বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৭

0
2084

# বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী

এইচএসসি পরীক্ষার দশ দিন আগে কহু
‘ কুঞ্জছায়া ‘য় এসেছে। ওর ইচ্ছে ছিল হোস্টেলে থেকেই পরীক্ষা দিবে। কিন্তু ঐ বাড়ির কেউই কুহুর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি৷ তাই বাধ্য হয়েই কুহুকে এখানে আসতে হয়েছে।

সিক্তা, কুহু দুজনেই কোমড় বেঁধে পড়ছে। শুধু খাওয়ার সময় হলেই রুম থেকে বের হচ্ছে। তাহমিদ আজকাল বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। কহু এই বাসায় আছে, ওকে প্রতিবেলায়ই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। আর কি চাই।

রাত বারোটা দশ। পড়তে পড়তে মাথা ধরেছে কুহুর। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে ছাদে আসে। আজও ছাদের দরজা খোলা। তবে সেদিনের মত আজ ছাদ জুড়ে অন্ধকার ওঁত পেতে নেই। ভেতর থেকে উঁকি দেয় কুহু৷ ওর ভ্রু কুঁচকে আসে। তাহমিদ রেলিংয়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।

” আমার ভবিষ্যতের বউ, এত রাতে ছাদে এসেছ কেন? এদিকে এসো। ”
কুহু যেই উঁকি দিয়েছে, ঠিক তখনই বলে তাহমিদ।
গুটিগুটি পায়ে তাহমিদের নিকট আসে কুহু।
” আপনি কি করে বুঝলেন, আমি এসেছি! ”
” তুমি আশেপাশে থাকলে ধরনের মিষ্টি গন্ধ আমার চারপাশে ভেসে বেড়ায়। যে গন্ধ জানান দেয়, তুমি এসেছ। বুঝতে পেরেছ, আমার শ্যামাঙ্গীনি? আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি কিন্তু। ”
” মাথা ধরেছে, তাই এখানে এসেছি। ”
” এই মেয়ে, এত রাতে ছাদে আসতে তোমার ভয় করেনা! আর মাথা ধরেছে, তাই আসলেই সুস্থ হয়ে যাবে? আজব! মেডিসিন নিয়েছ? ”
কুহু তাহমিদের কথার জবাব না দিয়ে বিরস বদনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর নিরুত্তর থাকায় তাহমিদ বুঝে নেয়, ও মেডিসিন নেয়নি।
” চুপটি করে বসে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি। ” কথাটা বলেই তাহমিদ ছাদ থেকে প্রস্থান করে।
কুহু ছাদে পেতে রাখা চেয়ারে বসে।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ পুনরায় ছাদে আসে। ওর হাতে একটা ট্রে। তাতে একটা পিরিচে দুইটা স্যান্ডউইচ, আরেকটা পিরিচে কয়েক টুকরা আপেল। আর দুইটা মগে কফি।
কুহু এসব দেখে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়।
” তারাতারি খেয়ে নাও। এগুলো শেষ করে মেডিসিন নিবা। ”
” আমার ক্ষুধা নেই। এখন কিছুই খেতে পারবনা। ” কুহু চোখমুখ কুঁচকে বলে।
” তোমার ক্ষুধা তার কি না, তা আমি জানতে চাইনি। আমি বলেছি, তুমি খাবে। ব্যাস। ”
” আমি একটা স্যান্ডউইচ খাই, আপনি একটা খান। বিশ্বাস করুন, দুইটা একসাথে খেতে পারবনা। ”
তাহমিদ কিছু না বলে একটা স্যান্ডউইচ নিজে নেয়, আরেকটা কুহুকে দেয়।
কুহু স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে বুঝতে পারে সেগুলো ঠান্ডা নয় গরম। তবে কি সে ফ্রিজ থেকে বের করে গরম গরম এনেছে!
স্যান্ডউইচ খেয়ে আপেল নিতে হয় কুহুকে। এবং ধীরে ধীরে সবগুলো শেষও করতে হয়। তাহমিদের জেদের কাছে কিছুতেই পেরে উঠেনা বেচারি। মেডিসিন নেয়ার পর নিস্তার মেলে ওর।

দুজন মানব-মানবী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
কুহু তাকিয়ে আছে সূদুর মহাশূন্যে। মহাশূন্যের অতল রহস্য ওকে সব সময়ই ভিষণভাবে টানে।
মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে মহাশূন্যের শূন্যতা।
এদিকে তাহমিদ যে ওকে এক দৃষ্টিতে দেখছে, সেদিকে নজরই নেই কুহুর।
তাহমিদ আজও জানেনা, এই মেয়েটাকে হঠাৎ করেই এত ভালোবাসল কেন!
এই মেয়ে কি জানে, তার জন্য সারা দুনিয়ার সাথে লড়তে দ্বিধা করবেনা ও? মেয়েটা কি অনুভব করতে পারে, ওর জন্য তাহমিদ এই মহাশূন্যের ন্যায় অসীম ভালোবাসা নিজের বুকে জমা রেখেছে? যে ভালোবাসায় কোন কামনা নেই। নেই কোন খাঁদ কিংবা সন্দেহ।
কিন্তু এই মেয়ে যে ধরা দিয়েও, দূরে পালায়! ও যে কি চায়, তা আজও বুঝতে পারেনি তাহমিদ। এত রহস্য কেন এই মেয়ের মাঝে! ঠিক যেন এই মহাবিশ্বের সমস্ত রহস্য এর মাঝে বিরাজমান।

” শ্যামাঙ্গীনি, আরও কত অপেক্ষা করাবে আমাকে? তোমার কি একটুও মায়া হয়না আমার জন্য? অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে বুঝি, আমিই শেষ হয়ে যাব। তবুও কি আমার অপেক্ষার পালা শেষ হবেনা? ”
তাহমিদের কথা শুনে চমকে তাকায় কুহু।
ঠোঁট কামড়ে, অসহায় চোখে চেয়ে আছে তাহমিদ। ওর এমন চাহনিতে কুহুর বুকের ভিতর দ্রিমদ্রিম শব্দ করছে। এমন মনে হচ্ছে, যেন এই শব্দ ধরনীর সব মানুষ শুনতে পাচ্ছে। এই বুঝি ঘুম ভাঙ্গলো সবার! শুকনো ঢোক গিলে কুহু। মনে মনে কথা গোছাচ্ছে।
” আমি আপনাকে অপেক্ষা করাচ্ছি! হঠাৎ আপনার এমন মনে হল কেন! ”
” অবশ্যই অপেক্ষা করাচ্ছ। লেখাপড়া শেষ করে তবে বিয়ে করবে। তোমার পড়া শেষ হতে কম করে ছয় বছর লাগবে। ততদিনে আমি বুড়োর খাতায় নাম লিখাব। কবে সংসার হবে, আর কবেইবা ছেলেমেয়ে হবে। তাদের মানুষ করব কবে। এ জন্মে আমার সংসার হবেনা। ”
তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হেসে উঠে।
” আপনার নিজেরই তো পড়াশোনা শেষ হয়নি। এখনই সংসার করার এত শখ! আগে পড়াশোনা শেষ করুন। একটা চাকরি শুরু করুন। বাবা-মা ‘র যোগ্য ছেলে হয়ে উঠুন। নিজের রোজগার তাদের হাতে তুলে দিন। তারপর বিয়ে করার স্বপ্ন দেখবেন। ”
” বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে। তোমার থেকে জ্ঞান কে চেয়েছে শুনি? আমার সংসারের স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে, সাধু সাজা হচ্ছে! ”
” আচ্ছা, যান আর জ্ঞান দিবনা। ”
” সত্যি কি তুমি সিদ্ধান্ত বদলাবানা! আমাকে এভাবে কষ্ট দিবা! এতটা নিষ্ঠুর তুমি শ্যামাঙ্গীনি! ”
তাহমিদের এই গলার আওয়াজ শুনলেই কুহু ভিষণ দূর্বল হয়ে পরে। কিন্তু ও যে নিরুপায়। এমনিতেই ফুপুর সংসারে এসে পরেছে। ফুপু-ফুপাই বাবা-মা’র দ্বায়িত্ব পালন করছে। তার ওপর যদি এখনই বিয়ের জন্য তাহমিদের সাথ দেয়, তবে আরেকবার তাদের বোঝা হতে হবে। তাহমিদ নিজেও স্টুডেন্ট। তার আরও দুই বছর লাগবে পাশ করে বের হতে। এসব ভাবলেই এখন বিয়ে করার সাধ মিটে যায় কুহুর।

” প্লিজ কুহু, একবার রাজি হও। আমি তোমাকে নিরাশ করবোনা দেখ। সব দ্বায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করব। দুনিয়াকে একজন ভালো সন্তান, ভালো স্বামী এবং আদর্শ বাবা হয়ে দেখাব। শুধু তুমি একটিবার আমার হাত ধর। ”
” আপনি এভাবে পাগলামি করছেন কেন! আগে নিজের পড়াশোনা শেষ করেন। তখন না হয় সব হবে। আমি বিয়ের পর দরকার হলে পড়াশোনা করব। ”
তাহমিদ বুঝতে পারে কুহু এখন কিছুতেই রাজি হবেনা।
” ওকে, তুমি যা চাও তাই হবে। আমার পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে, সেদিনই তোমাকে বিয়ে করে তবেই বাসায় ঢুকবো। মাত্র আর দুইটা বছর। ” তাহমিদ মুখে যতই বলুকনা কেন ও ভেতরে ভেতরে খুব করে কুহুকে চাচ্ছে।
” এখন নিজের রুমে যান। অনেক রাত হয়েছে। ”
” তুমি যাও, আমি কিছুক্ষণ পর যাব। ”
” না, আপনি এক্ষুনি যাবেন। একটা কথাও বলবেননা। ”
কুহুর কথার মধ্যে একটা অধিকারবোধ টের পায় তাহমিদ। নিমেষেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি খেলে যায়।
” কি ব্যাপার বউ বউ ফর্মে চলে গেছ মনে হচ্ছে! বিষয়টা মন্দ লাগছেনা। দুই বছর পরের শাসন, দুই বছর আগেই করছ! একটা সুখ সুখ অনুভূতি বুকে ধা’ক্কা মা’র’ছে গো, বউ। আমার মিষ্টি, বউ। এত সুখের জীবনও হয় বুঝি! তুমি সামনে আসতেই এত সুখ! যখন আমার রুমে থাকবে, সারারাত বুকে করে রাখব, অনেক ভালোবাসব, তখন না জানি কত সুখ হবে। ”
তাহমিদের এমন নির্লজ্জ রকমের কথা শুনে কুহু এক দৌড়ে নিচে চলে আসে।
কুহুর এরূপ কান্ডে হো হো করে হেসে উঠে তাহমিদ। এরপর নিচে আসে।

কায়েস কয়েকদিন থেকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। টুকটাক দেখভাল করছে। আসলে বাড়িতে বসে থেকে শিউলির মুখ দেখতে তার ইচ্ছে করেনা। তাই ধীরে ধীরে আবার নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছে।

শিউলি দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে। আজ সকালে দৃষ্টি ফোন করেছিল। সবুজ নাকি বলেছে, কি একটা কাজে আজ এখানে আসবে। তাই বাহারি রান্নার জোগাড় করছে শিউলি। ফাঁকা বাড়িতে মনের আনন্দে কাজ করছে সে।
শিহাবও স্কুলে গেছে। এতে বেশ সুবিধাই হয়েছে শিউলির। কায়েসও জানেনা সবুজ আসবে। আবার শিহাব স্কুল থেকে ফেরার পূর্বেই যদি সবুজ চলে যায়, এতে কেউ জানবেওনা ও এসেছিল। এমনিতেই শিহাব খুব একটা পছন্দ করেনা সবুজকে। এখন পর্যন্ত সবুজের সাথে কথা বলেনি ছেলেটা।
শিউলির রান্না শেষ হতেই সবুজের আগমন ঘটে। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ঢোকে।
শিউলি সবুজকে দেখেই একগাল হেসে এগিয়ে আসে।
মেয়ের জামাইকে আদর করে ঘরে এনে বসায়। একটু পর সবুজের সামনে নাস্তার পাহাড় নিয়ে হাজির হয় শিউলি।

এক টুকরা আপেল মুখে দিয়ে কথা বলে সবুজ।
” আম্মা, আমার আব্বা একটা কাজ দিয়ে পাঠালো। আপনি রাজি থাকলেই হবে। ”
” কি কাম, বাজান? আর তোমার আব্বা-আম্মায় কিমুন আছে? ”
” তারা সবাই ভালো আছে, আম্মা। আপনি জানেনই তো, চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে আমার আব্বা অনেককেই সরকারি ভাতার কার্ড করে দিতে পারে। প্রয়োজনমত কার্ড দেবার পরও আব্বার কাছে কয়েকটা কার্ড সব সময়ই থাকে। সেগুলো নিজের আত্মীয়দের দেয়। সেদিন দৃষ্টি বলল, ওর নানী, মামাদের কথা। আমি আব্বাকে বলেছি সে বিষয়ে। কিন্তু আব্বা বলল, তারা অন্য ইউনিয়নের বাসিন্দা তাই সরাসরি তাদের কার্ড করে দিতে পারবেনা। পরে আমি দৃষ্টির সাথে আলোচনা করে বের করেলাম, যদি আপনার নামে কার্ড করি, তাহলে হবে। ” সবুজের কথা শুনে আগলাদে গদগদ হয়ে যায় শিউলি।
দুইদিন হয়েছে বিয়ের, অথচ শিউলির মা, ভাইদের জন্য কত চিন্তা করছে!
” আমার কি করন লাগবো, বাজান? কিন্তু আমিতো হেইসব জিনিস পত্তর আনবার যাইতে পারুমনা। তোমার শ্বশুর জানলে আমারে মা’ই’রা ফালাইবো।
” আপনার কিছুই করতে হবেনা। শুধু একটা ফর্ম পূরণ করে দিবেন। আর বাকি কাজ আমিই করব। আর জিনিসপত্রগুলোও আমি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব। আব্বা কিছুই জানবেনা। ”
” কিন্তু, বাজান, আমি ফর্ম পূরণ করবার জানিনাতো। ”
” আচ্ছা, আম্মা আমিই সব ঠিক করে দিব। আপনি শুধু সই করবেন। আপনি সই করতে পারেন তো?”
” হ, নাম লেখবার পারি। ”
” তাহলে এখানে সই করে দেন। বাকিটা আমি পূরণ করছি। ” সবুজ পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে শিউলিকে দেখিয়ে দেয় কোথায় কোথায় সই করতে হবে। শিউলি সবুজের কথামত সই করে দেয়।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিদায় নেয় সবুজ। সবুজ বিদায় নিতেই শিউলি ফোন করে দৃষ্টির কাছে। মেয়েকে সবটা জানায়। দৃষ্টি বলে ওর শ্বশুরের সাথে আলোচনা করেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে দৃষ্টি খুব করে চায় ওর নানী, মামারা ভালো থাকুক।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here