বিরহের নাম তুমি পর্ব-১০

0
495

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
২৪.
জানালার গ্লাস খুলে দিতেই কার্ণিশ দিয়ে এক ফালি মৃদু রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেই সঙ্গে তিরতির করা বাতাসও সঙ্গ দিতে চলে আসে। বিছানায় শুয়ে জ্বরে কুঁইকুঁই করতে থাকে সূচনা। জারিফ একবার সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এখান থেকেও সে জয়ের অস্থিরতা স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছে। জানালার গ্লাস লাগিয়ে দিয়ে সে বিছানায় সূচনার পাশে বসে। তার ডান হাতটি সূচনার কপালে রেখে তাপমাত্রা মেপে দেখে জ্বর এখনো খুব একটা কমেনি। তবে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে বোঝা যাচ্ছে জ্বর নেমে যাচ্ছে। সে আলতো করে গালে দাগের জায়গায় হাত রাখল। সরল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’খুব কষ্ট হচ্ছে তোর?’
সূচনা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। জারিফও আর কোনো প্রশ্ন করেনি। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। চাপা আর্তনাদ বন্ধ করে শান্ত হয় সূচনা। ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। আলমারি থেকে আরও একটা কম্বল বের করে জারিফ তার গায়ের ওপর চাপিয়ে দিল। তারপর দরজা ভেজিয়ে সে নিচে নেমে এলো। বাড়ির বাইরে বের হওয়ার পরও দেখতে পেল জয় এই বাড়িটির দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। জয়ের সামনে দিয়েই জারিফ সিগারেট কিনল একটা। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেটে টান দিল। সিগারেটের ধোঁয়া উপরের দিকে কুণ্ডলী পাঁকিয়ে পাঁকিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। জয় খেয়ালই করেনি একদম। জারিফ এবার কিছুটা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,’কী ভাই? এলাকায় নতুন নাকি?’
চকিতে ফিরে তাকায় জয়। জারিফকে চিনতে একটুও বেগ পেতে হয় না। তবে জারিফেরও এটা জানা নেই যে, জয় তাকে পূর্ব হতেই চেনে। জয় বিচলিত না হয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,’এই এলাকার তো নই। এমনিই এসেছি হাঁটতে।’
‘তা বেশ! কাউকে খুঁজছেন মনে হচ্ছে।’
‘না, কাউকে খুঁজছি না।’
‘হ্যাঁ,আপনি খুঁজছেন।’
জয় নিরব হয়ে থাকে। জারিফ কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করে,’সূচনার সাথে আপনার সম্পর্ক কতদিনের?’
জয় ভারী অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করল,’কীসের সম্পর্ক?’
‘নাদান বাচ্চার মতো ব্যবহার না করলেই কি নয়? একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে কী ধরণের সম্পর্ক হতে পারে?’
‘অনেক ধরণের সম্পর্কই হতে পারে।’
‘আপনার আর সূচনার মধ্যে সম্পর্কটা তাহলে কী?’
‘আপনি কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন? কে আপনি?’ জয় সব জানা সত্ত্বেও প্রশ্নটি করল যেন, জারিফ বুঝতে পারে জয় তাকে চেনে না। জারিফ ক্রুর হেসে প্রশ্ন করল,
‘আপনার কী মনে হয়?’
‘কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে ধারণা করা উচিত নয়।’
জয়ের এমন বাঁকা উত্তরে ভেতরে ভেতরে অপমানবোধ করল জারিফ। সে সিগারেটটি মাটিতে ফেলে দিলো। পা দিয়ে পিষে আগুন নিভিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়াল। দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে বলল,’সূচনার থেকে দূরে থাকবেন।’
‘আমি কিন্তু এখনো আপনার পরিচিয় পাইনি।’
‘আমার পরিচয়টা জরুরী নয়।’
‘তাহলে আপনার আদেশ মানতেও আমি বাধ্য নই।’
‘সীমা অতিক্রম করা কি ঠিক হবে?’
‘সীমার মাঝেই যাইনি এখনো। আমি তো একটা জিনিসই বুঝতে পারছি না, সূচনাকে নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন?’
‘সূচনাকে নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যথা আপনাকে নিয়ে। সূচনা ওর বাবা-মাকে ছেড়ে এখানে এসেছে পড়াশোনা করার জন্য। প্রেম করার জন্য নয়।’
‘আপনাকে কে বলল আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক?’
‘সবকিছু বলতে হবে? শুনুন, আমি চাই না আপনি সূচনার আশেপাশে থাকুন। ও সুন্দরী আমি জানি। এটাও জানি যে ওর পেছনে ছেলেরা ঘোরে শুধুমাত্র ওর অতিরিক্ত সৌন্দর্যের জন্যই। নয়তো বোবা জেনেও কে-ই বা চাইবে জীবনে জড়াতে? তাই আমি চাচ্ছি না, ও ওর লক্ষ্য থেকে সরে যাক। কোনো ছেলে ওর জীবনে এসে ওর জীবনটা এলোমেলো করে দিক এটাও আমি চাই না। আমি সহ্যও করব না এমনটা। কথাগুলো মাথায় রাখবেন।’

কথা শেষ করে জারিফ আর দাঁড়াল না। গটগট করে চলে গেল বাড়ির ভেতর। জয় ফাঁকা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বুকের মাঝখানটায় কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। এতগুলো কথার মাঝেও মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগছে। সূচনা কোথায়? সেখানে আর অপেক্ষা না করে বাড়িতে ফিরে আসে। কাউকে কিছু না বলেই বিছানার একপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। অসহ্য রকম যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর। হিম শীতল স্পর্শ দরকার। এই সময়টায় মায়ের অভাববোধ করছে সে ভীষণভাবে। তার চতুর্দিকে শুধু শূন্যতা হাহাকার করছে। মাথার রগ দপদপ করে কাঁপছে। চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু।

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার দিনের আলোকে গ্রাস করে ফেলেছে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো টিমটিম করে জ্বলছে। পাখিদের আনোগোনা নেই এখন আর কোথাও। টং দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল জয়। মন ভালো করার বৃথা চেষ্টা বলা চলে। বন্ধুরা নানান রকম কথা বলে তাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে দুটি নারীর নিকটে। একজন তার জন্মদাত্রী মা; যে কিছুদিন আগেই জয়কে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। আর দ্বিতীয়জন বাকহারা এক নারী, সূচনা! যার কণ্ঠে কোনো কথা নেই, তবে চোখভর্তি রয়েছে শব্দভাণ্ডার। বিধাতা তাকে মুখ দিয়ে কথা বলার ক্ষমতা না দিলেও চোখ দিয়ে কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন। যে কেউ যখন তখন হয়তো তার এই চোখের ভাষা বুঝবে না। চোখের ভাষা বুঝতে হলে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তার ভাসা ভাসা চোখ দুটি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। তবেই পড়তে পারা যাবে মনের কথাগুলো। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যায় জয়। সূচনাকে না দেখার আগ পর্যন্ত সে স্বস্তি পাবে না এ কথাই যেন তার মন বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
_____________
২৫.
রেশমা বেগমের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই রাসেলের ভিডিয়ো কলে কথা হয়েছে। তিনি ছেলের ওপর নারাজ এবং ক্ষিপ্ত। কথা বলেছে অনিচ্ছার সঙ্গেই। মায়ের এমন গুরুগম্ভীর ভাবসাব বুঝতেও সময় লাগেনি রাসেলের। সে ঠান্ডা মাথায় মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত বেঁধে গেছে। রেশমা বেগম রাগে হিসহিস করতে করতে বলেছেন,’আমারে একদম উলটা-পালটা কিছু বুঝাইতে আসবি না। জন্ম আমি তোরে দিছি নাকি তুই আমারে দিছস?’
রাসেল তৎক্ষণাৎ কোনো কথা বলেনি। মাকে একটু সময় দিয়েছে। তিনি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। শান্ত না হয়ে শাসিয়ে বললেন,’তোর বউরে নিয়া তুই চলে যাবি এই বাড়ি থেকে। আর কোনোদিন আমার বাড়িতে আইবি না। আইজ থেইকা আমার কোনো পোলা নাই।’
‘এসব তুমি কী বলছ মা? একটা ছোটো বিষয়কে তুমি টেনে-হিঁচড়ে বড়ো করছ।’
‘তুই কি বলতে চাস আমি অন্যায় কোনো কথা কইছি? যা কইছি সব ন্যায্য কথা কইছি। বউ পাইয়া এখন তো মারে সহ্য হইবই না। বউয়ের কথা এখন মধুর মতো আর মায়ের কথা বিষ!’
রাসেলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। এসব ভিত্তিহীন, অর্থহীন কথা বলার কোনো মানেই সে খুঁজে পাচ্ছে না। সে রেগে গেল না। রাগ দমন করে শান্তকণ্ঠে বলল,’তোমার সাথে ভূমিকাকে কেন গুলিয়ে ফেলছ মা? মায়ের সঙ্গে কি বউয়ের তুলনা হয়? মা তো মা-ই। তার মতো এই জগতে দ্বিতীয় কেউ আর হতে পারবে না। আর বউ সে তো তার নিজ স্থানে। নিজের বাবা-মা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে আমায় ভরসা করেই তো এসেছে।’
‘তুই কী বলতে চাইতাছোস? ওয় তোরে ভরসা কইরা এই বাড়িতে আসছে আর আমি ওরে অত্যাচার করি? ভরসা নষ্ট করি?’
‘তুমি নিজে নিজেই সব কথার অর্থ সাজিয়ে নিচ্ছ আর রেগে যাচ্ছ। মাথা ঠান্ডা করো আর শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো।’
‘তোর কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না।’
‘মা, আমি কিন্তু বলেছি ভূমির সাথে তুমিও এখানে চলে আসো। আমরা একসাথে থাকব।’
তিনি রাগে গমগম করে বলে উঠলেন,’আমি যামু ক্যান? আমার স্বামীর ভিটা খালি কইরা আমি বিদেশে গিয়া বইসা থাকুম? শোন, বউয়ের জন্য তোর দরদ। তুই বউরেই নিয়া যা। আমার কথা এত ভাবা লাগব না তোর।’
‘মা, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো।’
তিনি কিছু শুনলেন না আর। বুঝতেও চাইলেন না। মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিলেন। রাসেল কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

মাকে আর ফোনে না পেয়েই ভূমিকে এখন ফোন করেছে রাসেল। শোয়ার জন্য বিছানা ঝাড়ছিল ভূমি। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি মায়ের চেঁচিয়ে বলা সব কথাই তার কানে এসেছে। সে নির্বিকার, নিরব থাকে। ফোনের টোন বেজে উঠতেই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ঝাড়ু বিছানার নিচে রেখে ফোন রিসিভ করে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছ?’
‘ভালো। তুমি কেমন আছ?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। খেয়েছ রাতে?’
‘না, একটুপর খাব। তুমি খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা কি তোমাকে কিছু বলেছিল?’

সবসময়ের মতো এবারও ভূমি শাশুড়ির অন্যায় ব্যবহারগুলো চেপে গেল। বলল,’না তো! কী বলবে?’
রাসেল কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,’মায়ের যে কী হয়েছে! কোনো কথাই বুঝতে চায় না। কেমন খিটখিট করে।’
ভূমিকা কিছু বলল না। দু’পাশেই এখন নিরবতা বিরাজ করছে। ভূমিকা বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল। সাথে সাথে ভুরভুর করে বাতাস প্রবেশ করে। কপালের ওপর পড়ে থাকা কয়েকগাছি চুলকে এলোমেলো করে দেয়। ঝিঁঝিঁ পোঁকারা ডাকছে তাদের নিজেদের ভাষায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এই আওয়াজ রাসেলও শুনতে পায়। জিজ্ঞেস করে,’কোথায় তুমি?’
‘ঘরেই তো।’
‘জানালার কাছে?’
‘কী করে বুঝলে?’
রাসেল হেসে বলল,’ঝিঁঝিঁ পোঁকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।’
ভূমিকাও নিরবে হাসে। পরক্ষণেই শাশুড়ির বলা কথাগুলো মনে পড়তেই বিশুদ্ধ হাসিটুকু হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়। সে মনে মনে রাসেলকে কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়। কণ্ঠ খাদে ফেলে প্রশ্ন করে,’একটা কথা বলব?’
‘বলো। পারমিশন নেওয়ার কী আছে? বলে ফেলো।’
‘আমার মনে হয় আমেরিকা যাওয়া ঠিক হবে না।’ এতটুকু বলে ভূমিকা থামে। থমকে যায় রাসেলও। তবে কিছু বলল না। ভূমিকার পরবর্তী বলা কথার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ভূমিকা বলল,’আমি চলে গেলে মাকে কে দেখবে বলো? মায়ের দেখাশোনা করার জন্য হলেও আমার এখানে থাকাটা প্রয়োজন।’
‘কথা শেষ?’
ভূমি ঘাবড়ে যায়। রাসেল রাগ করেছে নাকি বোঝা যাচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বলে,’হুম।’
‘ভূমি তোমার কি মনে আছে বিয়ের আগে তুমি কী বলেছে?’
‘কী?’
‘যখন জানলে, আমি আমেরিকা থাকি। এখানেই চাকরী করি তখন তুমি কিন্তু বিয়েতে রাজি হতে চাওনি। কারণ ছিল তোমার প্রবাসী পছন্দ নয়। অনেকেই প্রবাসীদের বউদেরকে বাঁকা নজরে দেখে। প্রয়োজনে ডাল, ভাত খাবে তারপরও দিনশেষে দুজনে একসাথে থাকবে। এসব কথা বলেছিলে। মনে আছে?’
‘আছে। কিন্তু এখন এসব কথা বলছ কেন?’
‘বলছি তার কারণ আছে। তখন আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম, বিয়ের পর তোমায়ও আমার কাছে নিয়ে আসব। আমি আমার কথা রাখব।’
‘শুধু কথা দিয়েছিলে বলেই নিয়ে যেতে চাইছ?’
‘উঁহু! বিয়ের আগে মনে হয়েছিল, যদি বিয়ে হয় তাহলে অবশ্যই কথা রাখব। আর বিয়ের পর ভেবেছি ভালোবাসি তাই বউকে নিজের কাছে রাখব।’
ভূমিকা তৃপ্তির সঙ্গে নিরব হাসে। রাসেলের আদরমাখা এই ছোট্ট ছোট্ট কথাগুলোই যথেষ্ট যোজন যোজন দূর থেকেও ভূমিকাকে ভালো রাখতে। সে বলল,’তবুও!’
‘আর কোনো তবুও নেই। তোমাকে আমি আমার কাছেই নিয়ে আসব। মায়ের জন্য পার্মানেন্ট একটা কাজের মেয়ে রাখব। সে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আর রিদি তো কাছেই থাকে। মায়ের কোনো সমস্যা হবে না। একটা কথা বলো তো, তোমার মনে একটুও ভয়-ডর নেই?’

ভূমিকা ভ্রুঁ কুঁচকে হেসে প্রশ্ন করে,’কীসের ভয়?’
‘এইযে স্বামী বিদেশে থাকে। চারপাশে শত শত শ্বেতাঙ্গ মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়
যদি কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়? অথবা কারো পাল্লায় পড়ে যায়?’
‘না, একটুও ভয় করে না। কারণ আমি মানুষটাকে বিশ্বাস করি।’
‘কতটা?’
‘যতটা ভালোবাসি।’
‘আর আমি কতটা ভালোবাসি?’
‘তা আমি কী করে বলব?’
‘তুমি কেন বলতে পারবে না?’
‘কী আজব! আমি কী করে বলব?’
‘তুমি আমার বউ না? তাহলে তুমি না বলতে পারলে কে বলতে পারবে?’
‘পাগল হয়ে গেছে এই লোক!’
‘ওমা! সেটা তুমি আজ জানলে নাকি? পাগল তো আমি তোমায় দেখার পরই হয়ে গেছিলাম। তারপর আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন তোমার কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম। তারপর আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন তুমি লজ্জা পেয়েছিলে। আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন তুমি হেসেছিলে। আরও একবার খুশিতে পাগল হয়েছিলাম, যখন তুমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলে। আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন তুমি বউ হয়ে আমার বাড়ি এসেছিলে। আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন বাসরঘরে তোমায় দেখলাম। আরও একবার পাগল হয়েছিলাম, যখন তোমায় একান্তভাবে কাছে পেয়েছিলাম। আরও এক…’
ভূমিকা তড়িঘড়ি করে থামিয়ে দিয়ে বলল,’হয়েছে, হয়েছে! আর কিছু বলতে হবে না। তোমায় পাগল বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
‘ভুল কেন হবে? যা সত্যি তাই তো বলছিলাম।’
‘হয়েছে তো। আর বলতে হবে না।’ একটু থেমে ভূমি প্রশ্ন করল,’আমি আহামরি কোনো সুন্দর তো নই। বলতে গেলে একদমই শ্রী নেই আমার। তবুও কেন আমায় বিয়ে করার জন্য এত উতলা হয়ে পড়েছিলে?’
‘আমার তো শ্রীযুক্ত বউ চাইনি। শ্রীযুক্ত বউ চাইলে হয়তো তোমায় বিয়ে না করে সূচনাকে বিয়ে করতাম। আমার দেখা বাঙালি সুন্দর মেয়েদের মধ্যে সেরা সুন্দরী সূচনা। ওর প্রসংশা করছি বলে আর রাগ কোরো না। যেটা সত্যি সেটাই বললাম শুধু। এছাড়া আমি কিন্তু ওকে রিদির মতো বোনের চোখে দেখি। রিদিকে যেমন ভালোবাসি ওকেও একই রকম ভালোবাসিনি। তাই মনে কোনো সংশয় এনো না। তো যা বলছিলাম, আমি সুন্দরী বউ কখনোই চাইনি। তোমায় বিয়ে করার বিশেষ কোনো কারণ আদতে আমার জানা নেই। লাভ এট ফার্স্ট সাইড বলতে কিছু হয় নাকি তাও জানা নেই। তবে তোমায় দেখার পর আমার অনুভূতি ঠিক লাভ এট ফার্স্ট সাইডের মতোই ছিল। তুমি সৌন্দর্যের উপমা নও তবে তুমি মায়াময়ী সুন্দর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সকল মায়া আল্লাহ্ তায়ালা তোমাকে দান করেছেন।’
ভূমিকা বাক্যহীন। বাঁধনহারা পাখির মতো সে উড়ছে। এক টুকরো স্বর্গীয় সুখ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। বুকের ভেতর প্রেমের শীতল হাওয়া বইছে। চোখ বন্ধ করে সে দূর-দূরান্তে থাকা মানুষটিকে অনুভব করছে। ভীষণ ভালোবাসে সে সেই মানুষটাকে। ভীষণ!
____________
২৬.
দু’দিনের দিন সূচনা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। হয়তো আরও কিছুদিন তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হতো। কিন্তু চাচা সেই রিস্ক নেননি। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ্’র রহমতে এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। খাওয়ার সময়ে চাচা সূচনাকে জিজ্ঞেস করলেন,’বই-খাতা, জামা-কাপড় সব গুছিয়েছিস মা?’
সূচনা উপর-নিচ মাথা নাড়ল। অবাক হয়ে তাকালো চাচি এবং জারিফ। চাচিই জানতে চাইলেন,’সবকিছু গোছাবে কেন?’
‘এখন থেকে সূচনা হোস্টেলে থাকবে।’ খেতে খেতে উত্তর দিলেন চাচা। চাচি এরপর আর কিছু বলেননি। বরং মনে মনে তিনি কিছুটা খুশি। তবে জারিফ বিষয়টা কেন জানি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না।সে বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,’কেন? আমাদের বাড়িতে সমস্যা কী?’
‘সমস্যার কী শেষ আছে? তোমার মা মেয়েটাকে দিয়ে কাজের লোকের মতো খাটাবে। তুমি যখন, তখন মারধোর করে জ্বর আনাবে এসব আমি সহ্য করব?’
চাচি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। চাচা সেই দৃষ্টি থোড়াই পরোয়া করে বললেন,’এসব আর হবে না।’
মনে মনে তিনি ভীষণ খুশি। এই নরক থেকে অন্তত এবার মেয়েটা মুক্তি পাবে। কলেজের কাছেই মেয়েদের একটা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। রাতে এসে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,’চাচাকে ভুল বুঝিস না মা। জারিফ আর তোর চাচি যদি এমন ব্যবহার না করত, তোকে মেনে নিত তাহলে কখনোই আমি তোকে হোস্টেলে থাকতে দিতাম না। ঢাকায় আমার বাড়ি থাকতেও তুই হোটেলে থাকবি। এতে তোর যতটা না কষ্ট হচ্ছে তারচেয়ে আমার অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে রে মা। আমি ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন অফিস আর কাজ নিয়েই আমায় ব্যস্ত থাকতে হয়। কখন ঐ অমানুষ দুটো তোকে বাড়িতে মেরে রেখে দেবে আমি হয়তো টেরও পাব না। তোকে চোখে চোখে রাখাও তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এজন্যই আমি চাচ্ছি তুই হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা কর। নিজের স্বপ্ন পূরণ কর।’
সূচনার কথা বলার ভাষা নেই। সে যেন তখন আরও বেশি বাক্যহারা হয়ে যাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে বাবা সমতূল্য বড়ো চাচাকে জড়িয়ে ধরেছিল শুধু। বাবার পর এই একটা পুরুষই তার বিশ্বাস, ভরসার সর্বস্বজুড়ে। যাকে সে বাবার চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না। পিতৃস্নেহে চাচা সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন।

জারিফের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেছে। কেন এমন প্রতিক্রিয়া তা ঠিক জানা নেই। হতে পারে বাবার অপমানসুলভ কথাবার্তার দরুণ কিংবা সে সূচনার চলে যাওয়াটা মানতে পারছে না ঠিক। তবে সেখানে সে কিছু বলতেও পারল না। বলারই বা কী আছে তার? কিছুই নেই। বরং সেও তার মায়ের মতো মুক্ত। আর তাকে প্রতিদিন সূচনাকে কলেজে দিয়ে আসতে হবে না, নিয়ে আসতে হবে না। এখন থেকে সে আগের মতোই বিন্দাস থাকবে।
.
চাচা হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা মহিলাটিকে সূচনার সম্পর্কে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। এমনকি ওর প্রতি এক্সট্রা কেয়ার রাখার জন্য মাস শেষে তিনি ঐ মহিলাকে টাকাও দেবেন। মহিলাকে এও বলে দিলেন, সূচনার রুমমেটরা যেন সূচনার সাথে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার না করে। সে যেন সবদিক খেয়াল রাখে।
যাবার পূর্বে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’সাবধানে থাকবি মা। তোকে কেউ কিছু বললে চুপ করে থাকবি না। সঙ্গে সঙ্গে আমায় টেক্সট করে জানাবি। খাওয়া-দাওয়া করবি ঠিকমতো। কলেজ আর হোস্টেলের খরচ নিয়ে তোকে কিছু ভাবতে হবে না। সব আমি দেখে নেব। অফিস ছুটির পথে প্রতিদিন এসে তোর সাথে দেখা করে যাব। কেমন?’

সূচনার ভীষণ কান্না কান্না পাচ্ছিল। সে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করে চাচার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চোখ ছলছল করে ওঠে চাচারও। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’পাগলী মেয়ে! কাঁদছিস কেন তুই? চাচা আছি তো।’
সূচনার জানা নেই, তার চাচার মতো এত ভালো চাচা দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টা আছে নাকি। তার দেখা সেরা ব্যক্তি বাবা এবং বড়ো চাচা। ভালোবাসার আরেক নাম এই দুটি পুরুষ এখনও পর্যন্ত আছে।
চাচা চলে যাওয়ার পর সূচনা মহিলাটির সঙ্গে নিজের রুমে যায়। উনার নাম পারভীন শেখ। তিনি রুমে নিয়ে এসে বললেন,’এখন কেউ নেই। সব আসবে দুপুরের পর। তখন সবার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো। এখন তুমি রেস্ট নাও।’
এরপর একটা কার্ড সূচনাকে দিয়ে বললেন,’কোনো সমস্যা হলে এই নাম্বারে ফোন দেবে। আমি চলে আসব।’
সূচনা সায় দিল। তিনি চলে যাওয়ার পর নিজের বিছানাটি পরিপাটি করে গুছিয়ে নিল। জামা-কাপড়গুলো আপাতত ব্যাগেই রাখল। চৌকির পাশে পড়ার টেবিল রয়েছে। নিজের বইখাতাগুলোও সে গুছিয়ে নিল। হাত-মুখ ধুয়ে এসে চুপটি করে বসে রইল বিছানায়। হোস্টেলে আসার কথা এখন পর্যন্ত বাইরের কেউই জানেনা। ভূমিকাকেও বলেনি। দেখা হলে তারপর বলবে। জয়ের কথা মনে পড়ছে। কেমন আছে সে? চাচা তো আজ কলেজে যেতেও বারণ করেছে। জয় যদি কলেজে গিয়ে অপেক্ষা করে? বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে যায়। ঠিক করে ছুটির সময় হলে সেও কলেজের সামনে যাবে। মাঝখানের সময়টুকু সে ঘুমিয়েই পার করে দেয়।

ঘুম ভাঙে কলেজ ছুটি হওয়ার ত্রিশ মিনিট আগেই। চাচার বাসা থেকে আসার সময়ে বাসায় পরে থাকা জামা পরেই এসেছিল। শুধু জামার ওপর বোরকা চাপিয়েছিল তখন। সে ব্যাগ থেকে থ্রি-পিস বের করে। জামা এবং সালোয়ার মেরুন রঙের। ওড়না সাদা কালার। সে ঝটপট গোসল সেরে নেয়। রেডি হতে হতে ১৫ মিনিট শেষ। হোস্টেলে কলেজের একদম পাশেই। হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। সূচনা হেঁটেই গেল। পাম্পের সামনে গিয়েই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। হাসিটা আরও বিস্তৃত হয় যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটিও এদিকে তাকায়। দুজনই দুজনের দিকে এগিয়ে যায়। জয়কে ভীষণ ব্যাকুল দেখাচ্ছিল। সূচনার ভাসা ভাসা চোখ দুটি যেন এতক্ষণে তৃপ্তি পেয়েছে জয়কে দেখে। ব্যাকুলতার সঙ্গেই জয় জিজ্ঞেস করল,’তুমি হুটহাট এমন উধাও হয়ে যাও কেন?’
‘তুমি’ শব্দটা সূচনাকে ভেতর থেকে নাড়া দিলো। জয় আজই প্রথম তাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছে। বেখেয়ালে বোধ হয়! জয় অস্থির হয়ে বলল,’জানো, তোমায় দেখার জন্য তোমার চাচার বাড়ির সামনেও গিয়েছিলাম। কলেজে না আসো; মানুষ তো একটু বাড়ির বারান্দায় কিংবা ছাদে যায়।’ জারিফের সাথে দেখা হওয়া এবং কথার বিষয়টা ইচ্ছে করেই চেপে গেল জয়। সূচনা শুধু অবাক হয়ে সামনের মানুষটিকে দেখছে। এত অস্থির কেন হয়ে পড়ছে মানুষটা?
জয় সূচনার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজের নাম্বার তুলে ডায়াল করল। দুজনের ফোনেই নাম্বার সেইভ করে বলল,’যাক! এখন আর কোনো প্যারা নেই। আচ্ছা তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’
সূচনা করুণচোখে তাকায়। আজ তো তার কাছে খাতা কিংবা কলম নেই। সে কী করে বোঝাবে? জয়ও যেন বিষয়টা বুঝতে পারল। বলল,’আচ্ছা থাক। এখন কিছু বলতে হবে না। তুমি ফ্রি নাকি তাই বলো।’
সূচনা উপর-নিচ মাথা নাড়ল। যার অর্থ ‘হ্যাঁ’।
‘বেশ। তাহলে চলো রিকশা দিয়ে ঘুরি আজ।’
সূচনা প্রফুল্লিত হয়ে এবারও মাথা নাড়ল। দুজনে একটা হুড খোলা রিকশায় উঠে বসল। বাতাসে সূচনার চুলগুলো উড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে চুল সামলানোর চেষ্টা করছে সে। জয় খেয়াল করে বলল,’আহা! ওভাবে আটকে রাখছ কেন? উড়তে দাও।’
জয়ের কথা মোতাবেক চুলগুলো সে হাত থেকে মুক্ত করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের সঙ্গে হৈহৈ করে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলেছে দীঘল কালো চুলগুলো। জয় আড়চোখে তাকায়। নিস্তেজস্বরে বলে,’তুমি ড্রাগস সূচনা!’
সূচনা বিস্মিত নয়নে তাকায়। পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
জয় বলল,’এই কয়টা দিন তোমায় দেখতে না পেয়ে ভীষণ একা একা লাগছিল আমার। মা আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, আমি কোথাও শান্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু কেন যেন, তোমার কাছে আসলেই আমার শান্তি মিলে। এমনটা কেন হয় বলো তো?’
সূচনা নিরবে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় এবার সে জয়ের দিকে তাকাল। জয় বলল,’তুমি কি জানো? তুমি আমার ভালো থাকার মেডিসিন, তুমি আমার অনুভূতির নাম, তুমি আমার নেশা।’
সূচনা আঁৎকে ওঠে। জয়ের কথাগুলো মনের মাঝে অজানা এক অনুভূতি সৃষ্টি করে। জয়ও কি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? কিন্তু! দুজনের মাঝে একটা যে বাঁধা, দেয়াল থেকেই যায়। ধর্মের দেয়াল পেরিয়ে ভালোবাসা পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। কিছুদিন পর আমার পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার পরও গল্প দেওয়ার চেষ্টা করি। অথচ কয়েকজন ব্যতীত বাকিরা একটা মন্তব্য করতে কার্পণ্য করেন। গল্প না দিলে তখন আবার আপনারাই চওড়া হন আগে। এগুলো কোনো কথা হলো? আজকের পর্ব পড়ার পর মনে প্রশ্ন জাগছে না? কার মনে কী প্রশ্ন আছে বলে ফেলুন শুনি। অথবা কার মন কী বলছে বলুন, শুনব।
হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here