#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী
সকালে ঘুম থেকে উঠে, নাস্তা করে কায়েস বাজারে যায়। বড় কাতল মাছ, চিতল মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, কবুতর, পাঁচ রকম মিষ্টি, দই, কয়েকরকম ফলমূল নিয়ে বাড়ি আসে। আসার পথে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা চাচিকে ডেকে নিয়ে আসে। বৃদ্ধার তিনটা মেয়ে। তাদের সবার বিয়ে হয়েছে। কোন ছেলে না থাকায় বৃদ্ধা বাড়িতে একাই থাকে। কায়েসের বাবা-মা বেঁচে
থাকতেও তিনি এ বাড়িতে এসে রান্না করে দিয়েছেন। তাই আজকেও কায়েস রান্না করার জন্যই চাচিকে নিয়ে এসেছে।
দোকানের ছেলেটার হাতে বড়বড় দুইটা বাজারের ব্যাগ দেখে শিউলির চোখ কপালে উঠে।
কায়েস চাচিকে ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করতে বলে। বৃদ্ধা ব্যাগ ঢালতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। এত মাছ-মাংস!
” বাবা, কায়েস? এত কিছু কিনছ যে? তোমার বাড়িতেই কোন কিছুর অভাব নাই, আবার বাজার থাইকা কিন্যা আনছ! ” বৃদ্ধা অবাক হয়ে জানতে চান।
” চাচি, আমার বড় মেয়ে আসছে। সাথে আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীও আসছে। তাই মেয়ের পছন্দের মাছ, ভাগ্নে-ভাগ্নীর পছন্দের মাছ-মাংস এনেছি। আপনি ভালো করে রান্না করুন। যাতে বাচ্চারা খেয়ে খুশি হয়। আর ওরা যে কয়দিন থাকবে সে কয়দিন আপনিই রান্না করবেন। এবং এখানে থাকবেন। ”
কায়েসের কথা শুনে বৃদ্ধা খুব খুশি হন। তিনি এই বাড়ির সকল ঘটনাই জানেন, তাই বাড়তি কোন প্রশ্ন তিনি করলেননা।
কুহুর মন মানছেনা। কখন যে গ্রামে যাবে। আজ পথ যেন শেষ হচ্ছেনা। তিনজন সারা রাস্তা খুনসুটিতে মেতে থাকে। আনান কুহুকে জ্বা’লি’য়ে মে’রে’ছে। তাহমিদকে নিয়ে এটাসেটা টিটকারি মেরেই গেছে। কুহু নীরবে আনানের অত্যাচার সহ্য করেছে। রাস্তায় কোন দোকানপাট দেখলেই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে, কুহুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছেমত খাবার কিনে খেয়েছে। কুহু এখন বুঝতে পারছে তাহমিদ কেন জোড় করে টাকাগুলো দিয়েছিল।
দুইটার দিকে ওরা ফুলতলা পৌঁছায়। কায়েস মেয়ের অপেক্ষায় শুধু ঘরবাড় করছিল। বাড়ির সামনে গাড়ির হর্ন শুনতেই সে দ্রুতই বাইরে আসে।
কুহু গাড়ি থেকে বেরিয়েই বাবাকে সামনে দেখে ছুটে যায় বাবার কাছে। কায়েসও পরম স্নেহে মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। সিক্তা আর আনান গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের মিলন দেখছিল। ওরা ইচ্ছে করেই দূরে দাঁড়িয়ে আছে।কতদিন পর মেয়ে তার বাবার কাছে এসেছে, তাদের এই সুখের মুহূর্তে ওরা বাঁধা দিতে চায়না।
” সিক্ত, তুইও কি শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি গিয়ে, তোর বাপকে এম্নেই জড়িয়ে ধরবি? আমার মনে হয় তুই ইচ্ছে করলেও, বাপকে জড়িয়ে ধরতে পারবিনা। তোর বাপের ভুঁড়ি যত বড়! যেন আস্ত একটা তবলা! তুই দুই হাত দিয়ে তোর বাপকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই, হাত শুধু ভুঁড়িটার মধ্যেই লুটোপুটি করবে। ”
আনানের কথা শুনে সিক্তা রে’গে আ’গু’ন হয়ে গেছে।
” এই, অসভ্য ভাইয়া তুমি চুপ করবে? আমার বাপের ভুঁড়ি আছে তাতে তোমার কি? গুণিজনের ভুঁড়িই সম্পদ। আমার বাবা গুণিজন তাই তার ভুঁড়ি আছে। তোমার বাপের কি আছে? না আছে ভুঁড়ি, না সে গুণিজন। শরীরে তো মাংসের বালাই নেই, আছে শুধু হাড়ের ওপর চামড়া। দেখে মনে হয় কেউ যেন ক’ঙ্কা’ল’কে মেকআপ করিয়ে দিয়েছে। ” সিক্তাও দ্বিগুণ তেজে উত্তর দেয়।
নিজের বাবার সম্পর্কে এরূপ বর্ননা শুনে আনানের মাথা গরম হয়ে গেছে।
” ঐ ছেমরি, চুপ যা। আসছে আমার বাবার খুঁ’ত ধরতে। আমার বাবার মত যোগ্যতা তোর বাপের আছে? আমার বাবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর তুই কিনা আমার সেই বাবাকে ইনসাল্ট করিস? তোর বাপের ঐ ভুঁড়ি ছাড়া আছেটা কি? ”
” তোমার বাপ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আর আমার বাবা কি ফকির? আবার বাবার তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর সবাইকে কিনে নেয়ার মত ক্ষমতা আছে। আর যে ভুঁড়ির কথা বলছো, তবে শুনে রাখ ঐ ভুঁড়িই বাবার অ’হং’কা’র। ”
ভাগ্নে-ভাগ্নীর উচ্চস্বর কানে আসতেই কায়েস তাদের দিকে তাকায়। ততক্ষণে ওদের ঝগড়া বেশ কঠিন আকার ধারণ করেছে। সিক্তা পারলে আনানকে দুই ঘা লাগিয়ে দেয়।
কায়েস হাসিমুখে ওদের দিকে এগিয়ে যায়।
” তোরা আসতে না আসতে ঝ’গ’ড়া করছিস! এভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে কেউ ঝগড়া করে! আগে ভেতরে চল, খেয়েদেয়ে শরীরে শক্তি করে তারপর ঝ’গ’ড়া করিস। ” কায়েস সিক্তার হাত ধরে নিয়ে যায় বাড়ির ভেতর। তবে ভেতরে যাওয়ার আগে ড্রাইভারকে ভেতরে আসতে বলে।
কয়েকমাস পর নিজের ঘরে এসে কুহু চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। ব্যাগ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। নীরবে অনুভব করে বাতাসের ঘ্রাণ।
সিক্তা ফ্রেশ হয়ে এসে ওকে বসে থাকতে দেখে খেঁ’কি’য়ে উঠে।
” ঐ কুহু, তুই ফ্রেশ হবিনা? নোং’রা মেয়ে , এতক্ষণ ফ্রেশ না হয়ে বসে আছিস! ওঠ, যা ফ্রেশ হয়ে আয়। ”
কুহু সিক্তার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে কলপাড়ে যায়।
শিউলি আক্তার বারান্দায় বসে ছিল। সে কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে। কুহুও সেটা বুঝতে পেরেছে। সে-ও শিউলির সাথে কথা না বলে সোজা কলপাড়ে যায়।
খেতে এসে কুহু দেখল এলাহি আয়োজন। সেই বৃদ্ধা দাদী ওদের খেতে দিয়েছে। শিউলি এত আয়োজন দেখে রা’গে ফুঁ’স’ছে। বৃদ্ধা অনেকবার বলেছে, শিউলিই যেন ওদের খেতে দেয়। কিন্তু শিউলি তার কথার ধার ধারেনি। বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাই বাচ্চাদের খেতে দেয়।
কায়েসও ওদের সাথে খেতে বসেছে। শিহাব স্কুলে গেছে, ওর আসতে আরও দেরি হবে। তাই ওরা শিহাবের জন্য অপেক্ষা না করে খেতে বসে।
কুহুর পাতে এটা-সেটা তুলে দিচ্ছে কায়েস। কুহু না করলেও জোড় করে দিচ্ছে। ভাগ্নে-ভাগ্নীকেও বাদ রাখছেনা।
অনেকদিন পর কুহু তৃপ্তি করে খায়। ওদের খাওয়া হলে বৃদ্ধা খেতে বসে। শিউলি তখন পর্যন্ত একবারও এদিকে আসেনি।
রাত বারোটা বেজে পাঁচ। সিক্তা ঘুমিয়ে পরেছে। কুহু বিছানায় বই নিয়ে পড়ছে। ফোনের শব্দে ওর পড়ায় বি’ঘ্ন ঘটে। বই রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখল তাহমিদ ফোন করেছে। কুহু মুচকি হেসে ফোন রিসিভ করে।
শিউলি সিক্তা, আনানের সাথে হেসে হেসে কথা বললেও, কুহুকে দেখলেই মুখ কালো করছে। একবারের জন্যও কুহুর সাথে কথা বলেনি। আনান, সিক্তা এসব খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে। তবে প্রতিবারের মত কুহু ছোটমা ছোটমা করছেনা। ও নিজের মত করে চলছে।
সেই বৃদ্ধা দাদী আর প্রতিবেশি দুইজনকে সাথে নিয়ে ওর পালিত হাঁস-মুরগীগুলো ধরেছে। সেগুলো কাউকে দিয়ে জবাই করে নিয়ে বেছ-কেটে ঢাকা নিয়ে যাবে। এখন আর গ্রামে এসে থাকা হবেনা। এগুলো দেখে রাখার মত সময় শিহাবের নেই। তাই চিন্তা করেছে হাঁস-মুরগীগুলো জবাই করে ফুপুদের জন্য নিয়ে যাবে।
এভাবে হাঁস-মুরগীগুলো ধরতে দেখে শিউলি আক্তার চুপ থাকতে পারেনা। ওর বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসলে রান্না করে কিংবা মাঝেমধ্যে মেয়ের বাড়িতে রান্না করে পাঠায়। এখন যদি সবগুলোই কুহু জবাই করে তাহলে কেউ আসলে তার নিজের পালিত হাঁস, মুরগীগুলো ধরতে হবে ভেবেই রা’গ তরতর করে বেড়ে যায়।
” সবগুলান হাঁস-মুরগীই জবাই দিতাছোস ক্যা? কয়ডা রাইখা দে। আমার মাইয়া-জামাই আইলে কি জবাই দিমু? এত খাওনের জিবলা ভালো না। ”
” তোমার মেয়ে-জামাইকে নিজের গুলো জবাই করে খাওয়াবে। এগুলো সব আমার। আমার নিজের জমানো টাকায় কেনা। এগুলোর দিকে তুমি নজর দাও কেন! আমি আমার হাঁস-মুরগী কি করব সেটা তোমার না দেখলেও চলবে। বাপ-দাদার অনেক কিছু আছে, তাই আমার খাওয়ার জিহ্বাও আছে। তোমার জিহ্বা থাকলে তুমিও খাবে, মানা করেছে কে! ” কুহুর সোজাসাপটা উত্তর শুনে শিউলির মুখে কোন কথা জোগায়না। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে আবার মুখ খোলে।
” কতা খুব বেশি কইতাছোস। এত বাড়িসনা, জিবলা টা’ই’না ছিঁ’ড়া ফালামু। তহন কতা কওনের জন্য আর জিবলাই থাকবোনা। ”
” আমার নিরবতাকে দুর্বলতা ভাবলে তুমি ভুল করবে। এতদিন আমি নিরবে তোমার সব অত্যাচার সহ্য করছি বলে ভেবনা এখনও সহ্য করব। কেউ আমাকে ই’ট মা’র’লে তাকে পা’ট’কে’ল ঠিকই ফিরিয়ে দিব আমি। আশাই করছি আমাকে মা’রা’র মত ভুল আর করবেনা। কখনও কিছু বলিনি তার মানে এই নয় যে আমি বলতে পারিনা। সেটাতো আমার ভদ্রতা ছিল। কিন্তু এখন ভদ্রতার কোন ধার আমি ধারবনা। আমাকে মা’রা’র সাহস কেউ করলে তার হাত আমি ভে’ঙে দিব। ”
কুহুর কথা শুনে শিউলির বুক শুকিয়ে গেছে। ডে মেয়ে সাত চড়ে রা কাটতনা, আজ সেই মেয়ে এসব কি বলছে! শিউলি বেশ বুঝতে পারছে তার আধিপত্য এবার শেষ হতে চলেছে।
কুহু শিহাব আর বাবার জন্য তিনটা হাঁ, তিনটা মুরগী কেটেবেছে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। সেই বৃদ্ধা দাদিকেও হাঁস-মুরগী দিয়েছে। বৃদ্ধা নিতে না চাইলেও কুহু জোর করে দিয়েছে। বৃদ্ধা খুব খুশি হয়েছে। কুহুকে অনেক দোয়া করেছে।
আজ ওরা ঢাকা ফিরবে। সেদিনের পর থেকে শিউলি আর কুহুর সাথে কথা বলেনি। কুহু ইচ্ছেমত রান্না করে বাবা, ভাই, ফুপাতো ভাই-বোনদের খাইয়েছে। সেই বৃদ্ধা দাদীও ওকে কাজে সাহায্য করেছে। ওরা প্রত্যেকবার খাবার সময় শিউলিকে ডেকেছে, কিন্তু শিউলি ওদের রান্না করা খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। সে নিজের খাবার নিজে রান্না করে খেয়েছে।
আনান সিক্তা এসব দেখে বেশ বিরক্ত হয়। আনান ওর মা’কে ফোনে সবটা জানিয়েছে। সব শুনে শাহনাজ সুলতানা ভিষণ রে’গে যান। ছেলেকে এ নিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করে দেন। আনান মা’য়ের কথামত চুপচাপ থাকে।
কায়েস বোনদের জন্য পুকুরের মাছ, শাকসবজী, ফলমূল গাড়ি ভর্তি করে দিয়েছে। কুহু, আনান, সিক্তাকে ওদের পছন্দমত পোশাক কিনে দিয়েছে। কুহুর হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। কুহু নিতে চায়নি, কিন্তু কায়েস জোর করেই মেয়েকে টাকাগুলো দিয়েছে।
শিহাব সকাল থেকে কাঁদছে। ওর বড় আপু চলে যাচ্ছে, আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই। অনেকদিন হয়তো আপুকে দেখতে পাবেনা, সেই দুঃখেই ও কাঁদছে।
” মা, সাবধানে থাকবি। মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। তোর ফুপুরা এখানে আসতে দিতে না চাইলে জোর করবিনা। তোর মন খারাপ হলে আমাকে বলিস। শিহাবকে নিয়ে তোকে দেখে আসব। আর যখনই টাকার প্রয়োজন হবে, আমাকে জানাবি। কখনোই ভাববি না তোর কেউ নেই। ”
” আমার কিছুই লাগবেনা, বাবা। আমি চাই তুমি সুস্থ থাক, ভালো থাক। নিজের শরীরের খেয়াল রেখ। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করো। ঔষধ খেও। যখনই শরীর খারাপ লাগবে, সাথে সাথে আমাকে ফোন কর। আমার কাছে কিচ্ছুটি লুকিওনা বাবা। ” কুহু কান্না থামাতে পারছেনা।
বাবার কাছ থেকে, শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে। কুহুর কান্না দেখে আনান, সিক্তারও মন খা’রা’প হয়ে গেছে।
চলবে…