বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১৫

0
2823

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী

” আম্মু জানো তাহমিদ ভাইয়া ঐ কুহুর সাথে কথা বলে। সে নাকি কুহুকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি? তাহলে সব সময়ই কুহুর আশেপাশে থাকে কেন? আবার আজ বেড়াতে যাওয়ার সময় তাহমিদ ভাইয়া কুহুর পাশে বসেছিল। পরে তাহমিদ ভাইয়া ওকে ঝালমুড়িও কিনে দিছে। ” দৃষ্টি শিউলি আক্তারের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে। আরও বেশকিছু কথা বানিয়ে বলল, যেগুলো কুহু করেইনি। দৃষ্টির মাথায় ছোটবেলা থেকেই শিউলি ঢুকিয়ে দিয়েছে কুহু ওর সৎ বোন। তাই সময় পেলই দৃষ্টি সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেই কুহুকে হেনস্তা করে।
শিউলি আক্তার মেয়ের কথার উত্তর না দিয়ে চিন্তার মাঝে ডুব দিয়েছে। সে ঢাকা আসার পর থেকেই কুহুকে নিয়ে সবার মাতামাতি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছে। সে ভেবেই পায়না ঐ কালীর মাঝে কি আছে যে সবাই ওকে মাথায় তুলে রাখে৷
” হের পাখনা গজাইছে। তাই এত উড়তাছে। সময় বুইঝা হেই কালীর পাখনা আমি কা’ই’টা দিমু। তহন কেম্নে উড়ে তা দেহা যাইব। হের ঢাকায় পড়নের সাধ আমি না মিটাইলে আমার নামও শিউলি না। এইখানে আসনের পর থাইকাই ওরে নিয়া সকলের আল্লাদ দেখতাছি। নিকুচি করি সকলের আল্লাদের। ” একদলা থুতু জানালা দিয়ে বাইরে ফেলল শিউলি।

সকালে নাস্তা করেই কুহু কলেজের জন্য বের হয়। যাওয়ার আগে শিউলি আক্তারের সাথে দেখা করে।
” ছোটমা, আজ বাবা আমার কলেজে যাবে। তুমিও যেও বাবার সাথে। আমার কলেজ দেখে আসবে। দৃষ্টি, শিহাবকেও সাথে নিও। ” উচ্ছ্বসিত হয়ে কুহু ওর ছোটমাকে বলে।
” কেন রে কালী, তর কলেজে আমার যাওন লাগব ক্যান? তুই কি এমন রাজরানী আইছস? আর তর কলেজে কি রাজভোগ আছে যে আমার যাওন লাগব? আমি দেখতাছি ঢাকায় ভর্তি হইয়া পা লম্বা হইছে তর। যেহানে ইচ্ছা সেহানে যাইতাছস। এত বাড়িসনা, তাইলে পা কা’ই’টা লু’লা বানায় দিমু।” কুহুর সকল আনন্দে জল ঢেলে খেঁকিয়ে উঠে শিউলি আক্তার।
নিমেষেই কুহুর মুখ চুপসে যায়। অবনত মস্তকে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। ফুপুকে বলে বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। গেইট পেরুতেই একটা সিএনজি দেখল। সেই দিনের সেই চাচা। যাকে রাস্তাঘাটে কুহু মাঝেমধ্যেই দেখতে পায়। চাচাও কুহুকে দেখে স্নেহের হাসি দেয়। কুহু উঠে বসে সিএনজিতে।
সারা রাস্তা কুহু ভাবতে ভাবতে যায়। কেন ছোটমা ওকে এত ঘৃণা করে? একটু মিষ্টি করে কথা কেন বলেনা ওর সাথে? ছোটবেলা থেকেই জেনেছি সৎ মানে ভালো, মহৎ। তবে সৎমা কেন ভালো বা মহৎ হয়না? সৎমা ডাকটা শুনলেই কেন বুকের ভিতর একদলা ভ’য় এসে হামলে পড়ে? সৎমা যদি ভালোই না হবে তবে এই ডাক কেন আবিস্কার হল? কেন সৎয়ের জায়গায় অন্য ডাক আসলনা?

সেইদিন বিকেলে আনানের সাথে কায়েস আর শিহাব এল কুহুর হোস্টেলে। বাবাকে দেখে কুহু সে কি খুশি। বান্ধবীদের ডেকে এনে বাবা ও ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাবা-মেয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটায় হাসি-আনন্দে। এরপর ওরা যায় আফরোজা নাজনীনের বাসায়। সেখানে শিউলিকে রেখে কায়েস মেয়ের কাছে এসেছে। কায়েস চলে গেলে কুহু কোচিং-এ যায়।

আফরোজা নাজনীন আজ খুব খুশি। কতদিন পর তার ভাই এসেছে। তিনি ও তাহমিনা আক্তার মিলে নানানরকম রান্না করেছেন।
শিউলি এর আগে একবার ঢাকায় ননদের বাসায় এসেছিল। সে ঘুরেফিরে ‘ কুঞ্জছায়া’র প্রতিটি কোন দেখছে। এতবড় বাড়ি, এত ধনী এরা ভাবলেই শিউলির হিং’সা হয়। কতবার সে কায়েসকে বলেছে ওদের পুরোনো বাড়ি ভেঙে দোতলা করতে কিন্তু কায়েস সেকথা শুনেইনা। এ নিয়েও কম অশান্তি সে করেনি।
” কত বড়লোক এরা! ঐ কালীর বিয়া এহানে হয়নি ঠিক হইছে। ঐ কালীর আবার রাজরানী হবার কপাল আছে নাকি। ঐ কালীর কপালে কুন ফকির/মিসকিনই আছে। ঐ কালী হা’রা’ম’জা’দি আবার ঢাকায় পড়বার আইছে। শখ কত, ভাবছে ঢাকায় পইড়া কোন না’গ’র জুটাইবো। হেই কালীর দিকে কোন কু’ত্তা’য়ও ফিরা তাকাইবোনা। ” শিউলির চোখমুখ ঘৃণায় কুঁচকে আসে।
রান্না শেষ করে আফরোজা নাজনীন আনানকে দিয়ে কুহুর জন্য খাবার পাঠিয়ে দেন। সেটা দেখে শিউলি ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।
নাজমা পারভিন তার পরিবারসহ এবং শাহনাজ সুলতানার পরিবারও এসেছে আফরোজা নাজনীনের বাসায়। সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে নাস্তা করছে সেই সাথে জমপেশ আড্ডায় মেতেছে।
তাহমিদ সন্ধ্যায় বাসায় আসলে সবাইকে দেখে তাদের কাছে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। কিছুক্ষণ তাদের সাথে কথা বলে নিজের রুমে আসে।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আজ সকাল থেকে ক্লাস এরপর বাকিটা সময় হসপিটালে যেয়ে টিচারের সাথে কাটিয়ে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে।
” তাহমিদ ভাইয়া, তুমি কি করছো? ” শিহাব দরজার বাইরে থেকে ডাক দেয়।
” শিহাব, ভেতরে এসো। ”
” ভাইয়া, তুমি নাস্তা করবেনা? তোমার ক্ষুধা লাগেনি? ”
” একটু পর খাব। তুমি খেয়েছ? ”
” খেয়েছি ভাইয়া। তোমার রুম কত্ত বড়! আর কি সুন্দর! ”
” তোমার পছন্দ হয়েছে? তুমি ঢাকায় থাকবে? আমাদের এখানে থেকে পড়াশোনা করবে। তোমার আপুও আছে। তার সাথেও দেখা করতে পারবে। ”
” আপুও আমাকে বলেছে, ঢাকায় পড়ার কথা। আমি একটু বড় হলেই এখানে ভর্তি হব। কিন্তু ভাইয়া, আপুর বিয়ে হয়ে গেলে তখন কিভাবে প্রতিদিন দেখা করব? ” ভাবুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে শিহাব।
শিহাবের মুখভঙ্গি দেখে তাহমিদ হেসে দেয়।
” শোন তোমার আপু বিয়ের পরও ঢাকায়ই থাকবে। তুমি তখন তোমার আপুর কাছে থাকতে পারবে। সবাই একসাথে থাকব। খুব মজা হবে তাইনা? ”
তাহমিদের কথা শুনে মাথা ঝাঁকায় শিহাব।

আফরোজা নাজনীন তার ভাই, বোনদের সামনে একের পর এক খাবার দিচ্ছেন। তারা খেতে না পারলেও তিনি ধ’ম’কে, জোর করে খাওয়াচ্ছেন।
” শিউলি, তোমরা কাল আমাদের সাথে চিটাগং চলো। কয়েকদিন থেকে এসো। এমনিতে তো ওমুখো হওনা। এই সুযোগে বেরিয়ে এস?।” নাজমা পারভিন মন থেকে বলেন শিউলিকে৷
” আমি কি কই আপা। আপ্নের ভাই জানে। হেয় আমারে চিটাগং নিলে আমি যাব। ”
” কায়েস আমাদের সাথে চল। কয়েকদিন থেকে আসবি। ” নাজমা পারভিন কায়েসকে বললেন৷
” আপা, এখন যাওয়ার সময় নেই। বুঝোইতো আমি একদিন না থাকলে ব্যবসার কত ক্ষতি হয়। আমি আগামীকালই যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বড় আপা নিষেধ করছে। তবে দৃষ্টির পরিক্ষা শেষ হলে ওদের নিয়ে তোমার ঐখানে যাব। ”

” বড় বউমা, তুমি কি কুহুর কাছে ফোন করেছিলে? সে কি খাবারগুলো পেয়েছে? আনানও তো এখনো আসলোনা। ” আয়েশা সালেহা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীনকে।
বৃদ্ধার কথা শুনে ওরা ভাই-বোন কথা বন্ধ আছে সেদিকে তাকায়।
” হুহ, বুড়ির ভালোবাসা দেইখা কইলজাডা জ্ব’ই’লা যাইতাছে। দুনিয়ায় ভালোবাসার মানুষের অভাব পরছে যে ঐ কালীরেই ভালোবাসতে হইব! ” বিরবির করে বলে শিউলি।
” বিকেলেই কুহুর কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছে আনান। কুহুই আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। ”
শাহনাজ সুলতানা উঠে যেয়ে বৃদ্ধাকে ধরে নিয়ে এসে সোফায় বসালেন।
” বুঝলে বাবা কায়েস, তোমার ঐ মেয়েটা একটা হীরা। লাখে একটা ওমন মেয়ে পাওয়া যায়। ”
বৃদ্ধার প্রশংসা শুনে কায়েস মৃদু হাসেন।
” দোয়া করবেন আম্মা আমার মেয়েটার জন্য। ” কায়েসও বৃদ্ধার কথার প্রত্যুত্তর করে।
” মা শিউলি, মেয়েটাকে দেখে রেখ। তোমার বড় মেয়ে ও। তুমি প্রথমেই ওর মুখে মা ডাক শুনেছ। জ্ঞান হওয়ার পর মা হিসেবে তোমাকেই জেনেছে ও। বড় লক্ষ্মী মেয়েটা। তোমাকে যেমন ভালোবাসে, তেমন সম্মানও করে। ওর ফুপুরা ওকে যতই ভালোবাসুক, ওর মা বলতে শুধু তুমিই আছো। আজ তুমি ওকে একগুণ ভালোবাসা দিলে ভবিষ্যতে ও তোমাকে দশগুণ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে। ” আয়েশা সালেহা নিজের সবটুকু দিয়ে বোঝান শিউলিকে৷
শিউলিও বৃদ্ধার কথায় মুখে মুখে সায় দেয়৷
” জ্বি আম্মা, আপ্নে দোয়া করবেন। সেও যেমন আমারে ভালোবাসে, আমিও তারে তেমনই ভালোবাসি৷ ” কিন্তু শিউলির মন বলছে অন্য কথা।

” দেখেছো আম্মু, দিদুনও কেমন করে তোমাকে উপদেশ দিল। এই বাসারও সবাই কুহু বলতে পা’গ’ল! আমিও যে আব্বুর মেয়ে তা যেন কেউ মনেই করেনা! যেন কুহুই সব! ”
” এহন সকলরেই কুহু কুহু করবার দে। সময় হইলেই ঐ কালীরে আমি সকলের মন থাইকা সরাই দিমু। আমার এত সুন্দরী মাইয়া থাকতে সকলরে ঐ কালীর নাম নেওয়ামু। একটু সহ্য কর। আমি এহন খালি দেইখা যাইতাছি। সময় হইলেই ফোঁ’স কইরা ঐ কালীরে ছো’ব’ল দিমু। সেই দিন আর খুব দূরে নাই । ”
দুই মা-মেয়ে উন্মাদের ন্যায় হাসতে থাকে। কিন্তু সেই হাসির শব্দ ‘কুঞ্জছায়া’র এই রুমেই গু’ম’রে ম’রে৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here