#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী
তাহমিদের পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে কুহু।
আর এদিকে তাহমিদের মনে লাড্ডু ফা’ট’ছে।রাজ্যের বিরক্তি এসে কুহুর শরীরে চেপে বসেছে। বিরক্তি কাটাতে ওর অপর পাশে বসা সিক্তার সাথে গল্প করতে শুরু করে। তাহমিদও ফোন বের করে অনলাইনে ঢুঁ মারছে। আপাতত কুহু ওর পাশে বসে আছে এই তার জন্য যথেষ্ট। ঘন্টাখানেক পথ অতিক্রম করে ওরা একটা রিসোর্টে আসে। নদীর ধারে বিশাল রিসোর্ট। একদম প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত রিসোর্টে বিনোদনের সকল ব্যবস্থাই আছে। গেইট দিয়ে ঢুকেই দুইপাশে রংবেরঙের গাছের সারি। নানান রংয়ের ফুলের গাছ চারপাশে শোভা পাচ্ছে। গাছ পাগল কুহু এত এত ফুলের গাছ দেখে আনন্দে উতলা হয়ে যায়।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে রিসিপশনে এসে একটা রুম বুক করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সবাই রুমে এসে একে একে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসে। প্রথমেই তারা নদীর ধারে এসে হৈহল্লা করতে শুরু করে দেয়। তাহমিদ আর আনান মিলে সবার জন্য জুসের ক্যান নিয়ে আসে। সবার হাতে একটা করে ক্যান দিয়ে কুহুর কাছে আসলে ও তাহমিদকে দেখে নিতে নিমরাজি হয়।
” এখন কি সবার সামনে জুস নিতে রিকুয়েষ্ট করতে হবে! একটা গান গেয়েই মানুষ যে নিজেকে স্টার ভাবতে শুরু করে তা এই প্রথমবার দেখলাম। কালে কালে যে আরও কতকিছু দেখব তা আল্লাহই জানে। ” তাহমিদের খোঁ’চা মারা কথায় কুহু হাত বাড়ায়৷
” তাহমিদ, এখানে নৌকায় চড়বার ব্যবস্থা আছে বোধহয়। একটু কারো সাথে যোগাযোগ বলে দেখবি। অনেক দিন নৌকায় চড়া হয়না। ” সুপ্তির আবদার পূরণ করে তাহমিদকে।
” সাঁতার জানিস তো? যতজন আছিস নৌকা তোদের ভার নিতে পারবে কিনা সেই চিন্তাই করছি। ”
” তাহমিদের বাচ্চা, তুই যেয়ে নৌকা দেখ। আমাদের চিন্তা করতে হবেনা তোর। ”
সুপ্তি আর তাহমিদ তিন মাসের ছোট-বড় হওয়ায় একে অপরকে তুই বলেই ডাকে।
” আমি কিন্তু নৌকায় থাকবনা। শেষে যদি ডু’বে যাস বাঁ’চা’বে কে? আশেপাশে কোন সুপার হিরো নেই কিন্তু। শেষমেষ ভরসা এই তাহমিদই। ” টি শার্টের কলার উঁচু করে ভাব নিয়ে বলে তাহমিদ।
” এই পোলা, এত কথা বলিসনা বলে দিলাম। ” সুপ্তি তাহমিদকে সামনে ঠেলে দেয়।
নদীর টলটলে পানিতে মাঝির বৈঠা ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করছে। কুহু একটু হেলে দু হাতের আঁজলা ভর্তি করে পানি নিয়ে আবার নদীতে ছুঁড়ে দেয়। তাহমিদ, আনান ওরা নৌকায় না উঠে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে নৌকার দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ করে আছে ।
হঠাৎই তাহমিদের চোখ যায় কুহুর দিকে। মেয়েটা দু হাতের আঁজলা ভর্তি করে পানি নিয়ে নদীতে ছুঁড়ছে। নদীর তীর থেকে কুহুর মুখের হাসি স্পষ্টই দেখতে পায় তাহমিদ।
তনয়া আর আরোশি মিলে নাচানাচি শুরু করেছে।
নৌকা থেকে নেমে ওরা রিসোর্টে ফিরে। সেখানে কনসার্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণ কনসার্ট উপভোগ করে আবারও বাইরে আসে। এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে।
” ফুচকা, চটপটি, বার্গার, স্যান্ডউইচ খাওয়াও ভাইয়া। দেখ কত দোকান আর তুমি কিছু খাওয়াচ্ছোনা। এত কিপ্টা তুমি! ” তনয়া তাহমিদের হাত ধরে বায়না করে।
” আমি কিপ্টা! তাহলে তুই নিজেই কিনে খা। আমার এত শখ জাগেনি তোকে খাওয়ানোর। ” তাহমিদ তনয়ার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে।
” ও ভাইয়া, তুমি কিপ্টা নও কিপ্টা তো আনান ভাইয়া। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ ইট্টু খাওয়াওনা। ”
” চল, সবাইকে নিয়ে আয়। ”
সবাই হুড়মুড়িয়ে সামনের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। যে যার মত খাবার অর্ডার দেয়। শুধু কুহু দাঁড়িয়ে আছে।
” কি রে কুহু, তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু খাবিনা? ” সুপ্তি জিজ্ঞেস করে কুহুকে।
” আমি এসব খাইনা আপু। তোমরা খাও। ”
” আনান, তুই ও কি মেয়ে নাকি রে! মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে ফুচকা খাচ্ছিস। সেইম অন ইউ আনান। ” তাহমিদের কটুক্তি শুনেও আনান নিজের মত খেয়ে যাচ্ছে।
কুহু দোকানের পাশে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এদিকসেদিক দেখছে।
” ফুচকা, চটপটি খাওনা ঝালমুড়ি নিশ্চয়ই খাও? ” কুহুর সামনে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা বাড়িয়ে ধরে আছে।
” ধন্যবাদ, আমি খাবনা। ” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে কুহু।
” যদি তিন সেকেন্ডে এটা না নাও তবে তোমাকে আমি নদীতে আ’ছা’ড় মা’র’ব। ” চোয়াল শক্ত করে বলে তাহমিদ।
” আমি সাঁতার জানি। তাই ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ” কুহুও ত্যাড়াভাবে উত্তর দেয়।
” ভেজা অবস্থায় এখানেই ফেলে রেখে যাব। আই প্রমিজ তোমার ভাই-বোনদের কারও সাহস হবেনা তোমাকে গাড়িতে নেয়ার। ”
তাহমিদের গলায় এমন কিছু ছিল যা মুহূর্তেই কুহুর সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে বাধ্য করে।
তাহমিদের হাত থেকে ঝালমুড়ির ঠোঙা নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে। তাহমিদ মুচকি হেসে সেখান থেকে সরে আসে।
এটা সেটা খেয়ে ওরা আসে ছোট্ট বাজারমত জায়গায়। যেখানে বেশ কয়েকটা দোকান। দোকান ভর্তি চুরি, কানের দুলসহ মেয়েদের নানানরকম সাজের জিনিস।
মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পরে দোকানগুলোতে। সবাই মুঠো ভর্তি করে বিভিন্ন রংয়ের কাঁচের চুরি কিনছে। অবশ্য ওরা পছন্দমত নিচ্ছে, দাম দিবে তাহমিদ।
আরোশি একা একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কানের দুর দেখছে।
” আরোশি, তোরা সবাই কতকিছু কিনছিস, কিন্তু ঐ রোবট তো কিছুই নিচ্ছেনা। সে কি কিছুই নিবেনা? ”
আরোশি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় তাহমিদের দিকে।
” না মানে কুহুর কথা বলছিলাম। সেতো কিছুই নিচ্ছেনা। ”
” আপুকে আমি বলেছি, কিন্তু আপু বলল কিছুই নিবেনা। ” আরোশির সরল স্বীকারোক্তি শুনে তাহমিদ কিছু ভেবে একমুঠো লাল, নীল, কালো চুরি কিনে আরোশির কাছে দিয়ে কুহুকে দিতে বলে।
” এগুলো তুই কুহুকে দিস। সেতো আমার আশেপাশে ভিড়েনা আর কথাও বলেনা তাই এগুলো আমি দিয়েছি জানলে ও নিবেনা। কথাটা নিজের মাঝেই রাখিস তুই। আসলে তোরা সবাই কিনছিস কিন্তু ও কিছুই কিনছেনা এটা মানা যায়না। শেষে দেখা যাবে আড়ালে আবডালে ঐ মেয়েটাই আমাকে কিপ্টে ডাকবে। ”
আরোশি চুরিগুলো নিয়ে তাহমিদকে বলে, কেউ জানবেনা চুরিগুলো কে দিয়েছে।
খুশিতে তাহমিদ আরোশিকে আরো অনেকগুলো চুরি, কানের দুল কিনে দেয়।
ওরা রিসোর্টে রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে। আসার পথে যে যেখানে বসেছিল ফেরার পথেও সেভাবে বসে।
সারাদিন সবাই হৈ হুল্লোড় করে গাড়িতে উঠেই ক্লান্ত হয়ে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছে।
গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েরা ঘুমিয়ে পরে।
কিন্তু কুহু গাড়িতে উঠলে কখনোই ঘুমাতে পারেনা। এদিকে অন্ধকার গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে কুহুর।
” কি হয়েছে? এমন তিড়িংবিড়িং করছ কেন? ”
” কিছুনা। ” আর কিছুই বলেনা কুহু। আসলে ও তাহমিদের সাথে কথা বলতে চায়না৷
” নাও চকলেট খাও। ভালো লাগবে। ”
” সরি, লাগবেনা। ”
” আমাকে ক্ষমা করা যায়না? ” তাহমিদের আবেগে মাখা কথা শুনে চমকে উঠে কুহু। এই লোক হঠাৎ ক্ষমা চাইছে কেন!
” আমার মত সাধারণ মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের সম্মান ক্ষুণ্ণ করবেননা। আর আপনি এমন কিছুই করেননি যে কারনে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ”
কুহুর এমন কথায় কি উত্তর দিবে তাহমিদ। গাড়ির সিটে মাথা ঠেকিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
কতটা কষ্ট পেলে একটা মেয়ে এভাবে বলতে পারে তা বুঝতে পারছে তাহমিদ।
রাত দশটা বেজে গেছে। তাহমিদ, সুপ্তি, সিক্তা বাদে সবাই আনানদের বাসায় যাবে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কুহুকে নিয়ে। এত রাতে হোস্টেলে যাওয়া যাবেনা। তাই ভেবেচিন্তে কুহু আনানদের সাথে যেতে চায়। আনানের বাসার সামনে এসে কুহু গাড়ি থেকে নেমে আসে। একটিবারও তাহমিদের দিকে তাকায়না কিংবা ওর সাথে কথাও বলেনা৷ তাহমিদ ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু কুহু সেই সুযোগ দেয়নি।
চলবে…