#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
১৮.
অফিসে এসেই লিন্ডার মুখোমুখি হতে হয় রাসেলকে। রাসেল এড়িয়ে যেতে চাইলেও পথরোধ করে দাঁড়ায় লিন্ডা। অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে, কণ্ঠস্বর খাদে ফেলে বলে,’স্যরি।’
এক মুহূর্ত নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাসেল বলে,’তুমি যা করেছ তারপর স্যরি বললেই সব সমাধান?’
‘কী করলে তুমি মাফ করবে বলো? আমি তাই করব।’
‘কিচ্ছু করতে হবে না তোমায়।’
‘তাহলে বলো আমায় মাফ করেছ।’
‘লিন্ডা আমার লেট হয়ে যাচ্ছে। পথ ছাড়ো।’
‘আগে বলো আমায় ক্ষমা করেছ।’
‘আমি কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না এখানে। সরে দাঁড়াও।’
‘তুমি বুঝতে কেন চাচ্ছ না? তুমি আমায় ক্ষমা না করলে আমি শান্তি পাব না।’
‘সেদিন এই কথাগুলো মনে ছিল না?’
‘আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি রাসেল। এজন্য আমি খুব-ই অনুতপ্ত। আর কখনও আমার দ্বারা এমন কিছু হবে না। প্রমিস।’
‘সেই সুযোগটাই তো তোমায় আর কখনো দেবো না।’
‘শেষবারের মতো বিশ্বাস করে দেখো প্লিজ!’
রাসেল বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এক তো লিন্ডাকে তার সহ্যই হচ্ছে না। আর দ্বিতীয়ত তার সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে। লিন্ডা যেভাবে গোঁৎ ধরে বসে আছে,মনে হয় না এত সহজে পথ ছাড়বে। রাসেল ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কপালের মাঝ বরাবর চুলকে একটুখানি ভাবুক হয়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা লাঞ্চ টাইমে এই টপিকটা নিয়ে কথা বলব।’
রাসেলের প্রস্তাবে লিন্ডা রাজি হয় এবং পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে রাসেল।
_________
১৯.
জয়কে মন্দিরে দেখার পর থেকে সবকিছু উলট-পালট লাগছে সূচনার। সে কিছুতেই কোনো সমীকরণ মেলাতে পারছে না। জয় কি তবে হিন্দু? নাকি সে এমনিতেই কোনো কারণবশত মন্দিরে গিয়েছিল? এমন কী-ই বা কারণ থাকতে পারে যার কারণে মুসলিম হয়েও জয় মন্দিরে যাবে। আর যদি কোনো কারণ না থাকে তাহলে সোজা উত্তরে যা বের হয়ে আসে তা হচ্ছে জয় হিন্দু! এই শব্দটাই সূচনাকে অনেক বেশি পীড়া দিচ্ছে। মানতে একটু হলেও খারাপ লাগছে। অসহ্যকর যন্ত্রণাও হচ্ছিল।
কোনোকিছুতে বুঝতে না পেরে দপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। সযত্নে তুলে রাখা ডায়েরিটি বের করে কভার পেইজে হাত বুলায়। অনেক স্মৃতির কথা তুলে রাখা হয়েছে এই ডায়েরিতে। ডায়েরিটাও তার নিকট অনেক বেশি স্পেশাল। জন্মদিনে মা গিফ্ট করেছিল। মায়ের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। কতদিন দেখা হয় না, কথা হয় না। কেমন আছে মা? কলেজ থেকে ছুটি পেলেই মায়ের কাছে যাবে। অনেকদিন থেকে আসবে চির-পরিচিত নিজস্ব বাড়িতে।
ডায়েরির অনেকগুলো পেজ লেখা হয়ে হয়ে গেছে। একটা ফাঁকা পেজ বের করে সেখানে আনমনে কিছু লাইন লিখে। যার প্রতিটি লাইনেই ছিল ‘জয়’ নামটি। এরপর লিখতে শুরু করে দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ, প্রথম পরিচয়, একসাথে হাঁটা, একসাথে ফুসকা খাওয়া, জারিফের থেকে লুকিয়ে পালানো সব। আর সর্বশেষ এসে সে কনফিউশনে কলম নাড়াতে পারে না। বারবার মনের ভেতর একটা প্রশ্নই উদিত হচ্ছে, জয় কি হিন্দু?
আনমনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ডায়েরি বন্ধ করে ফেলে সে। মোবাইলে সময় দেখে নেয়। চারটা পার হয়েছে। মিঠাইকে ঘরে আটকে রেখে সে রান্নাঘরে যায় রান্না করতে। আগে রান্নার জন্য লোক ছিল। চাচি ছাড়িয়ে দিয়েছেন। বুয়ার হাতের রান্না নাকি ভালো হয় না। সে নিজেই রান্না করবে। কিন্তু তার-ই বা সময় কোথায়? ক্লাস শেষ করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সে সময়ে সে রান্না করবে না সূচনা সেটা জানে। চাচির মনে কী চলে তাও তার অজানা নয়। তবুও সে নিরব থাকে। চাচাকেও কিছু জানায় না। এমনকি প্রতিবাদও করে না। বিনা পয়সায় থাকছে, খাচ্ছে যখন তখন না হয় কিছু কাজ করেই খাক। সমস্যা তো নেই। হাতে ফোসকার দাগটি দেখে পূণরায় জয়ের কথা স্মরণ হয়। কী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। ফোসকা দেখেই বুঝে ফেলেছিল সূচনা ভালো নেই। সে তো এখনও ভালো নেই। জয়ের জন্য সে ভালো নেই।
‘এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দিস তো।’
পেছন থেকে ক্লান্তস্বরে কথাটি বলে জারিফ চলে গেল। সূচনা ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফের চলে যাওয়া দেখতে পায়। সে ফ্রিজ থেকে লেবু আর ঠান্ডা পানি বের করে। চুলার আঁচ কমিয়ে আগে শরবত বানিয়ে ফেলে। গ্লাস নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে জারিফকে দেখতে পায় না। তাই অগত্যা রুমে যেতে হয় তাকে। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল জারিফ। সূচনার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,’ভেতরে আয়।’
সূচনা গ্লাস নিয়ে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। জারিফ চোখ মেলে তাকিয়ে কিছু্ক্ষণ তার দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে। তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসে শার্টের কলার টেনে পেছনের দিকে দেয়। ঘাড় ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,’গরমে বিরক্ত লাগছে খুব।’
সূচনা খেয়াল করে জারিফের পরনে অফ-হোয়াইট রঙের শার্টটি ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। কপালেও রয়েছে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা। সূচনাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে জারিফ ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করে,’ওভাবে কী দেখছিস?’
এ প্রশ্নে সূচনা বিচলিত হয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। জারিফ হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে পূণরায় আবার গ্লাসটি সূচনার হাতে তুলে দেয়। সূচনা চলে যাওয়ার মুহূর্তে জারিফ পিছু ডেকে বলে,’যাচ্ছিস কোথায়? বোস এখানে।’
সূচনা নিঃশব্দে জারিফের পাশে বসে। ভীষণ অস্বস্তিও লাগছিল কেন জানি। অস্বস্তির ছাঁপ চোখে-মুখে স্পষ্টভাবে ফুঁটে ওঠায় জারিফ সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জানতে চায়,’মুখটা ওমন গোবেচারা করে রেখেছিস কেন? তোকে কি কিছু করেছি আমি?’
হঠাৎ-ই জারিফের কাছ থেকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সূচনার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানো শব্দ হচ্ছে। মুখে বলতেও পারছে না,’আমি যাই। চুলায় রান্না বসিয়ে এসেছি।’ এই প্রথম সূচনার মনে হচ্ছে কথা বলতে না পারাটা ভীষণ বড়ো অপারগতা। জারিফেরই বা আজ হলো কী? সে তো কখনোই এমন কথা বলে না সূচনার সঙ্গে। জারিফ ফিচেল হাসে। মাথা দুলিয়ে, ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,’তোর কোনো ছেলে ফ্রেন্ড নেই?’
দু’দিকে মাথা নাড়ল সূচনা। জারিফ বলল,’প্রীতির সাথে ঝগড়া হয়েছে আমার। মন-মেজাজ ভালো নেই একদম। ওর কেন এত ছেলে ফ্রেন্ড থাকবে?’ শেষের প্রশ্নটি করে সে সূচনার দিকে দৃষ্টিপাত করে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সূচনা। এ কথার প্রেক্ষিতে যুক্তিযুক্ত প্রত্যুত্তর করার ক্ষমতা থাকলেও তার সেই ভাষা নেই। জারিফের মন মেজাজ ভালো নেই এমনিতেই। সেখানে লিখে বোঝাতে গেলে আরও রেগে যেতে পারে ভেবে সূচনা নিরব থাকে। জারিফ বিরক্তিসহকারে ‘চ’ কারক শব্দ করে বলে,’আচ্ছা, তুই গিয়ে তোর কাজ কর যা।’
খাঁচায় আটকে রাখা পাখিকে মুক্তি দিলে পাখি যেমন হাফ ছেড়ে বাঁচে, সূচনারও এখন একই রকম অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। সময় বিলম্ব না করে দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার মাথা এখন ফাঁকা। এই ফাঁকা মাথাতে জয় ব্যতীত অন্য কোনো প্রসঙ্গ আপাতত স্থান করে নিতে অপারগ। রাতে খাবার টেবিলে জারিফ এবং সূচনা দুজনকেই অন্যমনস্ক দেখাল। চাচা খেতে খেতে দুজনের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন করল,’কী হয়েছে দুজনের? মনমরা হয়ে আছ কেন?’
প্রশ্ন শুনে চাচি, জারিফ এবং সূচনা তিনজনই তিনজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। প্রশ্ন কোন দুজনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বুঝতে না পেরে জারিফ পালটা প্রশ্ন করল,’কাকে বললে?’
‘তুমি আর সূচনা।’ পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন তিনি। চাচি এবার সরু চোখে তাকায় দুজনের দিকে। জারিফ এবং সূচনাও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। সূচনা দৃষ্টি সরিয়ে নিলেও জারিফ তাকিয়ে থেকেই বলল,’আমার তো কিছু হয়নি। ওর কী হয়েছে জানি না।’
সূচনা চোরা চোখে জারিফের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় চাচাকে বলল,’আমারও কিছু হয়নি।’
চাচা আর এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বাড়াননি।
.
২০.
রুটিন মাফিক প্রতিদিন কাটছিল সূচনার। নিজেকে মাঝে মাঝে রোবট বলেও মনে হয় আজকাল। চারপাশে তাকিয়ে, জয়কে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে সেও যেন ব্যর্থতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মনমরা হয়ে একটা একটা করে সিঁড়ি মাড়িয়ে সে উপরে উঠছিল। চার তলায় উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্রাম নিতে কোমরে হাত দিয়ে কিছু্ক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাম পাশের ক্লাসে দৃষ্টি যেতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সূচনা। দ্রুত প্রস্থান করতে গিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ ফ্লোরে পড়ে যায়। সেই শব্দতেই চকিতে ফিরে তাকায় ক্লাসে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে থাকা ইউসূফ এবং দিবা। অস্বস্তি আর লজ্জায় সূচনার ফরসা গালদুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। অপ্রতিভ হয়ে দিবা তিন তলায় চলে যায়। কারণ সে কমার্সের ছাত্রী। এদিকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাগ তুলতে যাবে তখন ইউসূফ সামনে এসে দাঁড়ায়। সূচনা একবার তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইউসূফ বিরক্তমাখা কণ্ঠে বলে,’তোমার টাইমিং বলতে কিছু নেই? এখনই আসতে হলো? আচ্ছা যা হোক, কাউকে কিছু বোলো না।’
একটুখানি থেমে আবার বলল,’ওহহো! তুমি তো আবার কথাই বলতে পারো না। বলবেই বা কী করে? লিখেও বলার প্রয়োজন নেই।’
সূচনা চোখ রাঙিয়ে তাকায়। ইচ্ছে তো করছে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু ঐযে সে এক জায়গাতে গিয়েই আটকে আছে। কথা বলার ক্ষমতা তো সৃষ্টিকর্তা তাকে দেননি। তাই অপারগতা প্রকাশ করেই সে ব্যাগ নিয়ে ইউসূফকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অন্যদিকে অজ্ঞাত কারণে অপমানসূচক কথা বলে মনে মনে তৃপ্তি পায় ইউসূফ।
নুসরাতের সঙ্গ পেয়ে ইউসূফের করা অপমানিত কথা ভুলে যায় সূচনা। তাছাড়া প্রত্যহ যার এসব কথা শুনতে হয়, তার কি সবকিছু মাথায় রাখলে চলে? সবকিছু মানিয়ে নিয়েই তাকেও সংগ্রাম করে চলতে হবে। এজন্য উপেক্ষা করতে হবে মানুষজনের উপহাস। ক্লাসগুলো সূচনা মনোযোগ দিয়েই করার চেষ্টা করে। পড়াশোনার জন্যই সব ছেড়ে-ছুড়ে, মানুষজনের কথা শুনে সে শহরে এসে পড়ে আছে। তাই তার এই লক্ষ্যের কথা বেমালুম ভুলে বসলে চলবে না একদম। ছুটির পর প্রতিদিনের মতো নুসরাত বিদায় নিয়ে চলে যায়। জারিফ আজ নিতে আসবে নাকি কিছু বলেনি। বাইরে এসে দেখে সে আসেনি। তাই সূচনা ভাবে বাসেই চলে যাবে। তখনই পাশ থেকে কেউ ডাকে,’সূচনা।’
সূচনা কপালে ভাঁজ ফেলে, ভ্রুঁ কুঁচকে সেদিকে তাকায়। জয়কে দেখতে পেয়ে কপালের ভাঁজ মসৃণ হয়ে যায়। চোখে-মুখে ফুঁটে ওঠে বিস্ময় এবং আনন্দের ঝিলিক। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে স্তম্ভিত হয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়েই থাকে। ততক্ষণে জয় সূচনার কাছে চলে এসেছে। কোমলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো?’
ভাবনার অন্ত শেষ হয় সূচনার। সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। জয় বলল,’চলো ঐপাশে গিয়ে দাঁড়াই।’
জয়কে ফলো করে পিছু পিছু যায় সূচনা। দুজনে পাম্পের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্লাসের অনেক ছেলে-মেয়েই যাওয়ার পথে বাঁকা চোখে সূচনাকে দেখছে। কিন্তু তা নিয়ে কোনো রকম মাথা-ব্যথা সূচনার মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তার সকল ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা এখন শুধুমাত্র জয়ের মাঝেই ন্যস্ত। অনেক প্রশ্ন জমে আছে মনের ভেতর। যেগুলোর উত্তর জানা অতি আবশ্যক। জয় মাথার ক্যাপ সরাতেই আরেক দফা অবাক হয় সূচনা। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে; যেন তার দৃষ্টি দুটো জয়কে সুধালো,’তুমি চুল ফেলেছ কেন?’
জয় বুঝতে ফেরে স্মিত হেসে ক্যাপটি পূণরায় মাথায় রেখে প্রশ্ন করল,’দেখতে খুব অদ্ভুত লাগছে তাই না?’
যাকে দেখার জন্য এতদিন উদগ্রীব হয়ে ছিল, যার সাথে কথা বলার জন্য এতদিন অস্থির হয়ে ছিল এই মন তাকে আজ সামনে পেয়েও একটা টু-শব্দও মুখগহ্বর থেকে বের হচ্ছে না। সকল কথা যেন গলার মাঝে দলা পাকিয়ে আটকে রয়েছে। সূচনার মুখনিঃসৃত কোনো বাক্য শুনতে না পেলেও চোখ হতে আগত প্রশ্নসমূহ যেন স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছিল জয়। সে প্রত্যুত্তর করার ভঙ্গিতে বলল,’চুলগুলো ইচ্ছে করে ফেলিনি।’
সূচনা হাত উঠিয়ে জয়কে থামিয়ে দেয়। অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে সে তার প্রশ্নের উত্তর চায়। ব্যাগ থেকে কলম বের করে হাতের তালুতে লিখে, ‘এতদিন দেখা কেন করেননি?’
জয় অপরাধীর ন্যায় বলে,’তার জন্য আগেই বলি স্যরি। তবে আমার পরিস্থিতিও ছিল অন্যরকম। এই চুল কেন ফেলেছি জানো? কারণ আমার মা আর নেই!’ শেষ কথাটি বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে জয়ের। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। শক্ত মনের মানুষটি বোধ হয় এক্ষুণী ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, এমনটা সে হতে দেয় না। সূচনার সামনে সে স্বাভাবিক থাকে। কান্নাগুলোকে আটকে নেয়। ভাষাহীন সূচনা যেন আরও বেশি ভাষাহীনতায় ভুগছে। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষকে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়? তাছাড়া সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বাকশক্তিও তো তার নেই। জয় শশব্যস্ত হয়ে বলল,’এই তুমি কেন মন খারাপ করছ? মন খারাপ করে থেকো না। কার আয়ু কতদিন তা ভগবান ব্যতীত আমরা কেউই জানি না সূচনা।’
আরও একবার আঘাতপ্রাপ্ত হয় সূচনা। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। প্রথমত যেখানে সূচনার উচিত ছিল এসব কথা বলা, সেখানে জয় নিজেই সূচনাকে এসব বলছে। আর দ্বিতীয়ত জয়ের মুখে উচ্চারিত হওয়া ‘ভগবান’ শব্দটি! তার মানে জয় সত্যিই হিন্দু। স্বল্প সময়ের জন্য যেন তার পৃথিবীই থমকে যাচ্ছিল। তবে সেও বা কম কী? সেও জয়ের সামনে ভেঙে পড়ল না। বরঞ্চ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ভরসার সহিত বন্ধুত্বের অধিকারপ্রাপ্ত হাতে জয়ের হাতটি তুলে নিল। জয়ও একবার সূচনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। যদিও এই হাসিতে কোনো প্রকার খুশি কিংবা আনন্দ ছিল না।
সূচনার পেছনে তাকিয়ে জয় জিজ্ঞেস করল,’ওটা তোমার কাজিন না?’
সূচনা আৎকে পেছনে তাকায়। কলেজের মেইন গেইটের সামনে বাইক থেকে নামছে জারিফ। জয় বলল,’আমি কাল আবার ছুটির পর আসব। আমাদের একসাথে দেখলে তোমার সমস্যা হবে।’
সূচনা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলে জয় অন্যদিক দিয়ে চলে যায়। জারিফ চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে সূচনার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে যাওয়ার পর গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বলল,’বাইকে উঠ।’
সূচনার ভয় হচ্ছে। জারিফ দেখে ফেলেনি তো? নাকি প্রীতির সঙ্গে ঝামেলা বেড়েছে আবার? ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে জারিফকেও অস্বাভাবিক লাগছিল না। তাহলে ভয়ের কিছু নেই। বাড়ির সামনে এসে বাইক পার্ক করে দুজনে একসাথে উপরে আসে। বাড়িতে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় জারিফ। সূচনা নিজের রুমে যাচ্ছিল। পেছন থেকে সে বলে,’দাঁড়া।’
সূচনা দাঁড়িয়ে পড়ে। জারিফ এগিয়ে গিয়ে আগেপাছে কিছু না বলেই কষিয়ে থাপ্পড় বসায় সূচনার গালে। সঙ্গে সঙ্গে সূচনার মনে হচ্ছিল গাল ফেটে রক্তক্ষরণ হবে। ব্যথায় মূর্ছা যায় সূচনা। পুরুষালী শক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে পরতে গিয়েও সোফার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। জারিফ শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,’কলেজে যেতে না যেতেই প্রেম-পিরিতি শুরু করছিস? তুই ভেবেছিস আমি কিছু দেখিনি! এত সাহস পাস কোথায় তুই? এতদিন ভালো ব্যবহার করেছি ভালো লাগেনি? ভেবেছিস যা করবি তাই মেনে নেব, তোকে সাপোর্ট দেবো। এতটা মহৎ-ও আমি নই।’
কথা শেষ করে দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে থাকে। চোখের পানিতে কাজল লেপ্টে গেছে সূচনার। রাগ কমেনি জারিফের। সে আরও একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,’কাঁদিস কেন আবার? প্রেম করার আগে মনে থাকে না? মন দিয়ে শুনে রাখ, এটা তোকে শেষ সুযোগ দিলাম নিজেকে সুধরে নেওয়ার। নয়তো এরপর যা হবে তা তোর ধারণারও বাইরে বলে রাখলাম আমি।’
জারিফ চলে যাওয়ার পর অশ্রুসিক্ত নয়নে ফ্লোরে বসে পড়ে সূচনা। একই তো সে জয়ের বিষয়টা মানতে পারছিল না। অন্যদিকে জারিফের এমন আচরণ। সবকিছু এখন তার ধৈর্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। জীবনটা এখন বড্ড বেশি তিক্ত মনে হচ্ছে। দিনকে দিন জীবনের মায়া একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে তার।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। কিছু ব্যক্তিগত কারণে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে ছিলাম তাই গল্প দেওয়া হয়নি। এজন্য আমি দুঃখিত। সবাই একটু গল্পে রেসপন্স করবেন। নিজেদের মতামত জানিয়ে যাবেন। লেখার আগ্রহ, অনুপ্রেরণা কিন্তু আপনাদের-ই মন্তব্য দ্বারা আসে।
হ্যাপি রিডিং।]