বকুল, পর্ব:১২

0
2222

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||১২||

সময় আর স্রোত যেমন কারোর জন্য অপেক্ষা করেনা ঠিক তেমনই প্রিয়জনের সান্নিধ্যে থাকলে সময়ের হিসেব করা যায় না । আমার পেছনে থাকা সুদর্শন পুরুষটির দুষ্টু-মিষ্টি কথার মোহে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা । কলিং বেলের আওয়াজে দুইজনেরই ধ্যান আসে । ইতস্ততঃ হয়ে দুজন দুজনের নিকট হতে দূরে চলে আসি । মা উপরে বিশ্রাম করছেন , বাসায় নায়ক চাচা নেই বিধায় সদর দরজা খুলতে আমিই চলে গেলাম ।

এক এক করে চারজন ভদ্র সমাজের মানুষ ঘরে প্রবেশ করছেন । ভদ্র সমাজের মানুষ বলার কারন একটাই আর সেটা হলো প্রবেশকৃত মানুষদের হাতের জিনিসপত্রগুলো দেখে । উদয় আর রাফি ভাইয়াদের একজনের হাতে থালা-বাসন ধোঁয়ার ভিমবার তো অন্যজনের হাতে ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু , পেছনে মিরা বিনা আপুর একজনের হাতে বড় এক আয়না আর অপরজনের হাতে কাজল এদের পেছনে নায়ক চাচার হাতেও এসব টুকটাক সামগ্রী। এসব দেখে মাথা ঘোড়াচ্ছে আমার ।

‘ একি অবস্থা তোদের ? আমার বাড়িতে আসবি ভালো কথা এজন্য কি হান্ডি পাতিল আনতে হবে ?’
সানিম ভাই হাসতে হাসতে চারজনের উদ্দেশ্যে বললেন

‘ তোকে কে বলেছে এগুলো আমাদের ।’ উদয় ভাইয়া দাঁত বের করে দুষ্টু হেসে বললেন

উদয় ভাইয়ার এহেন কথায় আমি বলে উঠলাম , ‘ তো কার জন্য এসব কিছু ?’

সমস্ত জিনিস ঠুস করে ফ্লোরে ফেলে সবাই একসাথে বলে উঠলো , ‘ নতুন দম্পতিদের জন্য ।’

হা হয়ে তাকিয়ে আছি সবার পানে , এদের কথা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে । অবশ্য এসবকাজ এচারজনের দ্বারাই সম্ভব । সানিম ইয়াসারের বন্ধু বলে কথা !

‘বকুল আর সানিম ঝটপট এদিকে চলে আয়তো । ‘ আমাকে আর সানিম ভাইকে টেনে সোফায় পাশাপাশি বসিয়ে দিলেন সবাই । শুরু হয়ে গেল তাঁদের দুষ্টুমি । নানান কথায় তারা আমাকে লজ্জায় ফেলছে আর সানিম বদ লোকটা তা দেখে বেশ ইনজয় করছে । মিরা বিনা আপু মেয়েদের সাজার কিছু সামগ্রী নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে বলতে শুরু করলেন ,
‘ এই নাও বকুল এগুলো তোমার । সারাদিন এগুলো দিয়ে সাজবে আর আমাদের কথা মনে করবে ।’ আজ আমার চমক পাওয়ার দিন মনে হচ্ছে । একের পর এক চমক পাচ্ছি । একটু আগে স্বামী নামক ঐ সুদর্শন পুরুষের আর এখন তার বন্ধু-বান্ধবীদের থেকে । মনে মনে এসব বলে তাদের উপহার গ্রহণ করলাম ।

‘ নে ভাই সানিম এগুলো সব তোর জন্য স্পেশাল স্পেশার আসবাপত্র । আমাদের সিঙ্গেলদের মধ্যে তুই মিঙ্গেল হয়ে গেলি তাই ছোট উপহার আমাদের পক্ষ থেকে ।’ উদয় রাফি ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে কথা বলে উচ্চস্বরে হাসা শুরু করলেন এখন তাঁদের সাথে তাল মিলিয়ে নায়ক চাচা ও যোগ দিলেন । কেননা উদয় রাফি ভাইয়ার উপহারসমূহ দেখলে হাসতেই ইচ্ছে করবে । ভিমবার , হারপিক, ব্রাস , বদনা , মগ এমন আরো অনেক ছোট ছোট জিনিস উপহার হিসেবে দিয়েছে সানিম ভাইয়ার বন্ধুরা । তাদের কথা হচ্ছে আমি সারাদিন সাজার মধ্যে ডুবে থাকবো আর সানিম ইয়াসার বাড়িয সব কাজ করবেন তাই এসব সামগ্রী নিয়ে আসা ।

হাসি মজার স্থলে কেটে গেল সময় । সানিম ভাইয়া আর তার বন্ধুরা পড়াশোনায় ব্যস্ত । আমি ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নিচ্ছি । আর এতে পুরোপুরি সাহায্য করছেন আমার শ্বাশুড়ি আম্মু । কোনকিছু না বুঝলে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় আমাকে ।

সন্ধ্যায় পড়তে বসেছি। আজ শ্বশুর আব্বু বাসায়। আম্মু আজ আসবেনা আমার কাছে আমি জানি । এখন হয়তো শ্বশুর আব্বুর ফরমায়েশ পূরন করতে ব্যস্ত সে । আমার এক অভ্যাস আছে পড়া শিখা হলে তা যদি কাউকে না শোনাতে পারি তো শান্তি লাগেনা । এই সময়টায় সানিম ভাইয়ারা গ্রুপ স্টাডি করছেন বিধায় তাদের ডিস্টার্ব করা যাবেনা । আমার শ্বশুর তো আমাকে মেনেই নেননি , আবার পড়া শুনবে ? বাকি রইলো শ্বাশুড়ি আম্মু এসময়ে উনি রান্না ঘরে আছেন আর শ্বশুর উনার ঘরে তাই চুপি চুপি শ্বাশুড়ি আম্মুর কাছে চলে গেলাম ।

‘ মা জননী , ও মা জননী । কোথায় আপনি ? একটু পড়া ধরবেন আমায় ? সেই কখন শিখে বসে আছি ।’
একটু চিল্লিয়ে শ্বাশুড়ি আম্মুকে ডেকে বললাম । ঠিক তখনই সোফার রুম হতে কেউ বলে উঠলো ,

‘ এই মেয়ে , বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে তোমার? আমার স্ত্রী এখন আমার সেবা করতে ব্যস্ত । তুমি যেতে পারো ।’ শ্বশুর আব্বুর কথা শুনে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসলো মাথায় । তাই নিজে নিজেই জোরে এমনভাবেই বলা শুরু করলাম যেন শ্বশুরের কানে পৌছে ,

‘ ইশ রে এখন যদি পড়া শোনাতে না পারি তো ভুলে যাবো সব । আর ভুলে যাওয়া মানে পরীক্ষায় কিছু না পাড়া। পরীক্ষায় কিছু না পাড়া মানে ফেল করা আর ফেল করা মানে এবাড়ির মান সম্মান সব ধুলোয় মেশানো যেখানে আমার শ্বাশুড়ি এত বড় প্রফেসর সেখানে আমিই ফেল । শেষ সব শেষ হয়ে যাবে । এখন আমার ,,,,,,

‘ এই মেয়ে এদিকে আসো , কি সমস্যা তোমার ? দেখি কেমন পড়াশোনা করেছ সারাবছর ?’ শ্বশুর আব্বুর কথা শুনে লক্ষীমেয়ের মত সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন সামনে বসে থাকা শিক্ষক মানে শ্বশুর আব্বু । আর আমি , ফটাফট সবগুলো প্রশ্নের উওর দিচ্ছি ।খুব ভালো লাগছে এভাবে বাবার সাথে মজা করতে । প্রশ্ন করতে করতে বাবায চেহারা কেমন পরিবর্তন হতে শুরু করলো । শ্বাশুড়ি মায়ের থেকে শুনেছি বাবার নাকি শ্বাসকষ্ট আছে তাই দেরি না করে দৌড়ে উপরে খলে গেলাম । আমার দৌড়নো দেখে মা চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করছেন ‘ কি হয়েছে ‘ কিন্তু তার উওর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
দ্রুত দৌড়ে ইনহেলার নিয়ে আসলাম বাবার জন্য মুখে ঢুকিয়ে দুই তিনবার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেন বাবা । মা ও কাজ ফেলে এখানে চলে আসলেন তাকিয়ে দেখি উনি কৃতজ্ঞতা চাহনিতে তাকিয়ে আছেন আমার পানে । আমিও চোখ বন্ধ করে আশ্বাস দিলাম যে , আমি থাকতে বাবার কিছু হতে দেবোনা ।
‘ বাবা একটু পানি দেবো ?’ বাবার পাশে বসে বিনয়ীভাবে জিজ্ঞেস করলাম । প্রত্যুত্তরে বাবা ছলছল চোখে আমার পানে তাকিয়ে বলা শুরু করলেন ,

‘ মা রে , আমাকে ক্ষমা করে দিস এতদিন তোর সাথে খারাপ আচরণ করার জন্য । আসলে ছোট থেকেই সানিমের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলাম । তাই হুট করে ওর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারিনি । চেয়েছিলাম সানিমের জন্য এবাড়িতে বউ নিয়ে আসতে এখন দেখি ছেলে আমার এবাড়ির মেয়েকে নিয়ে এসেছে । আমি খুব খুশি মা তোকে পেয়ে খুব খুশি । ‘

‘ একি বলছেন বাবা আমি আপনার মেয়ের মত । আপনি তদি আমার কাছে ক্ষমা চান তো আমি কান্না করে দেবো ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ ‘

‘আরে আরে বাচ্চা মেয়েটা করে কি , এই সানিমের আম্মু নাস্তা কই আমাদের । দাঁড়িয়ে আছো কেন ? আমাদের মা বাপের পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে তার খবর আছে তোমার?’

বাবার কথা শুনে দৌড়ে মা চলে গেলেন নাস্তা আনতে । ততক্ষণে সানিম ভাইয়া ও তার বন্ধুরা ও চলে এসেছেন এখানে। এতদিন সবাই একসাথে হাসি মজা করে নাস্তা করতাম কিন্তু বাবা থাকতো দূরে বসে তাও মুখ ফুলিয়ে । আজ বাবার পাশে বসা দেখে সানিম ভাইয়া যেমন চমকে উঠলেন সাথে সাথে খুশিও হলেন ।

রাত দশটা বাজে । আজ বাবার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছি । পালিত বাবার কথা খুব মনে পড়ছে না জানি আমার অবর্তমানে কি করছে বাবা । সানিম ভাইয়া বলেছেন বাবার উন্নত মানের চিকিৎসা হচ্ছে । তার জন্য একজন সেবীকাও নিয়োজিত করেছেন । আকীবা মা কি এখনও আগের মত আছে নাকি আমার অবর্তমানে ঠিক হয়ে গেছে । আর নাঈম ভাইয়ার খবরও জানি না । শুনেছি বড়লোক মেয়ের প্রেমে পড়েছে তাই বাবা মাকে ভুলে ঐ মেয়ের পেছনেই ঘুড়ছে । কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরলাম । আমার সুদর্শন পুরুষটি হাসি উজ্জল চেসারায় আমার পানে তাকিয়ে আছেন । আচমকা খুব জোরে জরিয়ে ধরলেন আমায় । অনবরত মাথায় চুমু দিয়ে বড় নিশ্বাস ফেললেন । প্রায় অনেকক্ষণ জরিয়ে রাখার পর ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন ,

‘ বকুলফুল , নিচে বাবা মা আমাদের নিয়ে কথা বলছেন । আমার পরীক্ষার পর আমাদের বিয়ের রিসেপশনের আলোচনা করছিন । অবশেষে তোমাকে আমি পাবো । তুমি শুধু আমার হবে । ‘

সানিম ভাইয়ার মুখে হাসি দেখে আলাদা প্রশান্তি লাগে । কিন্তু আমার স্বপ্নের কি হবে ! নিয়মানুসারে আমি তার স্ত্রী আমার উপর তার সব রকমের অধিকার আছে । কিন্তু আমার পড়াশোনা ? আজ সব কিছু পরিষ্কার করা উচিত তাই সানিম ভাইয়াকে বললাম , আজ আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন ?’
আমার কথা শুনে সানিম ভাইয়া কি মনে করলেন জানিনা । রসগোল্লার মত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন আমার পানে ।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here