বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ২৪
#আনিশা_সাবিহা
সকাল বেলা বিছানায় নিজের পাশে ঐশানীকে না পেয়ে দিনের আলো পেয়ে পিটপিট করে তাকায় অভয়। চোখ দুটো ডলে হালকা মাথা উঠিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে ঐশানী সত্যিই তার পাশে নেই। রাজ্যের আলস্য ঘিরে ধরে তাকে। মাথা বালিশে রেখে আবার চোখ বুঁজে ফেলে। রাতে ঘুম আসছিল না আর এখন ঘুমটা তাকে ছাড়ছে না। তবে তার শুয়ে থাকলেও চলবে না। অনেক কাজ আছে। হাই তুলে আস্তেধীরে উঠে বসে অভয়। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সবেমাত্র ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁইছুঁই। ভ্রুজোড়া কুঁচকে আসে তার। নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে ওঠে…..
–“বাবাহ! গ্রামে এসে ঐশানীর এতো উন্নতি? এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে কোথায় গেল মেয়েটা?”
বিছানা থেকে নেমে দুইহাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে মুখ মুছে ফোনটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। উঠানে সকলে বসে আছে। ইশানের মা মিসেস. রজনী মাটির চুলোয় রান্না করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে মিসেস. তনয়া বসে বসে তরকারি কেটে এগিয়ে দিচ্ছেন। অনিন্দিতা একপাশে বসে রান্নাবান্না দেখছেন। চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন রাহাত সাহেব এবং আয়েশা বেগম। সবাই থাকলেও ঐশানী নেই। ইশানও নেই। ইশানের না থাকা স্বাভাবিক। কারণ এটা ওর গ্রাম ও সবটা চেনে গ্রামের। আয়েশা বেগম তার নাতনিকে দেখে দূরন্ত কন্ঠে বলেন…..
–“উইঠা পড়েছিস? তোরা শহরে থেকে সব একেকটা আলসে হয়েছিস। ভোরে ঘুমই ভাঙে না তোদের।”
উত্তরে অভয় একটা হাসি দিয়ে আয়েশা বেগমের কাছে যায়। একটু নিচু হয়ে মিষ্টি করে জবাব দেয়…..
–“কোথায় এতো লেট করেছি? এখনো তো সাতটা বাজেই নি দাদিমা।”
–“আমাদের তো পাঁচটার দিকে ওঠার অভ্যেস। তা রাহাত বিদেশে থাকতে না তুই বলেছিলি তোর ছেলে একদম গম্ভীর হইয়া গেছে। হাসে না সহজে! কথা বলে না দরকার ছাড়া কথা কয় না। কই আমি তো এমন কিছু দেখলাম না আমার নাতির মধ্যে। সবসময় কত সুন্দর হাসে আমার সোনার টুকরা টা।”
–“আম্মা, তুমি জানো না! ও তো কয়েকদিন হয়েছে হাসিখুশি থাকে। আগে কুমিড়ের মতো মুখ করে থাকত। এই হলো মিষ্টি খাওয়ার লক্ষণ বুঝলে?”
রাহাত সাহেব হেসে হেসে বললেন। সবটা বুঝলেও শেষ কথাটা বুঝল না অভয়।
–“মিষ্টি খাওয়ার লক্ষণ মানে?”
–“মানে আবার বুঝাতে হবে? বিয়ে করা আর মিষ্টি খাওয়া তো একই। খেলেও পস্তাবি না খেলেও পস্তাবি। যেমন আমাকে দেখ। আমি পস্তাচ্ছি।”
সকলে হেসে ওঠেন অভয় ছাড়া। বাবার মুখে এমন কথা শুনে মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে তার। মিসেস. তনয়া কড়া চাহনি নিয়ে রাহাত সাহেবের দিকে তাকান। রাহাত সাহেব একটা বোকা হাসি দেন উত্তরে।
অভয় এগিয়ে এসে অনিন্দিতার পাশে বসে। ধীর গলায় বলে……
–“তোর ভাবি কোথায়? দেখছি না যে!”
–“হঠাৎ ভাবিকে চোখে হারাচ্ছিস যে? রিলাক্স ভাইয়া। ভাবি চুরি হয়ে যাবে না।”
বলেই ভ্রু নাচিয়ে শয়তানি হাসি দেয় অনিন্দিতা। তা দেখে চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে অভয় বলে….
–“এতো সকালে কোথায় গেছে ও? এই গ্রামের কিছু চেনে না জানে না!”
–“ভাবি এখানেই ছিল। এই গ্রামে নাকি ভোরের দৃশ্য অনেক সুন্দর হয়। তো আম্মুর কথায় আমি আর ভাবি বেরিয়ে পড়ি গ্রাম দেখতে। পথে অনেক ছোট ছোট বাচ্চার দেখা পাই জানিস? কত মিশুক তারা। তবে তাদের দেখে মনে হলো চাকমা সম্প্রদায়ের। ওদের সাথে মিশে গেলাম। আম্মু আবার ফোন করে ডাকলো তাই এলাম। ভাবি আসেনি। বাড়ির আশেপাশেই আছে নিশ্চয়।”
অভয় দম ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। গ্রামের পথ! সকালে রোদ কম থাকায় হালকা শীতল হাওয়ায় ঠান্ডায় লাগছে। এক হাত পকেটে গুঁজে অন্যহাতে ফোন চাপতে চাপতে কাউকে যেন ফোন দিল। ফোন কানে ধরে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকল সে। নম্বর বন্ধ পেয়ে অন্য কাউকে কল লাগায় অভয়। কিছুক্ষণ পরই কল রিসিভড হতেই সে বলল….
–“হ্যালো, ভাবি বলছেন?”
–“জ্বি কিন্তু আপনি কে?”
–“আমি অভয়। মেহেরাজের বন্ধু। চিনতে পারেন নি?”
চিকন সুরে জবাব দিল অভয়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো…..
–“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। অনেকদিন পর ফোন করলেন তো তাই চিনতে পারিনি।”
–“ইটস ওকে। মেহেরাজকে কল করছিলাম কিন্তু ওর বন্ধ পেলাম। ও কি আপনার সাথে আছে?”
–“না। ও তো নেই দেশে। ও লন্ডনে গেছে নিজের কিছু কাজে। বড় বড় ডক্টর দের সাথে মিটিং করবে। ব্যস্ত আছে অনেক। কোনো জরুরি দরকার? আমি ওর লন্ডনের নম্বর দেব?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবতে শুরু করে অভয়। ও কল করেছিল ওর ডক্টর বন্ধুকে। যাতে ঐশানীর নেওয়া ঔষুধ সম্পর্কে সে কথা বলতে পারে। জানতে পারে। কিন্তু তা আর হলো কই? ভাবা শেষে বলে ওঠে….
–“না তার দরকার নেই। ও দেশে কবে আসবে?”
–“এই সপ্তাহের মধ্যেই।”
–“আচ্ছা ধন্যবাদ ভাবি। এখন রাখি। ভালো থাকবেন।”
কান থেকে সরিয়ে কল কেটে দেয় অভয়। বড় নিশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকায় সে। তার দুচোখ চিন্তায় পরিপূর্ণ! সেই দুচোখ শুধু ঐশানীর চিন্তা দখল করে রেখেছে। মনে কতশত বাজে ভাবনা! শুধু সবটা জুড়েই ঐশানী। এমন কি হয়েছে ওর যেটা সে তার স্বামীর থেকেও লুকিয়ে রাখতে চায়?
একগুচ্ছ কদম ফুল নিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে পায়ের ধাপ ফেলছে ঐশানী। মুখ ভর্তি হাসি মাতিয়ে চলেছে পরিবেশ। তার গজদাঁত চকচক করছে। পেছনে কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তাদের মুখেও রাজ্যের হাসি। তাদের মধ্যে থেকে একজনকে ঐশানী বলে উঠল……
–“তোমার ভালো লেগেছে এই গ্রাম?”
ঐশানী থেমে তাদের দিকে ঘুরে তাকালো। স্বস্তির কন্ঠে বলল…..
–“অসম্ভব সুন্দর লেগেছে। যতটা এই গ্রাম সুন্দর ততটাই তোরা সুন্দর। তোদের কারণে এই গ্রামের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। আর এই কদমফুল দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
–“চলো তোমায় আরো জায়গায় নিয়ে যাই। ওদিকে একটা বিল আছে। ওই বিলে শাপলা ফুল আছে। আমি তোমাকে এনে দেব।”
বাচ্চারা কত নিষ্পাপ! তাদের মুখেই ফুটে ওঠে তাদের নিষ্পাপের ছাপ। তাদের কন্ঠ শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আপনা-আপনি হাসি আসে ঠোঁটের কোণে। হাসতে হাসতে হঠাৎ ঐশানীর মুখ কিছু একটা ভেবে গম্ভীর হয়ে যায়। তার চোখজোড়া মাটিতে স্থির থাকে। বাচ্চাদের হৈহল্লা শুনে একটু চমকে তাকায় সে। ওরা কে শাপলা ফুল ঐশানীকে এনে দেবে তা নিয়ে ঝগড়া করছে। তাদের মাঝে দুজনের মাথায় হাত রেখে ঐশানী একটু বকা দেওয়ার মতো করে বলে….
–“চুপ চুপ। আগে নিয়ে তো চল সেখানে। আমাকে ফুল কে এনে দেবে তা নিয়ে ঝগড়া পরে করবি তোরা।”
সবাই মাথা নাড়িয়ে সামনে সামনে হাঁটতে শুরু করে। ঐশানীও তাদের অনুসরণ করে। করতে করতে জঙ্গলের চিকন রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় উঠতেই অভয়কে চোখে পড়ে ঐশানীর। সঙ্গে সঙ্গে বড় বটগাছের পেছনে লুকিয়ে যায় সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, চোখটা ঈগলের মতো ছোট্ট করে অভয়কে কটাক্ষ করে নেয় সে। বিড়বিড়িয়ে বলে….
–“কালকে আমার নিশ্বাস আঁটকে দিয়েছিল। আর ওই নোসপিন কতটা হার্টলেস লোকের মতো করে পড়িয়ে দিল। সব মনে আছে। ঐশু কিছু কর। শোধ তো তোকে তুলতে হবে!”
ঐশানীকে লুকাতে দেখে ছোট ছেলেমেয়ে গুলোও এসে ভীড় জমায় গাছের আড়ালে। তাদের মাঝে একজন জিজ্ঞেস করে…..
–“ওই লোক টাকে এভাবে দেখছো কেন? ওকে চিনো?”
–“হাড়ে হাড়ে হাড়ে চিনি। ডাকাত একটা!”
সবাই আশ্চর্যের সাথে অভয়ের দিকে তাকায়। সবাই ফিসফাস করে আলোচনা করতে থাকে। তাদের ভাষ্যমতে, ডাকাতের পোশাকআশাক এতো ভদ্র হয় নাকি? কত সুন্দর ছেলে কিনা ডাকাত? সবাই বিস্ময়ের চোখে ঐশানীর দিকে তাকালো। ঐশানী হাত বাড়িয়ে বলল…..
–“তোদের মধ্যে কার কাছে যেন বাঁটুল আছে ইট বা পাথর ছুঁড়ে মারার! আমাকে দে।”
ছেলেমেয়ে গুলো একে ওপরের দিকে তাকিয়ে বাঁটুল ঐশানীর হাতে দেয়।
ঐশানী একটা ছোট্ট পাথর হাতে তুলে নেয়। হাতে সেটা ধরে ভাবতে থাকে, এটা ছুঁড়ে মারলে কও আহামরি মাথা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হওয়ার সম্ভবনা আছে? নাহ, এটা তো ছোট পাথর। মারলে বড়জোর মাথায় একটা আলু বের হতে পারে। মনে মনে সে ঠিক করে নেয় আজ অভয়ের মাথা আলু আলু করে তবেই ঐশানী দম নেবে। অভয় বেচারা তো আর জানে না যে তার সাথে কি হতে চলেছে! ঐশানী নিজের হাতের ছোট পাথর বাঁটুল দিয়ে তাক করে নেয়। বড় বড় দুটো নিশ্বাস মেরে সেটা ছেড়ে দেয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলে যায় হয়। অভয়ের সামনে হুট করেই কোথা থেকে যেন ইশান এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অভয়ের পরিবর্তে ইশানের কপালে লাগে সেই পাথর। সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে সে। অভয় হকচকিয়ে উঠে তাকায়। ইশানকে ধরে বলে…..
–“ঠিক আছিস তুই? এভাবে চিৎকারের কি হলো?”
–“আমি বোধহয় আর দুনিয়া দেখতে পাব না রে। আমার শেষ ইচ্ছা জেনে নে। আমি বিয়ে করব। সেটা আর হলো না রে। আমি শেষ। এই ছোট বান্দরগুলো(ছেলেমেয়ে) আমাকে নিহত করে ফেলল।”
অভয় সেসব কথা কানে না ঢুকিয়ে জঙ্গলের গাছগুলোর দিকে লক্ষ্য করে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছোট ছেলেমেয়ের সাথে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়া মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে পেছন দিক থেকে দেখলেও অভয়ের চিনতে এক বিন্দুও ভুল হলো না। কিন্তু সেখান থেকে চোখ সরিয়ে ইশানকে ভালো করে ধরল সে। ইশান বরাবরের মতোই ভুলভাল বকছে।
–“অভয়, আমি কি এখনও বেঁচে আছি? চারিদিকটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বিয়ে না করে মরব না রে। আমারে বাঁচা।”
–“শাট আপ, ইশান। সামান্য মাথায় লাগলে মানুষ মারা যায় না। বাড়ি চল মাথায় কপালে পানি দিতে হবে।”
ইশানকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে যায় অভয়।
বাড়িতে সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ইশানের ঘরের ওপর। অভয় বসে আছে ইশানের পাশে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। ছেলেটাকে কে এভাবে মারল? মিসেস. রজনী অস্থির হয়ে ছেলের কপালে বরফ ঠেকিয়ে ধরে আছেন। যদিও কোনো গুরুতর কান্ড হয়নি। তবে কপালে ডান সাইডে ফুলে আলুর মতোই হয়েছে। যেটা অভয়ের কপালে করতে চেয়েছিল ঐশানী সেটা ইশানের কপালে হয়েছে। মিসেস. তনয়া ইশানের কপাল ভালো করে দেখে বলেন…..
–“মনে হয় গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মজা করে কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।”
অভয় তা শুনে চুপ করে থাকে। ভীড়ের ফাঁকে ঐশানীকে ঘরে চোরের মতো ঢুকতে দেখতে পায় অভয়। তা দেখে অদ্ভুত হাসি হেসে অন্য দিকে তাকায় সে। ভীড়ের মাঝে ঢুকে ইশানকে দেখে আফসোস হয় ওর। বেচারা শুধু শুধুই তার আর অভয়ের মাঝে এসে নিজের কপাল পুড়ল! মিনমিন করে ঐশানী বলল…..
–“অনিন্দিতার থেকে শুনলাম ইশান ভাইয়ার কপালে নাকি কেউ পাথর ছুঁড়েছে।”
–“সে আর বলতে? এখন কথা হচ্ছে কে জিনিসটা ছুঁড়ল? ছোট ছেলেমেয়ে নাকি বড় কোনো ফাজিলের মহারানী টানি হবে?”
ঐশানীর চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। অভয় কি তাকে ইঙ্গিত করছে? ইতিমধ্যে ঘরে দৌড়ে হাতে মলমের প্যাকেট নিয়ে ঢুকে পড়ে অনিন্দিতা। তার চোখমুখের হাবভাব দেখে মনে হবে সকলের থেকে বেশি চিন্তা তার ইশানের জন্য। দ্রুত ইশানের পাশে বসে পড়ে সে। হাতে মলম নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে…..
–“খুব ব্যাথা করছে ইশান ভাইয়া?”
–“হ্যাঁ রে অনি। আমি তো ভেবেছিলাম আর দুনিয়াতেই নেই। পটল তুলতে চলে গেছি। ভাগ্যটা ভালো ছিল।”
–“যত্তসব আজেবাজে কথা! এসব যেন আমি আর না শুনি। মলম এনেছি। লাগিয়ে দিচ্ছি। ব্যাথা কমে যাবে।”
অনিন্দিতার কথাগুলো যেন অধিকারসুলভ লাগল ঐশানীর। মেয়েটা যেন ছটফট করছে ইশানের ব্যাথায়। শুধু ঐশানীরই কি এমনটা মনে হচ্ছে?ইশানের কপালে আলতো ছুঁইয়ে যত্নসহকারে মলম লাগিয়ে দিল অনিন্দিতা। ঐশানী অনিন্দিতার উত্তেজনা থেকে শুরু করে সকল অনুভূতি উপলব্ধ করে ওর দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে থাকল। কেন যেন তার মন বলছে, ইশানের প্রতি অনিন্দিতার কোনো অন্যরকম অনুভূতি আছে! যা মোটেও ভাইবোনের না। এক বিশেষ অনুভূতি!
ভরদুপুরে ভ্যাপসা গরমে অস্থির হয়ে পড়েছে সবাই। ঐশানী ফোন হাতে নিয়ে নেট না পাওয়ায় বিরক্তি নিয়ে ফোন ঝাঁকিয়ে চলেছে। গ্রামের দিকে নেটওয়ার্ক পাওয়া যেন বড়ই কষ্টের। ফোন ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হঠাৎ করেই কারো ভিডিও কল আসে। বিস্ময়ের চোখে দেখে ঐশানী নম্বরটি। ঠোঁট বাঁকিয়ে সে বলে…..
–“কত বছর পর ভিডিও কল দেওয়ার ইচ্ছে হলো মহারানীর। আমাকে চিনবে কিনা তার ঠিকঠিকানা নেই।”
বলেই ভিডিও কল রিসিভ করে সে। ওপাশে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে একটা হাসিমাখা মেয়ে। কল রিসিভ করতেই ওপাশের মেয়েটা বলে…..
–“কতদিন পর তোকে দেখছি। কেমন আছিস?”
–“কে আপনি মহারানী??”
না চেনার ভান করে ঐশানী। তা শুনে ওপর পাশের মেয়েটা ধমকে বলে ওঠে…..
–“মারব এক থাপ্পড়। আমি জানি তুই রাগ করেছিস। ইভেন রিনি, মেঘনা, দিয়া এরা সবাই আমার ওপর রেগে বম হয়ে আছে। কিন্তু তোরা তো জানিস বিয়ে হওয়ার পর এডজাস্টমেন্ট করতে কতটা সময় লাগে! তার ওপর বিদেশে এডজাস্ট করতে তো আরো বেশি সময় লাগে। তাই তোদের খোঁজ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এমন না যে তোদের আমি ভুলে গিয়েছি।”
ওপাশে যেই মেয়েটি কথা বলছে তার নাম ‘সীঁথি’। ঐশানীর বেস্টফ্রেন্ড। সিলেট থেকে যখন ঐশানী ঢাকায় গিয়েছিল এবং নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছিল তখন থেকেই ওদের পরিচয়। রিনি, মেঘনা, দিয়া এরা পরে বন্ধুত্ব করলেও প্রথম থেকেই সীঁথি এবং ঐশানীর বন্ধুত্ব অনেক গভীরে। কিন্তু হঠাৎ করেই সীঁথির বিয়ে হয়ে যায়। ও বিদেশে চলে যায়।
ঐশানী হেসে ভাব নিয়ে বলে…..
–“যাহ এবারের মতো মাফ।”
সীঁথিও হাসে। তাদের গল্প শুরু হয়। এসবের মাঝে হঠাৎ করেই সীঁথি বলে বসে….
–“তুই নাকি বিয়ে করেছিস?”
ঐশানী থমকে যায় সীঁথির এই প্রশ্নে। তারপর নিজেকে সামলে বলে….
–“হ্যাঁ। বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করেছি। বাবার জন্য বিয়েটা করতে হয়েছে।”
–“বিয়ে করে কেমন আছিস ঐশানী? ভালো আছিস? মানতে পেরেছিস নিজের বরকে?”
সীঁথির কথাগুলো অদ্ভুত শোনালেও তার মানেগুলো ঐশানী ঠিকই বুঝল।
–“মানে কি বলতে চাইছিস?”
–“আমি কি বলতে চাইছি তুই সেটা জানিস। রিনির কাছ থেকে শুনেছি তুই নাকি তোর বরকে ডিভোর্স দিতে চাস? ছেড়ে আসতে চাস তাকে?”
ঐশানী হালকা মাথা নাড়ায়। সাথে সাথে তেতে ওঠে সীঁথি।
–“কিন্তু কেন? এমনটা করে কি পাবি তুই? সবাই তো নিজের জীবনকে একটা সুযোগ দেয়। সবাই পারে নিজের জীবনকে নতুন করে শুরু করতে। তুই কেন পারিস না? অতিত তো অতিতই। সেটাকে না ঘাঁটালে নয়?”
–“সবার জীবনে একটা অতিত থাকে সীঁথি। সেটা নিয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। হয়ত কারোর অতিত মনে থাকে না। আবার কেউ ভুলতে পারে না। তুই ভালো করে জানিস আমার ব্যাপারে আর আমার ওই সমস্যাটার ব্যাপারে। তাও আমাকে সংসার করতে বলছিস?”
রোবটের মতো কথাগুলো বলে ফেলে ঐশানী। সীঁথির মুখটা বিষন্নতায় ভরে যায়।
–“তোর মতো অনেক মেয়ে সংসার করছে। তুই কেন পারবি না?”
–“তুই আমার অতিতের কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন বার বার? হ্যাঁ আমি জানি অনেকেই সংসার করে এভাবে। আমিও পারতাম যদি অতিত ভুলতে পারতাম।”
–“ভুলে যা। মনে রেখে কি হবে? অতিত ফিরবে না। অতিতকে মনে রেখে বর্তমান নষ্ট করিস না। আচ্ছা তোর বর তোকে ভালোবাসে?”
দরজায় শব্দ হওয়ায় নিজেদের কথা থামিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় ঐশানী।
চলবে……
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]