বিরহের নাম তুমি পর্ব-৯

0
438

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
২১.
রাতে খাওয়ার সময় সূচনা ডাইনিংরুমে আসেনি। জারিফ আর চাচি ডিনার করছিলেন। চাচা ডাইনিং-এ এসে সূচনাকে না দেখে একটু অবাক হন। আজ তাকে খেতেও ডাকেনি। আবার এখানেও নেই। তিনি চেয়ার টেনে বসতে বসতে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,’সূচনা কোথায়?’
‘কোথায় আবার থাকবে? নিজের ঘরেই।’ তেতোস্বরে বললেন চাচি।
‘ওকে খেতে ডাকোনি?’
‘ডেকে আনতে হবে কেন মহারাণীকে? সে জানে না আমরা কোন সময়ে খাই? পেটে খিদে থাকলে নিজেই আসবে।’
‘অদ্ভূত কথা বলছ তো! ডাকলে কি এমন ক্ষতি হতো?’
এ কথার কোনো উত্তর চাচি দিলেন না। চাচা নিজে গিয়েই সূচনার ঘরের দরজায় নক করে বলেন,’সূচনা শুনতেছিস? খেতে আসিস না কেন?’

চেয়ারে বসে পড়ছিল সূচনা। চাচার ডাক শুনতে পেয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সে ইচ্ছে করেই খেতে যায়নি। গালে জারিফের দেওয়া থাপ্পড়ের দাগ স্পষ্টভাবে ফুঁটে আছে। চাচা দেখে ফেললে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। ঝামেলা এড়াতেই সে খেতে যায়নি। সে তো কথাও বলতে পারে না যে, দরজার আড়াল থেকেই বলবে তার খিদে নেই। দরজা খুলছে না দেখে চাচা আবার নক করেন। জিজ্ঞেস করেন,’কী হলো? সূচনা?’

চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথায় ঘোমটা টেনে দিল সূচনা। গুটি গুটি পায়ে দরজা খুলে দিয়ে মাথা একদম নিচু করে রাখল যাতে গালে থাপ্পড়ের দাগ চাচার দৃষ্টিগোচর না হয়। চাচা জিজ্ঞেস করলেন,’কী করছিলি? পড়ছিলি?’
সূচনা মাথা ঝাঁকায়। চাচা বললেন,’আয়, খেয়ে তারপর পড়তে বসবি।’
চাচার দিকে না তাকিয়েই সূচনা ইশারায় বলল খাবে না। কিন্তু চাচা কোনো বারণই শুনলেন না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। নিজের পাশে বসিয়ে ভাত বেড়ে দিলেন। আড়চোখে জারিফ একবার তাকিয়ে আবার খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। খাবার গলা দিয়ে নামছে না সূচনার। অপমানে আর মার খেয়েই তো আজকাল পেট ভরে যায়। খাবার খাওয়ার জায়গা কই? ভেতরটা তিক্ত অনুভূতিতে গুলিয়ে আসে।
‘খাচ্ছিস না কেন? তোর শরীর ঠিক আছে তো?’ এই বলে চাচা সূচনার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে জর্জেট কাপড়ের ওড়নাটি মাথা থেকে পড়ে যায় সূচনার। সঙ্গে সঙ্গে ফরসা গালে লাল টকটকে হয়ে থাকা পাঁচ আঙুলের ছাপ যেন প্রজ্জ্বলিত শিখার মতো ফুঁটে ওঠে। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকেন চাচা। গালে হাত বুলিয়ে বলেন,’তোর গালে দাগ কীসের? কে মেরেছে তোকে?’
সূচনা চোরাচোখে জারিফের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন। চোখ ছলছল করছে। এদিকে চাচা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বারবার জিজ্ঞেস করছেন কে মেরেছে। কিন্তু সূচনা একদম নিরুত্তর রইল। চাচা কিন্তু ক্ষান্ত হয়নি। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,’আমায় বল সূচনা। তোকে কে মেরেছে এভাবে? এত বড়ো সাহস কার?’
ঠোঁট উল্টিয়ে সূচনা এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলে। জারিফ নিজে থেকেই বলল,’আমি মেরেছি।’
চাচা এবং চাচি দুজনেই অবাক হয়ে জারিফের দিকে তাকালো। চাচা বিস্মিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,’তুই মেরেছিস?’
জারিফ একবার সূচনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে জয়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে বলল,’ওকে আমার শার্ট আয়রন করতে বলেছিলাম। আয়রন করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল। আর শার্টটাও আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। তাই রাগ সামলাতে না পেরে মেরেছি।’

চাচা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। চিৎকার করে বলেন,’তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি জারিফ। সামান্য শার্ট পুড়ে যাওয়ায় তুই এমন অমানুষের মতো মেয়েটাকে মারবি? তুই মানুষ?’
জারিফ প্লেটের ভাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বাবার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। চাচি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললেন,’আচ্ছা ওর ভুল হয়ে গেছে। বাদ দাও এখন। ওরই বা কী কাণ্ডজ্ঞান? একটা শার্টও ঠিকমতো ইস্ত্রি করতে পারে না।’
চাচা এবার স্ত্রীর ওপর রেগে গিয়ে বলেন,’তোমার জন্যই ছেলেটা খারাপ হয়েছে। তুমি স্কুলের টিচার হয়েছ কী করে বলো তো? ন্যায়নীতি, আদর্শ কিছুই তো তোমার মাঝে নেই। সন্তানকে গড়ে তুলেছ বেপরোয়াভাবে। আর সূচনা কেন করবে এই বাড়ির কাজ? আমি কি ওকে এখানে কাজ করতে এনেছি? ওকে পড়াতে এনেছি। ও শুধু পড়বে, খাবে। ওকে দিয়ে কেন তোমরা কাজ করাবে?’
‘আশ্চর্য তো! তোমার ভাইঝিকে দিয়ে আমি সব কাজ করাই? আমি কাজ করি না?’
‘কত কাজ করো তা তো আমি জানি। উঠতে, বসতে তুমি মেয়েটাকে কথা শোনাও। আর তোমার গুণধর ছেলে তো সঙ্গে আছেই। ওর সাহস দেখে আমি অবাক হই! কীভাবে ও সূচনার গায়ে হাত তুলল? কোন অধিকারে?’

অধিকারের প্রসঙ্গ আসায় জারিফ যেন একটু নিভল। ক্রন্দনরত সূচনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চাচিও এবার রেগে গিয়ে বললেন,’তোমার আদরের ভাইঝিকে তুমি মাথায় তুলে নাচো বারণ করল কে? আমিই বরং আমার ছেলেকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাব।’
‘এখনই চলে যাও। দরজা খোলা রয়েছে তোমার জন্য।’
অপমানের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছেন চাচি। মুহূর্তেই তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ভাইঝির জন্য তোমার এত দরদ। আর নিজের স্ত্রী,বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছ।’
জারিফ এই পর্যায়ে তার মাকে থামিয়ে বলল,’মা থামো।’
বাবার উদ্দেশ্যে বলল,’আমি স্যরি আব্বু। আমার কাজটা করা ঠিক হয়নি। আর কখনো এমন হবে না।’
‘আমায় কেন স্যরি বলছিস? অন্যায় যার সাথে করেছিস তার কাছে মাফ চা।’
জারিফ সূচনার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলল,’স্যরি সূচনা।’
সূচনা কান্না করেই যাচ্ছে। তার কারণে বাড়িতে এত অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেকে অনেক বেশি ফেলনা বলে মনে হচ্ছে তার। রাতে আর কারোরই খাওয়া হলো না। চাচি রাগে হনহন করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন। সূচনার সামনে মাথা তুলে তাকাতেও লজ্জা লাগছে চাচার। তার অবর্তমানে সূচনার ওপর এমন অত্যাচারের দরুণ তিনি খুবই লজ্জিত। তিনি ঘরে যাওয়ার আগে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’কষ্ট পাস না রে মা। খুব শীঘ্রই আমি একটা ব্যবস্থা করতেছি। তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।’
চাচা চলে যাওয়ার পরে জারিফ নিজের রুমে চলে গেল। একা ডাইনিংরুমে কিছু্ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শুধু সূচনা।

পরেরদিন ভোর রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে সূচনার। মাথা ব্যথায় মাথা ভারী হয়ে রয়েছে। সেই সাথে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মাথা ব্যথা তো আছেই। ভোরে আর রান্নার জন্য উঠতে পারেনি। রাতে রাগের জের ধরে চাচিও সূচনাকে আর ডাকেনি। রাগের রেশ কমেনি চাচারও। সকালে না খেয়েই অফিসে চলে গেছেন। সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙে জারিফের। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে এসে লক্ষ করে সূচনার ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা। কলেজে যায়নি আজ? সে দ্বিধাগ্রস্ত মনে কিছু্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সংশয় দূর করে দরজায় নক করে,’সূচনা?’
বেশ কয়েকবার ডেকেও যখন কোনো সাড়াশব্দ পেল না তখন দরজায় জোরে জোরে করাঘাত করে। করাঘাতের শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছালেও বিছানা থেকে উঠে আসার ক্ষমতা নেই সূচনার। ওদিকে বিরতিহীনভাবে দরজায় বারবার করাঘাত করছে আর নাম ধরে ডাকছে জারিফ। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে বসে বসে একটু একটু করে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। নিভু নিভু চোখে দেখতে পায় জারিফকে।
‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?’ মৃদু ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল জারিফ। সূচনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে ফ্লোরে বসে পড়ে। হকচকিয়ে তাকিয়ে থাকে জারিফ। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,’কী হয়েছে তোর?’ উত্তরের অপেক্ষামাত্র না করে এক হাঁটু ভাঁজ করে নিজেও সূচনার পাশে বসে। সূচনার ঘোলাটে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে। শরীর কাঁপছে তিরতির করে। জারিফ তার কপালে হাত রাখে। আতঙ্কিতস্বরে বলে,’তোর শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!’
আর একটু সময় বিলম্ব না করে সূচনাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে পানি আনে। বালিশের ওপর বড়ো র‍্যাক্সিন রেখে সূচনার মাথায় পানি ঢেলে দেয়। বেশ অনেকখানি সময় নিয়ে সে সূচনার মাথায় পানি ঢেলে কিছুটা জ্বর কমাতে সক্ষম হয়। প্রীতির সাথে দেখা করার কথা ছিল। সূচনার অসুস্থতায় সেই প্ল্যান দিব্যি ভুলে বসেছে। এমনকি ডাক্তার ডাকতে যাওয়ার সময় ভুলবশত ফোনটাও নেয়নি। প্রীতি একের পর এক ফোন দিয়েই চলেছে।
.
ডাক্তার এসে সূচনাকে দেখে কেমন যেন বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় গালে লেগে থাকা থাপ্পড়ের দাগ। তিনি প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে জারিফের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেন,’পেশেন্ট আপনার কী হয়?’
এ প্রশ্ন করার কোনো কারণ খুঁজে পেল না জারিফ। ওদিকে প্রেশক্রিপশন লেখা শেষ হলে ডাক্তারও উত্তরের জন্য তাকিয়ে থাকে। চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে জারিফ উত্তর দিল,’আমার কাজিন হয়।’
‘একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলছি, কিছু মনে করবেন না। এভাবে মেয়েটাকে মেরেছে কে?’
নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রইল জারিফ। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ডাক্তার বলল,’যা হোক, এভাবে মারধর করা ঠিক নয়। খেয়াল রাখবেন। আর এই ওষুধগুলো এনে খাইয়ে দেবেন। কিছু ওষুধ খাওয়ার আগে এবং কয়েকটা খাওয়ার পরে। প্রেশক্রিপশনে লেখাই আছে।’
জারিফ হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়াল। ডাক্তার তার ভিজিট নিয়ে চলে যাওয়ার পর সে সূচনার পাশে বসে। গালের দিকে তাকিয়ে অনুশোচনার অগ্নিতে দগ্ধ হতে থাকে। সে সূচনার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী খাবি বল? আমি ওষুধ আনার সময় বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসব।’
জ্বরের ঘোরে চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না সূচনা। সব কথা আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছে। সে অচেতনের ন্যায় শুয়েই রইল। সূচনার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জারিফ আর ঘাটাল না। ওষুধ আনার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পেছনে প্রীতিকে দাঁড়ানো দেখতে পায়। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছে বেশ অনেকক্ষণ ধরেই এসেছে। জারিফকে অবাক হতে দেখা গেল না। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই জানতে চাইল,’কখন এসেছ?’
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,’বেশিক্ষণ হয়নি। ডাক্তার বের হলো আর আমি আসলাম। দরজা লক করা ছিল না বলে নক করিনি। তোমার ফোন কোথায়?’
প্রীতি বলার পরে তার ফোনের কথা মাথায় আসে। পকেট হাতড়ে ফোন খুঁজতে থাকে। পরক্ষণে মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,’ওহ, ফোন তো আমার রুমেই রয়েছে।’
‘তোমার রেসপন্সসিবিলি বলতে কি কিছুই নেই জারিফ? একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা তোমার। কোনো সমস্যাগত কারণে দেখা করতে পারছ না, ওকে ফাইন। সেটা তো একবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেই হয়ে যায় তাই না? ফোন তো দাও-ই নি, উলটো আমি এতবার কল দিচ্ছি কোনো রেসপন্স-ই নেই।’ করুণ শোনাল প্রীতির কথাগুলো। জারিফ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল,’আন্তরিকভাবে দুঃখিত প্রীতি। পরিস্থিতিই সেরকম ছিল না। আচ্ছা শোনো, তুমি একটু সূচনার কাছে বসো। আমি ওষুধ নিয়ে আসি আগে।’
ফাঁকা দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল প্রীতি। মাঝে মাঝে তার বড্ড অবাক লাগে, এই মানুষটাই তার জন্য একটা সময়ে পাগল ছিল? কত রকম পাগলামিই না করত! আর যখন প্রীতিও ভালোবাসি বলে ফেলল তখন কি জারিফের ভালোবাসা কমে গেল? নাকি প্রীতিই একটু বেশি বেশি ভাবছে? তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই জারিফ বাইরে চলে গেছে। প্রীতির কেন জানি মনে হলো, জারিফ তাকে গ্রাহ্যই করছে না। সে আপাতত এই টপিকটা ঝেড়ে ফেলে সূচনার পাশে গিয়ে বসে। আদুরে হাতে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার দৃষ্টিও যখন গালের দিকে আটকে যায়, তখন একইভাবে সেও চমকে তাকায়।
.
২২.
রেশমা বেগম ঘরে বসে জোরে হাঁক ডাকেন,’ভূমিকা? শুনতাছো? ঘরে আহো তো।’
রান্নার জন্য তরকারি কাটছিল তখন ভূমিকা। শাশুড়ির এমন জরুরী তলব শুনে তরকারি না কেটেই আগে শাশুড়ির ঘরে যায়। তিনি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ এমন রাগের কারণ বোধগম্য হচ্ছে না তার। আগ বাড়িয়ে কোনো প্রশ্নও করতে পারছে না। শাশুড়ি মৃদু চিৎকারেরস্বরে বললেন,’দিনদিন তোমার সাহস বাইড়া যাইতাছে তাই না? বাড়িতে আসতে না আসতেই বিষ ঢালা শুরু করছ। আমার সংসার ধ্বংস করতেই যে আসছ তা তো আমি আগেই জানতাম। আমার পোলারে কী কইছ তুমি?’
ভূমিকা নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার জানামতে রাসেলকে সে এমনকিছু বলেনি, যাতে তিনি রেগে যেতে পারেন। এমন কিছু কী, সে তো এই বাড়ির কিছুই রাসেলকে জানায় না। এমনকি শাশুড়ি যে বকাঝকা করেন, কথা শোনান সেগুলোও সে কখনো রাসেলকে বলে না। সেখানে শাশুড়ি এমন রেগে কেন যাবে? সে নির্বোধের মতো করেই বলল,’আমি তো কিছু বলিনি মা।’
‘একদম ন্যাকা সাজবা না আমার সামনে। ঐদিকে আমার পোলার কান ভাঙাও আর এইদিকে আমার সামনে সাধু সাজো। এত নাটক করো কেমনে?’
ভূমিকা হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে। শাশুড়ি ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেন,’তুমি রাসেলরে বলো নাই তুমি ওর কাছে যাইবা গা? আমি তোমারে জ্বালাই?’
‘আমি এমন কিছুই বলিনি মা।’ ভূমিকার স্বাভাবিক স্বীকারোক্তি। তিনি এবার জোরে ধমক দিয়ে বলেন,’আমার সামনে একদম মিথ্যা কথা বলবা না। তুমি কী বলতে পারো আর না বলতে পারো সব জানা আছে আমার। দুই মুইখ্যা সাপ তুমি!’

অপমান, অপবাদে চোখ ছলছল করে ওঠে ভূমিকার। রাসেল ঠিকমতো বুঝালেও শাশুড়ি বোধ হয় বিষয়টা ভালোভাবে নেননি। মনে মনে ঠিক করে রাসেলকে ফোন দিয়ে বলবে, সে আমেরিকা যাবে না!
__________
২৩.
ঘরের সামনে মনমরা হয়ে বসে রয়েছে জয়। মায়ের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। ভেতরটা ভেঙে-চূড়ে গুড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে একা করে চলে যাওয়াটা কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? মায়ের অভাববোধ তাকে একটু একটু করে ভেতর থেকে নিঃস্ব করে তুলছে। চাপা কষ্ট সে মনের মাঝেই চাপা দিয়ে রাখে। কারো সামনে প্রকাশ করে না। দিগন্ত ঘর থেকে বের হয়ে এসে জয়কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। সম্পর্কে সে জয়ের চাচাতো ভাই। ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছে। ধীরপায়ে সে এগিয়ে গিয়ে জয়ের পাশে বসে। কাঁধে হাত রেখে বলে,’কী ভাবছিস দা’ভাই?’
ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে জয়। অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের কোণা থেকে আগত অশ্রু আঙুলের ডগায় মুছে নেয়। স্মিত হেসে বলে,’কিছু না তো!’
‘কাকির কথা মনে পড়ছে?’
জয় মাথা নত করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। কান্নারা গলায় দলা পাঁকিয়ে যাচ্ছে বারংবার। ছলছল নয়নে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে ধরে আসা কণ্ঠস্বরে বলে,’উঁহু!’
দিগন্ত এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলল না। জয়কে স্বাভাবিক করতে বলল,’চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
‘না, রে। ভালো লাগছে না।’
‘বাড়িতে বসে থাকলে আরও ভালো লাগবে না। কষ্ট বেশি লাগবে।’
‘না। সূচনার কাছে যাব।’
‘সূচনা কে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল দিগন্ত। জয় বলল,’ফ্রেন্ড। ওর মাঝে এমনকিছু আছে, যা আমায় ভীষণভাবে টানে। ওর কোন জিনিসটা ভালো লাগে জানিস?’
‘কী?’
‘ওর নিরবতা। যতটা সময় আমি ওর সাথে থাকি, শুধু আমিই কথা বলি। আর ও নিরব হয়ে শোনে। আমার ভেতর এখন অনেক কথা জমে রয়েছে। এগুলো বলা দরকার। এমন কাউকে বলার দরকার যে কথার মাঝে কিছু বলবে না। যে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে আসবে না। শুধু আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে যাবে। আর তাকিয়ে থাকবে তার কাজলকালো নয়ন মেলে। এবং সেই মানুষটা, সেই মেয়েটা হচ্ছে সূচনা।’

দিগন্ত ভারি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। জয়ের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এমন খুব কম মানুষই জয়ের জীবনে আছে, যাদেরকে সে এতটা প্রায়োরিটি দেয়। তাদের প্রত্যেককেই দিগন্ত চেনে। তবে এই সূচনা মেয়েটার কথা আজই প্রথম জানতে পারল। কে এই মেয়ে? যে জয়ের এতটা কাছের! দিগন্ত উৎসুক হয়ে বলল,’আমি যদি যেতে চাই, আমায় নিয়ে যাবি?’
‘আজ না। অন্যদিন।’
উৎসাহ থাকলেও দিগন্ত জোর করল না। জয় বরং একাই যাক। মেয়েটার সাথে কথা বলে মন হালকা করুক। দিগন্ত হেসে বলল,’আচ্ছা।’

জয় দিগন্তের থেকে বিদায় নিয়ে এসে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলেজ ছুটিও হয়েছে। একে একে সব ছাত্র-ছাত্রীরা বের হয়েছে। তবে এদের কারো সাথেই সূচনা ছিল না। পুরো ক্যাম্পাস এখন ফাঁকা। সে আরও কিছু্ক্ষণ অপেক্ষা করে। এরপরও যখন দেখল, সূচনা আসছে না তখন বুঝতে পারে আজ কলেজে আসেনি। ফোন নাম্বারও নেওয়া হয়নি যে, যোগাযোগ করবে। তবে ওর চাচার বাড়ি তো চেনে। সূচনাকে দেখার জন্য,একটু কথা বলার জন্য সেও তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় অস্থির হয়ে আছে। তাই দুঃসাহসিক কাজ হিসেবে সে সত্যি সত্যিই সূচনার চাচার বাড়ির সামনে চলে যায়। ভেতরে গেলে সমস্যা হবে বিধায় সে বাড়ির সামনে কিছু্ক্ষণ পায়চারি করে। বাড়ির পাশেই একটা চায়ের দোকান আর মুদি দোকান রয়েছে। সে চায়ের দোকানে বসে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার জানা নেই, সূচনা আসবে নাকি, দেখা হবে নাকি; তবুও ক্ষীণ একটা আশায় সে অপেক্ষা করছে। ওদিকে সূচনার ঘরের থাইগ্লাসের জানালা ভেদ করে জারিফের দূরদৃষ্টি তীক্ষ্ণ নয়নে জয়কে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত, তাই প্রতিদিন গল্প দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সকলের মন্তব্য আশা করছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here