বিরহের নাম তুমি পর্ব-৪

0
486

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
৯.
ফ্লোরে বসে বিছানার ওপর মাথা রেখেছে ভূমিকা। বাবার কথা অনেক বেশি মনে পড়ছে। নিশ্চয়ই বাবা বাড়ি থেকে বের হয়েও কেঁদেছে! বুকের ভেতরে এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে ইচ্ছে করছে অনেক দূরে চলে যেতে। জীবনের এত কঠিন সমীকরণ তার আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে করাটাই তার ভুল ছিল। ভূমিকার এখনও মনে আছে পাত্রপক্ষ যারাই দেখতে আসতো তারা একবার চলে গেলে আর যোগাযোগ করত না। কেউ কেউ মুখের ওপরও কথা শুনিয়ে যেত। কেউ কেউ আবার রাজি হলেও চাইত মোটা অংকের টাকা চাইত; যা দেওয়ার সামর্থ্য সেলিম মিয়ার ছিল না। ভূমিকাও রাজি ছিল না যৌতুক দিয়ে বিয়ে করতে। এর মাঝেই একদিন রাসেল ওর বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে ভূমিকাকে দেখতে যায়। ভূমিকা শিওর ছিল এরাও বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ করবে না। রেশমা বেগম প্রথম দেখাতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেলেন। ঘটকের ওপর মনে মনে বিরক্ত হন। তবে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে রাসেল সবার সামনেই বলেছিল,’আমি ভূমিকার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই। যদি আপনাদের কারো কোনো সমস্যা বা আপত্তি না থাকে।’
ছেলের কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ রেশমা বেগমের। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছিলেন না। ভূমিকা এবং রাসেলকে আলাদা রুমে কথা বলতে দেওয়া হয়। ভয়ে, অন্যরকম এক অনুভূতিতে সর্বাঙ্গ কাঁপছিল ভূমিকার। সে নার্ভাস হয়ে পড়ছিল ভীষণ। রাসেল বুঝতে পেরেছিল কি-না জানা নেই তবে মুচকি হেসে বলেছিল,’এত ভয় পাচ্ছেন কেন? কিছু করব না তো।’
লজ্জায় মাথা আরও নুইয়ে ফেলে ভূমিকা। রাসেল একটু শব্দ করে হাসে। আড়চোখে তাকায় ভূমিকা। অভিভূত হয় সে। একটা মানুষের হাসি এত সুন্দর হতে পারে? রাসেল আশেপাশে তাকিয়ে রুম দেখছিল আর ভূমিকা চোরাচোখে রাসেলকে দেখছিল।
‘এই রুম আপনার?’ জিজ্ঞেস করল রাসেল। ভূমিকা কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল,’আমার ছোটো বোনও সাথে থাকে।’
‘ও। আপনারা কয় ভাই-বোন?’
‘এক ভাই, দু’বোন। ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে ঢাকায় থাকে।’
‘ওহ। আমায় তো জিজ্ঞেস করলেন না। আচ্ছা আমিই বলি। আমরা এক ভাই এক বোন। একটা মেয়েকে যে দেখলেন বসার ঘরে? ঐটা আমার ছোটো বোন রিদি।’
ভূমিকা নির্বাক। রাসেলও কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,’আমি অনেক স্ট্রেইড ফরওয়ার্ড। ঠোঁটকাটা বা নির্লজ্জ স্বভাবের মনে হতে পারে। তবুও না বলে থাকতে পারছি না। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করলে আপনাকেই করব।’
ভূমিকা চমকে তাকায় রাসেলের মুখের দিকে। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’এর মাঝেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন? আগে বাড়িতে যান। সবার সাথে কথা বলুন। তারপর না হয় সিদ্ধান্ত জানাবেন।’
‘কেন? বিয়ে সবাই করবে নাকি আমি করব? আমার যখন পছন্দ হয়েছে তখন আমার পছন্দই ফাইনাল। আপনার কি অন্য কোথাও কোনো সম্পর্ক রয়েছে? থাকলে নির্ভয়ে আমায় বলতে পারেন।’
‘জি না । আমার কোথাও কোনো সম্পর্ক নেই।’
রাসেল মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। কিন্তু এই ব্যাপারে আর কোনো কথা ভূমিকার সাথে বলেনি। রুমের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলল,’এত সুন্দর সুন্দর ফুল আর্ট করা! আপনি মনে হয় ফুল খুব পছন্দ করেন?’
‘এগুলো আমি আর্ট করিনি। সূচনা করেছে। ফুল আমাদের দু’বোনের-ই খুব পছন্দ।’
‘ও আচ্ছা। আমাকে কিছু বলার আছে আপনার?’
ভূমিকা দু’দিকে মাথা নাড়াল। রাসেল বলল,’তাহলে চলুন বসার ঘরে যাই।’

অতীতের ভাবনা থেকে ফিরে এসে ফোন হাতে তুলে নেয় ভূমি। রাসেলের ফোনের অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো বসে থাকে। রাসেলের সাথে একটু কথা বলতে পারলেই অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে যেত। সে এবার আড়াআড়িভাবে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করার কয়েক সেকেণ্ডের মাঝেই রাসেলের ফোন আসে। খুশিতে চকচক করে ওঠে ভূমিকার দু’চোখ। সে ফোন রিসিভ করে শোয়া থেকে উঠে বসে। দু’জনই নিশ্চুপ।
‘সরি!’ অপরাধীর মতো করে বলল রাসেল। ভূমি জিজ্ঞেস করল,’সরি কেন?’
‘তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য।’
‘কষ্ট কখন দিলে?’
‘উত্তরটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। কষ্ট পেলে তো কখনো বলো না। বুঝতেও দাও না।’
ভূমিকা নিশ্চুপ। রাসেল বলল,’ভূমি!’
‘হু।’
‘তোমায় খুব কষ্ট করতে হয় তাই না?’
ভূমিকার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রাসেলের আদুরে আদুরে ভঙ্গিতে কথা শুনে কান্না চলে আসে। নিজেকে সামলায় সে। স্মিত হেসে বলল,’তোমার ভালোবাসার কাছে কোনো কষ্টকেই আমার কষ্ট মনে হয় না।’
‘আমি খুব খারাপ হাজবেন্ড তাই না?’
‘একদম বাজে কথা বলবে না। আমার হাজবেন্ড অনেক অনেক অনেক ভালো।’
রাসেল মৃদু হাসে। বলে,’আর একটুখানি কষ্ট করো ভূমি। তারপর তোমায় আমার কাছে নিয়ে আসব।’
এ কথা শুনে ভূমিকা অনেক বেশি খুশি হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না। সে বলে,’অপেক্ষায় থাকব। মায়ের সাথে কথা হয়েছে?’
‘না।’ রাশভারী গলায় বলল রাসেল।
‘মাকে ফোন দিয়ে কথা বলো। রাগ করে থেকো না। আর কখনো আমার হয়ে মায়ের সাথে কোনো কথা বোলো না প্লিজ!’
‘ভুল হলেও চুপ থাকতে বলছ?’
‘সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য অনেক সেক্রিফাইজ-ই করতে হয় বুঝেছ?’
‘বুঝলাম। আমি অনেক লাকি ভূমি। তোমার মতো মেয়েকে আমি বউ হিসেবে পেয়েছি। যে আমায় বোঝে আর অনেক বেশি ভালোবাসে।’
‘আচ্ছা আমি একাই ভালোবাসি? তুমি ভালোবাসো না?’ বাচ্চামো কণ্ঠে বলল ভূমিকা। রাসেল হেসে ফেলে বলে,’এতগুলো ভালোবাসি আমি আমার মিষ্টি বউটাকে।’
তৃপ্তির হাসি হাসে ভূমিকা। অপেক্ষার অবসান ঘটে গিয়ে প্রশান্ত বাতাস বইছে তার বক্ষজুড়ে।
.
.
১০.
জয়ের শান্ত কণ্ঠে বলা কথাগুলো সূচনার কানে ঝংকার তোলে। সে জানে জয় যা বলছে সব সত্য এবং বাস্তব। তবে সূচনার বাস্তবতার দেয়াল যে আরও বড়ো এবং বিস্তৃত। সে চাইলেও প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করাটা তার মানায় না। সে এবার আর কিছু লিখল না। জয় মৃদু হেসে বলল,’আজ আমার ব্রেকাপ হয়েছে।’
সূচনা অবাক হয়। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। জয় না তাকিয়েই বলল,’সে আমার সাথে হ্যাপি ছিল না। তার মনমতো নাকি সে চলতে পারে না। তার অনেক ছেলে ফ্রেন্ড রয়েছে। ফ্রেন্ডস থাকতেই পারে। কিন্তু ছেলেরা আবার ক্লোজ ফ্রেন্ড হয় কীভাবে? তার চাহিদাও অনেক। আমার সাথে থেকে তার ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট। এজন্য ব্রেকাপ করেছে।’
সূচনা জিজ্ঞেস করার পূর্বেই কথাগুলো বলল জয়। কারণ সে বুঝতে পেরেছে মুখে বলতে না পারলেও পরের ঘটনা জানতে আগ্রহী হয়ে থাকবে সূচনা।
জয় সূচনার আপন কেউ নয়। কাছেরও কেউ নয়। তবুও তার খারাপ লাগছে। তার মন ব্যথিত হচ্ছে জয়ের কষ্টে। তবে একটা জিনিস মানতেই হবে, জয় যথেষ্ট স্ট্রং একটা ছেলে। নয়তো এত সহজ, সাবলীলভাবে কেউ কথা বলতে পারে? সূচনাকে মন ভার করে থাকতে দেখে জয় বলল,’আপনি তো আমায় চেনেন না। আমিও না। তবুও একটা অন্যায় অনুরোধ করতে চাই। আপনি কি আমার বন্ধু হবেন?’
সূচনা ভড়কে যায়। হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে ভাবতে থাকে। একটা মানুষকে কখনোই পুরোপুরিভাবে চেনা সম্ভব নয়। সেদিক থেকে সে জয়কে যতটুকু দেখেছে অথবা জানে সেটুকুতে এই মানুষটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়। বাকিটা না হয় আস্তে আস্তে জানা যাবে। তাছাড়া এত বড়ো শহরে সেও তো একা। আপন মানুষ থেকেও আপন নয়। তারও বন্ধুর প্রয়োজন আছে। সবকিছুর মাঝেও একটা কঠিন সত্য হলো কথা বলতে না পারার দরুণ সূচনার কখনো কোনো ফ্রেন্ড হয়নি। প্রথম কয়েকদিন কেউ আগ্রহ নিয়ে সাথে থাকলেও পরবর্তীতে বিরক্ত হয়ে যেত তার নির্বাক স্বভাবের কারণে। মানুষ স্বভাবতই মনের ভাব প্রকাশ করতে চায় এমন একটা মানুষের সাথে যেই ব্যক্তি সব শুনে প্রত্যুত্তর করতে পারবে। অথচ সূচনার সেই বাকশক্তি নেই। নেই কথা বলার মতো ক্ষমতা। সে জয়কে নিরাশ করল না। তবে কোনো এক্সপেকটেশনও রাখল না। সে যতবার কারো কাছে এক্সপেকটেশন রেখেছে ততবার তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। তাই এখন আর কারো কাছে তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে জয়। সূচনা মৃদু হেসে হাতটা বাড়িয়ে দেয় বন্ধুত্ব করার জন্য। জয়ও মুচকি হেসে হাত বাড়ায়। সে সূচনাকে সাহায্য করতে চায়। এছাড়া তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।

জয়ের পাশে ক্যামেরা দেখতে পেয়ে সূচনা ইশারায় বলল,’আপনি ছবি তুলতে পারেন?’
সূচনার ইশারা করা হাতটিকে লক্ষ্য করে জয়ও ক্যামেরার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,’আপনি ছবি তুলবেন?’
সূচনা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,’আপনি ছবি তুলতে পারেন?’
‘এই ক্যামেরা আমার কি না জিজ্ঞেস করছেন?’
সূচনা ইশারায় বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে কপালে হাত রাখে। ইশারা বুঝতে না পেরে জয় বোকা বোকা চাউনীতে তাকিয়ে থাকে। হেসে ফেলে সূচনা। খাতায় লিখে,’জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি ছবি তুলতে পারেন কি-না।’
জয়ও এবার মৃদু হেসে বলে,’ওহ আচ্ছা! আসলে প্রথম প্রথম তো তাই বুঝতে পারিনি। আপনার সাথে থাকতে থাকতে সব বুঝে নেব। আর হ্যাঁ, আমি ছবি তুলতে পারি। আপনি ছবি তুলবেন?’

সূচনা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। যদিও জয় সূচনার কোনো বারণ শোনেনি। প্রথমে সূচনার অনিচ্ছায় কতগুলো ছবি তোলে। ক্যান্ডিড ছবি হওয়ার পরেও ছবিগুলো যথেষ্ট সুন্দর তুলেছে। সূচনা অভিভূত হয়ে হাত দিয়ে ইশারায় বলে,’অসাধারণ।’
‘বৃষ্টি এখন নেই। চলুন হাঁটি।’
সূচনা সায় দেয়। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। কোনটা কোন জায়গা, কোন ভবনের কী নাম, কী কাজ সব বলছে সূচনাকে। রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, ঢাকা-শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সে সূচনাকে। রাস্তার এক সাইডে ফুসকা বিক্রি করতে দেখে জয় জিজ্ঞেস করে,’ফুসকা খাবেন?’
সূচনা ‘হ্যাঁ’ বলে। ফুসকা খেতে গিয়ে ভূমিকার কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামে থাকতে দু’বোন আগে একসাথে ঘুরতে যেত। একসাথে ফুসকা খেত। আজও দুজনে একই শহরে। তবুও দূরত্ব যেন যোজন যোজন! জয় এখনও গল্প করছে।মন খুলে কথা বলছে। আর সূচনা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মনে হচ্ছে দুজন, দুজনের কত পরিচিত, কত বছর ধরে দুজন দুজনকে চেনে। অথচ খুব ভালোভাবে পরিচয় হয়েছে মাত্র কিছু্ক্ষণ আগে। সূচনা জানে না, জয় কীভাবে নিজেকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়। তার ব্রেকাপ হওয়ার বিন্দুমাত্র কষ্টও বোঝা যাচ্ছে না।সেও ভীষণ স্বাভাবিক। যেন সে জানত এই বিচ্ছেদ একদিন হওয়ারই ছিল। ফুসকা খেতে খেতে জয় কথা বলছে। কখনো কখনো হেসে উঠছে। প্রত্যুত্তরে প্রত্যেকবারই সূচনা হাসি প্রদান করেছে। আর এতেই যেন জয় তার কথা বলার উত্তর পেয়ে যেত। অল্প সময়েই সূচনা তার বিষাদের কথা ভুলতে শুরু করে। হঠাৎ সেখানে জারিফ এসে পড়ে তখন। হাসি মিলিয়ে যায় সূচনার। কী করবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে কাঠ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

মুন্নি আক্তার প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here