরে রেখেছি। আমি ভারী গলায় ভাবী কে বললাম..
“কি হয়েছে ভাবী, মা বাবা দের সাথে এমন করছো কেন?
“এলো রে কোন নবাবজাদি! বলি এখন তো আসবার সময় হয়েছে রে মুখপুড়ি। ঘরের কাজ গুলো করবে কে শুনি!
মা বলে উঠে…
“বউ মা আমি তো করে দিচ্ছিলাম সব, মেয়েটা আজ পরিক্ষা দিতে গিয়েছিল!
“মা গো আপনি যদি ঘরের কাজ গুলো করেন তাহলে সাহেবদের বাসায় কাজ করতে যাবে কে। আর সেখানে কাজ না করলে টাকা আসবে কোখান থেকে। আমি কি আপনাদের তিন জন কে খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদের সব কিছু শেষ করে দেবো নাকি। আর রইল এই মহারানির কথা তো এনি কি সত্যি’ই পরিক্ষা দিতে গিয়েছিল না অন্য কিছু কিভাবে বলবো এইসব!
“ভাবী!
“কিহ হুম কি বলবি তুই!
“ভাইয়া, তুমিও! তুমিও এমন করছো। এরা তোমার বাবা মা ভাইয়া।
“তো তোমার কি মা বাবা নয় নাকি। তোমাকে যে বললাম আমার দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই খালেদ তোমাকে বিয়ে করতে চাও করছো না কেন বাপু। তাহলে তো কিছু টাকা আসত সংসারে!
বাবা বলে উঠেন..
“এসব কি বলছো মা, খালেদ যে ওর অনেক বড়। আর সে তো বিবাহিত!
“হ্যাঁ তো কি হয়েছে, ৩ টাই তো বিয়ে করেছে একটা তো পটল তুলেছে আর দুটো আছে। কিন্তু কেউই তাকে ছেলের মুখ দেখাতে পারছে না তাই সে বিয়ে করতে চায়। আর আপনাদের তো সোনার ভাগ্য যে সে আপনার মেয়ে কে বিয়ে করতে চায়!
মা বাবা দুজনেই মাথা নিচু করে নেয়। কারন তারা কেউই চায় না আমি তাকে বিয়ে করি। কথাটা শুধু এই ছিল না উনি বিবাহিত। এর ছাড়াও তার নামে আরো অনেক কথা আছে। কারন তিনি একজন দুশ্চরিত্র প্রকৃতির মানুষ। তার নামে আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা সবসময় বলা বলি করে মানুষ। এমন একজন মানুষের সাথে কারো মা বাবা কখনো চাইবে না বিয়ে হোক। আমাদের ও তার ব্যতীক্রম হয় নি। ভাবী কর্কশ গলায় আবারো বলে..
“দেখলে তুমি, দেখলে কান্ড টা। দুজন বুড়া বুড়ি কিভাবে মাথা নিচু করে ফেলল।
ভাইয়া বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বলে..
“তো আমি কি করবো, আমাকে কেন বলছো। বলেছিলে বের করে দিতে বের করে দিয়েছি আর কি করবো এখন।
“তোমার বোন কে বলে দাও আমার ভাই খালেদ আরেকটা প্রস্তাব দিয়েছে নবাবজাদী কে।
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ভাবী একটু ভাব ভঙ্গি করে শাড়ি’র আঁচলটা কোমর থেকে খুলে গলার ঘাম মুছতে মুছতে বলে..
“বুঝতে পারি না বাপু তোর মতো একটা মেয়ের এতো ভাগ্য হয় কি করে। আমার ভাই তোর মধ্যে যে কি দেখল। নেহাত আমার ভাইয়ের মন টা অনেক বড় তাই এই প্রস্তাব টা দিয়েছে। বলেছে তুই যদি বিয়ে করিস তাহলে তোর বুড়ো বাপের চিকিৎসা’র খরচ সে দেবে। তোর অসুস্থ বাপ সুস্থ হয়ে যাবে। বুঝলি তো মুখপুড়ি! সোনার ডিম পাড়া হাস পেলি রে তুই!
আমার চোখ দুটি জ্বল জ্বল করে উঠলো। বাবা’র চিকিৎসা’র খরচ দেবে তার মানে তো আমার বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। যদিও আমিও এতোদিন বিয়েটা নিয়ে অমত ছিলাম কিন্তু বাবার চিকিৎসা’র কথা শুনে এখন দেখছি বিয়েতে রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠি…
“ভাবী সত্যি! সত্যি তিনি বাবার চিকিৎসা করাবে।
“আমাকে তো তাই বললো! এখন তোর কি ইচ্ছা সেটাই বল।
আমি হ্যাঁ বলতে যাবো তখন’ই মা আমার হাত ধরে ফেলল। আমি মা’র হাত টা নামিয়ে চোখে আশ্বাস দিয়ে বললাম..
“আমি রাজি ভাবী এই বিয়েতে, যদি তিনি আমার বাবা চিকিৎসা করান তাহলেই আমি রাজি!
আমার কথা শুনে ভাবী আর ভাইয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল এমনটাই লাগলো আমার কাছে। আমার মা হয়তো আগে আমাকে দেখতে পারতো না কিন্তু এখন তার কাছে আমি ছাড়া আর কোন আশ্রয় নেই। তার ছেলে আর ছেলের বউ তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না বলে দিয়েছে। তখন আমি তাদের আশ্বাস দিতাম। এরপর থেকে কিছুটা হলেও মায়ের আপন হতে পেয়েছিলাম। আমার বড় ভাইয়া আর আমি সৎ ভাই বোন। আমার বাবা’র দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে ছিলাম। হ্যাঁ আবার বাবাও ২ টি বিয়ে করেছিলেন তবে সেটা আমার দাদা’র কথায়। শুনেছিলাম আমার মা অনাথ ছিল আর তার দায়িত্ব ছিল আমার দাদা’র কাছে। তিনি মারা যাবার আগে আমার বাবা কে তার দায়িত্ব দিয়ে যান। বলেছিলেন তাকে যেন বিয়ে করে।
এতে আমার সৎ মা খুশি ছিলেন না। এটা স্বাভাবিক ছিল তিনি খুশি হবেন না কারন কোন বউ তার স্বামী কে কারো সাথে ভাগ দিতে পারবে না। অতঃপর আমি জন্মের সময় আমার মা মারা যান। ছোট বেলা থেকে মায়ের আদর আর ৫ টা সন্তানের মতো বিশেষ ভাবে পায়নি। তবে আমাদের এই ছোট সংসারে শান্তি ছিল। কিন্তু ভাইয়ার বিয়ে হবার পর থেকেই তিনি আর আমাদের সহ্য করতে পারেন না। এটার কারন আমার কাছে আজও অজানা। তবে সবাই বলে ভাবী আর তার শাশুড়ি মিলে তার মাথায় কু- বুদ্ধি দিচ্ছে। আচ্ছা আসলেই কি এটা হতে পারে। সৎ ভাই হবার কারনে তিনি কখনো আমাকে ওতোটা আদর করে নি। তাই বলে খারাপ ব্যবহার ও করেনি। কিন্তু এখন যা করে, এসব কিছু আর সহ্য হয় না আমার।
আমার বাবা কিছু বলবে এর আগেই আমি বাবার হাত টা ধরে বলি..
“তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, চলো আমার সাথে।
বলেই বাবা কে টেনে ঘরে নিয়ে এলাম। বলা বাহুল্য ভাবী আর ভাইয়া এখন আর কিছু বললো না। হয়তো এজন্যই তারা এসব কিছু করেছে যাতে আমি বিয়েতে রাজি হই।
তবে খালেদ ভাই যে সত্যি একজন দুশ্চরিত্রের মানুষ তার প্রমাণ আমি নিজে। তার ভাইকে আমি প্রথমে ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলাম। তার বিয়ে হলো আজ ১ বছর। খালেদ কে তখন আমার বেশ সুবিধার মনে হয় নই। লোকটা শুধু বার বার তখন আমার কাছে কথা বলতে চেয়েছিল যদিও আমি বারবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম। তিনি বিবাহিত হবার পরও আমার সাথে কথা বলার এতো আগ্রহ আমার মটেও ঠিক মনে হয় নি।
এরপর বিয়ের পর প্রায় অনেকবারই তিনি এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। বলতেন বোন কে দেখতে এসেছি কিন্তু আমার কেন জানি মনে তিনি হয়তো অন্য কোন কারনে এসেছে কারন বার বার তিনি আমার সাথেই কথা বলতেন চাইতে। এরকম একদিন তিনি আসার পর তাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলাম আমি। পানির গ্লাস টা তিনি চাইলে আমার দেবার সময় সে আমার হাত ধরে ফেলেন, এরপর থেকে আমি বুঝে যাই সে আসলে কি রকম প্রকৃতির লোক। অবশ্য এসব কথা মা আর বাবা ছাড়া কেউ বিশ্বাস করি নি। ভাবী আরো আমাকে দোষ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন..
“সব দোষ এই মেয়েটার, সারাদিন আমার ভাইয়ের সামনে ঘুরঘুর করবে। এখন তো কিছু হয় নি তাই এসব বানিয়ে বলছে। দেখেছে অনেক সম্পদ, টাকা আছে তাই আর লোভ সামলাতে পারে নি। চিনি চিনি এসব মেয়েদের খুব ভালো করেই চিনি”!
আমার ভাইয়াও তার কথায় শায় দিল।তাই আর সাহস হলো না কিছুর বলার। দাঁড়িয়ে শুধু নিঃশব্দে কেঁদেছিলাম। ইচ্ছে করছিল চেঁচিয়ে বলি আমি কিছুই করে নি। সব দোষ খালেদ ভাইয়ের। কিন্তু কথাটা আমার মনেই রয়ে গেল, সেটা শোনার প্রয়াস করল না কেউ!
.
রিক্সার টুং টুং শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটল না আমার। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝ পথে চলে এসেছি। পেছন থেকে রিক্সা বলছে..
“আপা সামনে যেতে সরুন, মাঝপথে হাঁটতেছেন কেন। পরে তো কিছু হলে দোষ হবে আমাগো”
আমি তৎক্ষণাৎ সরে গেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো আকাশ কালো অন্ধকার কিন্তু তবুও এর মাঝে যে তারা মিটিমিটি করছে কিন্তু আমার মনের আকাশে যে শুধুই অন্ধকার!
#চলবে..