#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী(ছদ্মনাম)
#পর্ব_ছয়
হাতের ক্ষত টার ব্যাথা ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে জেমি। হাতের পোড়া জায়গার উপরের চামড়া উঠে যাচ্ছে। জেমি মেঝেতে বসে বিছানার চাদর টা খামচে ধরে শান্ত হয়ে বসে আছে। ওর শরীর কাপছে রাগে। চোখ থেকে নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু এই জল কষ্টের না, এ জল রাগ, ক্ষোভ, সংমিশ্রণে। জেমি শান্ত হয়ে ভাবছে জায়ানের যখন হাত মুচড়ে ধরলো তখন জায়ান চাইলেই জেমিকে ছিটকে ফেলে দিতে পারতো কিন্তু দিলো না কেনো? জেমি হুট করে দাড়িয়ে গিয়ে চোখের পানি গুলো দুই হাতে মুছে নিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো…..
—কেনো কাঁদছি আমি ? কেনো চোখ থেকে পানি পড়ছে ? আজ থেকে আমি কাঁদব না। আমার প্রতি করা প্রত্যেক টা অন্যায়ের শাস্তি পাবে ইরা বেগম আর জায়ান। শুধু মাত্র নিজেকে দূর্বল ভেবে অনেক অন্যায় সহ্য করেছি আমি ভুলে করেছি। আর একটাও ভুল করব না। “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী” আমি তো কোনো দোষ করেনি তাহলে শাস্তি কেনো পাবো? শাস্তি পাবে তো তারা যারা আমার সাথে প্রতিনিয়ত অন্যায় করে চলেছে। আজ থেকে অন্যরকম জেমিকে দেখবে সবাই। যে থাকবে মানসিক ভাবে স্ট্রং, প্রতিবাদী, যার থাকবে না মায়া, অনুভূতি, যার মনে থাকবে না ভালোবাসা। নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলাম।
বলেই ছাদের দিকে পা বাড়ালো। এই মুহূর্তে এই বাড়িটা ওর কাছে নরক মনে হচ্ছে। মাইন্ড ফ্রেশ তাই ছাদের দিকে হাটা শুরু করলো।
____________________________________________
জায়ান খাটের উপর মাথার চুল খাবলে ধরে বসে শান্ত হয়ে বসে আছে। মাথার যন্ত্রনা হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে। মাথায় এত যন্ত্রনা কেনো হচ্ছে? বিগত কয়েক দিন ধরেই মাথার যন্ত্রনা বাড়ছে ওর। জায়ান এর এহেতুক মাথা ব্যাথার কারন খুঁজে পাচ্ছে না। জায়ানের যখন মাথা ব্যাথা উঠে তখন ওর কাছে সব কিছু বিষাক্ত লাগে। জায়ান মাথাটা চেপে ধরে বিছানায় সুয়ে পড়লো। মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলো। জায়ান নিজেও বুঝতে পারছেনা ওর এতটা কষ্ট হচ্ছে কেনো? জায়ান মাথা চেপে বালিশে মাথা রাখতে রাখতে নিজে নিজেই বলে উঠলো…..
—এতটা ব্যাথা হচ্ছে কেনো হঠাৎ? হয়তো বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করায়। একটু ঘুমানো প্রয়োজন?
বলেই আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নিলো।
____________________________________________
মায়া ইরা বেগমের রুমে পায়চারি করছে। ওর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ও কিছু নিয়ে চিন্তি। মায়ার সামনেই ইরা বেগম খাটের উপর বসে বসে পান চিবাচ্ছেন। মায়াকে এমন করে পায়চারি করতে দেখে ইরা বেগম মুখ ভর্তি পান চিবাতে চিবাতে বলে উঠলো…..
— আহঃ মায়া মামনি এত রাতে এমন করে পায়চারি করছো কেনো? নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও। সকাল হলে কিছু একটা ভেবে নিও। অনেক রাত হয়েছে আমি বরং ঘুমাই তুমি নিজের রুমে যাও। তোমাকে এই রুমে এই সময় জায়ান বা ওই মেয়েটা দেখে নিলে সন্দেহ করবে।
ইরা বেগমের কথা শুনে মায়া পায়চারি বন্ধ করে দিয়ে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো…..
— তোমার মোটা মাথায় এইসব ঢুকবে না মামনি না। তুমি তো সারাদিন মুখ ভর্তি পান চিবাতে ব্যস্ত থাকো। তুমি কি করে আমার মনের অবস্থা বুঝবে।
মায়ার এমন কথা শুনে ইরা বেগম চোখ বড় বড় করে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। যেই মেয়েটার জন্য সে এত কিছু করছে আর সেই মেয়েটাকে তাকে এইভাবে কথা শুনাচ্ছে। এটা ইরা বেগম মানতে পারছে না। ইরা বেগম কে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া ইরা বেগমের সামনে সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে আদেশ স্বরে বলে উঠলো…..
— আমার জন্য এক কাপ করে নিয়ে এসো তো মামনি?
মায়ার কথা শুনে ইরা বেগম মনে হয় আকাশ থেকে পড়লো। এত রাতে মায়া ইরা বেগম কে কফি বানানোর জন্য আদেশ করছে। ভাবতেই ইরা বেগম জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো….
— আমি? আমি এত রাতে তোমার জন্য কফি করে আনব? কি বলছো তুমি মায়া মামনি?
ইরা বেগমের কথা শুনে মায়ার মুখের মধ্যে বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠলো। মায়া ঝাঝালো কন্ঠে পাল্টা উওর দিলো…..
— এই রুমে যেহেতু তুমি আছো সেহেতু তোমাকেই বলেছি তাইনা। সো, ননসেন্স কুয়েশ্চন করে আমার মাথাটা গরম করো না। যাও এক্ষুনি আমার জন্য কফি নিয়ে এসো। আমার আদেশ মানতে তুমি বাধ্য। ভুলে যেও না এই বাড়িটা আমার।
বলেই মায়া মোবাইল এর মধ্যে মনোযোগ দিলো। ইরা বেগম আহত চোখে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। বাধ্য হয়ে উঠতে হলো ইরা বেগম কে। মায়ার মুখের উপর আর কথা বলার সাহস হলো না। ইরা বেগম কে বেরিয়ে যেতে দেখেই মায়া বাঁকা হেসে বললো……
— তুমি এতটা বোকা কেনো মামনি? কি ভেবেছো, জেমির উপর যেমন করে ছু/ড়ি ঘুরিয়েছো আমার উপর ও তেমন করবে।
বলেই শব্দ করে হাসলো মায়া। তারপর হাসতে হাসতেই বলে উঠলো……
— মায়া এত কাচা খেলোয়াড় না মাই ডিয়ার মামনি। জায়ানের জীবন থেকে জেমিকে সরানোর পর তোমাকেও আমাদের জীবন থেকে আউট করে দিব। ছুঁড়ে ফেলে দিব রাস্তায়। আর জেমি কাল সকালে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, এমন সারপ্রাইজ যে তুমি ভেঙে যেতে বাধ্য হবে, চমকে উঠবে অজান্তেই, সবশেষে তোমার জন্য কি ওয়েট করছে তুমি নিজেও জানো না।
বলেই মায়া একা একাই হাসতে লাগলো। ওর খুশিতে বাধ মানছে না। দীর্ঘ চার বছর পর ওর চাওয়া পূর্ন হতে যাচ্ছে।
ইরা বেগম রান্না ঘরে এসে রাগে ফেটে পড়লো। রাগে গা জ্বলে উঠলো তার। রাগে ফোস ফোস করতে করতে বলতে লাগলো….
— আমাকে হুমুক দেওয়া এই ইরাকে হুমুক দেওয়া। তোকে তো মেয়ে আমি দুইদিনে পিশিয়ে দিব একবার শুধু জায়ানের সাথে বিয়ে হোক। তোকে ও যদি ওই মেয়েটার মতো নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছি আমার নাম ইরা না।
ইরা বেগম রাগে বকবক করছে আর কফি বানাচ্ছে। মায়াকে জায়ানের বউ করতে চাওয়ার পেছনে কারন টা হলো মায়ার বাবার সম্পত্তি আর এই দুই তলা বাড়ি হাতানোর লোভ। মায়া ইরা বেগমের উদ্দেশ্য টা খুব ভালো করেই জানে। ইরা বেগমের লোভে অন্ধ হয়ে যে অন্যায় করছে তার পরিনাম কি হবে সে ভাবতেও পারছেনা। লোভের বশীভূত হয়ে আজ সে জেমির উপর অত্যাচার করছে। কতটা ভুল করছে এখন সে বুঝতে পারছেনা।
____________________________________________
আছানের শব্দ কানে যেতেই জেমি উঠে নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর কিছুক্ষন বেলকনিতে দাড়িয়ে থেকে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢুকে গেলো। যাইহোক মেয়েটা তো নতুন এসেছে ওকে না খাইয়ে রাখা তো ঠিক হবে না ? রান্না ঘরে গিয়েই জেমি ওর নিজের মতো রান্নায় মনোযোগ দিলো। হাতের পোড়া আর কাটার ক্ষত দুটোর ব্যাথা আজ একটু কম। তাই সাবধানে কাজ করছে। সবার জন্য নাস্তা বানাতে বানাতে ঘড়ির কাটা ৮ টা ছুঁইছুঁই। জেমি সব নাস্তা গুলো টেবিলে সাজিয়ে রেখে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো জায়ানের রুমের দরজাটা বন্ধ। এতক্ষনে তো জায়ানের অফিসে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ার কথা। কৌতূহল বশত জেমি জায়ানের রুমের দরজায় হাত রাখতেই দরজাটা একটু খুলে গেলো। জেমি ভেতরে উঁকি মারতেই ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখার মতো শক্তি ওর শরীরে অবশিষ্ট নেই। জেমি চোখ বন্ধ করে জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে ধীর পায়ে পুতুলের মতো এগিয়ে যাচ্ছে নিজের রুমে। ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে না টলমল করছে। জেমি নিজের রুমে এসেই দরজা লাগিয়ে দরজা ঘেষে মেঝেতে বসে পড়লো। নাহ জেমি কাদঁছে না। ওর চোখ স্থির হয়ে আছে, নড়ছে না, চোখের পলক ও পড়ছে না। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলো হাঁটুর ভাঁজে। সকাল সকাল এ দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ও। কি করবে এখন ও? এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত?
____________________________________________
কতক্ষন ঠিক এইভাবে বসে ছিলো জেমি নিজেও জানেনা। হাঁটু ভাঁজে মুখ লুকিয়ে গুটিশুটি মে/রে বসে আছে জেমি। হঠাৎ করেই দরজায় কেউ টোঁকা মা/রতেই জেমির ধ্যান ফিরে এলো। জেমি তাড়াহুড়ো করে নিজেকে সামলে নিলো। চোখের কোনে জমে থাকা জল শাড়ির আঁচলে মুঁছে নিয়ে দরজা খুলতেই মায়া বিভৎস,বিধ্বস্ত,অবস্থায় চোখের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখি জেমি অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করে আছে মায়ার দিকে। মায়াকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ও সারারাত কেঁদেছে, চোখের চার-পাশ লাল হয়ে ফুলে আছে। চোখের কোনে জল জমে আছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে আছে, ঠোঁটের নিচে খানিক টা ফুলে লাল হয়ে আছে। মায়াকে এই অবস্থায় দেখেই জেমির বুকের ভেতর টা মুচড়ে উঠলো। জেমির কন্ঠস্বর নিমিশেই হাওয়া হয়ে যেতে লাগলো। জেমি কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। সব শব্দ গুলো জেমির গলায় ঝট পাকিয়ে আছে । জেমি কয়েকবার ঢোঁক গিয়ে ঝট পাকানো স্বরে বলে উঠলো…..
—ততততোমার এই অবস্থা কেনো মমমমায়া?
জেমি মায়াকে প্রশ্ন করতেই মায়া হুট করেই জেমিকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো…………
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। আমার ভুলগুলো ক্ষমা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিয়ে দিবেন সংশোধন করে নিব। ছোট পর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত। এইচ এস সি ব্যাচের চাপ সম্পর্কে আশা করি আপনারা জানেন। আজকের পর্বে দুইটা রহস্য আছে বলুন তো কি?)