#বকুল
#লেখনীতে: আফসানা মিমি
||৫||
আমরা বাঙালিরা বাঙালি খাবার রাঁধতে এবং খেতে ঢের পটু । আমরা বাঙালিরা ভোজনপ্রিয়। বিভিন্ন মৌসুমে মৌসুমের খাবার মিলিয়ে খেতে পছন্দ করি । যেমন এখন বৃষ্টির মৌসুম। এসময়ে গরম গরম খিচুড়ি সাথে আচার মিলিয়ে খাবারের আড্ডার আসর জমে যাবে ।
‘ ওরে পরান যায় জ্বালিয়া রে পরান যায় জ্বালিয়া রে ‘
মাথায় গামছা পেঁচিয়ে চিৎকার করে উদয় ভাইয়া গান গাচ্ছে । উনার বেসুরে কন্ঠে গান শুনে সকলে কানে হাত দিয়ে রেখেছি । কিছুক্ষণ আগে সামিন ভাইয়ার পেছনে বড় বড় পাতিল সহ লতিফ চাচা ,আরিফা ও রবিন ভাইয়া হাজির হয় । তাদের দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যাই আমি । আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সানিম ভাইয়াও পেছনে তাকায় তাদের দেখে হেসে সামনে এগিয়ে হাতে হাতে সাহায্য করতে চলে যায় । চিল্লিয়ে আমাকে বলতে ভুললেন না যে ,’ তারা আজ এখানে পিকনিক করবে । ‘
সানিম ভাইয়ার আম্মুসহ আরো শিক্ষার্থী গতকাল রাতেই ফিরে গেছেন ঢাকায় । আর রাহাত ভাই এখন পুলিশের কাস্টডিতে হাসপাতালে ভর্তি । বিনা আপুর থেকে শুনলাম এই রাহাত নাকি কলেজ ভার্সিটিতে মেয়েদের অনেক ডিস্টার্ব করত । মাঝে মাঝে গায়েও হাত দিত। বার বার সতর্ক করার পরেও মানেনি । গতকাল আমার সাথে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল তাই মেরে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সানিম ভাই । মেয়েদের প্রতি সানিম ভাইয়ার এমন সম্মান থেকে সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছি । রাফি ভাইয়ের কান্ড দেখে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলাম।
আজ আপনাদের রান্না হচ্ছে গরম গরম খিচুড়ি ,ডিম ভাজি ,চাটনি ।
রাফি ভাইয়ার পেছনে মিরা আপু দৌড়াচ্ছে । রাফি ভাইয়ার হাতে আচারের বয়াম । যার অর্ধেক অংশ খালি আর বাকি অর্ধেক অংশ রাফি ভাইয়ার পেটে । এদিকে মিরা আপু এক প্রকার চিল্লিয়ে বলছে ,
‘ ঐ রাফি , তোরে আজ হাতের কাছে পেলে আস্ত রাখব না । কেমন ছেলে রে তুই মেয়েদের মত আচার খাচ্ছিস এখনই ফেরত দে আচার ?’
সামনে থেকে রাফি ভাইয়াও সমানতালে চিল্লিয়ে বলছে , ‘ কোথায় লেখা আছে রে যে ছেলেরা আচার খেতে পারবেনা ? আমি তোকে দিবোনা । দেখি তুই কি করতে পারিস ।’
মিরা আপু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ,
‘ আরে ভাই , আচার বেশি খেতে হয় না । বেশি খেলে একেবারে ডিরেক্ট ছুটবে। এবার খাওয়া বন্ধ কর ইতিমধ্যে অর্ধেক সাবার করে ফেলছিস । ‘
এদিকে তাদের কান্ড দেখে আমরা হাসতে হাসতে বসে যাচ্ছি । সবসময় এদুজন টম এন্ড জেরির মতো লেগেই থাকে । হাসি বাদ দিয়ে তাঁদের দিকে মনোযোগ দিলাম
‘ আমার অভ্যাস আছে বেশি প্যাচাল পারবিনা যা ভাগ। আর আমার কিছু হলে তাতে তোর কি ?’
মুহুর্তেই দেখলাম মিরা আপু উনার চেহারার রং আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে গেল । কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিরা আপু বলল ,
‘ আমার কিছুই না তুই তোর মতো থাক আমি চললাম।’
অবস্থা কিছুটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে তাই উদয় ভাইয়া আবার তার বেসুরে কন্ঠে গান ধরলো ,
‘আরে স্বজন সুজন ছাইড়া এসেছি এসেছি
স্বপ্ন তোমার লইয়া দেখেছি দেখেছি ‘
এবার আর সহ্য করা যাচ্ছে না সামিন ভাই আর বিনা আপু এগিয়ে উদয় ভাইয়ার কাছে গিয়েই উরুম ধুরুম কিল। সাথে যোগ হলেন রাফি ভাই আর মিরা আপু । কিছুক্ষণ আগেও যেই মিরা আপুর চোখে কষ্ট দেখেছিলাম তা এখন আপাতত নেই । ইচ্ছেমতো উদয় ভাইয়াকে মেরে পাঁচজনই বসে পড়লো মাটিতে একেকজন আরেকজনের দিকে চেয়ে উচ্চস্বরে হাসা শুরু করলো । আর আমি ! পাঁচজন বন্ধুর এমন মিষ্টি সম্পর্ক দেখছি বসে বসে । হাসাহাসির এক পর্যায়ে রাফি ভাইয়া বলে উঠে , ‘ দোস্ত আচার তো শেষ এখন কি হবে ? ‘
‘ সমস্যা নেই । কিছুই হবে না ‘ বলে আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমার কথায় সকলে উঠে আসে ।
সানিম ভাই জিজ্ঞেস করে ,
‘ কি বলছ বকুলফুল কিছু হবেনা মানে ? তুমি জানো , এগুলো সেই রুপনগর বাজার থেকে কিনে নিয়ে এসেছি । আচার এক বয়াম ছিল যা অর্ধেক এই রাফির পেটে । এখানে পাবো কোথায় ? ‘
প্রত্যুওরে মুচকি হেসে পাহাড়ের বাম পাশে নিয়ে গেলাম তাদের । হাত দিয়ে নিচে দেখালাম
‘ ওমা একি অবস্থা পুরো গ্রামের বাজার এখানে ? ঐ পাহাড়ের মোড়েও তো একটা ছোট বাজার দেখে আসলাম ।’ বিনা আপু বলে উঠলেন
‘ হ্যাঁ এজন্যই ঐ মোড়ের নাম স্বপ্নের মোড় ধাপ -১
আদিবাসীদের সাথে সাথে জীবিকা নির্বাহের জন্য আমাদের গ্রামের মানুষদেরও এখানে দোকানপাট আছে তাই ঐ ছোট পাহাড়ের চূড়ার বাজারের মোড়কে স্বপ্নের মোড় বলে এখানে সব পাওয়া যায় সব রকমের খাবারের সাথে সাথে আদিবাসীদের হাতে বানানো কাঁঠ-বাশের সামগ্রী মাটির জিনিস আর মেয়েদের অলংকার পাওয়া যায় । যেহেতু প্রথম মোড় দিয়ে তাদের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে আসে তাই সেটার নাম স্বপ্নের মোড় ধাপ-১ । ‘
সামনে তাকিয়ে দেখি সবাই হা করে আমার পানে তাকিয়ে আছে কিছুটা ইতস্ততবোধ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কি হয়েছে ? আমি কি বেশি কিছু বলে ফেললাম ?’
একসাথে হাত তালি দিতে শুরু করলো সবাই। শুরুতেই সামিন ভাইয়া বললো ,
‘ মাশাআল্লাহ বকুলফুল , তুমি তো দেখি বেশকিছু জানো এখানকার সম্পর্কে ।’
সানিম ভাইয়ার পিঠে চাপড় দিয়ে উদয় ভাইয়া বলে উঠলেন ,
‘ আরে ভাই বকুলের জন্মই তো এখানে । এখানের সম্পর্কে জানবে না তো ঢাকার সম্পর্কে জানবে ?’
‘আচ্ছা বকুল ঢাকায় গিয়েছ কখনো ?’
মিরা আপুর কথায় মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি এমন এক অভাগি যার কপালে এই রুপনগর ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই । ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ালাম যার অর্থ যাইনি ।
ঝট করে সানিম ভাইয়া বলে ,
‘ আরে আর বেশি দূর না অতি শীঘ্রই ঢাকায় যাবে বকুলফুল আমার সাথে তাই না বকুলফুল ?’
‘ কিইইই
একসাথে সকলের চিল্লিনোতে কান শেষ হয়ে গেল আমার । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি সকলের পানে । এদিকে মিরা বিনা আপু সানিম ভাইয়াকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গেলেন । একে অপরের আদান প্রদান কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা । কিছুক্ষণ পর দেখি সানিম ভাইয়া মুচকি হেসে কোকড়ানো চুলে মাথা চুলকিয়ে আমার দিকে তাকালেন ।
রবিন ভাই রান্না করছেন খিচুড়ি । ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে । যেহেতু আমরা পাহাড়ের চূড়ায় আছি তাই আশেপাশের প্রকৃতি খুব ভালোভাবেই উপভোগ করা যাচ্ছে ।
‘বাচ্চারা খাবার তৈরি । যার যার জায়গায় বসে পড়ো।’
এক হাতে চামচ আর অন্য হাতে বাটি নিয়ে টুংটুং আওয়াজ করে ডেকে যাচ্ছে রবিনভাই সকলকে । পরিহিত বস্ত্রের উপর কোমড়ে গামছা বেঁধে হকারের মতো ডেকে যাচ্ছেন অমাদের ।
চারটি বাঁশ চারকোনায় দাড় করানো আর তার সাথে একটি ত্রিপল কাগজ ছাঁদ হিসেবে ছেঁয়ে আছে মাথার উপর । নিচে পাটি বিছিয়ে রবিন ভাই সকলকে বসালেন এমনকি আমাকেও আজ কোন কাজ করতে দিচ্ছেন না । অগত্য বসে আছি সকলের সাথে । আরিফা এসে সবার সামনে কলাপাতা বিছিয়ে দিয়ে দিলো । আমি গ্রামের মেয়ে তাই ব্যপারটা সাধারণ আমার কাছে । পাশে ফিরে দেখি তারা একে অপরের পানে তাকাচ্ছেন ।
‘ এই যে শহরের ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মতো আজ তোমাদের জন্য সাধারণ কিছুর আয়োজন করেছি । ‘
রবিন ভাইয়ের কথায় রাফি ভাই বলে উঠলো,
‘ রবিনভাই গরুর খাবারের মতো একি দিলেন আমাদের ‘
উদয় ভাই মাথায় একটা চাটি মেরে রাফি ভাইকে বলে,
‘ তুই যেমন গাধা তোর চিন্তা ভাবনাও গাধার মতো । ছোট বেলায় পড়াশোনা কি কিছু করেছিলি ? বইয়ে পড়িসনি কলাপাতায় যে খাওয়া যায় সেটার কথা ?’
রাফি ভাই দাঁতে জিহ্বা কেঁটে এক হাতে কন ধরে কিউট করে একটা সরি বলে দিল রবিন ভাইকে ।
রবিনভাই সমস্যা নেই বলে খাবার পরিবেশন শুরু করলেন ,
কলাপাতায় গরম গরম খিচুড়ি তার একপাশে ডিম ভাজি আরেকপাশে চাটনি । খুবই তৃপ্তির সহকারে খেলাম সবাই । এমন ঠান্ডা পরিবেশের সাথে খাবারটা মজার হয়েছে । উদয় ভাইয়া তো রবিনভাইকে বাহবা দিচ্ছি বার বার । বিকেলে চলে যাবো সবাই । মিরা বিনা আপু বায়না ধরলো স্বপ্নের মোড়ের ঐ বাজারে যাবে । যেই ভাবা সেই কাজ । পাহাড়ের এঁকেবেঁকে যাওয়া ঢালু পথে নেমে বাজারে যাচ্ছি । বজারের কাছাকাছি যেতেই সানিম ভাইয়া হাত ধরে টেনে অন্য প্রান্তে নিয়ে গেলেন ফলস্বরূপ নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে আমি উনার বুকে । ভয় পেয়ে সানিম ভাইয়ার টি শার্ট খামচে ধরে আছি । অনুভব করছি আমার সাথে সাথে সানিম ভাইয়ার হৃদপিন্ডের আওয়াজ । মুখ তুলে উনার পানে তাকালাম সানিম ভাইয়ার মতো সুদর্শন পুরুষের সামনে আমি একদম বেটে। উনার বুকের সাথে মিশে আছি ঠিক তখনই পাশের একজন বলে উঠলো ….
চলবে …..