বুধবারের আহ্বান,পর্ব:৪

0
450

#বুধবারের_আহ্বান
.
নিকিতা রাত দু’টায় জঙ্গলের রাস্তা বরাবর হেঁটে চলেছে। তুহান নিকিতাকে অনুসরণ করতে করতে জঙ্গলের ভেতরে পা দিতেই মাথার পেছনে প্রচন্ড আঘাতে যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মাথার পেছনে উষ্ণ, আঠালো তরল কোনো পদার্থ অনুভব করলো সে। নিকিতা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে পিছন ফিরে তাকালো। তুহান নিকিতার দিকে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে বন্ধ হয়ে আসার ঠিক আগমুহূর্তে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো নিকিতার চোখ বন্ধ অথচ ঠোঁট দুপাশে প্রশস্ত হয়ে আছে। তার ঠোঁটজুড়ে অস্বাভাবিক একটা হাসি। আচমকা চোখ খুলে তাকালো নিকিতা। তার চোখের মণিদুটোতে নীলচে আলো জ্বলছে!
তুহান আর তাকিয়ে থাকতে পারলোনা। সব ঝাপসা হয়ে চোখে আঁধার নেমে এলো………..
.
.
পরদিন সকাল আটটায় তুহানের ঘুম ভাঙলো। তুহান জমিদার বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিকের তাদের ঘরটায় নিজেকে আবিষ্কার করলো। চোখ মেলে উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকালো। নিকিতা নেই পাশে। আচমকা তার গত রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। তার মাথায় আঘাত লেগেছিলো। মাথার পিছনে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরছিল। সে তড়িৎ গতিতে মাথার পেছনে হাত দিলো। কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই সেখানে। মাথার সে জায়গায় কয়েকবার হাত দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলো তুহান। ব্যাথার কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেলোনা। তুহান কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা! এটা কি কোনো স্বপ্ন ছিলো? এতোটা স্পষ্ট স্বপ্ন হতে পারে? স্বপ্ন হলে, নিকিতা কোথায় এখন? তুহান হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলো। তখনোই নিকিতা একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো।
“উঠে পড়েছো তুমি? আমি তোমাকেই ডাকতে আসছিলাম। দেখেছো, আজ আমি তাড়াতাড়ি উঠেছি। এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম৷ ফজরের নামাজের সময়ই ঘুম ভেঙেছে।” হাসিহাসি মুখে টেবিলের ওপর ট্রে থেকে নাস্তার প্লেট, গ্লাস নামিয়ে সাজাতে সাজাতে কথাগুলো বললো নিকিতা।
তুহান হতভম্ব চোখে নিকিতার দিকে তাকিয়ে আছে! নিকিতা তার ঘরেই আছে! তার মানে রাতের পুরোটুকুই তার স্বপ্ন ছিলো!
.
নিকিতা তুহানের পাশে বসলো। তুহান একদৃষ্টে নিকিতার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে দেখতে। খোঁপা করে চুলে গন্ধরাজ গুঁজে দিয়েছে। এবাড়ির সামনে গেটের ঠিক পাশেই একটা গন্ধরাজ গাছ আছে।
খোঁপাটা ধরে আলতো ছোঁয়া দিয়ে গোঁজা গন্ধরাজের অস্তিত্ব পুণরায় নিশ্চিত করে নিকিতা বললো, “শুনো, আমরা ঢাকায় ফিরে গিয়ে বারান্দার কোণায় একটা গন্ধরাজ গাছ লাগাবো। তুমি কিন্তু এনে দিবে আমায়।”
নিকিতা এখানে আসার পর থেকে কয়েকশ বার এই একটা কথা তুহানকে বলে ফেলেছে। তুহান নিকিতাকে একহাতে টেনে কোমর জড়িয়ে কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকালো। কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ পড়া, তাতেই সৌন্দর্য যেনো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে৷ আরো একদিন নিকিতাকে দেখে তুহানের এমন মনে হয়েছিলো। সেটা ছিলো তাদের বিয়ের রাতের পরেরদিন সকাল!
তুহানের হঠাত নিকিতার ঘাড়ের কিছুটা নিচের দিকে চোখ পড়তেই সেখানে একটা ক্ষত চোখে পড়লো। ছোট্ট কাটা ক্ষতের চতুর্দিক জুড়ে কালচে নীল হয়ে আছে। তুহান চট করে শাড়ি আঁচল হালকা সরিয়ে ক্ষতটা নিরীক্ষণ করতে গিয়ে আরও খানিকটা নিচে ঠিক তেমনি আরেকটা ক্ষত দেখতে পেলো। উত্তেজিত হয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠে বললো, “নিকিতা এখানে ব্যথা কখন পেলে? কিভাবে লাগলো এমন?”
নিকিতা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আঁচল টেনে ক্ষতদুটো ঢাকার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো।
“ও কিছুনা। এলার্জির দাগ!”
“এলার্জির দাগ এমন হয়?” সন্দেহ প্রকাশ করে বললো তুহান!
“আমার হয় এমন!”
“আগে তো হতে দেখিনি!”
“আগেও হয়েছে। তুমি খেয়াল করোনি!”
“ওহ। আচ্ছা। আমি অফিস থেকে ফিরতি পথে ওষুধ আনিয়ে দেবো এখন”
“তুমি জলদি হাতমুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নাও। খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি আরেকবার গরম করে আনছি!”
.
.
তুহান অফিসে যেতে যেতে গতরাতের স্বপ্নের কথা ভাবছে। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন কেনো দেখলো সে হঠাত? নিকিতাকে সে বেশিই সন্দেহ করছে। বুধবারের ইনসাইডেন্ট তার উপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। নিজের অপারগতার হীনমন্যতায় বারবার মনে হচ্ছে, নিকিতা হয়তো তার সাথে থাকতে চাচ্ছেনা! আবার এঅঞ্চল নিয়ে প্রচলিত সব কুসংস্কারের কারণেও তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তারজন্যই এমন সব স্বপ্ন দেখছে সে! সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার সময়ে মনে করে ওষুধ এনে নিকিতাকে দিলো তুহান।
.
কয়দিন পেরিয়ে গিয়েছে। তুহানের সাথে এ কয়দিনে নিকিতার সম্পর্কটার উন্নতিই হয়েছে। নিকিতার অস্বাভাবিকতাগুলো কমেছে। সেদিন আগে রাতে নিকিতা নিজেই তুহানের কাছে গিয়েছে; গতবারের মতো অদ্ভুত আচরণ করেনি। তুহানের মনে হয় নিকিতা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলো। কোনো স্বপ্ন নিয়ে হয়তো৷ সেই ভয়টা কেটে গিয়েছে নিশ্চয়ই। আজ বৃহস্পতিবার; তুহানের তাড়াতাড়ি ছুটি। বারোটার মধ্যেই অফিস শেষ। তুহান বাসায় ফিরার সময় কি মনে করে একবাক্স চকলেট নিলো। নিকিতা চকলেট খুব পছন্দ করে। বাচ্চাদের মতো দোকানে গেলেই দু’তিনটা চকলেট কিনবে!
.
.
গত কয়দিন থেকেই নিকিতার শরীরটা খারাপ লাগছে। সারাদিন তেমন কোনো কাজ করছেনা। তারপরেও ক্লান্তবোধ হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরতিছে। গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে বারবার। কোনো খাবার ঠিকমতো খেতেও পাচ্ছেনা। তুহান অফিসের কাজে কয়দিন এত ব্যস্ত ছিলো যে নিকিতা তার নিজের অসুস্থতার খবর দিয়ে তাকে চিন্তায় ফেলেনি।
.
আজ বিকালের দিকে তুহান ছাদের মেঝেতে বড় একটা মাদুর বিছিয়ে তার ওপর বসে আছে। নিকিতা তুহানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। তুহান চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
“আচ্ছা তুহান, আমাদের একটা মেয়ে থাকলে বেশ হতো না?”
হঠাৎ এমন কথায় তুহান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো! নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“তুমি কি বাচ্চা দত্তক নিতে চাচ্ছ?”
“না। আমি আমাদের মেয়ের কথা বলছি। আমাদের দুজনার একটা মেয়ে হলে দারুন হতোনা? আমার মতোন আরেকজন তোমার খেয়াল রাখতো?” হাসি হাসি মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো নিকিতা।
তুহান হতভম্ব চোখে নিকিতার দিকে তাকিয়ে আছে। নিকিতা কি মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভুগছে? প্রচন্ডভাবে অসহায় মনে হতে লাগলো তুহানের। কি বলবে বুঝতে পারলোনা।
নিকিতা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করে নিজেই বললো, “তুহান, মিরাকল বলেও তো কিছু হয়, তাইনা? মানে মেডিকেল সায়েন্সকে অতিক্রম করে অবিশ্বাস্য কতকিছুই তো ঘটে আমাদের চারপাশে।”
তুহান এবারেও কোনো কথা বললোনা। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে নিকিতার কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।
“তুহান তোমার আমার জীবনেও একটা মিরাকল ঘটেছে। আমি প্রেগনেন্ট। গত কয়দিন থেকেই শরীরটা খারাপ করায় আজ সকালে আমি মিনিকে দিয়ে প্রেগনেন্সি কিট কিনে আনিয়েছিলাম। টেস্ট পজিটিভ। আর এমাসে আমার পিরিয়ড ও হয়নি। পিরিয়ডের ডেট অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে।”
তুহান তাকিয়েই আছে৷ নিকিতা কি বলছে এসব সে বুঝতে পারছেনা৷ হাতে জোরে চিমটি কাটলো এটাও স্বপ্ন কি না নিরীক্ষণ করার জন্য। না স্বপ্ন না! তুহান খুশি হতেও পারছেনা৷ কিভাবে সম্ভব এমনটা!
তুহান নিকিতার হাত ধরে বললো, “নিকিতা এসব প্রেগন্যাসি কিটের রেজাল্ট বেশিরভাগ সময়ই সঠিক হয়না।”
“তাহলে তুমি ঢাকায় ফিরে চলো। আমার মন বলছে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হলেই বোঝা যাবে, আমি যা বলছি, তাই সত্যি!”
তুহান আপত্তি করলোনা। তার মনের এক কোণেও ক্ষীণ আশা বাসা বাঁধছে।
পরদিন সকালের বাসেই দুজনে ঢাকায় ফিরে এলো।
.
নিকিতার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঢাকাতেই থাকেন। ঢাকায় ফিরে তুহান বা নিকিতা কেউই নিকিতার এসব সন্দেহের কথাটা তাদের আর জানালোনা। নিকিতার আচরণে মনে হচ্ছে, সে পুরোপুরি নিশ্চিত সে প্রেগন্যান্ট। তুহান ঢাকায় ফিরেই গাইনোকোলজিস্ট এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলো। ডাঃ নাহার নায়লা নামকরা গাইনোকোলজিস্ট। তার সাথে দেখা করে নিকিতার ধারণার কথা বললো তুহান। এর আগেও ডাঃ নায়লার কাছে নিকিতা ও তুহান এসেছিলো। তিনিই বলেছেন তুহানের সমস্যার কথা। সব কথা শুনে ডাঃ নায়লা হাসলেন।
“মিস্টার তুহান চৌধুরী, আমি আপনাদের সকল টেস্ট ভালোভাবেই করিয়েছিলাম। একবার না, বেশ কয়েকবার করিয়েছিলাম। আমার রিপোর্ট কখনো ভুল হতে পারেনা!”
“জি ডাঃ নায়লা আপনার কথা আমি বুঝেছি। কিন্তু নিকিতা…”
এতটুকু বলতেই ডাঃ নায়লা বললেন, “আচ্ছা, তুহান আপনার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। আপনি বরং নিকিতার একটা আলট্রাসনো করিয়ে আনুন। আমি লিখে দিচ্ছি। তাহলেই তো পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যায়!”
.
.
ডাঃ নায়লার হাতে নিকিতার আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট। তিনি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছেন রিপোর্টের দিকে। রিপোর্টে স্পষ্ট নিকিতা একমাসের প্রেগন্যান্ট। একমাসে ভ্রূণের অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যাওয়ার কথা না। ডাঃ নায়লা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আল্ট্রাসনো রিপোর্টটা দেখছেন। তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না নিকিতা প্রেগন্যান্ট!
.
তুহান আজ একাই এসেছে রিপোর্ট নিয়ে ডাঃ নায়লার চেম্বারে। তুহানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে মলিন চেহারায় তাকিয়ে ডাঃ নায়লা বললেন, “মিস্টার তুহান, আমি জানিনা, এটা কিভাবে সম্ভব! আমি আপনার পরীক্ষাগুলো নিজে করিয়েছিলাম এবং আমি পুরোপুরি নিশ্চিত আপনি বাবা হতে পারবেন মা। কিন্তু নিকিতার আল্ট্রাসনো রিপোর্ট বলছে সে প্রেগন্যান্ট!”
তুহান যা শুনলো তা বুঝতে কিছুটা সময় নিলো। ডাঃ নায়লা ঠিক কি বোঝাতে চাচ্ছে তাকে! তুহান বেশিক্ষণ ভাবলোনা। এই মুহূর্তে তার কাছে এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে নিকিতা মা হতে চলেছে, আর সে বাবা!”
.
তুহান বাড়ি ফিরার সময়ের পুরোটাজুড়েই নানান কল্পনা করেই চললো। আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে শুভ একটা দিন। বাসায় ফিরতেই নিকিতা ছুটে এসে বললো, “কি বললো ডাক্তার? আমার মেয়ে হবে তাইতো?”
তুহান হালকা জড়িয়ে ধরে বললো, “মেয়ে হবে না ছেলে হবে তা তো এখনোও জানিনা! তবে আমাদের সন্তান হবে৷ আমাদের! হ্যাঁ, তোমার আর আমার! আমাদের” তুহানের চোখের কোণে হালকা জলের কোণা চিকচিক করে উঠলো।
নিকিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “ছেলে না, ছেলে না। আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। আমি জানি তো।”
তুহান নিকিতার এমন নিশ্চিত বিশ্বাসে কিছুটা বিস্মিত হলো। কিন্তু কিছু বললোনা। হালকা হেসে বললো, “আচ্ছা! তোমার ইচ্ছেই যেনো পূরণ হয়!”
.
চলবে………..
.
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_৪
জান্নাতুল মীম (নবনী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here