বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ১৩+১৪

0
279

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৩–১৪

” জেরিন এটা কি তুমি?
” জি স্যার ”
” কিচেনে চলে এসো ”
মেডিসিন ক্যাবিনেটে পুরান ইনহেলারের জায়গায় নতুনটা স্থাপন করে এগিয়ে গেল জেরিন।তার কর্মস্থলের এই অংশে রেস্ট্রিকটেড।
গ্যাব্রিয়েল কিচেনের সি ই ওর ফ্ল্যাটে অধিনস্তরা সচরাচর কম আসে। জেরিনের হাতে কিছু ব্যালেন্সসিটের ফাইল যেগুলো স্যারকে দেখানো দরকার। জি এস স্যার দেখা গেলো কিচেনে কাজ করছেন। মেয়ে হিসেবে পুরুষদের একা কিচেনে কাজ করতে দেখা অস্বস্তিকর। কিন্তু এই কাজটা জি এস কতটা আনন্দে নিয়ে করেন। গ্যাব্রিয়েল এক গ্লাস পাইনএপেল সরবত ঢেলে দিলো জেরিনকে।

” তুমি প্যানকেকের সাথে মধু নেবে তো?”

জেরিন হাসলো, ” অনেক ধন্যবাদ স্যার তবে আমি নাস্তা করেছি”

” কী আবার করেছ এককাপ কফি আর টোস্ট, আজ আমার সাথে আরেকবার হোক ”

জেরিন হেসে মাথা নাড়লো। রম্য বেশ মজা পেলো খাওয়াদাওয়া নিয়ে এই দেশে জোর জবরদস্তি একটা শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে ধরা হয়।জেরিন বলছে,
” স্যার, বিষয়টা তো ধামাকা হয়ে গেছে”

” কোনটা? ”

জেরিন বেশ অবাক হলো,” আপনি অনলাইনে যাননি, শ্রেয়া ম্যামের ভিডিও তো ভাইরাল”

” তেমনই কি হবার কথা নয়? ”
গ্যাব্রিয়েল এগ সুগার বেটার মিক্স করতে করতে বলল। জেরিন এখন বসে বসে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাচ্ছে। দিনে দিনে প্রমাণ হচ্ছে এই মানুষটা কতটা ঠান্ডা খেলোয়ার।
কাজ করতে করতেই রম্য বলল, ” আচ্ছা জেরিন উত্তরা জায়গাটা কোনদিকে? ”

” ঢাকার উত্তরে স্যার, আ…গুলশান বারিধারা ছাড়িয়ে আরো আগে এয়ারপোর্টের আরেকটু আগে , কেন স্যার”

” তোমার মনে আছে কিছুদিন আগে ড্যাড এখানে একটা ফ্ল্যাটের ডিলে আগ্রহী হচ্ছিলো? কিনতে চাইছিল”

” ওটা তো মনে হয়, সিম্পল ইন্টারেস্ট ছিলো স্যারের। ঢাকা শহরের কোন এরিয়ায় কত দাম সেটা জানার আগ্রহ আর কিছু না.. ”

গ্যাব্রিয়েল একঝলক জেরিনের দিকে তাকিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো। প্যান কেক জিনিসটা আপাতভাবে সহজ হলেও এটায় মনোযোগ ছুটে গেলে ঝামেলা হয়ে যায়। বিশেষ করে ডিমের সাথে চিনির বেটারটা খুব মসৃণ হতে হয়।যদিও তার চোখের পর্দায় কিছু কাগজ ঝুলছে,অর্ণবের দেওয়া এভিডেন্স ভুল কিছু নয়, ” ড্যাড ফ্ল্যাট কিনেছে এবং বর্তমানে সম্ভবত সেখানে কাজ চলছে। সামনের সামারে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে ”
” কিডিং! ”

” আই এম নট কিডিং রমি,মম ওয়াজ রাইট ”

রম্য কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। অর্ণব নিজেই বলে উঠলো রেস্টুরেন্টের চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ব্যাক কর, বুড়োর মাথা গেছে। তার ওপরে ড্যাড যদি সত্যিই এরকম কিছু করে, মমকে আমি একা সামলাতে পারব না।

” সামলানোর কিছু নেই, তারা অলরেডী ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছে ”

” তারপরেও তুই তাকে চিনিস। মাম ড্যাডের ব্যাপারে এখনো অবসেস্ট । এখন তোর কাছে দুইটা অপশন, হয় ব্যাক কর, নয়ত বাবার এই পাগলামি থামা। অন্তত এই মুহূর্তে থামা তেমন কিছু করলে মম ঝামেলা করতে চলে আসবে ওখানে, আর মম ওখানে এলে তোর কাজ কিছুই উদ্ধার হবে না ”

রম্য বিরক্তিতে কথা আগায়নি। বাবার কার সাথে সম্পর্ক হয়েছে, বা কাকে বিয়ে করছে এই সম্পর্কে এখনো কোনো স্পষ্ট ধারণা রম্য করতে পারেনি।সোহরাব নিজেও কিছু বলেননি। অর্ণব নিজেই একের পর এক থিউরি বলে যাচ্ছে, মে বি কোন গোপন কেউ, মেবি তার নতুন ইন্টারেস্ট অর মেবি সেই মেয়েটা…

” ও মাই গড “জেরিনের কথায় রম্য ঘুরে তাকালো।

” এত সুন্দর এত পাফি ! এর থেকে সেরা প্যানকেক মনে হয় আমি আগে খাইনি ”

জেরিনের প্রশংসায় রম্য খুশি হলো কিন্তু প্রসঙ্গ বদলাল না ” আমাকে ওই জায়গার ঠিকানাটা এনে দিতে হবে জেরিন যেখানে ড্যাড ফ্ল্যাট দেখেছিলো” ”

” স্যার আমি খুঁজে দেখি” জেরিন কিছুটা হকচকিয়ে গেছে। রম্যের মাথায় অন্য ভাবনা সমস্যাটা ফ্ল্যাট নয় সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে। কে হতে পারে যাকে নিয়ে বাবা এতো পজেসিভ? কোন গোল্ড ডিগার ইয়াং মেয়ে হওয়া অসম্ভব নয়।ড্যাড হ্যান্ডেল করতে পারলে কুল। কিন্তু রম্যকে লূকানোর কী হলো? অনি বাড়াবাড়ি ভাবছে নাতো?

” আমি তাহলে নিচে যাই, লিস্ট গুলো মিলিয়ে নেবেন স্যার”
জেরিন ফাইল রেখে নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে,
” মেহরোজ কি এসেছে এলে আমায় অবশ্যই কল দেবে,
” এখনো না স্যার ” জেরিন বিষয় লুকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ” বড় স্যারও খোঁজ নিচ্ছেন কথা বলছিলো। ইনফ্যাক্ট এখনো করছেন। ”

জেরিন আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। নদী মেয়েটার ওপর ঝড় বয়ে গেছে।তবে সেদিন জি এস স্যার এটা চাইলে থামাতে পারতেন। আংটিটা ওনার কেবিন থেকে অনেক আগেই উদ্ধার হয়েছিল। জেরিন উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে খবর দিতে গেলে গ্যাব্রিয়েলই বাধা দিলো।

” সার্চ করতে দাও ওকে”

” স্যার মেয়েটা খুব বিব্রতকর অবস্থায়.. ”

” আমি সামলে নেব । এই মোমেন্টগুলো জরুরী। শ্রেয়াকে চেঁচাতে দাও দেখি কত চেঁচায়। সব ক্যাপচার কর।ইনফেকশন দূরে সরাতে গেলে একটু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। তুষার কোথায়?”

জি এস স্যারের ইশারায় তুষার কায়দা করে নদীকে হাইড করে শ্রেয়ার চিৎকার আর গালিগালাজগুলো ভিডিও করেছে, সাথে আংটি পাবার পর শ্রেয়ার চেহারাও। রাতে তুষারের একজন রিপোর্টার বন্ধু দিয়ে ঠান্ডা মাথায় এডিট করে ছেড়ে অন এয়ার করা হয়েছে।সেই সাথে তার আগের কিছু পুরুষঘতিত স্ক্যান্ডেল জুড়ে দেয়া বাড়তি মশল্লার মতো। সকাল থেকে এই পর্যন্ত প্রায় একশো শেয়ার হয়ে গেছে। সেই সাথে শ্রেয়ার ব্লগে ধোঁয়া তোলা কমেন্ট।

শ্রেয়া গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের বড়ো বিষকাঁটা ছিলো। ইফতেখারের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। সে বুঝেসুঝে প্ল্যান করে এসেছিল, গতরাতে জি এস স্যার একটু ঠান্ডা থেকে পাশার দানটা উলটে দিলেন শুধু। আপাত সমাজকর্মী মানব দরদী শ্রেয়ার ইমেজ ফাটা বেলুনের মতো নিশ্চিহ্ন। তবে কষ্টটা হলো নদী মেয়েটার।জেরিন ছোট একটা নি;শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল। রম্য বাবার জন্য ব্রেকফাস্ট টেবিলে গুছিয়ে বাবার কল পেলো,

” হেই বেটা কী অবস্থা?.

” ব্রেকফাস্ট করনি আশাকরি”
” না, তবে একটা বাইরে প্রগ্রাম আছে।আমরা ডিনার একসাথে করব ইনশাল্লাহ ,তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে ”

“তাই কি? “রম্য কিছুটা শ্বাসরোধ করে বলল।

” হ্যাঁ একচুলি আমার এত উত্তেজিত হয়ে তোমার সাথে কথা বলা ঠিক হয়নি। আই এপোলোজাইস। ”

” ইটস ওকে ড্যাড ”

“নদী মেয়েটাকে হ্যাম্পার করার ব্যাপারটা নিতে পারিনি। আ রিয়েল পুওর সোল ”

” আই আন্ডারস্ট্যাণ্ড ড্যাড ”

” ইউ ডু? তাহলে আশা করব আমার কথাটা তুমি শুনবে ”

“শুনছি।”

” যাক একটা চিন্তা দূর হলো আমায় ঠিক করতে দাও। আর… ইয়ে আরেকটা কথা।”

রম্য চুপ করে অপেক্ষা করছে,সোহরাব সময় নিয়ে বললেন, অনেকদিন ধরেই ভাবছি তোমাকে বলবো, আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।আমি আসলে একটা রিলেশনে আছি”

” আই সি “রম্যের শান্ত কন্ঠ।

“তোমাদের নিজের একটা লাইফ আছে, সেই নিয়ে তোমরা ব্যস্ত। তোমার মা আমেরিকায় তার চেইন ফুড বিজনেসে হ্যাপি। আমি আর একা থাকতে চাচ্ছি না। যদিও ও একটু ইয়াং তবে আমায় বোঝে ”

” কে জানতে পারি ড্যাড?

” আমি রাতে বলব ”

রম্য চুপ করে আছে। ছেলের নীরবতা দেখে সোহরাব সামদানীও চুপ করে গেলেন। কিছু নীরবতার অনুভব বড় জটিল হরফে লেখা।
******

” তুই কাজে যাবি না মানে! উল্টো এখনতো অ্যারোগান্স নিয়ে যাবি, তুই কি চুরি করেছিস যে লজ্জা পাচ্ছিস। উল্টো তারা তোকে রেসপেক্ট করেনি, তুইতো কম্পেন্সেশন মানি চাইবি তাদের কাছে। আমি হলে ফেইসভুক লাইভ করে ছ্যারাবেরা করে ফেলতাম। তুই কি না চোরের মত মুখ লুকিয়ে আসতে চাচ্ছিস।তুই গাধা নাকি কেচো রে? ”

তৃষা, সূবর্ণা বড় বড় চোখ করে বক্তৃতারত নিশির দিকে তাকিয়ে আছে।যতটা তার কথা শুনছে ততটাই তার পোশাকে চোখ আটকে যাচ্ছে, নদীর যে এত আপ টু ডেট ঝাকানাকা টাইপ বোন আছে তারা জানতোও না।আজ কলেজে যায়নি দেখে নিজেরাই ঠিকানা খুঁজে চলে এসেছে নদীর বাড়ি। এসেই দেখা নিশি নামক ঘূর্ণিঝড়ের সাথে। নদীকে নিয়ে সামনের রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলো। বান্ধবীদের নদী কি খুলে বলবে নিশিই হড়বড় করে বলল, অনলাইনে দেখ নাই?

সুবর্ণা বড় বড় চোখ করে বলল, ” ঘটনা তো পুরা ভাইরাল, এই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে তুই ফেসে গেছিস”

” তুই এত বড় জায়গায় কাজ করিস আমাদের বলিস নাই ”

” বড় জায়গায় ছোট কাজ করে বলার কিছু নাই “নদীর শান্ত জবাব।” তাছাড়া কাজ আর করব না,যে জায়গায় ম্যানেজমেন্টই দায়িত্বহীন ”
যদিও নদীর ভেতরে অন্যকেউ বলল, চলবে কীভাবে সামনের মাসে নতুন বাসা ভাড়া করা লাগবে।

” জব ছাড়িস না রে ফাইনানশিয়াল সাপোর্ট হুট করে ছাড়া উচিৎ না” রাস্তায় পাশাপাশি তৃষার মুখ অন্ধকার করে বলল।

সূবর্ণার মাধ্যমে জানা গেল তৃষার বিয়ের বিষয়টা আগায়নি৷ ছেলেদের বিশাল ডিমান্ড। বিয়ের ধুমধামে করতে হবে এই শুনেই নাকি তৃষার পরিবার পিছিয়ে গেছে।

” তোর মতো আমি কামাই করলে হেল্প হতো আব্বার ”

নিশি পূর্ণ চোখে তাকালো ” তুমি বিয়ে করার জন্য কামাতে? দ্যাটস দি অনলি থিং ইউ ওয়ান্ট? ”

” তুই চাও না, ওমা! বিয়ে ছাড়া কেউ থাকতে পারে? তবে ভাগ্যের শিকে সবাই ছিড়ে না” তৃষার গলায় স্পষ্ট হতাশা।

নিশির মাথা ধরে গেল। এই লুজারগুলোর সাথে মিশে মিশেই নদী কনফিডেন্সের বারোটা বাজছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা চায়ের দোকানে এলো তারা,
“উচা হিলটা খোলার পরই ওদের ভালো লাগেনি। ইশ নদীটার মতো হাইট হলে আর ঠেকতো না” তৃষার এখনো আক্ষেপ।

” নদী তুই বিয়ে করবি? সুবর্ণা মাথা নেড়ে বলল, পাত্র আছে বিয়ে করে নিলে বাসা ভাড়ার টেনশন নাই জব ছাড়ারও টেনশন নাই পড়ার খরচ তো পেয়েই যাবি ”

“বিয়ের জন্য তো তোমরা হর্নি হইসো ওকে টানছ কেন? নিজেরাই করে ফেল ” নিশির গলায় বিরক্তি।

” আরে আমার মামা হয়, বয়সটা বেশি তবে খুব যত্ন করবে,নদীর তো ফ্যামিলি নাই, এমনে ভালো পাত্র মিলবে? একটু তো কম্প্রমাইজ করতেই হবে ” সুর্বণার কথা শুনে নিশির ইচ্ছা করলো দুটো চড় দিয়ে মেয়েটাকে কম্প্রমাইজ করা শিখিয়ে দেয়।নিশির মেজাজ নদী ইশারায় নিবৃত্ত করলো। তার অস্বস্তির কারণ কাছাকাছি টেবিলে বসা দুজনের আলোচনা,না চাইতেও সুঁচের মতো কানে ফুটছে কথাগুলো,

-রেডলাইট এরিয়া বইলা আজকাল কিছু নাই বুঝছস,সব উঠে যাইব

-কেমনে?

– শালা ফ্রী ওয়াইফাই এসে যেমন সাইবার ক্যাফের মার্কেট খারাপ করসে। আজকাল ফ্রী প্রেমের যুগ এসে প্র*সগুলার মার্কেট ডাউন দিসে। পয়সা খরচ না কইরাই সব ফ্রেস পাওয়া যায়।

-খরচ করতে হয় না কে কইলো? গিফটের বহর গুলা দেখ না? কয়েকটা শালী তো মনে হয় টয়লেট টিস্যুটাও বফের কাছ থেকে চাইয়া মোছে।

– ক্যাশ লয় না, এমনে লয়; তয় কতগুলো ছাগল লইতে পারে না , উল্টা লুইটা দিয়া আয়া পড়ে।হি হি হি..।

এই বক্তা দুজন মিমি আর জয়া। দুই ঘনিষ্ট বান্ধবী। নদী আর নিশির পাশের ঘরেই থাকে। নিশির বিষয়টা কানাঘুষা করতে বেশ পছন্দ তাদের। মজার বিষয় হলো ফ্ল্যাটের ঠিকে-ঝি এদের খাটের তল থেকে কয়েকদিন আগে কিছু পচে যাওয়া বেগুন উদ্ধার করেছিলো।এমন মাঝেমধ্যেই নাকি বের হয়। নদী বিষয়টা তখনও আঁচ করতে পারেনি। আজ ভাবলে গাগুলিয়ে ওঠে। মানুষ নিজের গায়ের ময়লা ঝেড়ে কী অদ্ভুত ভাবে অন্যের দিকে আঙুল তোলে।

এদিকে রাফিন হুমকি দিয়েছে তাকে কিছু টাকা ম্যানেজ করে দিতে নয়ত ভিডিও ভাইরাল করবে। আমেরিকাতেও মেইল করা হবে। আজ সকালেও ফোন করে নিশির সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে। নদীর নিজের ওপর চাপ লাগছে। নিশির জন্য ভয়ে দিশাহারা লাগছে। দুটা কাজ তাদের অচিরে করা দরকার এলাকা ছাড়া, আর দ্রুত কিছু টাকার ব্যবস্থা করা। এই অবস্থায় নদীর চাকরি ছাড়লে…

” বিয়েই সমাধান বুঝলি। মামার আবার কমবয়সী মেয়েরই শখ, উনার এইজ একটু বেশি আর মাথায় চুল একটু কম কিন্তু.. ”

” মাথাতেই কম, বা** তো ভালোই আছে”

বলতে বলতে নিশি গজগজ করছে ধমকে নদী থামালো,” দোস্তরা শোন আমার পছন্দ আছে”

” পছন্দ আছে কী বলিস! ” তৃষা সুবর্ণা একসাথে বলে উঠলো। ” আমাদের বলিস নাই!

” বলার মতো সুযোগ হয় নাই ”

” কে? এখন বল,তোকে মাইর লাগানো দরকার ”

সুবর্ণা তার মামার বিয়ের প্রস্তাব আগেও নিয়ে এসেছে। নদী এখন দ্রুত ভাবছে কার নামে টিকিটটা কাটা যায়, চেনাজানা পুরুষদের চেহারা ভাসছে চোখে, সালেম ভাই… আরে যাহ! ভালো মধ্যবয়স্ক বড়ভাই, নাফিজ,শয়তান লুইচ্চা, মেয়েদের মুখের দিকে কম বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশি।
তুষার?ধুর!ভদ্র ভালো বন্ধু তবে কেন যেন টানেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই চার – পাঁচ মাসে পড়া আর কাজের ফাঁকে তেমন কারো সাথে অন্তরঙ্গ আলাপও হয়নি। আসলেই তো রেস্তোরায় আগত কত কত অতিথি বেশিরভাগই অভিজাত। এক দুজন বেশ নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব…তবে সত্যি হলো গোমড়ামুখো বসের থেকে বেশি আকর্ষনীয় নদী এখনো কাউকে দেখেনি। বাঙ্গালীদের মত চোখ কালো চুল কালো, কিন্তু টকটকে ত্বক আর এত লম্বা । তবে এই লোকটাকে ভাবলে আজকাল বুক ভারী হয়ে আসে।সে চাইলে সেইদিনের ব্যপারটা থামাতে পারতো। নদীর এত অপমান হতে হতো না।

” ওই নদু এটা সামদানী না? ”

নিশির কথায় নদী চমকে সামনে চাইলো।
তবে পুত্র নয় পিতা। রাস্তার একপাশে সোহরাব সামদানী গাড়ি থামিয়ে নেমেছেম। নিশিকে চিনে হাত নাড়ালো তৃষা সুবর্ণা হা করে তাকিয়ে। নিশি দূর থেকে হাই বলেও এগোলো না। নদী হেঁটে গেল কথা বলতে।

সোহরাব সাহেব আলাদা একটু সময় চাইলেন। সেদিনের ঘটনার জন্য তিনি লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছেন। যদি নদী ঠান্ডা মাথায় কিছু কথা শোনে খুব ভালো হয়। নদী কী বলবে বুঝলো না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল না কাজে ফিরে। কর্মযুদ্ধের জন্য যথেষ্ট সক্ষমও লাগছে না। চায়ের দাম মিটিয়ে তিনজনের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।তৃষা সুবর্ণা অবাক নিজের মাঝেই করছে প্রশ্ন চালাচালি,

” কে রে?”

“যেই হোক তোমার মামার থেকে বেটার অপশন ” নিশির প্রত্যুত্তর” দেখ না, কাঁচাপাকা হলেও ওনার সুন্দর চুল আছে ”

” এ্যা? ”

” হ্যাঁ”
*******

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৪

” এই আমেরিকান সালাদটা আমাদের স্পেশালিটি স্যার, খুবই চমৎকার হবে আপনি অর্ডার করতে পারেন ”

নদী সাবলীলভাবে হাসিমুখে কাস্টমারদের ডিল করে যাচ্ছে।সম্ভবত আজ শেষবারের মতো। সোহরাব সামদানী শান্তমুখে দেখছেন। নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতি এবং স্মার্ট, তবে এই জায়গাটার মেয়েটার জন্য সঠিক নয়।শুরু থেকেই মেয়েটাকে এখানে কাজ করতে দেখতে সোহরাব সাহেবের খারাপ লাগতো। তিনি নদীর সাথে বেশ ধৈর্য্য ধরে কথা বলেছেন। যতটুকু সমবেদনা দরকার ছিল সেটা সোহরাব দিয়েছেন।

” দেখ হিউমিলেশন জিনিসটা কখনো কারো কাম্য নয়। কিন্তু এমন কোন মানুষকে তুমি দেখাতে পারবা না যেকোনো দিন লজ্জায় পড়েনি বা বিব্রত হয়নি। আমার একটা লজ্জার গল্প বলি?
এই এলাকাতেই সাত মসজিদ রোডের দিকে নব্বুই দশকে একটা মেস ছিল। ইউনিভার্সিটিতে হলে সিট হয় নাই তখন। অনেক কষ্টে মেসের ভাড়া দিয়ে থাকতাম। একবার খুব বড় বিপদে পড়লাম। টিউশনি ছুটে গেল দেশ থেকেও টাকা আসে না। তিনমাসের মেস ভাড়া বাকি। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে আসি সোজা ডাইনিংয়ে ঢুকে খেয়ে আবার বের হয়ে যাই। ফিরি মাঝরাতে। কয়েক সপ্তাহে এমন করে একদিন খাওয়ার মাঝখানে ম্যানেজার আমার ঘাড় চেপে ধরল। বলল,ভদ্র ঘরের ছেলে কাপড়-চোপড় নিয়ে এখনই বের হও, অপমান করতে চাই না ”

মুখে বলল অপমান করতে চাই না অথচ সামনে পনের বিশ জন মানুষ আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। আমি আমার কাপড় গুছিয়ে বের হলাম কিন্তু এর মধ্যেও আমার মন পড়ে রইল আধা খাওয়া ভাতের প্লেটের দিকে। মজার ব্যাপার কী জানো সেই মেসটা নেই তবে সেই ম্যানেজার কাছেই এক ফার্মাসিতে বসে। তার সামনেই অন্যতম পশ রেস্টুরেন্টের ওনারশিপ আমার।ধৈর্য ধরলে সময় খুব অদ্ভুত প্রতিশোধ নেয়।

নদী চুপ করে শুনে যাচ্ছিলো।

সোহরাব সাহেব বললেন, সেদিন রাতে তোমার বাবা আমাকে নিজ বাড়িত্র আশ্রয় দিয়েছিলো কিন্তু আজ সেই একই জায়গায় তোমাকে এইভাবে দেখা আমার জন্য খুব কষ্টের।ধরে নাও আমি যা করছি তার রিটার্ন হিসেবেই করছি। তোমার হোস্টেলের খরচ পড়ার খরচের আলাদা একটা ফান্ড করার ব্যবস্থা হচ্ছে।এখন থেকে তোমার সব চিন্তা আমার। আমি চাই না তুমি আর কোনও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ো।

নদী বুঝতে পারছে না কী বলবে। তবে একটা বিষয় বুঝলো বড়ো মামার মতো তিনি সম্ভবত কোন অবস্থাতেই চাইছেন না নদী এইখানে কাজ করুক।এর পেছনে কোন একটা বিশেষ কারণ কি আছে? নাকি শুধু তার ভালোর জন্য ?

” আজ জি এস ডাকবে তোমায়, প্লিজ কথা বলে নিও। ওর কথাই আমার কথা। আমি চাই না তোমার পড়ায় হ্যাম্পার হোক। রাবেয়াও আমারো ভালো বন্ধু। সামনের মাসে আসছে।তোমার একটা ভালো ব্যবস্থা শুনে সেও খুশি হবে। এখন ধর এটা তোমার।সিংগাপুর থেকে এনেছিলাম ”

সোহরাব একটা ছোট চৌকো বাক্স এগিয়ে দিলো৷ ” একটা প্লাটিনামের লকেট।ধরে নাও তোমার গুডলাক চার্ম। আমেরিকানরা এসবে খুব বিশ্বাস করে। ”

নদী অবাক হয়ে বাক্সটা নিলো।তিরতিরে সাদা ধাতব চেনে ছোট নকশার আকিবুকির লকেট মাঝামাঝি বসানো ছোট্ট একটা সর্ষে দানার মত সাদা পাথর, কি এটা? হীরে? তা না হোক তবে অনেক অনেকদিন পর কেউ উপহার দিলো তাকে।
হাসিমুখে নদী সাবলীল ভাবে নিজের কাজে ফিরে গেল। সোহরাব দূর থেকে রম্যের গম্ভীর মুখ দেখলেন।স্বাভাবিক ভাবেই একজন চৌকস এমপ্লয়ি সে হারাতে চাইছিলো না। তবে অবশেষে বুঝেছে এটাই ভালো।

নদী কাজে ফেরার পর সালেম ভাই সহজ আচরণ করলেও সাথের নাফিজের ঠোঁটে কেমন একটা লাম্পট্যের হাসি ঝুলে আছে। অর্ডার নেবার ফাঁকে ফাঁকে রাজিয়া আর নাফিজের টুকরো কথা ভেসে আসছে।

” জি এস স্যার বাঁচায় দিসে নাহলে লম্বুর খবর ছিলো, আংটি হয়তো নেয় নাই, কিন্তু ফ্রীজ থেকে মাঝেমাঝে এটা ওটা সরায়। আমি তো আমার ব্যাগ সামলে রাখি। ”

“কাপড় কি সব খুলসে? ”

রাজিয়ার প্রত্যুত্তরে নাফিজের আগ্রহ। অথবা চাপা আক্ষেপ সেইখানে উপস্থিত না থাকতে পারার । নদীর কান ঝা ঝা করছে। অনলাইনে শ্রেয়াকে ট্রোল করে অনেক ভিডিও হচ্ছে। যাতে নদীর কোন ছায়াও নেই তবুও স্বাভাবিক থাকাটা একটা যুদ্ধ।

” বি ইজি নদী, কর্মক্ষেত্রে ঝামেলা মাথায় নিয়েই চলতে হবে।রাজিয়া নাফিজ এখানের ঝামেলা। বিশেষ করে নাফিজ তো বিশিষ্ট লুচু সর্দার।কাজেকর্মে ভালো,কিন্তু মেয়েমানুষ দেখার সাথে সাথে তার মেশিন সক্রিয় হয়। কন্ট্রোলে থেকে সভ্য আচরণ করে শুধু। এমন মহিলা স্টাফ নাই যাকে বিরক্ত করে না। ”

জেরিন ম্যাম বিড়বিড় করে আরো বলছেন, শ্রেয়া ম্যাডাম আরেক সাইকো মহিলা । একবার তার সাথে কেউ ভিড়ে গেলে শান্তি হারাম করে দেয়। আমেরিকা থেকেই জি এস স্যারের কাছের বন্ধু । তার কুনজরে পড়েছিলে বলেই ঝামেলা হলো” তবে নদীরকাছে শ্রেয়ার টেনশন ছাড়াও আরেকটা ঝামেলা টেনশন দিচ্ছিলো । সেটা হলো তুষারের কোমল ব্যবহার।

” কী যে ভালো লাগতেসে তোমাকে দেখে” ডিউটির ফাঁকে তুষার নিচুগলা।নদী কোন উত্তর দিলো না।
-আমার ফ্রেন্ডই কিন্তু ভিডিও লিক করে দিসে।হইসে না এইবার? শ্রেয়া শালীর বারো বেজে যাচ্ছে”

নদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। জেরিনও শুনছে তুষার পুরা কাজের ক্রেডিট নিজের হস্তগত করছিল,
– ওই বেটি যখন চেঁচামেচি করছে আমি টুক করে রেকর্ড করা শুরু করলাম পুরা পাশার দান উলটো পড়ে গেল।শ্রেয়া ম্যাডাম কিন্তু কম বড় ভিআইপি না।কিন্তু আমার তোমার অপমানটা সহ্য হলো না। খুঁজে বের করতে পারতাছে না এই ভিডিও ছাড়লো কে।
তুষার হাসলো, “আমি মানুষটা ছোটখাটো কিন্তু নেটওয়ার্ক কিন্তু অনেক বড়। সোহরাব স্যারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দেই। কোন রকমের ঝামেলা হলেই বলবা। সব ভাবে প্রটেক্ট করব।

নদীর মাথার মধ্যে রাফিনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।একবার ভেবেছিল সোহরাব সাহেবকে বলবে।নিশির শরীর খারাপ সাথে অর্থনৈতিক অবস্থাও। আমেরিকা থেকে গেল মাসে খালামনি টাকা পাঠায়নি। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, তুষার কি কোন সাহায্য করতে পারে?

তুষারের নিজের মনে একটা তিতে অস্বস্তি। আসার পর বেশ অনেকক্ষণ নদী কথা বলেছে সোহরাবের সাথে।সোহরাব সাহেব খুব কড়া প্রাইভেসি মেনটেন করেন নদীর সাথে কথা বলার সময়।
মূলত তাদের সম্পর্কটা আসলে কী আন্দাজ করতে পারছে না। ধনবান মানুষের পি এস হবার দরুন তার বিচিত্র স্বভাবগুলো সম্পর্কে তুষার পরিচিত। বুড়ো তলে তলে বেশ রঙিন মেজাজের। কিছু দিন আগে জমকালো একটা শাড়ি কিনেছে তার কোন অল্পবয়সী বন্ধুকে দেবে বলে। আজব চরিত্র দুই দামড়া ছেলের বাপ। নাতি নাতনি নিয়ে খেলার বয়সে অল্পবয়সী বান্ধবীদের সাথে খেলতে মন চাইছে।

আমেরিকান সিটিজেন, বুড়ো হলেও দেখতে ভালো, তার ওপর টাকার অভাব নেই। সময় কাটাতে অধীনস্ত কাউকে আঙুরের ছড়ায় দানার মতো টুক করে গিলে ফেলা অসম্ভব নয়। তা গিলতে চাইলে গিলুক, নদীকেই কেন? সোহরাব স্যারের সাথে তার ঘাপলাটা কী তুষার ইনিয়েবিনিয়ে টুকটাক জানার চিন্তা করছিলো এরমাঝেই নদীর ডাক পরলো জি এস স্যারের।

******

” শি ইজ হট! ” নতুন এপয়েন্টেড ওয়েট্রেসের ছবি দেখে অনির কন্ঠে মুগ্ধতা,” কার্ভিস ডাস্কি বিউটি”

” অত ডাস্কি না বিট অফ অলিভ ” রম্য নিরস কন্ঠে বলল।

” তোর চোখে সমস্যা হলেও, ড্যাডের নেই প্রমাণ হলো ”

রম্য চটে গিয়েছিলো ভাইয়ের কথায়- ” দিস ইজ রি ডিক্যুলাস অনি, আমি এই বিষয়টা আসলে বুঝে উঠতে পারছি না। মানে কীভাবে?আমি জানতাম এই দেশের আঠেরো উনিশ বছরের মেয়েদের কিছু প্রিজুডিস থাকে, তারা বুঝেশুনে কোন ষাট বছরের বুড়োর সাথে জড়াবে? এটা স্টুপিডিটি না? ভাবতেও উইয়ার্ড লাগছে”

ভিডিও কলে অর্ণব নিজের ঝাকড়া চুল ঝাকিয়ে হাসছে, ভাইয়ের স্বভাবের বিপরীত মুখী চরিত্রটা মুখ দাড়িগোফের জঙ্গল। শুধু হাসিটা দেখেই বোঝা যায় সে রম্যের জমজ, দারুণভাবেই জমজ।অর্ণব বলল, “উইয়ার্ড না রমি, আসলে তোর ইগোতে লাগছে। তুই ইয়াং, গুডলুকিং রিচ। মেয়েটা জানে বাট ইউ হ্যাভ গট সাম গুড ক্যাচ অলরেডি; স্ট্যাটাস বিচারে তুই তাকে পাত্তাও দিবি না। বিং ভলনারেবল, তোর থেকে বাবাকে পটানো ওর জন্য ইজি না?ইজি এন্ড প্রফিটেবল। বুড়ো বাঁচবেই আর কতদিন? শি ইজ নট স্টুপিড রমি শি ইজ ভেরি স্মার্ট। আমাদের ড্যাডও কিন্তু স্মার্ট।নিজের মতো ডিল করতে চাইছে।এইজন্যই সরাচ্ছে ওকে, নয়তো তুই মামাস বয় হয়ে বাগড়া দিবি। মাকে বলবি। মম খবর পেয়ে উড়ে আসবে।

অর্ণবের কথায় রম্যের মাথা ঘুরছে।ব্যাপারটা যদি সত্যিই এইদিকে গড়ায় সবকিছু সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
কী করা যায়? মেয়েটার সাথে বাবার খাতির আছে সেটা লক্ষ্যণীয়, তবে অন্তরঙ্গতা কতদূর অর্ণব রম্য অনেক ভেবেও সমাধান বের কর‍তে পারেনি। মাথা ঠান্ডা রাখার যুদ্ধে যখন ধরাশায়ী দরজা ঠেলে নীরবে মেহরোজ মেয়েটা ঘরে ঢুকলো। রম্য দ্রুত গ্যাব্রিয়েলের খোলস পরে নিল।

” আস সালামু আলাইকুম স্যার”

“কেমন আছ মেহরোজ”গ্যাব্রিয়েল খুব আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করলো।

” ভালো আছি স্যার”নদী মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে মুখে কাঠিন্য।

” আমার ওপর রেগে আছ?”

নদী উত্তর দিলো না।

গ্যাব্রিয়েল প্রথম মনোযোগ দিয়ে দেখছে তাকে৷ শরীরের বানটা অনেকটাই ব্ল্যাক মডেল টায়রা ব্যাঙ্কসের মতো, ইন্ডিয়ান গাঢ় রঙ, বাঙালি টানা টানা চোখ, খাড়া চিকন নাক,পুরু ঠোঁট মুখটায় আলাদাই একটা বৈশিষ্ট দেয়; তবে চিবুকের খাঁজ আর ভিরু চাহনীর মাঝে এখনো কৈশোরটা পালায়নি। এই বাচ্চাটাকে কিনা বাবা…! যদিও রম্য তেমন দেশেই জন্মেছে যেখানে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনাই ঘটে। হাইস্কুলে থাকতে তার নিজের এক বন্ধু আরেক বন্ধুর মায়ের সাথে ডেট করা শুরু করে দিয়েছিল। তবে অন্যের জায়গায় নিজেকে রাখা বড় কঠিন। রম্য নিজেকে স্বাভাবিক করতে করতে হঠাৎ কেবিনের ফ্রিজ থেকে একটা কেক বের করে আনলো। নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,

“ডেজার্ট পছন্দ কর? এটা চকলেট চিজ কেক তবে লো ফ্যাট। আমার বানানো,
ট্রাই করো। ”

” থ্যাংকস স্যার কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না”

” তুমি আমার এখনো এম্প্লয়ি আর নতুন ডিশ ট্রাই করা ইটস পার্ট অফ ইউর জব ” গাব্রিয়েলের ঠান্ডা নির্দেশ।

নদী যন্ত্রের মতো চিজ কেক ভেঙে মুখে দিলো। মুখে মিষ্টি অল্প নোনতা স্বাদের ঘন ক্রিম চিজ, মনে মনে নদী নিজেকে শক্ত করছে।আজ কাজটা ছাড়তে হবে।কিন্তু বাড়িটার জন্য মায়া লাগছে। যদিও সোহরাব হয়ত ছেলেকে বুঝিয়ে বলেই দিয়েছেন,তাকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য। রাফিনকে চুপ করাতে টাকাটা দরকার কীভাবে কী করবে বেশি ভাবতে পারল না, রম্য এগিয়ে নদীর হাতে ফর্ক ধরার কায়দা ঠিক করতে করতে বলল,

” সিচুয়েশনে এক্সপেকটেড কিছু বিষয় না হলে মানুষ রেগে যায় ,হুইচ ইজ ভেরি নরমাল। সেই অসহায় সময় তোমার আমার সাপোর্ট আশা করাই ন্যাচারাল ছিল।বাট রেসপনসিবল মানুষকে সব বিষয়ে কায়দা মতো আগাতে হয়। যেমন যারা খাবার পরিবেশন করবে তাদের নিজেরো খাওয়ার কায়দায়টা ভালোভাবে জানতে হবে দ্যাটস দ্যা ওয়ে ইট গোজ ”

রম্য হাত দিয়ে ফর্কের পেছন অংশ নদীর হাতের তালুতে ঢেকে দিয়েছে। একটু কৌণিক ভঙ্গিতে কেক ভাঙার কায়দা শিখতে গিয়ে নদীর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তার বস তাকে বাচ্চাদের মতো হাতে ধরে শেখাচ্ছে বলছে,” ইটস ওকে, সবাই শিখতে শিখতে উন্নতি করে, আর ইমোশন মানুষের শেখার পথে বড় ক্ষতি কড়ে। ওই মুহূর্তে আমি ইমোশনাল হয়ে শ্রেয়াকে থামালে, সে আরো ঝামেলার ইস্যু পেয়ে যেতো সেটা কিন্তু হয়নি উল্টো শ্রেয়া কালারড হচ্ছে। ঠিক যেমন তুমি যদি ইমোশনাল হয়ে জবটা ছেড়ে দাও তাহলে শুধু তুমি জানবে যে তুমি রিজাইন দিয়েছ, কিন্তু মানুষ জানবে গ্যাব্রিয়েলস কিচেন তোমাকে ছাটাই করে দিয়েছে। কেন ছাটাই করেছে? আমরা কিন্তু এবিষয়ে কিছুই বলবো না, কিন্তু মানুষ জানতে চাইবে।

নদী অবাক হয়ে তাকিয়ে, রাগ করবে না মুগ্ধ হবে বুঝতে পারছে না। মুখের ভেতর চিজ কেক আচ্ছন্ন করছে। গ্যাব্রিয়েল স্যারের হাতের জাদুর ব্যাপারে শুনেছিল। আজ স্বাদ নিচ্ছে। এই মানুষটা কি সত্যিই এটা বানিয়েছে?সাধারণ কোন কেক মনে হচ্ছে না, স্বর্গীয় একটা জিনিস। হাল্কা ঠান্ডা মসৃণ রেশমের মতো কিছু মুখে মিশে যাচ্ছে৷ যেন মিষ্টি পনিরের পুডিং ওপর চকলেটের পুরু লেয়ার।মানুষটা এটা কীভাবে করেছে? কীভাবে?

জি এস স্যার যেন জাদু দেখিয়ে মিটমিট হাসছে,

” মেহরোজ তুমি তোমার কাজে খুব চমৎকার, তোমার আরো উন্নতি হতে পারে ব্যাস ইমোশনাল হবার বদভ্যাসটা দূর কর। ড্যাড মনে করছে এখানে তোমার কোনো ভবিষ্যত নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ এখানেই আটকে আছে।তুমি শুরু থেকেই খুব কমফোরটেবলী কাজ করো, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তোমার দারুন আমি সেই সুযোগ নিতে চাই। তার সাথে তোমাকেও কিছু সুযোগ দিতে চাই,
তোমার স্টুডেন্টশিপ, সোশ্যাল সিকিউরিটি সব কনভিনিয়ন্স দিয়ে একটা পারমানেন্ট জব৷ তুমি আরো শিখতে পারতে , নিজের কেয়ার করতে পারতে তবুও একটা ফেক ইনসাল্টকে পাত্তা দেবে? এটাকে self-respect বলে না বোকামী? ”

“বোকামী “নদী শান্ত গলায় বলল।

“যেটা তুমি নিশ্চয়ই করতে চাও না মেহরোজ “গ্যাব্রিয়েল শান্তচোখে তাকিয়ে আছে।

” না চাই না” নদী সম্মোহিতের মতো বলল।

জি এস স্যার হাত বাড়িয়ে দিলো,” সো ওয়েলকাম ব্যাক।

নদী বেশ হকচকিয়ে গেল। না চাইতেই করমর্দন করছে বসের।যেন নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই একটা জাদুকরী কেকের টুকরোয় তার রিমোট কন্ট্রোল চলে গেছে এই বিলিতি যুবকের কাছে। মানুষটা জাদু জানে এই জাদুটা শেখার তৃষ্ণায় নদীর মুখে কথা ফুটলো

” কিন্তু স্যার, আমি কিচেনে কাজ করতে চাই”

“কিচেন?”

” আমার মনে হয় আমি গেস্ট আপ্যায়নেরর থেকে বেশী কুকিং ভালো করব। ‘

” চিজ কেক কেমন ছিলো? ”

” চমৎকার স্যার”

” ইনগ্রেডিয়েন্টস গুলো বল তো ”

” ইনগ্রেডিয়েন্টস! নদী ভাবনায় পড়ে গেল,” সেটা তো এখন পারবো না ‘

“তাহলে তুমিও কিচেনের জন্য প্রস্তুত না। গ্যাব্রিয়েলের সাথে কাজ করতে গেলে ন্যুনতম যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
তবে যদি তুমি শিখতে চাও আমার ফ্রেমের মধ্যে থাকতে হবে।”

নদী বেশ কিছু কাগজে সিগনেচার করে যখন বের হলো তখন সোহরাব সাহেবের কাছে খবর চলে গেছে৷ তিনি স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন পুত্রের দিকে। অনিচ্ছায় অস্ফুটে চলে এলো একটাই কথা

“রম্য তুমি আগুন নিয়ে খেলছ ”

” অভ্যাসটা তোমার কাছ থেকেই পাওয়া ”
রম্যের উত্তর।

” অভ্যাস পেলেও কায়দাটা জানো না।শুধু জেনে রাখ এই বাড়িতে মেয়েটার কোন ক্ষতি হলে তোমারো অনেক কিছু ঝুঁকিতে পড়ে যাবে”

সোহরাব কঠিন গলায় বলে ঘরে চলে গেলেন। রম্য শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। মেহরোজের কন্ঠে হোয়াইট গোল্ডের লকেটটা চোখ এড়ায়নি তার। এই লকেটের ছবিই মা পাঠিয়েছিল ড্যাড তার গার্লফ্রেন্ডের জন্য কিনেছে। একটা আঠেরো বছরের মেয়ে। অর্ণব রম্যের থেকেও নয় বছরের ছোট,ভাবলেও গা গুলিয়ে আসছে। যদিও বুড়ো বয়সে ভীমরতিগ্রস্ত বাবার আবেগকে গুরুত্ব দেওয়ার কোন মানে হয় না। লক্ষ্যে ফোকাস করা আগে দরকার।রম্য দৃষ্টি স্থির করলো ক্লায়েন্ট অর্ডাররত মেহরোজের দিকে চোখাচোখি হলে অল্প হাসলো।একটু আপসোস হলো, মেয়েটা সত্যিই ছেলেমানুষ কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই।

*******
কলিংবেল বাজছে একাধারে।নতুন বাসায় নদীদের সুবিধা হলো মেইন ডোরের একটা দরজা তাদের রুমের সাথেই। বাইরে তুষার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে,হাতে একটা প্যাকেট।

” তুষার ভাই আজ ডিউটি নেই? আমি তো একটু পরে কাজে বের হচ্ছিলাম ”

” আজকে ছুটি নিসি বাবা আসছে দেশ থেকে, ডাক্তার দেখাইতে নিতে হবে। স্টার কাবাব থেকে চিকেন তান্দুর নিয়ে আসছি নিশি আপুর জন্য। উনি এখন খাইতে পারবে? ”

নিশি মাথা বের করে বলল” আপনি আমাকে খাওয়াইতে আসছেন হাউ সুইট, ওহ না কাবাব তো হাউ টেস্টি”

নদী কথা বাড়ালো না। তুষারকে চেয়ারে বসিয়ে লাগোয়া বারান্দায় কাপড় মেলতে চলে গেল। আজকে ডিউটিতে যাওয়ার আগে ভেবেছিল কিছুক্ষণ পড়তে বসবে। তুষার এসে গিয়ে সময় নষ্ট করল।

ঝড়ের গতিতে কর্মযজ্ঞের সাথে দিন পার হচ্ছে। দম ফেলবার সময় নেই। নদীর চাকরি পার্মানেন্ট হওয়ার সাথে সাথে ক্লাসের বহর নেমেছে। সামনের সপ্তাহ থেকে আইটেম। ঝড়ের গতিতে ক্লাস চলছে, সকালবেলা ক্লাস থেকে এখন আর বাড়িতে আসতে পারে না, সোজা কর্মক্ষেত্র চলে যেতে হয়। রাতে আসতে আসতে 11 টা মতো বাজে এরপর বই বের করে ঘন্টা দুয়েক পড়ার চেষ্ট করে। কিন্তু পড়া কতটা হয়, বুঝতে পারে না।

তবে সুখের কথা হলো তাদের বাসাটা জিগাতলা থেকে ধানমন্ডিতে চলে এসছে
।আশেপাশের রুমের মেয়েরা নিশিকে নিয়ে কানাঘোষা ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সাথে রাফিনের যন্ত্রণা। সপ্তাহ হলো নতুন ফ্ল্যাটে সাবলেট উঠেছে। চাকুরীজীবী নবদম্পতি বিদেশি আত্মীয়র বাসায় পাহারা দেয়ার মতো থাকেন। ফাকে পড়ে বড় ফ্ল্যাটের গেস্টরুমটা কাজে লাগানো যায়। এটাস্ট বাথরুম, একটা লাগোয়া বারান্দা একঘন্টা কিচেনের কাজ। তারা তিন মাসের এডভান্স ভাড়া চেয়েছিলো। নদী আর নিশির কাছে একমাসের ছিলো।তবুও ফ্ল্যাটটা ম্যানেজ হয়ে গেল শুধুমাত্র তুষারের জন্য। তুষার বাড়ি খুঁজতে এই দুইবোনকে দারুন সাহায্য করেছে।বাড়িবদলের সময়ও নিজেই আগ্রহ নিয়ে চলে এসেছে। সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে। নিশি তার নাম দিয়েছে নদীর লাট্টু দেওয়ানা। নদী প্রতিবাদ করেনি আবার মজাও নেয়নি। নিশির ব্যাপারে তুষার জানে তার খালাতো বোন যে স্বামীর সাথে বনিবনা না হয়ে আলাদা থাকছে। আপাত নিশির প্রতি সহমর্মিতা তার দেখার মত। যেমন এখন ঘর গোছাতে গোছাতে নিশির সাথে গল্প করার চেষ্টা করছে, নদী বারান্দা থেকে শুনছে,
“আপু তাহলে কিন্টারগার্ডেনে জব নিয়েছ। ডিউটি কবে থেকে?
“পরশু”
” এখম জব না করতে, মানে এখন স্ট্রেস নেওয়া কি ঠিক?”

” আমি মানুষটাই তো বেঠিক “নিশি হাল্কা গলায় বলল।

” কেন? ”

“আগের বাসায় আরো তিন মাস থাকতে পারতাম চলে আসলাম কেন জানো…? ”

” নিশি আমি আসি, ফ্রীজে তরকারি তোলা গরম করে খেয়ে নিস” নদী ঘরে এসে ব্যস্ত হয়ে বলল। নদী বের হচ্ছে তুষারের আর বসে থাকা চলে না। দোর পর্যন্ত যেতে যেতে নিশির ফোন এলো। চেহারা দেখেই নদী বুঝতে পারলো এটা রাফিন।

মন তিতা করে নদী বের হয়ে গেল।রাফিনকে নিশি কিভাবে সামলাচ্ছে নদীর ধারণা নেই মাঝে মাঝে হতাশায় ভাবনা চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। তুষার হাসিমুখে আসছে পাশে। তার এই বাড়তি বন্ধুত্বের পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছে, নদী ভালোই জানে। প্রতিক্রিয়াতে তেমন আবেগ হয় না তবে ঢাকা শহরের মতো জায়গায় একজন এমন খেটে খাওয়ার মতো মানুষ থাকলে বেশ হয়।
স্বার্থটা পেছনে রেখে বাড়তি কেয়ারিং দেখায়, এই যেমন এখন রাস্তায় পাশে হাঁটতে হাঁটতে নরম গলায় কথা বলছে তুষার, ” তুমিতো কিছুই খেয়ে বের হলে না , আজ আমি থাকবো না, ডিউটির মাঝখানে খাওয়ার টাইম পাবা না, আজ আবার বুফেট আছে খাবার সুযোগ সেই রাত দশটার পরে… “.

” অভ্যাস হয়ে গেছে তুষার ভাই আপনি শুধু শুধু এসব কষ্ট করেন ”

” তোমার জন্য কষ্ট করতে ভালো লাগে ” তুষার কন্ঠ গাঢ় করে বলল।

” আমার একটা সমস্যা আছে “চলতে চলতে নদী কিছুটা থেমে গেল। “একটা টেনশন যাচ্ছে”

” কেমন টেনশন বল তো ”

” আপনাকে বলব বিশ্বাস করতে পারি ? ”

” বলেই দেখ..”

নদী কিছু সময় নিয়ে বলল ” একটা বদমাশ আমাকে আর নিশিকে খুব বিরক্ত করছে ”

” বিরক্ত করছে? কেন বিরক্ত করছে? ”

” বন্ধু ছিলো একসময়। ড্রাগস নেয় বলে আমরা সরে গেছি এখন ঝামেলা করছে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আপনার কাছে তো কোন র‍্যাব অফিসারের যোগাযোগ আছে বলসিলেন.. ”

” আছে না,মানে বড় স্যারের জন্যই যাওয়া লাগতো। এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে মাঝেমধ্যে ঘাপলা হয় উনারই পরিচিত, তুমি বল তো কে সে?”

তুষারকে নদী রাফিনের আইডি দিয়ে দিলো ফোন নাম্বার দিলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছিল মাথায় আর কিছু খেলছিলো না।মনে হচ্ছিলো তুষার যা মনে করে করুক। একটা ব্যবস্থা না নিলেই নয়।নিশিকে বললে আগানো যেত না। ধারেকাছে কেউ নেই যে সাহায্য করতে পারে।

” দেখি শালার নাড়ি নক্ষিত্র খুঁজে বের করি আগে চিন্তা করবা না”

তুষার কতটা উদ্ধার করতে পারবে জানে না মনে চাপ বাধা দুশ্চিন্তা কারো সামনে মুক্ত করে হাল্কা লাগছে।
যদিও নদীর জীবন এখন এমন একটা ট্র‍্যাকে চলছে যে একটা ঝামেলা শেষ হলে মনে মনে প্রস্ততি নিতে হয় আরেকটা নতুন ঝামেলার জন্য।গ্যাব্রিয়েল কিচেনে পা দেবার সাথে সাথেই তৃষার ফোন এলো, রুটিন দিয়েছে সামনের মাসেই প্রথম সেমিস্টার, ফুড ক্যামিস্ট্রির একটা এসাইনমেন্ট জমা দেবার লাস্ট ডেট কাল, তারটা রেডি আছে তো? নদী মুখ অন্ধকার করে ইউনিফর্ম পরলো৷ এসাইনমেন্ট মানে অনেক লেখালেখি। নোট ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সময় করে তোলা হয়নি। জেরিন ম্যামকে বলে আজ কি আগে যাওয়া যায়?সারারাত জেগে বসে বসে নোটগুলো খাতায় তুলতে হবে। জেরিনকে কিছু বলার আগেই রিসিপশন থেকে ডেকে পাঠালো, “আজ সেকেন্ড ফ্লোরে বড়ো কর্পোরেট ডিনার আছে। তুমি আর রিজভি গেস্ট এটেন্ট করবে। বড় পার্টি ,এটেনডেন্সে কমিশন আছে তিন পার্সেন্ট।”

” ম্যাম আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমার আসলে কাল কলেজে একটা এসাইনমেন্ট ছিলো আজ তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার ”

জেরিনের চোখেমুখে বিরক্তি ধরে গেল “স্টুডেন্ট হলেই এই সমস্যা, গ্যাব্রিয়েল স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু ওনার সাথেও কথা বলা মুশকিল, উনি আজ কিচেনে ”
” তাহলে? ”
“কিছু করার নাই, ডিউটি পড়া দুটাই ম্যানেজ করো, চ্যালেঞ্জটা তুমি নিয়েছিলে”

নদী ডিউটির ফাঁকে নিশিকে কল দিলো।অ্যাসাইনমেন্ট তুলতে তার হেল্প লাগতো। নিশির কোন খবর নেই। দুশ্চিন্তা নিয়ে কিচেনে অর্ডার ডেলিভারি নিতে এলো, আশান্বিত ভাবেই আজকের কিচেনের পরিস্থিতি ভিন্ন দেখল। সাদা এপ্রোনে চিফ শেফের ভূমিকায় আছেন জি এস স্যার। উনুনের আগুনে জ্বলজ্বল করছে একটা সুন্দর অথচ কঠিনমুখ। একাগ্রভাবে জলন্ত আগুনের তাওয়ায় স্টেক সেকছেন , অন্য চুলায় ফ্রাই প্যানে কোন সবজি। হঠাৎ সেদিকে ঘুরে কায়দা করে একবার ছলকে নেড়ে দিলেন , সবজিগুলো কিছুক্ষণ হাওয়ায় উড়ে আবার সঠিকভাবে স্থান নিলো ফ্রাইপ্যানে। সবাই ব্যস্ততার মধ্যেও তার কাজ দেখে স্থির তাকিয়ে থাকে। নদী স্বীকার করলো এই মানুষটা রান্নাটা রীতিমত উপভোগ করেন।সৃষ্টির নেশায় চুর এক বিমগ্ন শিল্পী; চোখ সরানো দায়,তবে সরাতে হলো। গোমড়ামুখো লোকটা কাজের ফাঁকে দেখেছে তাকে। ব্যস্ততার মধ্যে ঝাড়ি না খায়৷ নদী দ্রুত সরে এলো।

” ফ্রীজার রুমে ছোট ফ্রিজে এক বোতল ম্যাঙ্গো স্কোয়াশ আছে৷”সালেম ভাইয়ের কথায় নদী অবাক, ” উপরে সাইনপেন দিয়ে তোমার নাম লেখা ।আমগুলো ফ্রেশ ছিলো,করে রাখলাম। বোনের জন্য নিয়ে যেও অসুস্থ শুনেছিলাম ”

– থ্যাংকস সালেম ভাই

– আরে থ্যাংকসের কিছু নাই ব্যাস ওই রাজিয়া ম্যাম না দেখলেই হলো। তিলকে তাল বানায় মহিলা।সন্ধ্যায় ব্যাস্ততা বাড়বে তোমায় বলে রাখলাম।”

‘ আপনিই বলেন আমাদের তো কিছু বলার সুযোগই হয় না” পেছনে নাফিজ এসে দাঁড়িয়েছে।

” যদিও কাজের মধ্যে সুযোগ নেওয়া ঠিক না।” কথাটা নাফিজ নদীকে বললেও দৃষ্টি তার ইউনিফর্মের বুকের মাঝামাঝি বোতামের খাঁজের দিকে। নদীর শরীর রিরি করে উঠলো। দ্রুত বিদায় নিতে বের হতে হতে নাফিজ তাকে আবার আটকে দিলো,বিশাল ওভেন থেকে মাফিনের ট্রে বের করতে করতে বলল” গরম জিনিসটা গরম হাতে নিয়ে যাও। মাফিনগুলো রাতের পার্টির অর্ডার ”

” আমি ফ্রিজার রুমে নিয়ে যাচ্ছি”নদী দ্রুত পাশ কাটাতে চাইলো।

” ফ্রিজার রুমটায় দোষ আছে কিন্তু..” নাফিজ পেছন থেকে বলল,” ওখানে একটা অকারেন্স ঘটেছিলো দিনের বেলায়ও ভয় ভয় লাগে। একজন তো বেহুশই হয়েছিল।আমি আসবো, একা যেতে পারবে তো?”

” সেইটা নদী বুঝবে জি এস স্যার ঝাপড় দিলে তুমি সামলাতে পারবা তো ” সালেমের কথায় হুশ এলো নাফিজের।

কথা আর না বাড়িয়ে বিশাল মাফিনের ট্রে নিয়ে নদী বেরিয়ে গেল।

আজ কিচেনে ভয়াবহ ব্যাস্ততা। কর্পোরেট বুফেট ডিনার এরেঞ্জমেন্ট। গ্যাব্রিয়েলের আশেপাশে কিচেনে সবাই দক্ষ মানুষ । নদীর সে জায়গায় প্রবেশ দুরহ। প্রবেশ করলেও নাফিজের মতো একটা ঝামেলা রয়ে যায়। এই ঝামেলাকে সাইজ করা যায় না? এলোমেলো চিন্তায় নদী ফ্রীজার রুমে গেল৷ একসময় এটা কিচেনের সাথে লাগোয়া চওড়া বারান্দা ছিলো। এখন রেলিং ভেঙে দেয়াল উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ভালোই হয়েছে অবশ্য, আগের ডিজাইন থাকলে ঘনঘন মনে পড়তো এখানেই বাবলুর নিথর দেহটা..।

স্মৃতি কাটিয়ে নদী মাফিনগুলো ফ্রিজার রুমে ফ্রিযে তোলার করার সময় কয়েক মুহূর্ত শ্বাসরূদ্ধ হয়ে গেল ।

ফ্রিজে একটা কাটা হাত! একটা প্লেটে সাজিয়ে কেটে রাখা। নদী চিৎকার দিতে দিতে সামলে নিলো, দাঁড়াও! এটা একটা কেক! রক্তগুলো টকটকে লাল জিলোটিন। কাটাহাতের রক্তের রং এত লাল হয় না। কাঁপা হাতে টেনে নিয়ে ভ্যানিলা এসেন্স এর গন্ধ পেল। রাজিয়া ম্যাম এটা সম্ভবত কাল বানিয়েছিলেন। নাফিজের আর্জিতে। কিচেনেই তাদের কথা চালাচালি হচ্ছিল। নাফিজ তার কোন বন্ধুকে ভড়কে দেবে৷ রাজিয়া বেকারি বিশেষ করে ডেজার্ট ও কেক মেকিং কোর্স করেছেন দেশের বাইরে থেকে। তার হাতের কাজ একেকটা শিল্প। এইজন্য তার অহংকারও কম নয়। কিন্তু কাটা হাত সদৃশ কেক দেখে মনে হলো মহিলার বিকারগ্রস্ততাও কম নয়৷ কাটা হাত বা মানুষের অঙ্গ সদৃশ কেক কেউ কেন খেতে চাইবে? ভাবনা আগালো না নিশি কল দিচ্ছে,

” অনেক মিস কল, ব্যাপার কী রে?”

“আমার আসতে দেরি হবে রে। তুই খাবার গরম করে খেয়ে নিস৷ আরেকটা জিনিস টেবিলের ওপর আমার নীল ফাইলটা আছে৷ ফুড ক্যামিস্ট্রির কয়েকটা নোট তুই সিরিয়াল ওয়াইজ আমার প্রেকটিকাল খাতায় তুলতে পারবি? ”

” না পারব না তোর চাকরানি না আমি বাসায় ভালো রান্নাও নাই আমি তান্দুরি সব খেয়ে ফেলসি এখন… ”
নিশি ওইপাশে বকবক করে যাচ্ছে নদী ফোন কেটে হাতের মতো কেকটা ফ্রীজে তুলল। হঠাৎ আবিষ্কার করলো টানা চারটা ফ্রিজারের পরে রুমের একটা কোণায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। ধুলামলিন পোশাক দশবারো বছরের মেয়ে৷ সেইদিন সেই শ্রেয়া ম্যামের আংটি হারানো দিনেও একই মেয়েটা পেছনের লনে ছিলো। আজ পালালো না এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে, মাঝে মাঝে আড়ে দেখছে মাফিন গুলোর দিকে।

নদী গলা না কাঁপিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল,, ” তুমি কে?”

মেয়েটা হাসলো, আঁধার কোনায় তার ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে ” আমি এই বাড়িতে থাকতাম ” নিচু ফ্যাসফ্যাসে গলা।
” এইটা আমাদের বাড়ি”

” তোমাদের বাড়ি? ”

” হ, অনেক আগে আমি আর আমার ভাই বাইচে থাকতে এই বাড়িতেই থাকতাম। কাজের লোক খুন করলো আমাদের, এখন মরে ভূত হয়েও থাকি”

মেয়েটা মাথা দুলিয়ে হাসছে গোল গোল চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। নদী কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরতে গেল। রোগা চিকন তপ্ত, হাত, মেয়েটা ভয় পেয়ে হাত ছাড়িয়ে পাশের চিকন দরজা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে পালালো৷ নদী বেশি এগোলো না।ক্লায়েন্ট ফেলে লম্বা সময় এখানে থাকা ঠিক না। নদীর ফোন বেজে যাচ্ছে,নিশি বলছে ” কীরে বললি না কোন কোন নোট উঠাতে হবে, কেটে দিলি ক্যান?

“আমার ভূতের সাথে কথা বলছিলাম এইজন্য কেটে দিয়েছি”

” কী বললি কার সাথে কথা বলছিলি ?”

” আমার ভূত! এখন এই ভূতেরবাড়ি খুঁজে বের করতে হবে” নদী শান্তগলায় বলল।
(চলবে)
#লেখক_শারমিন_আঞ্জুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here