বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৯

0
1704

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী

তাহমিদ ওর বড় চাচ্চুকে ফোন করে সবটা জানিয়েছে। সব শুনে তিনি তার এসপি বন্ধুকে ফোন করেছেন। তাকে বলেছেন, পুলিশ যেন খুব তারাতারি এসে, ঠিকমত তদন্ত করে।

শিউলি আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। আনান তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
তাহমিদ দৃষ্টির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। মেয়েটার চোখেমুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। চোখের কোন দিয়ে পানির শুকনো রেখা বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা মৃ’ত্যু’র আগে অনেকক্ষণ যাবৎ কেঁদেছে।
তাহমিদ অনেক কষ্টে দৃষ্টির থেকে চোখ ফেরায়। ধীরেসুস্থে কায়েসের পাশে যেয়ে বসে। হাত রাখে কায়েসের কাঁধে।
কায়েস ঘাড় ঘুড়িয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে।
একজন সন্তানহারা পিতাকে সান্তনা দেয়ার উপায় তাহমিদের জানা নেই। সে কায়েসকে কিছু না বলে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

আফরোজা নাজনীন তাহমিদের ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কুহু, তাহমিনা এবং সানাউল রাশেদিনের সাথে ফুলতলার দিকে রওনা দেন।
যাবার পথে তারা শাহনাজ সুলতানা ও তার স্বামীকে নিজেদের সাথে নিবেন।
নাজমা পারভিন তার স্বামীসহ রওনা দিয়েছেন।
তাহমিদ তাদের কিছুই জানায়নি। শুধু খুব তারাতারি ফুলতলা যেতে বলেছে।
কিন্তু আনান ওর মায়ের কাছে ফোন করে সবটা জানিয়েছে। আর শাহনাজ সুলতানা ফোন করে বোনদের জানিয়েছে। তাই তারা সবাই মিলে রওনা দিয়েছেন।

আফরোজা নাজনীন কাঁদছেন। কুহু ঘটনা শোনার পর থেকেই মাঝেমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছে।
তাহমিনা আক্তার হিমশিম খাচ্ছেন দুইজনকে সামলাতে।
শাহনাজ সুলতানা বড় বোনের সাথে মিলিত হওয়ার পর তারা একদফা কাঁদলেন। হাজার হোক দৃষ্টি তাদের ভাইয়ের মেয়ে। ছোট মেয়েটা আবেগের বশে ভুল পথে পা বাড়ালেও, তারা দৃষ্টিকে দূরে ঠেলে দেননি।

আজ পথ যেন শেষ হচ্ছেনা। আফরোজা নাজনীন ছটফট করছেন বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। তিনি অস্থিরচিত্তে শুধু গাড়ির জানালার বাইরে তাকাচ্ছেন। শাহনাজ সুলতানা বারবার ড্রাইভারকে জোরে গাড়ি চালাতে বলছেন।
কুহু নিস্তেজ হয়ে তাহমিনা আক্তারের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
তাহমিনা আক্তার ছেলের জন্য চিন্তা করছেন। তার ছেলেটা এই অবস্থায় কিভাবে সবাইকে সামলাচ্ছে!

আনান শিউলিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, তার পাশে শিহাবকে রেখে, সে তার নানুর ভাইয়ের বাড়িতে তাদের দুঃসংবাদটা জানাতে যায়।

আনানের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওর নানুর ভাইয়ের ছেলেরা, তাদের স্ত্রীরা সবাই ছুটে আসে।
শিউলির সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় তারা কেউ এ বাড়িতে আসেনা। তবে কায়েসের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু আজ দুঃসংবাদটা শোনার পর তারা কেউই শিউলির ওপর রাগ করে থাকেনা।

কায়েসের চাচাতো ভাইয়েরা এসে দৃষ্টিকে এই অবস্থায় দেখে শিউরে ওঠে।
তারা দৃষ্টিকে নিচে নামাতে চাইলে তাহমিদ নিষেধ করে। সে সবাইকে বলে, ব্যাপারটা পুলিশ এসেই দেখবে৷

পুলিশ এসে সাথে সাথেই তাদের কাজ শুরু করে দেয়। তারা দৃষ্টিকে নামিয়ে পোষ্ট ম’র্টে’মে’র জন্য পাঠিয়ে দেয়। আর দুই-তিনজন মিলে দৃষ্টির রুম চেক করে। চেকিংয়ের এক পর্যায়ে তারা দুইটা চিঠি পায়। কায়েসকে সেগুলো দেখালে সে নিশ্চিত করে, এটা দৃষ্টির লিখা।

আফরোজা নাজনীনরা যখন ফুলতলা এসে পৌঁছায়, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।
পুরো বাড়ি লোকে লোকারন্য। গাড়ি থেকে বেরিয়েই তারা দুই বোন প্রায় দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। কুহুও ফুপুদের পিছুপিছু যায়।

উঠানে পা রাখতেই নজর যায় কায়েসের দিকে। সে কুহুর ঘরের বারান্দায় বসে আছে তার পাশে চাচাতো ভাইয়েরা বসে আছে।
বোনদের দেখে কায়েস ডুকরে কেঁদে ওঠে।

শিউলি সেই অনেকক্ষণ আগেই জ্ঞান হারিয়েছে। তাহমিদ প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে, কিন্তু তার জ্ঞান এখনো আসেনি।

দৃষ্টির লা’শ বিকেলেই গ্রামে পৌঁছে যায়। দা’ফ’নে’র সব ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছে।

মেয়ের লা’শ দাফন হলো, অথচ শিউলি শেষবারের মত মেয়েকে দেখতে পায়না। শেষবারের মত মেয়েকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।

সানাউল রাশেদিন তার এসপি বন্ধুর সাথে কথা বলে, দৃষ্টির লিখা চিঠিগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন।
একটা চিঠি দৃষ্টি তার বাবা-মা’ কে লিখেছে। আরেকটা লিখেছে কুহুকে।
সানাউল রাশেদিন একটা চিঠি কায়েসকে আরেকটা কুহুকে দেন। কুহু চিঠিটা হাতে নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে।

কায়েস কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠি খোলে। কি লিখেছে তার মেয়ে!


প্রিয় আব্বু,
আমি চলে যাচ্ছি। তুমি কষ্ট পেওনা কেমন? তোমার মেয়ে খুব খারাপ। ভুল মানুষকে ভালোবেসে আজ তোমার মেয়ে নিজেকেই শেষ করে দিচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিও, আব্বু। আমি তোমার স্বপ্ন পূরন করতে পারিনি। আমার জন্য তোমাকে সমাজের মানুষের কাছে ছোট হতে হয়েছে। বিশ্বাস করো আব্বুু, আমি সত্যি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। কিন্তু সবুজ সেটা হতে দিলনা।
জানো আব্বু, আজকাল আমার এই অধঃপতনের জন্য আম্মুকে দায়ী করতে মন চায়। আম্মু যদি আমাকে প্রথমেই শাসন করত, তবে আমি ভুল পথে পা বাড়াতামনা। আম্মু আমাকে শাসন না করে, সবুজের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমিও তখন ভেবেছিলাম, এটাই বোধহয় ঠিক। তাই তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করতে আমার একটুও বুক কাঁপেনি। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন পর থেকে বুঝতে পেরেছি, আমি ভুল ছিলাম। প্রতিনিয়ত শ্বাশুড়ির কটুকথা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে। আর তখনই আমার বোধ হয়েছে, আমি কত বড় ভুল করেছি। আব্বু, তুমি তোমার এই অসহায় মেয়েকে ক্ষমা করে দিও। আজ যদি আমি এই সিদ্ধান্ত না নিতাম, তবে তোমার দিকে সমাজের মানুষেরা আঙুল তুলত। তোমাকে দেখে বলত, ঐ যে দেখ, কলঙ্কিনীর বাবা যাচ্ছে। কোথায় কি আকাম-কুকাম করে আসছে, যেগুলো আমরা দেখছি। আব্বু, সবুজ লিংকটা ভাইরাল করে দিত। আমি তখন সবাইকে মুখ দেখাতাম কেমন করে! সবুজ আমাকে হুমকি দিয়েছে, আমি যদি তার বাড়িতে না যাই, মামলা তুলে না নিই, ওর মা’কে জেল থেকে বের না করি, তবে সে লিংক ভাইরাল করে দিবে। আমার কাছে আর কোন রাস্তা ছিলনা, আব্বু। আমি জীবন দিব, তবুও সবুজের কাছে আর ফিরবনা। তোমরা সবুজকে ছেড়ে দিওনা, আব্বু।

আম্মু,
আমি চলে যাচ্ছি। তোমার কাছে আমার ছোট ভাই, আর আপুকে রেখে গেলাম। তুমি আপুকে আর দুরছাই করোনা। আপুটা আমার ভালোবাসার কাঙাল। তুমি তাকে একটু ভালোবাসা দিও, বিনিময়ে সে তোমাকে এক সমুদ্র সম্মান দিবে। তার সত্যিকারের মা হয়ে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিও, সৎমায়েরা সব সময় খারাপ হয়না। তাহমিদ ভাইয়া খুব ভালো মানুষ। তুমি আপুকে ভালোবাসলে, ভাইয়াও তোমাকে মায়ের মতই সম্মান করবে।
আম্মু, শিহাবকে আমার মত করে মানুষ করোনা। তাকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলো। দেখবে তোমার ছেলে-মেয়ে তোমাকে নিরাশ করবেনা। তখন হয়তো তুমি ভুলেই যাবে দৃষ্টি নামে তোমার একটা মেয়ে ছিল।
আম্মু, নিজেকে পাল্টাও। মনে হিং’সা, রা’গ পুষে রেখনা। আমার ফুপুদের সম্মান করো। দেখবে তারা তোমাকে মাথায় তুলে রেখেছে।
আমি চলে যাচ্ছি, আম্মু। তোমার এই অযোগ্য মেয়েকে মাফ করে দিও। ”

দৃষ্টির চিঠি পড়ে কায়েস হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তার মেয়েটা যে কতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে এই চিঠি লিখেছে, সেটা ভাবতেই তার কলিজা ফেটো যাচ্ছে।

আনানের কথায় কুহু তার জন্য লিখা দৃষ্টির চিঠির ভাঁজ খোলে।


আপু,
তোমার এই অপরাধী বোন আজ কিছু বলতে চায়৷ আমি আর আম্মু মিলে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমার নিয়তি দেখ, তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি, তার কয়েকগুণ কষ্ট আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তুমি মনে কোন কষ্ট রেখনা। আমার আম্মুকে মাফ করে দিও। আমি চলে গেলে তাকে দেখার মত কেউ থাকবেনা। আব্বুও আম্মুর সাথে কথা বলেনা। এমনকি শিহাবও আম্মুর থেকে দূরে থাকে। আমার আম্মু এই বাড়িতে পরবাসীর ন্যায় বাস করে। তুমি আমার আম্মুকে ভালোবাসা দিয়ে আমার শূন্যস্থান পূরন করো।
আপু, আমি যে কারনে আজ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি, সেই ভিডিওর ব্যাপারে কিছুই জানতামনা।
নিজের স্বামীর ঘরে, বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া বিছানায় স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। কিন্তু আমার জঘন্য স্বামী যে, সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্ত গোপনে ধারন করেছে, তা আমার জানা ছিলনা। এই ভিডিওকে সেই তার হাতিয়ার বানিয়েছে তা আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। সকালে যখন ভিডিওটা আমি দেখলাম, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার আত্নীয়দের কেউ এসব দেখলে, আমি তাদের সামনে যাব কেমন করে? সবাই আমাকে ছি ছি করবে। আমার সামনেই আমাকে নিয়ে হাসবে। আমাকে ঘৃণা করবে। এসব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম, এই দুনিয়ার মেয়াদ আমার শেষ হয়েছে।
আমি যেদিন জেনেছিলাম, সবুজ তোমার সাথেও অসভ্যতা করতে চাইছিল, সেদিন থেকে তাকে আমি মনে প্রানে ঘৃণা করি। সে তার বাবার সাথে মিলে আম্মুর কাছ থেকে শোরুম, জমি লিখে নিয়েছে। আম্মুর গহনা চুরি করেছে। দিনে দিনে আম্মুর কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছে। তার বাড়িতে আম্মু অনেক কিছু দিয়েছে। তবুও সে আমার এত বড় ক্ষতি করল।
তোমরা ওকে ছেড়ে দিওনা, আপু। ওর কৃতকর্মের শাস্তি ওকে দিও।
আমার ভাইটাকে দেখে রেখ। আব্বু ভিষণ ভেঙে পরবে। তাকে সামলে রেখ।
তোমার সংসারে সুখেরা ভেসে বেড়াক। অনেক আশা ছিল তোমার ছেলে-মেয়ে হলে আমি তাদের নাম রাখব। তা আর হলোনা।
তাহমিদ ভাইয়াকে বলো, তার আসার অপেক্ষা আমি করতে পারলামনা। সবুজ আমাকে অপেক্ষা করতে দিলনা।
তোমাদের থেকে চিরবিদায় নিলাম। তোমরা সবাই ভালো থেক। ”

দৃষ্টির চিঠি পড়ে কুহু নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। চিৎকার করে কেঁদে উঠে। কেউ ওকে থামাতে পারছেনা। একপর্যায়ে জ্ঞান হারায় সে।

তাহমিদ ওকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়৷

আনান ও তাহমিদের ছেলেরা হন্যে হয়ে সবুজকে খুুঁজছে।
পুলিশও থেমে নেই। কিন্তু সবুজ যেন হঠাৎই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here