বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
৩.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
প্রভাত বেলা। গত রাতের ঝড়ের পর, আজ আকাশ পরিষ্কার। ফকফকে উজ্জ্বল আলোয় ভুবন ছেঁয়ে। আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে উঠল চাঁদ। ঘুমে মাখোমাখো চোখজোড়া খুলতে, আষাঢ়কে সামনে বসে থাকতে দেখলো। গম্ভীর মুখ, কেমন জানো চাহনি তার। গতরাতে কি উনি ঘুমায়নি? এমন র/ক্তিম চোখ কেন তার! ভাবতে ভাবতে নড়েচড়ে উঠে বসলো চাঁদ। গতর থেকে কাঁথা সরাতে থমকে গেল। হাঁটু অবধি শাড়ি উঠে, রফাদফা অবস্থা আঁচলের। ছোট ঢোক গিলে, পিটপিট দৃষ্টি তুলে আষাঢ়ের দিক তাকালো এক পলক। দৃষ্টি লুকিয়ে কেশে উঠল আষাঢ়। আতঙ্/কিত চেহারায় তড়িঘড়ি হাতে আবারও গতর ডেকে নিলো চাঁদ। কিছু ঘটেনি এমন হাবভাব নিয়ে বসলো। আষাঢ় চাঁদের দিক এগিয়ে এসে, কপালে হাত ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ জ্বর কমেছে! এখন কেমন লাগছে? ‘
চাঁদের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। ঠান্ডা বসে যাওয়ায় স্বর আটকে আটকে আসছে। অনেক জোর খাটিয়ে মিহি ভা/ঙা আওয়াজে বলল,
‘ ভালো।’
কাছ থেকে সরে এলো আষাঢ়। পাশের টেবিল থেকে কুমকুমে গরম পানির গ্লাসটা তুলে। চাঁদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।’
চাঁদ পানিটা শেষ করল। আষাঢ় গম্ভীর আওয়াজে বলল,
‘ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।’
চোখ তুলে তাকালো চাঁদ। আষাঢ় চেয়ার টেনে সামনে এসে বসলো। গলা ঝেরে বলতে লাগল,
‘ বিয়েটা যেভাবেই হোক। তুমি আমার স্ত্রী তা অস্বীকার করতে পারবো না। গতরাত থেকে মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। পারছিনা। কোথাও একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে আমার। এই সম্পর্কের জের কতদূর আগাবে আমি জানিনা। তবে গতকাল তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারবো কিনা! যতদিন তুমি আমার কাছে আছো, সেই দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। এরচেয়ে বেশি কিছু আমার থেকে আশা করোনা। রুবেল আমার বন্ধুর চেয়ে বেশি, ভাইয়ের মত ছিল। আমাদের এতবছরের বন্ধুত্ব। তার দৃষ্টিতে নিচু হওয়া মেনে নিতে পারছিনা। তুমি এখন কল্পনায় বাস করছ। নতুন নতুন এসব ভালো লাগছে হয়তো। কয়েকদিন কা/টলে মাথা থেকে এসব ফ্যান্টাসি ঝরে যাবে। চারিপাশের বাস্তবতায় দম আটকে আসবে। তখন যদি তোমার মনে হয়, এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই। আমি বা আমার পরিবারের কেউ বাঁধা দিবেনা তোমায়। কথা দিলাম।’
টলমল চোখ তুলে তাকালো চাঁদ। ব্যথাতুর সুরে বলল,
‘ ভয় দেখাচ্ছেন? আমাকে তাড়ানোর এত তাড়া আপনার?’
ঠোঁট মেলে হাসলো আষাঢ়। তাচ্ছিল্য সুরে বলল,
‘ তুমি আবার ভয়ও পাও?’
‘ পাই তো। আপনাকে হারাবার।’
‘ তুমি এত জেদি কেন?’
‘ আপনি এত কঠোর কেন?’
আষাঢ় বুঝানোর স্বরে বলল,
‘ আমাদের দুজনের দুনিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুমি কাঁচের বাক্সে যত্নে বেড়ে ওঠা গোলাপ। আর আমি রাস্তার পাশে অযত্নে বড় হওয়া আগাছার মত। আমাদের এক সাথে পথচলা হবেনা চাঁদ।’
আষাঢ়ের চোখে চোখ রাখলো চাঁদ। নিগূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ কথা দিলাম শেষ নিশ্বাস অবধি পাশে থাকবো আপনার।’
আশাহত, হতাশ শ্বাস ফেলল আষাঢ়। বিরক্তি ভারী মুখ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নিরুত্তর। আষাঢ়ের যাওয়ার পথে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল চাঁদ। গভীর কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
‘ সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে, একদিন আপনি আমায় অগাধ ভালোবাসবেন আষাঢ় ভাই। সেই দিনটার অপেক্ষায় রইলাম।’
আরশি চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে হতভম্ব। পাগলের মত শরীর চুলকাচ্ছে চাঁদ। আরশি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে। তড়িঘড়ি করে চাঁদের দিক এগিয়ে গেল। বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে! এভাবে শরীর চুলকাচ্ছ কেন?’
আরশির গলার ভাঁজ পেয়ে থেমে গেল চাঁদ। পিছন ফিরে তাকালো। মাথা নুয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ ঠান্ডা পানিতে আমার সমস্যা আছে। সারাবছর কুমকুমে গরম পানিতে গোসল করতে হয়। নয়তো শরীর চুলকায়।’
‘ গরম পানির কথা আগে বলোনি কেন? আমি করে দিতাম।’
উত্তর খুঁজে পেল না চাঁদ। গতকাল থেকে তার কারণে এতকিছু হয়ে গেল। এইটুকু্র জন্য তাদেরকে বিরক্ত করা উচিত মনে হয়নি। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরশি গামছা নিয়ে চাঁদের দিক এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ চুলের পানিতে জামা ভিজে একাকার। এদিকে এসো। মুছে দেই। নয়তো, শরীর চুলকাবে আরো।’
ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গেল চাঁদ। তার কোমর সমান লম্বা চুল মুছে দিতে দিতে আরশি বলল,
‘ এটা এখন তোমার বাড়ি। কোনকিছু নিয়ে লজ্জা পাবে না।যা প্রয়োজন নির্দ্বিধায় বলবে।’
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াল চাঁদ। মুখে কিছু বলতে পারলো না। চোখজোড়া ভিজে এলো। ভাবিকে মনে পড়ছে খুব। মায়ের আদর কেমন হয় চাঁদের জানা নেই। জন্মের পরপর মাকে হারিয়েছে। ফুপুর কঠোর নজরদারীতে বেড়ে উঠা। বড় ভাইয়ের বিয়ের পর যখন পৃথা ভাবি বাড়িতে এলো। সেই অভাবটা তখন পূরণ হলো। ভাবি রূপে মায়ের মমতা পেল। পৃথা সবসময় চাঁদকে আগলে রাখতো। গোসলের পর রোজ এভাবেই চুল মুছে দিতো।
আরশির ডাকে চাঁদের ঘোর কাটলো। আরশি নিজে থেকে বলল,
‘ জানো চাঁদ! আমি আর আষাঢ় যমজ। আষাঢ় আমার পাঁচ মিনিটের বড়। ছোট থেকেই ও ভীষণ দায়িত্বশীল। বাবা না থাকায়। সেই দায়িত্ব গুলো নিজে পালন করতে চাইতো। আমাকে চোখেচোখে রাখতো, মায়ের কাজে, ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতো। সবসময় শক্ত, গম্ভীর বড়দের মত করে মুখভার করে রাখতো। ওর বয়সের ছেলেরা যখন বন্ধুবান্ধব, ঘুরাফেরা আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ও তখন ব্যবসায় হাল ধরল। অবসর সময়টা সেখানে ব্যয় করত। রাজিব মানে তোমার দুলাভাইয়ের সাথে আমার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে প্রেম হলো। মাখোমাখো সম্পর্ক। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁ/চবো না এমন। সব ঠিকঠাক চলছিল। রাজিবের সরকারি চাকরি হলো। তারপর বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। ওদের বাড়িতে আমার কথা জানালে, উনারা তীব্র নাকচ করল। টাকা-পয়সাওয়ালা মানুষ। বাবা ম/রা মেয়েকে ঘরে তুলবে না। রাজিব অনেক বুঝানোর পর, তারা মানল। কিন্তু সেই সাথে শর্তও জুড়ে দিলো। বিয়েতে বিশাল আয়োজন করতে হবে। নগদ আড়াই লাখ টাকা ক্যাশ দিতে হবে। এসব শুনে মা অমত করল। সাফসাফ মানা করে দিলো। আমিও রাজিবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করলাম। আষাঢ় বোধহয় ব্যপারটা বুঝল। মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করল। কোথা থেকে যেন টাকার ব্যবস্থা করে বিয়েটা তুলে দিলো। বিয়ের অনেকদিন পর জানলাম, সেই টাকা গুলো বাড়ি বন্ধক দিয়ে জোগাড় করেছিল। ওর পড়াশোনার খুব শখ ছিল। কিন্তু অনার্সের পর পড়ল না আর। ব্যবসায় খরা নামলো। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে হিমসিম খাচ্ছিলো। তাই পুরো সময়টা ব্যবসার কাজে লাগালো। অবসর সময়টায় টিউশনি করত। খুব অল্প বয়সে সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। তাই হয়তো ওর মনের দরজা বন্ধ। কঠোর, বাস্তববাদী প্রচন্ড! ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি গুলো বুঝতে অক্ষম। কিন্তু তোমার উপর ভরসা আছে। কি সাহসী, মিষ্টি একটা মেয়ে। আস্তে আস্তে ও ঠিক ভালোবাসতে শিখে যাবে।’
চাঁদের মলিন মুখ। কন্ঠে অভিমান, অভিযোগ জুড়ে বলল,
‘ উনি ভীষণ শক্ত মানুষ আপা। তার উপর আবার রেগে। আদৌ কি কোনদিন আমাকে ভালোবাসবে সে?’
চাঁদের বোকাসোকা কথা শুনে আরশি হেসে ফেলল। হেয়ালি সুরে বলল,
‘ ভালোলাগা না থাকলেই কি কেউ রাত জেগে অমন সেবাযত্ন করে? সারারাত বোধহয় দুচোখের পাতা এক করেনি। ভোরবেলা উঠে দেখি দরজা খোলা। আষাঢ় পাশে বসে জলপট্টি দিচ্ছে তোমার । এসব চিন্তা, যত্ন ভালোলাগা থেকেই আসে।’
চাঁদের চোখ বড়বড় হয়ে এলো। আশ্চর্য চাহনি। বিমূঢ় সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ উনি সারারাত জেগে জলপট্টি দিচ্ছিলো?’
‘ ওমা! তুমি টের পাওনি?’
লজ্জায় আমতা আমতা করে চুপ হয়ে গেল চাঁদ। নিজের উপর প্রচন্ডরকম রাগ হচ্ছে। সারারাত অমন ম/রার মত বে/হুঁশ হয়ে কি করে ঘুমালো। আরশি আবার ডেকে বলল,
‘ কথায় কথায় চা’টা বুঝি ঠান্ডাই হয়ে গেল। ঝটপট শেষ করো।’
আরশি চলে যেতেই গভীর ভাবনায় ডুবে চায়ের কাপে আনমনে চুমুক দিলো চাঁদ।
সারাদিন আর বাড়িতে ফিরেনি আষাঢ়। দুপুরের খাবার কাউকে পাঠিয়ে কারখানায় নিয়ে গেল। বিকালে পাড়াপ্রতিবেশিরা নতুন বউ দেখতে বাড়িতে আসলো। শাড়ি পড়তে জানেনা চাঁদ। আরশি পড়িয়ে দিলো। খুব সাদামাটা ভাবে সাজিয়ে দিলো। মালা বেগম ডাকতে এসে চাঁদকে দেখে থমকে গেল। শাড়িতে মেয়েটিকে ভীষণ মানাচ্ছে। গতরাতে তাড়াহুড়োর ভেতর ঠিকঠাক খেয়াল করা হয়নি। দিনের ফকফকে আলোতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। আকাশে চাঁদ যেন তার ঘরে নেমে এসেছে। চাঁদের পাশে যেয়ে বসলো মালা বেগম। গহনার বাক্স হাতে। বাক্স খুলে একজোড়া চিকন সোনার বালা আর কানের ঝুমকা বের করল। চাঁদকে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ হয়তো এসব তোমার কাছে অতি সামান্য। বড় ঘরের। অনেক দেখে বড় হয়েছ। আমার কাছে এগুলোই সারাজীবনের সঞ্চয়। অনেক বছর আগে, বিয়ের পরপর আষাঢ়ের বাবা গড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি চলে গেছেন। পরিস্থিতি বে/গতিক হলো। মাঝে দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা এলো। আর্থিক সং/কটে পড়লাম। তবুও এসব ছুঁইনি। ছেলের বউকে দিবো বলে, যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। এখন থেকে এসব তোমার।’
চাঁদ অবাক হলো। বিস্ময়ের সুরে বলল,
‘ কিন্তু আন্টি এসব তো আপনার।’
মালা বেগম হেসে ফেলল। চাঁদের মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়ে বলল,
‘ তোমার জন্যই রাখা ছিল। আর আন্টি না, মা বলবে। চলো এবার। বউ দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।’
মলিন হাসলো চাঁদ। অবশেষে মায়ের অভাবটা বুঝি পূর্ণ হলো। সত্যি সত্যি একটা মা পেল।
চলবে……
( ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺