বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৫

0
2140

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী

” চিপসগুলো কি মিউজিয়ামে রাখবে ভেবেছ! যদি রাখতেই মন চায় তবে আমি পরে কিনে দিব। এখন এগুলো খাও। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে।
” বইন আমার, তাত্তারি খা। তুই-ই দুনিয়ায় একমাত্র, যে চিপস হাতে নিয়ে বসে আছিস। এর আগে আর কেউ চিপস হাতে নিয়ে বসে থাকেনি৷ ” আনানের খোঁ’চা শুনে তাহমিদ চোখ গরম করে তাকায়।
কুহু কিছু না বলে প্যাকেট খুলে চিপস মুখে দেয়৷

সুপ্তিকে ঘিরে ওর বোনেরা বসে আছে। রাহাত তাহমিদ, আনান, নিহানদের সাথে আড্ডায় মেতেছে।
” এরপর তো আমাদের হবু ডক্টরের পালা? বউ কি ঠিক করাই আছে, নাকি আমাদের খুঁজে দিতে হবে? ” রাহাত প্রশ্ন করে তাহমিদকে।
” আমার আবার দয়ার শরীর। আমার বউ খুঁজতে গিয়ে আপনারা এনার্জি লস করবেন, তা হতে দিতে পারিনা। তাই বউ রেডিই রেখেছি। সময় হলেই টুপ করে সবার সামনে হাজির করব।”
” আমার শা’লাবাবু দেখছি দারুণ ফরোয়ার্ড! সবার কথা কত ভাবে! এমন শা’লা’বাবু ঘরে ঘরে দরকার। ” রাহাত হেসে বলে।
” দুলাভাই, আমাদের তাহমিদ ভাই, দ্বায়িত্ববান পুরুষ। তাই বিয়ের আগেই বউয়ের দ্বায়িত্ব কাঁধে নেয়ার চেষ্টা করছে। ” আনান দুজনের মধ্যে ফোঁড়ন কাটে৷
” তাই নাকি! তা বউটা কে শা’লাবাবু? ” রাহাত দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
” সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। ” আনান উত্তর দেয়।
এভাবেই আড্ডা চলতে থাকে।

সুপ্তির পাশে কুহু বসে আছে। সুপ্তি কুহুকে নানান প্রশ্ন করছে। মা কেন আসেনি, বারবার জানতে চাচ্ছে কুহুর কাছে। ওর মন বড্ড উচাটন করছে। সবাই এসেছে অথচ মা আসেনি। কুহু সুপ্তিকে বারবার বোঝাচ্ছে, ফুপু ঠিক আছে। কিন্তু সুপ্তি তা মানতে নারাজ।
” কি রে, ছাতার মিস্ত্রির বউ। দিনকাল কেমন যাচ্ছে? শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সম্মান করছিস তো? আর জামাইকে আঙ্গুলে নাচানোর মিশন শুরু করেছিস? ” তাহমিদ দুজনের কথার মাঝে বাগড়া দেয়।
” তাহমিদের বাচ্চা, ঐটা ছাতার মিস্ত্রি নয়, আর্কিটেক্ট হবে। আমার কাউকে নাচানোর জন্য মিশন শুরু করতে হয়না। আমার চোখের দিকে তাকালেই জনগণ নাচতে প্রস্তুত হয়ে যায়। ”
” বাপরে ক্ষমতাবান নারী তুই! তোর চেখে কি ম্যাগনেট আছে নাকি! দেখি একবার তাকাতো আমার দিকে। ”
” তুই থামবি ব’দ পোলা। এত খোঁচাস কেন! চলেই তো এসেছি তোর বাড়ি থেকে। ”
” একবারে তো আর চলে আসিননি। দুই-চার মাসে হলেও একবার যাবি। তাই খোঁ’চা’নো বন্ধ হবে নট। ”
কুহু ওদের দুই ভাই-বোনের কথা শুনছে আর মৃদু হাসছে।
” ভালো কথা, ছাতার মিস্ত্রির বউ। সেদিনের পর থেকে, তোর মামাতো বোনের সামনে আমি ইচ্ছে করে আসিনা। চেষ্টা করি তার সামনে না পরতে।মাঝেমাঝে বাধ্য হয়েই তার সামনে আসতে হয়। সে যেন এইটা নিয়ে আবার কাহিনী না করে। আমি কথা রাখতে খুব ভালো করেই জানি। ”
কুহুর কেন যেন তাহমিদের কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগল।
” তুই আমার বোনকে এমন করে বলছিস কেন? আমার বোনটা কত ভালো জানিস? শুধু একটু বোকা এই যা। তবে একসময় এমন বোকা আর থাকবেনা। ”
” এর জন্য আমাকে যে কত কষ্ট করতে হবে, তা আমিই জানি। জিরোকে হিরো বানানোর চেষ্টা যে আমাকেই করতে হবে, তা কি বুঝতে পারছিস? ”
কুহু তাহমিদের কথার পূর্ণ মানে বুঝতে পারলেও চুপ করে থাকে।
” জিরোকে হিরো বানাতে পারদর্শী হিরো আলম। ” সুপ্তি হাসতে হাসতে কুহুর শরীরে ঢরে পরে।
” কি বললি, আমি হিরো আলম! তাহলে তোর জামাই রিপন ভিডিও। আগেতো ছিল ছাতার মিস্ত্রি। আর এখন প্রমোশন পেয়ে হলো রিপন ভিডিও। ” তাহমিদও কম যায়না।
কুহু এবার চুপ করে থাকতে পারলনা। ফিক করে হেসে দিল। কুহুর হাসির আওয়াজে তাহমিদ ওর দিকে তাকায়। ও আজই প্রথম এমনভাবে কুহুকে হাসতে দেখল। আর এ-ও দেখল বামপাশের গজদাঁত ওর হাসিকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। তাহমিদ কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে।

সুপ্তিকে নিয়ে ফিরতে রাত হয়ে যায়। তাই কুহুর আর হোস্টেলে যাওয়া হয়না।
পরদিন সকালে খাবার খেয়েই ও ফুপুকে বলে, আজকেই হোস্টেলে ফিরবে। তিনিও রাজি হন। কয়েকদিন থেকে কুহুর পড়াশোনা হচ্ছেনা, তাই রাজি না হয়ে উপায় নেই।
তাহমিনা আক্তার কুহুর যাওয়ার কথা শুনলে, কুহুকে বলে দেন, তাহমিদ ওকে পোঁছে দিবে। কুহু শুধু মাথা নাড়ায়।

দিদুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, কুহু ফুপুদের কাছ থেকে বিদায় নেয়।
ড্রয়িংরুমে কায়েস, শিউলি আক্তার বসে ছিল। কুহু গুটিগুটি পায়ে বাবার কাছে যায়। শিহাব বাবার পাশে বসে ছিল। কুহু শিহাবকে কাছে টেনে নেয়। চুমু দেয় ওর কপালে।
” বাবা আমি আসছি। তোমরা ভালো থেকো। ” বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কুহু বেরিয়ে আসে। একটিবার শিউলি আক্তারের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা। শিউলি আক্তারের সেইদিনের আচরণ ওর মনে দাগ কেটে গেছে। তারউপর বড় ফুপুর বলা কথাগুলো ও বারবার বিশ্লেষণ করেছে। এবং এটাই বুঝেছে যে, এবার ওকে শক্ত হতে হবে।
শিউলি আক্তার অবাক হয়ে গেছে কুহুর আচরণে। কুহু সবার কাছ থেকে বিদায় নিল, অথচ একটাবারও তাকে বলার প্রয়োজন মনে করলনা!
বাইরে এসে দেখল তাহমিনা আক্তার গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে একটা ব্যাগ।
” কুহু, এখানে কিছু খাবার আছে। ফ্রিজে রেখে দিবি। আর আমি কয়েকদিন পর তাহমিদকে পাঠাবো তোকে আনতে। চলে আসবি কিন্তু। ” তাহমিনা আক্তারের কথায় অধিকারবোধ চাপা থাকেনা।
তাহমিনা আক্তারকে সালাম জানিয়ে গাড়িতে উঠে কুহু। পুরো রাস্তা দুজনেই নিরব থাকে। একজনের মনে হাজার কথার ফুলঝুরি ছুটেছে, কিন্তু বলার সাহস নেই। আরেকজন তো নিরবতাকেই নিজের সঙ্গী করেছে।
কুহুর হোস্টেলের সামনে এসে গাড়ি থামায় তাহমিদ। কুহু নিচে নামলে, তাহমিদ ওর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়।
” এখানে চকলেট, চিপস, আর আইসক্রিম আছে। ইচ্ছে হলে খেও, না হলে ফেলে দিও। ” ভাবলেশহীন মুখে বলে তাহমিদ।
” আপনি সব সময় এভাবে কথা বলেন কেন! ” সাহস করে কুহু বলেই ফেলে।
” কিভাবে কথা বলি? ” সিরিয়াস হয়ে জানতে চায় তাহমিদ। কিন্তু ভেতর ভেতর ও হাসিতে ফেটে পরছে। ওর কথার ভঙ্গিতে কুহু বেশ ভড়কে গেছে।
” সব সময় কেমন বাঁকাভাবে কথা বলেন। এখন যেমন বললেন। ” ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় কুহু।
” আমি মানুষটাই তো বাঁকা, তাহলে কথা সোজাভাবে বলব কেমন করে। ”
কুহু আর কিছু না বলে তাহমিদের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে হোস্টেলের গেইট অতিক্রম করে।
তাহমিদ হাসিমুখে ওর যাওয়া দেখে।

শাহনাজ সুলতানা আজ বিকেলে নিজ বাড়িতে যাবেন। আগামীকাল যাবে নাজমা পারভিন। কায়েস আর শিউলিও আগামীকাল যাবে। আজ সকাল একে একে সকল আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নিচ্ছে। আজ থেকে ‘ কুঞ্জছায়া ‘ ফাঁকা হয়ে যাবে।

কুহুর এইচএসসি পরীক্ষার আর ছয়মাসও নেই।
ও পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। সুপ্তির বিয়ের পর আর বড় ফুপুর বাসায় যাওয়া হয়নি। আর না গেছে ফুলতলা। ক্লাস, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত কুহু। আফরোজা নাজনীনও ওকে তার বাসায় আসতে বলেলনি। তিনি চাচ্ছেন এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই তিনি কুহুকে তার কাছে আসতে বলবেন। তাহমিনা আক্তার অবশ্য বড় জায়ের কাছে কুহুকে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, কুহু পরীক্ষার পরই আসুক। তাই তাহমিনা আক্তারও আর জোড় করেননি।
‘ কুঞ্জছায়া ‘ থেকে আসার পর তাহমিদের সাথে কুহুর আর দেখা হয়নি। যদিওবা কুহু তাহমিদকে দেখেনি কিন্তু তাহমিদ ঠিকই আড়াল থেকে কুহুকে প্রতিনিয়তই দেখেছে।

ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা বেজেছে। কুহু মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ঠিক সেই সময় ফোনে ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। কুহু ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করে। কিছুদিন থেকে একটা আননোন নম্বর থেকে সকালে, রাতে দুইবার নিয়ম করে ম্যাসেজ দিচ্ছে কেউ। ম্যাসেজে তেমন কিছুই লেখা থাকেনা। শুধু শুভ সকাল আর শুভ রাত্রীতেই সীমাবদ্ধ। কুহু প্রথম প্রথম কয়েকটা নম্বর ব্লক করেছে, কিন্তু যতবারই একটা নম্বর ব্লক করে, পরে নতুন আরেকটা নম্বর থেকে ম্যাসেজ আসে। তাই পরে আর এই নম্বর ব্লক করেনি। যার ইচ্ছে হয়, সে ম্যাসেজ দিক।

ক্লাস শেষ করে সবে মাত্র হোস্টেলে ফিরেছে কুহু। ঘামে ভিজে গেছে শরীরের পোশাক। হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে, আলনায় থাকা জামাকাপড় নিয়ে, করিডোরের উল্টোদিকে থাকা ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
গোসল সেরে এসে দেখল অনবরত ওর ফোন বেজেই চলেছে। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে শিউলি আক্তারের নাম। কৌতুহলে কপাল কুঁচকে আসে কুহুর। ছোটমা কোনদিন ওকে নিজ থেকে ফোন দেয়নি, আজ হঠাৎ তার ফোন এসেছে! কারও কি কোন বিপদ হয়েছে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here