#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী
শিউলি আক্তার ডুকরে কাঁদছে। সে ভাবতেই পারেনি তার স্বামীর সাথে এমন কিছু হবে। কায়েসের সাথে যেতে পারেনি বলে তার আফসোসের অন্ত নেই।
শিহাব মায়ের থেকে একটু দূরে বসে আছে। ওর চোখেও পানি। মনে একটাই চিন্তা হানা দিচ্ছে, আব্বু সুস্থ হবে তো?
সারাটা রাস্তা কুহু কাঁদতে কাঁদতে যায়। কায়েস ঘুমাচ্ছে। তাহমিদ সকালে কোন একটা ঔষধ দিয়েছিল, যার প্রভাবে ব্যথা কম অনুভব করছে এবং সেই সাথে ঘুমাচ্ছে।
মধ্য দুপুরে ওরা মেডিকেলে পৌঁছায়। তাহমিদ পূর্বেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল, তাই কায়েসকে ভর্তি করতে কোন ঝামেলা হয়না। ওরা মেডিকেলে পৌঁছানোর খানিক পরেই তাহমিনা আক্তার হাজির হন সেখানে৷
কায়েসকে ভর্তির পর ডক্টর আসলেন। যিনি তাহমিদের শিক্ষক। তিনি সকল পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে জানালেন, বুকের তিনটা হাড় ভেঙে গেছে। গত কয়েকদিন থেকে চিকিৎসার অভাবে সেখানে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করা প্রয়োজন। তাহমিদ বড়মার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় অপারেশনের। ডাক্টরকে ওদের সিদ্ধান্ত জানালে, তিনি জানান আগামীকাল দুপরেই অপারেশন করবেন।
কুহু বারান্দায় বসে কাঁদছে। ওর পাশে তাহমিনা আক্তার বসে আছে। ফুপু কথা বলছে ডক্টরের সাথে। এমন সময় তাহমিদ সেখানে আসে। কুহুর সামনে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। কুহু তাহমিদের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দেয়। ওর তো পিপাসা লাগেনি! তবে তাহমিদ কেন ওকে পানি দিচ্ছে!
” জলদি খেয়ে নাও। এখানে স্যালাইন গুলিয়ে এনেছি। সারাটা রাস্তা যে হারে কেঁদেছ, আমি ভয়ই পেয়েছিলাম। শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে, না জানি রাস্তায়ই কিছু একটা ঘটে যায়। ভাগ্য ভালো তেমন কিছুই হয়নি। এখন স্যালাইন না খেলে দেখা যাবে, ডিহাইড্রেশন হয়ে বাপ-মেয়ে একসাথে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছ। তারাতারি খেয়ে নাও। তোমার এখন সুস্থ থাকা জরুরি। তাছাড়া যে ত্যা’ড়া মেয়ে তুমি, বাপের সেবা করতে দিলেও, নিজের বিষয়ে আমাকে নাক গলাতে দিবেনা, তা ভালোই জানি। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু বিরাট ঝটকা খায়। এই মানুষটা বলে কি! এর মাথার তার ছেঁ’ড়া নাকি!
” আহ, তাহমিদ কি শুরু করেছিস এসব! এখন মেয়েটার পেছনে না লাগলেই কি নয়? দেখছিস ও এমনিতেই বাবার চিন্তায় অস্থির। তার ওপর তুই ওকে খোঁ’চা’চ্ছি’স? ”
” তুমি আর ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলনা মা। এই মেয়ে এমনিতেই যে ত্যা’ড়া, এরপর তোমার সাপোর্ট পেলে ইন্টারন্যাশনাল ত্যা’ড়া কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ পাবে। এখন এই স্যালাইনটুকু ওকে খেতে বল৷ আর বেশি চিন্তা করতে নিষেধ কর। ওর বাপের কিছুই হবেনা। এ যাত্রায় তার লাইফের লাইসেন্স রিনিউ হলো। তবে আরে একটা দিন দেরি হলেই টপকে যেত। ”
কুহু যতই তাহমিদের কথা শুনছে ততই ওর মাথা ঘুরাচ্ছে। কি অবলীলায় কঠিন কথাগুলো বলছে, এই অ’স’ভ্য ছেলে।
” আন্টি, তোমার ছেলেকেই তার আনা স্যালাইন খাওয়াও। বকবক তো কম করলোনা। এখন এই স্যালাইন তারই প্রয়োজন। ” কুহু রে’গে একসা।
তাহমিদ ওর রা’গ দেখে হাসছে। এই মেয়ে রা’গ’তেও জানে!
” তাহমিদ, তুই যাবি? তুই কি বলতো? আমি তোকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি! ”
” অবাক পরেও হতে পারবে। এখন ওকে এটা খেতে বল। আর সে যদি কথা না শোনে, তবে আমি ওকে জোর করে খাওয়াব বলে দিলাম। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। এত মানুষজনের সামনে যদি, ওকে সত্যিই জোর করে! এই ভেবেই কুহু তাহমিদের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়েই ঢকঢক করে পান করে গ্লাসের সবটুকু স্যালাইন পানি। এরপর খালি গ্লাস এগিয়ে দেয় তাহমিদের দিকে।
তাহমিদ গ্লাস নিয়ে মুচকি হেসে প্রস্থান করে। কারন ও জানত, ও যদি এভাবে কথা না বলত তবে কুহু কিছুতেই খেতোনা। গতকাল থেকেই মেয়েটা কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে। ওকে দেখেই বোঝা যায়, অনেক দূর্বল হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা থেকেই ওদেরকে মেডিকেল থেকে বাসায় যেতে তাড়া দিচ্ছে তাহমিদ। আফরোজা নাজনীন ভাইকে রেখে কিছুতেই যেতে চাচ্ছেননা। আর কুহুও বারবার বলছে, বাবার কাছেই থাকবে
এদিকে সেই সকাল থেকে ওরা না খাওয়া। তাহমিনা আক্তার দুপুরে আসার সময় খাবার আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার শ্বাশুড়ির কথায় আনেননি। তিনি বলেছিলেন, ওরা আসছে এরপর কোথায় কোথায় দৌড়াতে হবে। খাবার খাওয়ার সময় পাবেনা। হয়েছেও তাই। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তারা ঝামেলামুক্ত হন। তাই এখন তাহমিদ ওদের বাসায় পাঠাতে চাচ্ছে। কিন্তু কেউই রাজি নয়।
” বড়মা, তোমরা চলে যাও। আমি আজ রাতে মেডিকেলে থাকব। এমনকি আমাদের ক্লাসের অনেকেই আজ এখানে থাকবে৷ আমরা মামার খেয়াল রাখতে পারব। তুমি বরং বাসায় গিয়ে রেষ্ট নাও। অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর। কাল সকালে আবার আসবে। আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। তোমরা এখনই যাবে। ”
” বাপ, ওর যদি কিছু প্রয়োজন হয়, কিংবা ক্ষুধা লাগে। তখন ওকে কে দেখবে? আমি বরং থাকি। কুহু আর তাহমিনা বাসায় যাক। ”
” না ফুপু, আমিও তোমার সাথে থাকব। বাবাকে এভাবে রেখে আমি যাবনা। ”
” এই মেয়ে, তুমি শুনতে পাওনি আমি কি বলেছি? তোমরা কেউই এখানে থাকতে পারবেনা। আমি এখানে থাকব, বুঝেছ? তাছাড়া কাল তোমার ক্লাস নেই? কোচিং নেই? তুমি ক্লাস করে এখানে আসবে এবং কোচিংয়ের আগেই ফিরে যাবে। আমার কথার ওপর যদি আর কিছু বলেছ, তবে ঠাঁ’টি’য়ে একটা দিব। বড়মা তোমরা বাসায় যাও। আর একটা কথা বলবেনা। ”
তাহমিদ রেগে গেছে বুঝতে পেরে আফরোজা নাজনীন আর কিছুই বলেননা। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, নার্সদের কাছে তাকে দেখতে বলে বেরিয়ে আসেন কেবিন থেকে।
” মা, ওকে দেখে রেখ। বাসায় নিয়ে যেয়ে খাইয়ে দিও। ও সকাল থেকেই না খেয়ে আছে। ”
” আমি জানি বাসায় যাওয়ার পর কি করতে হবে। কত দ্বায়িত্ববান হয়ে গেছে আমার ছেলে! যে ছেলে কখনো মা খেয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করেনি! আর আজ সেই ছেলেই আরেকজনের কথা ভাবছে! ” মুচকি হেসে বললেন তাহমিনা।
” প্লিজ মা, তুমি অন্তত এভাবে বলোনা। আমরা ছাড়া ওর কে আছে। ওর ভালোমন্দ আমাদেরই দেখতে হবে। ”
” হয়েছে, হয়েছে। একটু আগেই যে ধমকটা দিলি, এরপর ওকে পাওয়ার আশা বাদ দে। এমন ভাবে কথা বলিস, যেন মুখে নিমপাতার রস লেগে আছে। একটু ভালো করে কথা বলতে পারিসনা? এমনিতেই মেয়েটা চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে আছে। এরমধ্যে তুই শুধু ওকে ধ’ম’কা’স। আচ্ছা শোন, বাসায় যাবিনা? তুই কি খাবিনা? সকাল থেকেই এভাবে আছিস, ফ্রেশ হতে হবেনা? তুইও বাসায় চল। গোসল সেরে, খেয়েদেয়ে আবার আসবি। ”
” স্যারকে না বলে আমি যেতে পারবনা, মা। আচ্ছা তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি বড়মাকে ডাকছি। স্যারের সাথে কথা বলে দেখছি উনি কি বলেন। ”
তাহমিদ ফোন করে বড়মার কাছে। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাহমিনার। তাহমিদে ওর বড়মাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে। এরপর সোজা যায় স্যারের কাছে। তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মা, বড়মা আর কুহুকে নিয়ে বাসায় আসে।
বাসায় এসে যে যার রুমে যায়। কুহু আসে সিক্তান রুমে। সিক্তার কাছ থেকে একটা থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
গোসল সেরে ওরা নিচে আসে। তাহমিনা আক্তার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাহমিদ, কুহু আর আফরোজা নাজনীন একসাথে খেতে বসে। খাওয়া শেষে তাহমিদ বেরিয়ে যায় মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।
শরীর ক্লান্ত থাকায় কুহু শোওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরে। আফরোজা নাজনীনেরও একই অবস্থা। আজ তিনি কুহুকে নিজের সাথে রেখেছেন। সানাউল রাশেদিন দেশের বাইরে গেছেন কিছুদিনের জন্য।
সকালে খাবার খেয়েই আফরোজা নাজনীন মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার সাথে কুহুও আছে।
কুহুকে মেডিকেলে দেখা মাত্রই তাহমিদের মাথা গ’র’ম হয়ে যায়। এই মেয়েকে সে ক্লাস শেষে আসতে বলেছিল, আর সে কিনা সকালেই এসে হাজির। ওর ইচ্ছে করছে কুহুকে আচ্ছামত ধো’লা’ই করতে। কিন্তু বড়মা থাকায় কিছু বলতে পারছেনা।
কায়েসের বুকের ব্যথা আগের থেকে কম। কিন্তু তিনি ভালোমত কথা বলতে পারছেননা। আফরোজা নাজনীন ভাইয়ের পাশে বসে আছেন।
ডক্টর এসে চেক-আপ করছেন। একটা নার্স কুহু আর আফরোজা নাজনীনকে বাইরে যেতে বললে তারা বাইরে এসে দাঁড়ায়। এমন সময় শিউলির নম্বর থেকে ফোন আসে আফরোজা নাজনীনের ফোনে। তিনি ফোন রিসিভ করে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ান ।
” তুমি একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বড়মা কোথায়? ” তাহমিদ জিজ্ঞেস করল কুহুকে।
” ফুপু ফোনে কথা বলছে। ”
” তোমাকে সকালে এখানে আসতে নিষেধ করেছিলাম। ক্লাস করে আসতে পারতে। ”
” বাবাকে এ অবস্থায় রেখে ক্লাসে মন বসবেনা। ”
” পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। তুমি এখানে থাকলেও কিন্তু কোন লাভ নেই। আর ক্ষতিটাও তোমারই হচ্ছে। আমি মামার খেয়াল রাখতে পারব। আর নার্সদেরও বলে দিয়েছি। তারা তাদের সাধ্যমত মামার খেয়াল রাখবে। তুমি ক্লাস আর কোচিং মিস দিওনা। এখান থেকে সোজা হোস্টেলে যাবে। তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় যাবে। সেখান থেকেই ক্লাস কর। আমি বড়মাকে বলে দিব। ” তাহমিদের কথার মাঝে অধিকারবোধ দেখে অবাক হয় কুহু।
এই মানুষটার মন বোঝা দায়। এই রা’গ তো এই স্বাভাবিক।
” আমি হোস্টেল থেকেই যাতায়াত করতে পারব। ” কুহুর বলতে দেরি, কিন্তু তাহমিদের রা’গ’তে দেরি হয়না।
” আবার ত্যা’ড়া’মি করছে দেখ! এই মেয়ে, তোমার কি ত্যা’ড়া লগ্নে জন্ম? নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছ, আমি যা বলব তার বিপরীতে যাবে তুমি? হোস্টেল থেকে যখনতখন বের হতে দিবে তোমাকে! নাকি সাহস খুব বেশি বেড়েছে? শুধু তুমি বলে আমি তোমার সব ত্যা’ড়া’মি সহ্য করছি। অন্য কেউ হলে, তার গাল লাল করে দিতাম। ”
” আপনি এভাবে রিয়্যাক্ট করছেন কেন! অন্য কারও সাথে তো এমনভাবে রা’গে’ন’না। শুধু আমার সাথেই রা’গ করেন কেন? ”
” আল্লাহ, আমাকে উল্টো প্রশ্ন করছে! মুখে মুখে কথাও বলছে আবার! এখন দেখছি আগেই ভালো ছিল এই মেয়ে। ”
” আমি আগে কিংবা এখন সবসময়ই ভালো ছিলাম, আছি, থাকব। ” সাহস করে বলে ফেলে কুহু।
” মাফ কর আমাকে। তোমার যা ইচ্ছে তাই কর। ” দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে তাহমিদ। আর দুপদাপ পা ফেলে কোথাও চলে যায়।
কুহু নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। ও কিভাবে তাহমিদের মুখের ওপর কথা বলল! এত সাহস হয়েছে ওর!
বিঃদ্রঃ গত কয়েকদিন থেকে হাসবেন্ড ভিষণ অসুস্থ। তাকে সময় দিতে যেয়ে, লিখার সময় পাচ্ছিনা। এবং পার্টগুলোও ছোট হচ্ছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমি সকলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।
চলবে…