#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী
আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কুহু, সিক্তা দুজনেই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম দিচ্ছে। আজ থেকে আগামী কয়েকদিন শুধু ঘুম আর ঘুম।
মাগরিবের আজান কানে আসতেই কুহু উঠে বসে। সিক্তাকে অনেক ডেকেও ঘুম থেকে জাগাতে না পেরে, অজু করে নামাজ আদায় করে। এরপর নিচে আসে দিদুনের কাছে। তাহমিনা আক্তার এবং আফরোজা নাজনীন মিলে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। কুহুও এসে তাদের সাথে হাত লাগায়।
ওদের কাজের মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন দরজা খুলতে।
কুহু দরজা খুলেই দেখল আনান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
” কি রে, তাহমিদ ভাইয়ের বউ ভাবি, কেমন আছিস? বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়িতে বউমার আদর খাচ্ছিস! এমন কপাল কয়জনের হয়! ”
” ভাইয়া, তুমি এসেই শুরু করেছ! আবার আমাকে ভাবি ডাকছ! তোমার পা’গ’ল হতে আর দেরি নেই। ”
” সাধে কি আর তোকে ভাবি ডাকছি। তোর সেয়ানা হবু জামাই, আমি তোর বড় জানা স্বত্বেও সম্মান দিতে চায়না। আবার ছোট বোনকে যে তার হাতে তুলে দিতে চাই এ উপলক্ষে কোন ট্রিটও দেয়না। কথায় কথায় বেকায়দায় ফেলে। তাই তাকে শায়েস্তা করতেই এই নিনজা টেকনিক এ্যাপ্লাই করতে হচ্ছে। এখন থেকে তুই আমার ভাবি। যখন ইচ্ছে তোর কাছ থেকে ট্রিট আদায় করব। তার প্যাঁচে, তাকেই ফেলব। এখন সামনে থেকে সর। আর যা আমার জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত করে আন। ” কুহুকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আনান ভেতরে ঢোকে।
কুহু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।
আনান নিচে কিছুক্ষণ খালামনির সাথে কথা বলে উপরে আসে। উপরে উঠেই প্রথমে উঁকি দেয় তাহমিদের রুমে। কিন্তু পুরো রুম জুড়ে সুনশান নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
এরপর আনান সোজা আসে সিক্তার রুমে। সিক্তা তখনও ঘুমে বিভোর।
আনান এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক টানে সিক্তাকে তুলে বসায়। হঠাৎ এভাবে হ্যাঁচকা টান খেয়ে সিক্তার মাথা ঘুরে উঠে।
” এই কোন আপদ রে, এভাবে ঘুম ভাঙালি? ” বলেই সিক্তা আবার শুয়ে পরে।
” আমি তোর ঘুম ভাঙ্গাইলাম রে , ভুঁড়িওয়ালা বাপের ত্যাঁদড় মেয়ে। পরীক্ষা যেন দুনিয়ার আর কেউ দেয়না। ” আনানের গলা শোনা মাত্রই ঝট করে চোখ খোলে সিক্তা।
” এই অ’স’ভ্য ছেলে, তুমি এখানে এসেছ কেন! আমার বাড়িতে এসে, আমার বাবাকেই ইনসাল্ট করছ! তোমার এত বড় সাহস! ”
” তোর বাপের বাড়িতে এসেই তাকে ইনসাল্ট করব। তোর কোন সমস্যা? ”
” আমি বাবাকে ডাকব বলে দিচ্ছি। অ’স’ভ্য ছেলে। নিজের শুটকো বাপের কথা চিন্তা না করে, আমার বাবাকে নিয়ে পরে আছে। ”
” ঐ, আমার বাবাকে কি বললি? দাঁড়া আজকে তোর হচ্ছে। ” আনান সিক্তার চুল টেনে ধরে।
সিক্তা ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
” একশো বার বলব শুটকো, শুটকো, শুটকো। তোমার বাপ একটা শুটকো। যতক্ষণ আমার চুল না ছাড়বে, ততক্ষণ বলতেই থাকব। ”
” বে’য়া’দ’ব মেয়ে, নিজের শ্বশুরকে কেউ এভাবে বলে! শ্বশুরকে সম্মান দিতে জানিসনা আবার নিজের ভুঁড়িওয়ালা বাপের সম্মান আশা করিস? ”
আনানের কথা শুনে সিক্তার মাথা হ্যাং হয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।
” কি বললে তুমি? কে, কার শ্বশুর? ”
আনান হঠাৎ করেই হুঁশে এলো। ঝগড়ার মাঝে কি বলেছে ভাবতেই চোখ বুজে আসে। সিক্তা আনানের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, উত্তর শোনার আশায়।
আনান ঘাড় চুলকে অপ্রস্তুত হাসে।
” আমার বাবা, তোর শ্বশুর। তোর একমাত্র বরের একমাত্র বাপ। এবার বুঝেছিস, তোর শ্বশুরের একমাত্র ছেলের বউ? নাকি আরও ডিটেইলস বলতে হবে? ”
আনানের ঠোঁটকাটা কথা শুনে সিক্তা কি অনুভূতি প্রকাশ করবে বুঝতে পারেনা। তবে ও লক্ষ্য করল হঠাৎ করেই সামনের ছেলেটাকে বেশ লাগছে। তার হাসি, বাম গালে টোল, কোঁকড়া ঘনকালো চুল, একহাড়া গরনের উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারা নেহাৎ মন্দ নয়।
” কি রে, এভাবে সাইলেন্ট মোডে চলে গেলি কেন! আমার কথার প্রত্যুত্তরে তোর কোন কথা নেই বুঝি? আচ্ছা যা, তোর বাপকে ডেকে আন। তার সামনেই তাকে ভুঁড়িওয়ালা বলছি। ”
” একদম চুপ, শুট….. ” সিক্তা কথা শেষ করার আগেই আনান কথা বলে,
” আবার শ্বশুরকে উল্টাপাল্টা নামে ডাকছিস? তাও আবার একমাত্র বরের সামনে, তার একমাত্র বাপকে। তোর সাহস খুব বেড়েছে দেখছি! ”
” কক কে, কার বর? ফালতু কথা বলার জায়গা না পেলে, ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করো গিয়ে। ”
” কেন বর হিসেবে আমাকে পছন্দ নয় বুঝি? তোর বাপ কিন্তু এমন একটা ছেলে পেলে, সুযোগটা লুফে নিবে। তবে আমার কিন্তু তোকে হেব্বি পছন্দ। বউ হিসেবে তুই কিন্তু আমার মনের মতন। এই তোর কি আমাকে পছন্দ নয়? পছন্দ না হলেও অসুবিধা নেই। আমাকে তোর পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যত ইচ্ছে সময় নিবি। তবে শেষে হ্যাঁ বলবি এটাই আমার অর্ডার। তোর সেয়ানা ভাইকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা কিছুতেই। ”
” আমার ভাইয়া তোমাকে কি করল! তার ওপর তোমার এত কিসের হিং’সা! ”
” কি করেনি তোর ভাই? এই তোর এসবে এত আগ্রহ কেন! তোর আগ্রহ থাকবে শুধু আমার ওপর। এখন অন্য চিন্তা না করে শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করবি, বুঝলি? এই নে, তোর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই নুপুর তোর জন্য কিনেছি। যদি মুখে বলতে না পারিস, তবে নুপুর পায়ে পরলেই আমি বুঝে নিব। ” আনান পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে সিক্তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আনান আরেকবার তাহমিদের রুমের সামনে এসে উঁকি দেয়।
” কি রে, বউয়ের বড় ভাই, এভাবে ছোট বোনের জামাইয়ের রুমে উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন! একটুতো লজ্জা কর। আজকাল দেখছি ছুঁচোর মত আচরণ করছিস! ”
” হাহ্ ভাই, মুখে বলছ বউয়ের বড় ভাই, কিন্তু মনে সম্মানের লেশমাত্র নেই। একটা কথা শুনে রাখ, কয়েকদিন পর, তুমি তাহমিদ আমাকে সম্মান দিতে সচেষ্ট থাকবে। আমি কিন্তু তখন তোমার মত এমন হিটলারি ফলাবোনা। ”
” কোন লাভ নেই। এমন একটা ফিঁচকে ছেলের কাছে আমার বোনকে কিছুতেই দিবনা। তাই মিছেমিছি সম্মান পাওয়ার আশা বাদ দে। ” তাহমিদের কথা শুনে আনানের মাথায় যেন বাজ পরল! বেচারার মুখ চুপসে গেছে। যেই কথা ও ছাড়া কেউ জানেনা, সেই কথা এই সেয়ানা লোকের কাছে পৌঁছাল কিভাবে!
” ভাই, স্যালুট তোমাকে। তোমার ঐ দুটা চোখ নাকি সিসি ক্যামেরা! তবে সে যাইহোক তোমার বোন আমার হচ্ছে, এটা জেনে রাখ।তোমার আশায় গুড়েবালি। তুমি অযথাই আমাদের দুজনের মধ্যে ডিপজলের ভুমিকা পালন করতে এসোনা। ও অলরেডি পটে গেছে। আর কয়েক বছর পর, আমি তোমার ছোট বোনের স্বামী হব। তুমি উঠতে-বসতে আমার সামনে সম্মানের ডালা নিয়ে হাজির হবে। এইযে আমি, আমার কন্যার বড় ভাই হয়েও সম্মান না পাওয়ার আক্ষেপ তখন ঘুচবে। ”
আনানের কথা শুনে তাহমিদের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওর এখন হাসা মানেই আনানকে প্রশ্রয় দেয়া, তাই অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে।
” কই গো বউ, খালি এমন করে শুয়ে থাক কেন? বাড়ির কাজকর্ম করা লাগবেনা? বাড়ির বউদের শুয়ে থাকলে সংসারের অবনতি নিশ্চিত। ” সবুজের মায়ের ক’র্ক’শ আওয়াজ শুনেও কোন হেলদোল নেই দৃষ্টির। ও শ্বাশুড়ির কথার জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
” কি ব্যাপার, তুমি না উঠে বিছানায় গ’ত’র চেপে ধরলে কেন? আচ্ছা মেয়ে তো তুমি! কোন আদবকায়দা বাপ-মা শিখায়নি! ”
” আহ্ আম্মা। আমার আদবকায়দা যথেষ্ট আছে , শুধু আপনাদের মনে হয় মাথার দো’ষ আছে। আপনি আগে বলতেন, বাপেরবড়ি থেকে কিছু আনিনি তাই বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হবে। আমিও সেটাই করলাম। কিন্তু যখন বাপের বাড়ি থেকে সবকিছু আনলাম, আপনার ছেলেকে আমার আব্বু ছয় লাখ টাকা দিল, তারপরও আমাকে কাজ করতে হবে! এখন থেকে আমি কোন কাজ করবনা। হয় আপনি সব কাজ করবেন, নয়তো কাজের মেয়ে রাখবেন। ” দৃষ্টির পাল্টা জবাবে মিইয়ে যায় ওর শ্বাশুড়ি।
এই মেয়েকে বাগে আনতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে তার স্বামী, সন্তান বাড়িতে আসা মাত্রই এই মেয়ের নামে বিচার দিবে। একটা দফারফা না করে সে আজ ভাত মুখে তুলবেনা।
বিঃদ্রঃ গত দুইদিন থেকে বাসায় মেহমান আছে। কাজের ফাঁকে যতটুকু লিখতে পারি, ততটুকুই পোস্ট করি। আমি জানি গল্প ছোট হয় কিংবা দেরিতে পোস্ট করি, এ নিয়ে আপনাদের বিস্তর অভিযোগ আছে। আবার হয়তোবা মাঝেমধ্যেই বাসায় মেহমান আসার কথায়ও বিরক্ত হন। কিন্তু আমি সত্যিই নিরুপায়। আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি লজ্জিত।
চলবে….