বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১৭

0
2663

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী

অসীম শূন্যতার পানে তাকিয়ে থাকার মাঝেও কখনো কখনো আলাদা অনুভূতি কাজ করে কুহুর কাছে। আজ যেমন এই অসীম শূন্যতা আলাদা অনুভূতি যোগাচ্ছে। হোস্টেলের রুমের ছোট্ট জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে জীবনের হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে অনবরত। কিন্তু বারবার ঐ অসীম শূন্যতার ন্যায় ফলাফল শূন্য আসছে। জানালার সামনে স্বল্প পরিসরের জায়গায় চাঁদের আলো এসে আলোআঁধারির এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কুহুর মনে এই আলোআঁধারি পরিবেশ কোন ভালো লাগা সৃষ্টি করতে পারেনা। অদ্ভুদ সব ভাবনা থেকে থেকেই মনে হানা দিচ্ছে। কি হতে চলেছে এরপর?
বারবার দিদুন, তাহমিনা আন্টি ফোন করছে। যেতে বলছে ‘ কুঞ্জছায়া’য় ‘। বড়ফুপু, তাহমিনা আন্টি কয়েকদিন এসেছে ওকে ঐ বাসায় নেয়ার জন্য। কিন্তু কুহুর মন আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়েছে। কোন কথা মানতে সে নারাজ। তাইতো বারবার দিদুন আর আন্টির অনুরোধ অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারছে। অবাধ্য মন প্ররোচনা দিচ্ছে, কেন যাবি ঐ বাসায়? যেখানে চরম অপমানিত হয়েছিস এক সময়! যে তোর মূল্য দেয়নি, তার সামনে, তার বাসায় কেন যেতে হবে? সে সুযোগ পেলে আবার তোকে অপমান করবে। পরক্ষনেই মস্তিষ্ক বলছে, সে তোর কাছে একদিন ক্ষমা চেয়েছিল। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। মন থেকে কেউ ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করতে হয়। তবেই না মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়।
ঠিক তখনই অবাধ্য মন বাঁধ সাধছে। সে বলছে, সেই মানুষটা তোকে করুনা করছে, দয়া দেখাচ্ছে তোর প্রতি। তুই অসহায়, মা নেই, অত্যাচারিত তাই তোর প্রতি সমবেদনা স্বরূপ ক্ষমা চেয়েছে। করুনা কিংবা সমবেদনা কারো জন্য চিরকাল থাকেনা। একসময় বিরক্তিতে রুপান্তরিত হয়।
বারবার নিজের অবাধ্য মনের বি’ষা’ক্ত প্ররোচনার কাছে মস্তিষ্ক হার মানে। কঠিন মন সিদ্ধান্ত নেয় আর কখনোই ‘ কুঞ্জছায়া’র ‘ চৌকাঠে পা রাখবেনা সে।
হার মেনে যায় মা সমতুল্য ফুপুর ভালোবাসা। দিদুনের স্নেহ কিংবা তাহমিনা আন্টির মমতা।

” তাহু, দুই-তিনদিন ধরে তাহমিদকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। ঠিকমত খাচ্ছেনা। কি হয়েছে ওর? তুই কিছু জানিস? ” আফরোজা নাজনীন ডালে ফোঁড়ন দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল তাহমিনা আক্তারকে।
” বড় ভাবি, আমার ছেলের সেইদিনের সেই ভুল ক্ষমা করেছ তুমি? সে যে আজও অনুশোচনায় পু’ড়’ছে। সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে। ”
” তাহু, কি বলছিস এসব! সেইদিন ভুল আমাদেরও ছিল। ওর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল আমাদের। ওর রাগ সেদিন স্বাভাবিক ছিল। হ্যাঁ কিছু কথা ও বলেছিল যেগুলো ঠিক ছিলনা কিন্তু সেইদিনই ওকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। সন্তানের হাজারও অপরাধ কোন মা মনের ভেতর পুষে রাখতে পারেনা। ও আমার সন্তান তাহু। আমার অস্তিত্ব ও। ”
” ভাবি, আমার ছেলে তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি সেটা ওকে দিবে? ও যা চাইবে তাই ওকে দিও। কখনো ফিরিয়ে দিওনা। ফিরিয়ে দিলে আমার ছেলেটা যে বড় আ’ঘা’ত পাবে। ” তাহমিনা আক্তারের গলায় অনুনয় ঝরে পরে।
” তাহু, বারবার আমার ছেলে, আমার ছেলে বলছিস কেন! তাহমিদ কি আমার কেউই নয়? ওকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি আমি। মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়েছি। আমার কি ওর ওপর কোন দাবী নেই! ও কিছু চাইবে আর আমি সেটা দিবনা তা কেমন করে হয়! ”
” ভুল হয়ে গেছে, ভাবি। ও তো তোমারই সন্তান। আমি জানি ওর জন্য ভালো কিছুই তুমি সব সময় ভেবে রাখ। আচ্ছা এসব বাদ। আমার বড় ছেলের বউয়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার? সে কবে আসতে চাইছে? আমাকে তো তার ফোন করার সময়ই হয়না। আবার আমি ফোন দিলেও হাজার বাহানা দেখিয়ে অল্প কথা বলেই ফোন কেটে দেয়। ”
” গতকাল কথা হয়েছে। নীরা বলল, বিয়ের দুইদিন আগে আসবে। তাওহীদ ছুটি পাচ্ছেনা বেশিদিনের । সুপ্তির বিয়ের তিনদিন আগে ছুটি পাবে। আর দুইদিন আগে আসবে। ”
” ওর অন্তত আগে চলে আসা উচিত ছিল। তাওহীদ যেদিন ছুটি পাবে সেদিন আসবে। আমরাতো এমন ছিলামনা ভাবি। সারাজীবন শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। পরিবারের প্রয়োজনে সব সময় গুরুজনদের পাশে থেকেছি। তবে কেন আমার ছেলের বউ এমন হল! শ্বশুর বাড়িকে আজও আপন করতে পারলনা। আমারও তো ইচ্ছে করে নাতনিকে খুব কাছে থেকে আদর করতে, ওর বড় হওয়া দেখতে। সারা বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করবে আমি সেগুলো প্রান ভরে দেখব। কি দোষ ছিল আমাদের? আবার আমি তার কাছে যেয়ে কয়েকটা দিন থাকি সেটাও তার পছন্দ নয়। ” কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পরে তাহমিনার চোখ থেকে।
” কাঁদিসনা তাহু। ধরে নে আমরাই ওকে আপন করে নিতে পারিনি। আমাদের বাঁধনই ঢিলা ছিল। যার ফাঁক গলে আমাদের ভালোবাসা ওর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এবার যখন ওরা আসবে তখন নাতনিকে প্রানভরে আদর করিস। ওরা যে কয়দিন থাকবে তোর কোন কাজ করতে হবেনা। সারাদিন তূরকে কোলে নিয়েই থাকবি। ওকে আদর করবি ওর দৌড়ঝাঁপ দুচোখ ভরে দেখবি। ”
” হুম, আমি সারাদিন তূরকে নিয়েই থাকি আর তুমি কাজ করতে করতে শহীদ হও। থাক আমার এত ভালোবেসে কাজ নেই বাপু। নাতনি যেদিন বুঝবে আমরা ওকে কত ভালোবাসি সেদিন ওকে কেউই আমাদের থেকে দূরে আটকে রাখতে পারবেনা। ” শাড়ির আঁচলে নাক মুছে জবাব দেন তাহমিনা আক্তার।
দুই জা মিলে নানান গল্প, স্মৃতিচারনের মধ্য দিয়ে রান্না করতে থাকেন।

” কি রে, ছাতার মিস্ত্রীর বউ। তোর জামাই এখন কার ছাতা ঠিক করছে? ভাগ্যগুনে একটা ছাতার মেকার পাচ্ছিস। আমাদের কারও ছাতা ভাঙলে কোন চিন্তা নেই মিস্ত্রি রেডি আছে। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশী, শহরের প্রত্যেকের ছাতা ঠিক করার দ্বায়িত্ব তোর মিস্ত্রি জামাই বহন করবে। ”
সুপ্তির চুল টেনে দিয়ে বলে তাহমিদ। সুপ্তি নিজ রুমে বসে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল।
” তাহমিদের বাচ্চা, ঐটা ছাতার মেকার হবেনা। ঐটা আর্কিটেক্ট হবে। আমার জামাই আর্কিটেক্ট বুঝলি? হাহ্ নকল করে পাশ করলে যা হয় আরকি। আর্কিটেক্ট আর ছাতার মেকারের পার্থক্য বুঝবি কেমন করে! কি বলতে এসেছিস বলে বিদায় হ এক্ষুনি। তোর আজাইরা প্যাচাল শোনার সময় আমার নেই, বুঝলি? ”
” একটু তো সম্মান কর। হাজার হোক ডাবল আত্নীয় হই। আর দশ মাস পর ডাক্তারের প্রয়োজন পরলে আমার কাছেই সাহায্য চাইবি বুঝলি? ”
” আইছেরে, ডাবল আত্মীয়। এসব একতরফা ডাবল আত্মীয় আমি মানিনা। যাকে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়াবে তাকেই এখনও মানাতে পারলনা শুধু শুধু সবার কাছে আত্মীয়তার গান গেয়ে বেড়ায়। অকর্মার ঢেঁকি একটা। আবার এখন আমার দশমাসের চিন্তা করছে! আমারটা আমিই সামলাবো, তোকে লাগবেনা। ”
সুপ্তির কথা শুনে তাহমিদের হেঁচকি উঠে। চোখদুটো আপনাআপনি রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে গেছে। এই মাইয়া জানলো কেম্নে!
” ঐ বইন, কি কস এগ্লা? তুই যা ভাবছিস সেসব কিছুই না বুঝেছিস? আমি একদম নিষ্পাপ, বাচ্চা একটা ছেলে। আমিতো জাষ্ট মজা করি তোদের সাথে। ”
” হ, সবাইকে ঘাস খাওয়াতে পারলেও আমাকে পারিসনি। আমিতো আর সবার মত গ’রু নই। তুই একদম ফ্রেশ, নিষ্পাপ বাচ্চা তাও আমি জানি। শুধু একটু আমার মামাতো বোনের লগে লাইন মারতে চাস এই যা। ”
” তোর চারটা হাতে-পায়ে ধরি এই কাউকে বলিসনা। আমি না তোর কলিজার ভাই। পিলিজ লাগে বইন। ” তাহমিদের চুপসানো মুখ দেখে সুপ্তির হাসি পায়। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
” সেই তো ভালোইবাসলি তবে সেদিন কেন রিয়্যাক্ট করেছিলি? কম কষ্টতো মেয়েটা পায়নি। এখন কিভাবে রাজি করাবি ওকে? ও কি আদৌ রাজি হবে! ”
” জানিনা সেদিন কি থেকে কি হয়ে গেছিল। সেদিন তোরা সবাই কষ্ট পেয়েছিল আর আজ আমি কষ্ট পাচ্ছি। সবই ঠিক আছে পার্থক্য শুধু সময়ের । তুই আমাকে একটু হেল্প করবি? প্লিজ। ” তাহমিদ অনুরোধ করে সুপ্তিকে।
” কি হেল্প লাগবে বল। বিয়ের আগে যতটুকু পারি হেল্প করি। ”
” ঐটার সাথে দেখা হলে আমাকে দেখলে উল্টো রাস্তা ধরে। ডাক দিলেও কথা বলেনা। ওর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিবি? আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব। প্রয়োজনে ওর পায়ে পরব। ”
” তুই অন্যায় করেছিলি মানছি। কুহু আমার বোন তাও মানছি। কিন্তু তুই ওর পায়ে পরবি এইটা আমি বোন হয়ে মানতে পারছিনা। তুই আমার ভাই। তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি। ভালোবাসিস তারমানে এই নয় যে তুই কারও পায়ে পরবি! যাকে ভালোবেসেছিস তাকে বীরের মত জয় করবি। এতে নিজের গৌরব বাড়ে। কারও পায়ে ধরে ছোট হওয়ার মধ্যে কোন গৌরব নেই। ”
তাহমিদ সুপ্তির কথা শুনে চুপ করে থাকে। ও এতটাই ভালোবেসেছে যে তার কাছে ছোট হতেও কোন অনুশোচনা বোধ করবেনা!
” শোন কাল বিকেলে আমি শপিংয়ে যাব। যাওয়ার সময় কুহুকে ডেকে নিব। তোকে ম্যাসেজ করে দিব কোন শপিংমলে যাব। তুই চলে আসিস। তবে মনে রাখিস কুহু তোর কথা না মানলে কোন সিনক্রিয়েট করবিনা। ” তাহমিদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সুপ্তি আবার বলে।
” থ্যাংকিউ বইন। তোর কথা আমার মনে থাকবে।
কাল ছাতার মিস্ত্রিকেও নাহয় ডেকে নিস। একসাথে কফি খাওয়া যাবে। ”
” হ, আমি দুনিয়া সুদ্ধ মানুষকে জানাই আমার ভাই আমার মামাতো বোনের লগে লাইন মারতে শপিংমলে আসছে। বাপরে শিক্ষিত ভাবা যায়! ”
” হইছে, আর নাক শিটকাতে হবেনা। আমি অক্ষিশিত সেটা সবাই জানে। এখন গেলাম। দেখ তোর ছাতার মিস্ত্রি ফোন দিচ্ছে। রিসিভ করতে দেরি হলে তার হার্ট আবার লাফ দিয়ে মাথায় উঠতে পারে। ” তাহমিদ বেরিয়ে গেলে সুপ্তি ওর ফোনের দিকে তাকায়। সাইলেন্ট থাকায় ও বুঝতে পারেনি ফোন এসেছে।

কুহু আর সুপ্তি শপিংয়ে এসেছে। দুজনে ঘুরেঘুরে দেখছে আর এটাসেটা কিনছে। অবশ্য যা কেনার সুপ্তিই কিনছে। কুহু শুধু ওর সাথ দিচ্ছে। সুপ্তি ম্যাসেজ করে তাহমিদকে জানিয়ে দিয়েছে ওরা কোথায় আছে।
একটা শাড়ির দোকানে বসে শাড়ি দেখতে ব্যাস্ত সুপ্তি। এত শাড়ি দেখেছে যে ওর সামনে শাড়ির স্তুপ হয়ে গেছে। তবুও কোনটাই ওর পছন্দ হচ্ছেনা। এদিকে কুহু যেই শাড়িই দেখছে সেটাই পছন্দ হচ্ছে।
” আপু, এতগুলো শাড়ির মধ্যে একটাও তোমার পছন্দ হচ্ছেনা! দেখ, ঐ বেগুনি রঙের শাড়িটা কি সুন্দর। তোমাকে খুব মানবে। ”
” ঐ শাড়িটা এই ছাতার মিস্ত্রির বউকে নয়, আমার বউকে মানাবে। আমার বউয়ের জন্য সিলেক্ট করলাম শাড়িটা। ভাই, বেগুনি রঙের শাড়িটা প্যাক করেন। ” তাহমিদ কুহুর পাশের চেয়ারে বসে দোকানীকে নির্দেশ দেয় ।
এদিকে কুহু শপিংমলে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। ও এখানে তাহমিদকে কিছুতেই আশা করেনি।
” আপু, তোমার যা প্রয়োজন কিনো। আমি হোস্টেলে যাব। ”
” এক থা’প্প’ড় দিব, ফা’জি’ল। আমার সাথে এসেছিস, আমার সাথেই যাবি৷ আমার ভাইটা কি ফেলনা নাকি? ওকে দেখেই উঠে যেতে চাচ্ছিস! চুপচাপ বস আর আমার জন্য শাড়ি পছন্দ কর৷ ”
কুহু সুপ্তির ধমক খেয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
তাহমিদ কয়েকটা শাড়ি সুপ্তিকে পছন্দ করে দেয়।
কুহুর জন্য থ্রীপিস কিনতে ওরা আরেক দোকানে আসে। কুহু বারবার না বলা স্বত্বেও সুপ্তি ওকে নিয়ে থ্রীপিস কিনতে আসে। কিন্তু এখানে এসে কুহু কোন কিছু পছন্দ না করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাধ্য হয়ে তাহমিদ আর সুপ্তি মিলে পাঁচটা থ্রীপিস পছন্দ করে কিনে। কিন্তু একটারও দাম তাহমিদ সুপ্তিকে দিতে দেয়না। কুহুর অগোচরে তাহমিদ সুপ্তির কাছে টাকা দেয়।
আরও কিছু কেনাকাটা করে ওরা একটা কফিশপে বসে। সুপ্তি তিনজনের জন্য স্ন্যাকস আর কফির অর্ডার দেয়। কফিশপ মোটামুটি ফাঁকাই বলা চলে। কফি রেডি হতে কয়েক মিনিট লাগবে। তাই ওরা অপেক্ষা করছে। ঠিক তখনই সুপ্তির ফোন বেজে ওঠে। ওর হবু স্বামী রাহাতের ফোন এসেছে। সুপ্তি ফোন রিসিভ করে কফিশপের পেছনে একটু ফাঁকামত জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে।
কুহু আর তাহমিদ টেবিলের দুই প্রান্তের দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে। কুহু সব সময়ের মত মাথা নিচু করে আছে। আর তাহমিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। ওদের টেবিল এক কোনায় হওয়ায় কেউ ওদের দেখছেওনা আবার ওদের কথাও শোনা যাবেনা।
” কুহু, একটু তাকাবে আমার দিকে। ” তাহমিদের অনুনয় কুহুর কানে ঠিক পৌঁছায়। কিন্তু তবুও ও মাথা নিচু করে থাকে।
” প্লিজ কুহু, আমার কথা একটু মনযোগ দিয়ে শোন। তোমার সাথে কিছু কথা আছে যেগুলো তোমাকে না বললে আমি ঠিক থাকতে পারবনা। ”
কুহু ভাবছে, এই মানুষটার আবার কি কথা থাকতে পারে! তাও আবার আমার সাথে!
” কি বলবেন বলুন। যা বলার আজকেই বলুন অযথা রাস্তাঘাটে মানুষের সামনে ডাকবেননা। এতে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। ”
তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কথা গুছিয়ে নেয়।
” কুহু, সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য আমি সরি। জানি সরি বললেও তোমার ক্ষত একটুও কমবেনা। তোমার দুঃখও মুছবেনা। কিন্তু আমি তোমার কাছে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা। বিবেকের কাছে প্রতিনিয়ত দং’শি’ত হচ্ছি। আমাকে একটিবার ক্ষমা করা যায়না। ”
” আপনি নিজেকে আমার কাছে ছোট করছেন কেন? আপনি সেদিন ভুল কিছুই বলেননি। আমি আসলেই যোগ্য নই। আপনি কোন ভুল করেননি অথচ আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন, বিষয়টা পরস্পর বিরোধী হয়ে গেলনা! ” কুহুর গলায় রাগ, অভিমান কিংবা জেদ স্পষ্ট। যা তাহমিদের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়না।
” আমি অবশ্যই ভুল করেছি। বড়দের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত ছিল। কিন্তু আমি বাবা-মা’র অবাধ্য সন্তান। তাই সেদিন তাদের অপমান করেছি সেই সাথে তোমাকেও। শাস্তি আমার অবশ্যই প্রাপ্য। যদি তুমি মনে কর আমাকে শাস্তি দিবে, সেটাও আমি মাথা পেতে নিব। ”
” আমি বারবার বলছি আপনি অন্যায় করেননি তবে কেন এত কথা বলছেন। যেগুলো শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছেনা। ”
” ওকে, আমি যদি অন্যায় নাই করে থাকি তবে তুমি কেন আমাদের বাসায় যাচ্ছনা? বড়মা প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছে। মনমরা হয়ে থাকছে সব সময়। আমি বড়মার কষ্ট আর দেখতে পারছিনা। প্লিজ, আমাদের বাসায় চলো। সুপ্তির বিয়েতে সবাই আনন্দ করবে কিন্তু সেখানে তুমি থাকবেনা এটা আমি মানতে পারবনা। বড়মাও খুশি হবে। ”
” সরি, আমি কোথাও যাবনা। কোথাও যাবনা বলছি কেন! আমি কমিউনিটি সেন্টারে যাবতো। ”
” কিন্তু বাসায় কেন নয়? তাহলে কি ধরে নিব তুমি আমাকে মিথ্যা বলছ? আমি অন্যায় করেছি এবং তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি এটাই সত্যি? ”
” আপনার যা ইচ্ছে তাই ভাবুন। তবে একটা কথা শুনে রাখুন আমি আপনাদের বাসায় যাচ্ছিনা। আর এই বিষয়ে কথা না বললেই আমার ভালো লাগবে। ”
কুহুর শেষের কথা তাহমিদের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়। ঠিক তখনই ওয়েটার আসে। স্ন্যাকস, কফি টেবিলে রেখে যায়। কিন্তু কারোরই এখন সেগুলো খাওয়ার মুড নেই।

” কিরে তোরা এমন স্ট্যাচু হয়ে বসে আছিস কেন? কফিতো ঠান্ডা হয়ে গেছে! ” সুপ্তি চেয়ারে বসে ওদের জিজ্ঞেস করে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নেয় সুপ্তি।
” হুম, কি বললি? ও আচ্ছা কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে! আমি আবার অর্ডার দিচ্ছি। ” তাহমিদ উঠতে গেলেই সুপ্তি ওর হাত ধরে বসিয়ে দেয়।
” কুহু, শোন জীবন যে কত কঠিন তা তোর থেকে বেশি কেউ জানেনা। তুই জীবনের যত দিক দেখেছিস তার একশো ভাগের একভাগও আমরা দেখিনি। আর দেখিনি জন্যই তাহমিদ সেদিন সেই ভুলটা করে বসেছিল। ও যদি তোর মত জীবনের সব ভালোমন্দ দিক বুঝত তবে সেদিন নির্দিধায় বড়দের কথা মেনে নিত। কিন্তু আজ যখন ও সেই ভুল শোধরাতে চাইছে তখন তুই এত জিদ করছিস কেন! তুই বুদ্ধিমতি আমি তাই জানতাম। কিন্তু তোর বর্তমানের আচরণ আমাকে হতাশ করছে। তুই আমার বোন, তাহমিদ আমার ভাই। তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। কেউ যদি ভুল করে এবং পরে অনুতপ্ত হয় তখন তাকে ক্ষমা করা উচিত। আমি কি বলতে চেয়েছি তুই নিশ্চয়ই বুঝেছিস? ”
কুহু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। সুপ্তির কথা মনযোগ দিয়ে ভাবছে। সত্যিই আমি জিদ করছি! আমিতো কখনো জেদি ছিলামনা। কেউ কখনো জেদি তকমা আমার নামের আগে বসায়নি। তবে আজ কেন জেদি তকমা পেলাম! আমার ভেতরে মনুষ্যত্বের বদলে রা’গ কেন মাথাচাড়া দিল! আমি কেন সেদিনের কথাগুলো ভুলতে পারছিনা। ছোটমাও তো বহুবার আমাকে অ’প’মা’ন করেছে, আ’ঘা’ত করেছে, অ’স’ম্মা’ন করেছে কই তার উপর কখনো এমনভাবে রে’গে থাকিনি তো! ছোটমা কখনোই আমার কাছে ক্ষমা চায়নি তবুও বারবার বেহায়ার মত তার সাথে যেচে কথা বলি। কিন্তু এই মানুষটা ক্ষমা চাইছে, অনুশোচনা করছে তবুও তাকে কেন ক্ষমা করতে পারছিনা! আমার কি হয়েছে!
” আপু তোমাদের যেতে দেরি হবে বোধহয়? আমি আর থাকতে পারছিনা। তোমরা থাক আমি গেলাম। ” সুপ্তির কথার কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে কুহু চলে যেতে চায়।
কুহুর যাওয়ার কথা শুনে তাহমিদ অসহায় চোখে সুপ্তির দিকে তাকায়।
” খুব বড় হয়ে গেছিস দেখছি আজকাল! আমার কথা শেষই হলোনা কিন্তু তুই চলে যাচ্ছিস! অহংকার এতটাই গ্রাস করেছে তোকে! ”
” আমাকে ভুল বুঝনা আপু। আমি আগে যেমন ছিলাম, এখনও তেমনিই আছি। অহংকারকে নিজের ভেতরে ঠাঁই দেয়ার মত দুঃসাহস আমার কখনোই হবেনা। তোমরা আমার পাশে না থাকলে এতদিন কোন ন’র’কে পঁ’চে ম’র’তা’ম। তোমার বলা কথাগুলোর কোন জবাব আমার কাছে নেই, তাই আমি চলে যেতে চাইছি। আর ভুলের কথাই যদি বলো, সেদিন তাহমিদ ভাইয়া কোন ভুল করেনি। তাই এখানে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই আসেনা। তিনি সত্যি কথাগুলোই সেদিন বলেছিলেন। তার পাশে দাঁড়ানোর কোন যোগ্যতাই আমার নেই, এটা আমার কাছে চিরন্তন সত্য। তবে আমি চাইছিনা বা চাইনা কেউ আমাকে দয়া অথবা করুনা করুক। হয়তো সেদিনের কথাগুলো বলার পর তার মনে আমার জন্য করুনা জন্মেছে। একটা মা হীনা মেয়েকে কেন এভাবে বলেছে, সেটাই বোধহয় এই করুনা জন্মানোর মূল কারণ। কিংবা দিনের পর দিন কিভাবে সৎমায়ের দ্বারা অ’ত্যা’চা’রি’ত হয়েছি এটা জানার পর দয়া দেখাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমিতো কারো দয়া অথবা করুনা চাইনা। তাই আমার প্রতি কোন দয়া কিংবা করুনা না দেখালে, আমাকে আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে দিলে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি তাকে বলে দাও রাস্তাঘাটে আমাকে ডাকাডাকি না করলে আমার জন্য ভালো হয়। তার এত করুনার আমার প্রয়োজন নেই। কে চাইছে তার এত করুনা! ”
” কুহু তুই এসব কি ব….
” ব্যাস, অনেক হয়েছে সুপ্তি। আমি সব শুনেছি। তবে তোর বোনকে বলে দিস আজকের বলা কথাগুলোর জন্য ভবিষ্যতে তাকে যেন অনুশোচনা করতে না হয়। আমি আর তাকে রাস্তাঘাটে ডাকবনা। আর এটাও বলে দিস কোন দয়া অথবা করুনা তাকে আমি কখনোই করিনি। তার জন্য আমার কি অনুভূতি ছিল বা আছে তা যদি সে জানত তবে আজ এসব বলতে পারতনা। আজ থেকে তার ভালো থাকার দিন শুরু হলো। আশা করছি যেখানে তাহমিদের ছায়া পরবেনা সেখানে সে মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারবে। ” সুপ্তির কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে তাহমিদ কথাগুলো বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে অবশ্য বিল মিটিয়ে যায়।
কুহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তি স্তব্ধ হয়ে তাহমিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেল ও বুঝতেই পারছেনা।

(আপনারা অনেকেই বড় পার্ট কিংবা তারাতারি গল্প দিতে বলেন। আমি চেষ্টা করি ২৪ ঘন্টার মাঝেই গল্প দিতে। কিন্তু সংসার, সন্তান, স্বামী সব কিছু সামলাতে যেয়ে লিখতে দেরি হয়, পার্টগুলো ছোট হয়। আমিও খুব করে চাই তারাতারি গল্প দিতে। কিন্তু আমি নিরুপায়।)

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here