বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ৩০
#আনিশা_সাবিহা
নিজের স্ত্রী এর মুখে অন্য একটা পুরুষের নামটা শুনে যেন অভয়ের হার্টবিট এক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকে গেল। মূহুর্তেই অকারণেই ‘সায়ান’ নামটির প্রতি অসংখ্য ঘৃণা ও রাগ তৈরি হয়ে গেল অভয়ের মনে আপনা-আপনি। তার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল। সেটা হচ্ছে, ‘ঐশানী যেদিন জেনেছিল তার স্বামী মানে অভয়ের জীবনে অন্য কোনো নারী আছে তখনও ঐশানীর মনেও এমনই ঝড় এনেছিল?’
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে অভয় নিজেকে শান্ত রেখে বলল…..
–“সায়ান? কে সায়ান?”
–“আমার অতীত! একটা কালো অধ্যায়। যেই অধ্যায়টা আমি চাইলেও আমার জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে পারি না।
আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা। গল্পটা একটু ভিন্ন ছিল। অভয় ও ঐশানীর গন্তব্য অন্য ছিল! তাদের পথ আলাদা ছিল।
অতীত…..
–“ঐশানী!! আজ নাকি তোর কলেজের ফার্স্ট ডে। প্রথম দিনেই লেট করবি তুই?”
–“নো ওয়ে মা! গতকাল এখানে শিফট হলাম ঘরদোর গুছিয়ে নিতে ক্লান্ত আমি। একটু দেরি হলে এমন কিছু হবে না।”
ঘরের দরজা লক করতে করতে ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে পা রাখে ঐশানী। আজ তার কলেজের ফার্স্ট ডে। গতকালই সিলেট থেকে এসে ওরা ঢাকা শিফট করেছে। ঐশানী ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ার গ্রাম থেকেই কমপ্লিট করে এসেছে সে। বয়স তার উনিশে পা রেখেছে।
খাবার টেবিলে এসে বসে ঐশী। তাকে দেখার সাথে সাথে ঐশানী আঙ্গুল উঁচিয়ে হুমকি দেওয়ার মতো করে বলে…..
–“আমি আমার রুম লক করে দিয়েছি। তোর চোরের মতো স্বভাব তো কোনোদিনও যাবে না। তাই সিকিউরিটি ফার্স্ট। তবুও যদি রুমে ঢোকার চেষ্টা করিস তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।”
ঐশী তখন ছোট হলেও ভারি দুষ্টু। দুই বোন একই ধাতু দিয়ে তৈরি যেন। সে ইচ্ছে করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে মিসেস. দিশার দিকে তাকাতেই মিসেস. দিশা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলেন…..
–“ও ছোট ঐশানী। এমন করিস কেন ওর সাথে?”
–“যাকে নদীর ধারে কুড়িয়ে পেয়েছি তার সাথে এতো ভালো করে কথা বলা অসম্ভব!”
বলেই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করে না ঐশানী। দ্রুত পায়ে দৌড়ে বাইরে চলে আসে। ঐশী রেগেমেগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থেকে একসময় চিল্লিয়ে ওঠে….
–“মা দেখো! আপু এসব কি বলে গেল?”
–“তুই তো জানিস ঐশী। ও এমনই বাদ দে। ও বললেই তো সব সত্যি হয়ে যাবে না।”
ঐশানী আজ বড্ড খুশি। কত দিনের স্বপ্ন বড় কলেজে পড়াবে সে! আজ পূর্ণ হয়েছে। খুশিতে গদগদ হয়ে কলেজের গেটে পা রাখে সে। ভালো করে প্রথমেই আশপাশটা দেখে নেয়। প্রথমেই তার নজরে আসে ডান দিকে ক্যান্টিন। তার আগে ক্যাম্পাস। বড় ঘাস ভরা মাঠের মাঝখানে চার তলার বিশাল বিল্ডিং। আচ্ছা সে কোনদিকে যাবে? এখনো ক্লাস শুরু হতে ত্রিশ মিনিটের মতো বাকি আছে। সে ডানদিকে ক্যাম্পাসের দিকেই পা বাড়ায়। সেখানে বেশির ভাগ স্টুডেন্ট গল্পতে মগ্ন! কাঁপা কাঁপা পায়ে ক্যাম্পাসের ভেতর যেতেই বেশ চিল্লাপাল্লা ও হট্টগোল শুনতে পায় সে। সবাই যে যার মতো গল্প মশগুল। সে একা কি করবে? ভেবেই ভারি অসহায় হয়ে পড়ে। এরই মাঝে তার চোখ যায় একটা ছেলের হাতে থাকা গিটারের দিকে। ছেলেটা সহ আরো কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছে সে।
–“সায়ান কোথায়? তোকে গিটার রাখতে বলে কোথায় হারিয়ে গেল?”
–“কি জানি! রাখতে বলে কোনো কাজ আছে বলেই ছুটে গেল।”
–“দেখ কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে। পারসোনাল কাজ হচ্ছে এটাই।”
–“তোরাও না আধপাগল! সায়ান আর গার্লফ্রেন্ড? ওর গার্লফ্রেন্ড তো এই গিটার। যেটা ছাড়া একটা কদমও চলে না।”
বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল একে ওপরের ওপর ছেলেদের দল। ঐশানী আগ্রহের সাথে গিটার টা দেখে নেয়। একেবারে কালো রঙের গিটার। যেন চকচক করছে। প্রতিনিয়ত যেন গিটার টা পরিষ্কার করা হয়। হঠাৎ করেই গিটার টা বেশ ভালো লাগল ঐশানীর কাছে। একটু মুচকি হেসে নিল। ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেই হাসি উধাও হয়ে গেল তার। ছেলেরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঢক গিলে ঝড়ের গতিতে সোজা স্ট্রেইট হেঁটে ক্যান্টিনের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। সূর্যের অতিরিক্ত তেজ! একটা ঠান্ডা কোক খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলে মন্দ হয় না। ঐশানী কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্যান্টিনে ঢুকল। দোকান থেকে একটা কোক কিনে নিয়ে এসে বসল খালি চেয়ার-টেবিলে। কোক খেতে খেতে ফোনের দিকে মনোযোগ দিল সে। বেশ কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করার পর একটা মেয়েলি কন্ঠে মাথা তুলে তাকায় ঐশানী।
–“এক্সকিউজ মি!”
–“ইয়েস?”
–“আমি কি টেবিল শেয়ার করতে পারি? আসল সব চেয়ার-টেবিল বুকড হয়ে গেছে। তোমাকে দেখলাম একা বসে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
মিষ্টি হেসে বলে মেয়েটা। এক পলকে মেয়েটাকে দেখে নেয় ঐশানী। উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের, টানা টানা চোখ, খাঁড়া নাক বিশিষ্ট ছিমছাম মেয়েটা। মেয়েটার জবাবে ঐশানীও সুন্দর হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“অবশ্যই বসে পড়ো। তাছাড়া আমি এখানে কাউকে চিনি না। নতুন হলে যা হয় আরকি!”
–“ওহ তুমি নতুন? নাম কি তোমার? কোন ইয়ার?”
–“ঐশানী। ঐশানী আমার নাম। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। আর ঢাকায় নতুন শিফট হয়েছি। তাই কলেজেও নতুন। আর তুমি?”
–“হোয়াট এ কোয়েন্সিডেন্স! আমিও ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এবার। আর আমার নাম সীঁথি।”
আরো গল্প হলো তাদের মাঝে। ক্লাসমেট হওয়ায় বন্ধুত্বটাও তৈরি হয়ে গেল খুব সহজেই। ঐশানীর যতটুকু অসহায় মনে হচ্ছিল ততটুকুও নিমিষেই কেটে গেল। সীঁথি ঘড়ি দেখে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল….
–“এই ক্লাস শুরু হবে। আজকে যেই স্যার প্রথমে ক্লাস নেবে সেই স্যার সময়মতো স্টুডেন্টদের না পেলে ক্ষেপে ওঠেন। তাড়াতাড়ি চলো।”
ঐশানীও দেরি না করে ফোন টেবিল থেকে নিয়ে উঠে পড়ল। দুজন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে ঘাড় ভরা মাঠের ওপর পিচঢালা হাঁটার জন্য সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকল। কিন্তু এরই মাঝে ঘটল একটা বিপত্তি! অদ্ভুতভাবে তাদের দুজনের সামনে পড়ে গেল একটা বড়সড় কৃত্রিম পেঙ্গুইন।
সীঁথি পেঙ্গুইনে হাত বুলিয়ে বলল….
–“রাস্তার মাঝে এটা কে রাখল?”
–“যেই রাখুক। কিউট না?”
হাসিমুখে পেঙ্গুইনটা দেখে বলল ঐশানী। ভালো করে পেঙ্গুইনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সীঁথি জোরেশোরে বলে ওঠে….
–“হেই ওয়েট! এই কলেজে অদ্ভুত জিনিস এমনি এমনি ঘটে না। এর পেছনে অনেকাংশে সিনিয়রদের হাত থাকে।”
ঐশানী সেসবের কাছে গিয়ে ফোনটা বের করে বলে….
–“এর মাঝে সিনিয়র রা আবার কি করবে? লেটস টেক এ সেল্ফি! কাম।”
সীঁথি ঠাঁই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐশানী মনের সুখে ছবি তুলে চলেছে। কেমন পোজ দিয়ে ছবি তুলবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না সে। একসময় ছবি তুলতে তুলতে নিজের ঠোঁটজোড়া সরু করে পেঙ্গুইনের কাছে নিয়ে যায় ঠিক সেই মূহুর্তে পেঙ্গুইন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা জীবন্ত মানুষ। তাও আবার একটা ছেলে। ছেলেটির ফর্সা মুখে বিরক্তির ছাপ। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।
–“আরে ইয়ার! এই আমাকে কোথায় ফাঁসিয়ে দিলি আমার দ্বারা এস…..”
কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তার থুঁতনির একটু ওপরে ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে ফ্রিজড হয়ে এলো সায়ান।
ঐশানী ঠোঁট সরু করে পেঙ্গুইন জড়িয়ে ছবি তুলতে নিলেই ফোনের ক্যামেরায় একটা ছেলেকে দেখে সেকেন্ডেই ধড়ফড়িয়ে ছিটকে আসে ঐশানী। চোখজোড়া কপালে উঠে যায় তার। ওপরকে সায়ানের চোখজোড়াও চরকগাছে পরিণত হয়েছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। সায়ান তো নড়তে চড়তেই ভুলতে বসেছে। জীবনে যা নয় তাই ঘটে গেল! আশেপাশের সকলে দৃশ্যটা দেখে হতবাক। বেশ দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ভিডিও করতে থাকা সায়ানের ফ্রেন্ডের দলের মুখ হা হয়ে গিয়েছে। যে ভিডিও করছিল তার হাত থেকে ফোন পড়ে গিয়েছে। সবাই বলাবলি করছে, ‘দ্যা গ্রেট গিটারিস্ট সায়ান শেখ! যে কিনা মেয়েদের থেকে একশ হাত দূরে থাকে সে আজ একটা মেয়ের চুমু খেয়ে হতবাক!’
–“আমি তোমাকে বলেছিলাম যে এটা কোনো চাল হতে পারে। তুমি কলেজে নতুন। তোমাকে জ্বালানোর চেষ্টা তো এরা করবেই করবে। কিন্তু সায়ান ভাইয়া এমন করেছে তা মানা যাচ্ছে না।”
ঐশানীর কোনো ধ্যানই নেই। তার কাঁধে হাত দিতেই নড়েচড়ে ওঠে ঐশানী। আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখে কি করবে ভেবে পায় না সে। চোখজোড়া খিঁচে দুটো হাত দিয়ে দুটো চোখ ঢেকে সায়ানের উদ্দেশ্যে এক নিশ্বাসে বলে ওঠে…..
–“আমি জানতাম না আপনি এর মধ্যে ছিলেন। আই এম সরি! আই এম রিয়েলি সরি! আমি বুঝতে পারিনি।”
বলেই দুটো পা যেদিকে যায় সেদিকেই ছুট লাগায় ঐশানী। ওকে এভাবে ছুটতে দেখে সীঁথিও তার পিছু নেই। জোরে চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে…..
–“দাঁড়াও ঐশানী। পড়ে যাবে তুমি।”
পেঙ্গুইনের ভেতর থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে নেমো আসে সায়ান। তার দুটো চোখ নিবদ্ধ সেই ছুট লাগানো মেয়ের দিকে। তার সরু চোখে চিকন চশমায় স্পষ্ট মেয়েটির রিফ্লেকশন পড়েছে। অস্ফুটস্বরে সে বলে ওঠে….
–“ঐশানী!”
থুঁতনি একটু ওপরে হাত রাখে সে। যেখানে ঐশানীর ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ পেয়েছিল সায়ান। সেখানে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি! তার বন্ধুদের দৌড়ে আসার শব্দে পকেটে এক হাত গুঁজে পেছন ফিরে চোখ গরম করে তাকায় সে। চোখেমুখে রাগি ভাব দেখে থতমত খায় সকলে। গম্ভীরতা ও রাগের সাথে বলে….
–“এই প্লানটা কার ছিল?”
দৃষ্টি নামিয়ে সকলে সকলের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে দিতে থাকে। সায়ান সূক্ষ্ম চাহনি নিয়ে মিরাজের(সায়ানের বন্ধু) দিকে তাকিয়ে বলে…..
–“ডেয়ার টা আমাকে তুই দিয়েছিলি না?”
–“হ…হ্যাঁ আমিই দিয়েছিলাম কি…কিন্তু এটা আমার প্লান ছিল না বিশ্বাস কর। এটা তো রাহিদের প্লান ছিল। ও আমাকে বলেছিল এই ডেয়ার তোকে দিতে।”
নাহিদের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই নাহিদ তুতলিয়ে বলে….
–“আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো জাস্ট ভেবেছিলাম নতুন মেয়েটা এসেছে। আমাদের ভালো করে চিনে রাখুক। আমি তো শুধু তোকে ভয় দেখাতে বলেছিলাম। আমি কি করে জানব ও তোকে চুমু টুমুর মতো ভয়ানক জিনিস দিয়ে বসবে?”
–“মেয়েটা কি তোর কথামতো কাজ করবে নাকি?”
ধমক দিয়ে বলে ওঠে সায়ান। নাহিদের জবান এতটুকুতেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সায়ান আবার আশপাশটা দেখে নেয় ঐশানীকে দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পায় না। শান্ত হয়ে মিরাজের কাছে গিয়ে গিটারের ব্যাগ নিজের পিঠে নিতেই ঘন্টা পড়ে যায়। সায়ান সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলে….
–“লেটস গো। ক্লাস শুরু হবে।”
সামনে দুই কদম যেতেই আবারও ঘাড় ঘুড়িয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে সায়ান বলে…..
–“যেই ভিডিওটা করেছিস ওটা ডিলেট করে দিবি। গট ইট?”
নাহিদ মাথা নাড়াতেই সকলের ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।
ক্লাসরুমে বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে ঐশানী। মনে মনে নিজেকে অজস্র গালি দিচ্ছে সে। তার পাশে বসে আছে সীঁথি। ঐশানীকে লজ্জায় মুখ তুলতে না দেখে সে বলে ওঠে…..
–“রিল্যাক্স ঐশানী। আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম সাবধানে থাকতে। কিন্তু সায়ান আজ নিজে মেয়েদের জ্বালাতন করতে লেগেছে ব্যাপারটা উইয়ার্ড।”
ঐশানী রেগে মুখ ফুলিয়ে মাথা তুলে ফোঁস ফোঁস করে বলে….
–“কেন? উনি এমন কোন ভদ্রলোক? আজ যদি উনি আমার সাথে এমন না করত তাহলে না হয় ভদ্রলোক ভাবতাম।”
–“সায়ান। যার ওপর চেহারার আগে তার গিটারের সুর ও গানের কন্ঠ শুনে লোকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়। চেহারার কথা বাদই দিলাম। এই কলেজে এখনো এমন কোনো গিটারিস্ট নেই যে সায়ানের চেয়ে সুন্দর গিটার বাজাতে পারে। তার গলার সুর শুনে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।”
এতটুকুই শুনে ঐশানীর বেশ আগ্রহ হয় সায়ানকে জানার জন্য। মনোরোগ দিয়ে শোনে সীঁথির বলা কথাগুলো।
–“যেই সায়ানের হাত অবধি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে ধরতে দেখা যায়নি সেই সায়ানকে আজ তুমি চুমু খেয়ে বসেছো। ভাবতে পারছো?”
সীঁথির কথায় একটু ঘাবড়ে ঢক গিলে ঐশানী। তার পর দম নিয়ে বলে….
–“দেখো ভয় দেখাবে না। আমি ভয় পাই না। দোষটা উনারই। তবুও আমি সরি বলেছি।”
সীঁথি মুচকি হেসে ক্লাসে মন দেয়।
ক্লাস শেষে অফিস রুমে ডেকে পাঠিয়েছে ঐশানীকে। ঐশানী সেদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু অফিস-রুম কোনটা ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। আশেপাশে কাকে জিজ্ঞেসা করবে তারও উপায় পাচ্ছে না। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত। এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে ঐশানী এসে পৌঁছায় একটা ফাঁকা ক্লাসরুমের সামনে। সেদিক দিয়ে যেতেই ভেসে আসে গিটারের সুর। জানালা একটু ফাঁক করে অতি আগ্রহ নিয়ে ভেতরে চোখ বুলায় ঐশানী। সেই ছেলেটাই গিটার বাজাচ্ছে! সায়ান। কত সুনিপুণ ভাবে গিটারে সুর তুলছে সে। চশমার ভেতরে থাকা চোখজোড়া সায়ানের বন্ধ। এক মনোমুগ্ধকর সুর! সেই সুরে বেশির ভাগ মেয়ে ছুটে এসে দাঁড়ায়। ছেলেদের মাঝেও কেউ কেউ আসে।
গিটারের তারে সুর তুলতে তুলতে একসময় চোখ খোলে সায়ান। বাঁকা চোখে চোখ বুলিয়ে নেয় ক্লাসরুমের বাইরের দিকে। শেষ প্রান্তের জানালার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ঐশানীকেও চোখ পড়ে তার। গিটার বাজানো থামিয়ে দেয় সায়ান। চশমা খুলে পকেটে ঝুলিয়ে গিটার একপাশে রেখে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে বাইরে। সকলে দেখে হকচকিয়ে ওঠে। ঐশানী ঢোক গিলে স্ট্রেইট হাঁটতে শুরু করে। এই ছেলের ঝামেলায় আর জড়াতে চায় না সে। কিন্তু সকলকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে সায়ান জোরে ডেকে ওঠে….
–“হেই গার্ল! ওয়েট।”
ঐশানী ভাবে হয়ত অন্য কাউকে ডাকছে। সায়ান তাকেই বা ডাকতে যাবে কেন? তাই সে হাঁটতে থাকে। সায়ান আবার ডাকে…..
–“মিস. ঐশানী….!!”
থমকে যায় ঐশানীর দুটো পা। বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। রোবটের মতো পিছন ফিরে তাকায়। সায়ান এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। এতটুকু অবধি ঠিক থাকলেও ঐশানীর মনে হলো সায়ান অতিরিক্ত কাছে আসছে তার। ভয়ে মাথা ঘুরে আসে ঐশানীর। একপা একপা করে পিছিয়ে যায় সে। ভয়াতুর কন্ঠে বলে….
–“দে…দেখুন দূর থে…থেকেই যা বলবেন বলুন।”
সায়ান কি অন্য কারো কথা শোনার ছেলে? এগিয়ে আসতে আসতে এক পর্যায়ে ঐশানীর অতিরিক্ত ভয় পেতে দেখে তার বাম হাতে থাকা এসাইনমেন্টের খাতাগুলো ঐশানীর সামনে তুলে ধরে। ঐশানী নির্বাক হয়ে তাকায়।
–“এটা আমার এসাইনমেন্ট। তুমি আমায় করে দেবে তাও দুই দিনের মধ্যে। গট ইট?”
ঐশানী রেগে একাকার। নাক ফুলিয়ে বলে…..
–“আমি কেন আপনার এসাইনমেন্ট করতে যাব?”
–“করবে কারণ এটা তোমার শাস্তি আমাকে কিস করার। টেক ইট।”
ঐশানীর হাতে খাতাগুলো ধরিয়ে দিয়ে পেছন ঘুরে চলে আসে সায়ান। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে সায়ানের গুষ্টি উদ্ধার করেন ফেলে ঐশানী।
চলবে……
[বি.দ্র. অতীতের ঘটনা শুরু হয়েছে যা শেষ হবে কালকে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]