#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|আঠারো তম পর্ব|
একটা সময় আসে, যখন আমরা ভালো খারাপের দিক বিবেচনা করতে পারি না। দিক বেদিক উপলব্ধি করতে পারি না। চোখে যাই দেখি তাই চাকচিক্য মনে হয়। আমরা ভুলে যাই চকচক করলেই সোনা হয় না।
কাজী অফিসে কাঠের কেদারায় বসে আছি। ভয়ে,দ্বিধায় বুকে স্কুল ব্যাগ চেপে রেখেছি।
পরিবারের সহস্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যাবির ভাইয়ার হাত ধরেছি। আমি জানি এই পথ ভুল কিন্তু অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমি সুখী হতে পারব না। আমার জন্মদাত্রী মা নিজের রাগ,জেদের মধ্যেই অটল। উনি নিজের কার্য হাসিলের জন্য অনেক নিচে নামতে পারেন। বর্তমানে আমি একা বসে আছি। কাজী সাহেব আড়চোখে কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছেন আবার আগত মানুষদের সাথে কথা বলছেন। সকলের মধ্যমণি হয়ে আছি। একজন একজন করে আসছেন আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে যাচ্ছেন। জীবনের প্রথম একাকী কোনো স্থানে বসে রয়েছি। যাবির ভাইয়া আধঘণ্টার মত সময় হয়েছে বের হয়ে গেছেন। বিয়ের জন্য কিছু কাগজপত্র তৈরি করতে হবে সেই সুবাদে। আমার হাতে আমাকে দেওয়া ফোন এবং কিছু শুকনো রুটি কলা কিনে দিয়ে গেছেন। আমরা গাজীপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছি টঙ্গীর একটা কাজী অফিসে বিয়ে করব বলে।
আরো দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। যাবির ভাইয়া আসার কোনো খবর নেই। ইতিমধ্যে কাজী সাহেবও দুপুরের খাবার খেতে চলে যাবেন বলে তাড়া দিচ্ছেন। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মনে শুধু খারাপ ভাবনা আসছে। যাবির ভাইয়া কী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? আমি একা একজন মেয়ে এই ঢাকা শহরে কোথায় ঘুরে বেড়াবো। হঠাৎ মনে হল আমার হাতে না ফোন আছে। যাবির ভাইয়াকে একটা ফোন করি। নাম্বার ডায়াল করে উনাকে ফোন লাগালাম। তিন চার বার লাগাতার ফোন লাগানোর পর সপ্তমবারের মতো উনি ফোন রিসিভ করে হাপিয়ে বললেন, –” আর একটু অপেক্ষা করো জান! আমি এইতো চলে এসেছি।”
কান্না করে দিলাম। নাক টেনে জবাব দিলাম, –” তাড়াতাড়ি আসুন কাজী সাহেব চলে যাবেন।”
দেখা গেলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে উনি চলে আসেন। একা নয় সঙ্গে দুইজন লোককে নিয়ে এসেছেন। আমাকে দেখা মাত্রই অভিবাদন জানালেন। যাবির ভাইয়া খুব ব্যস্ততার সহিত কাগজপত্র দেখছেন। পরিহিত ধূসর রঙের পাঞ্জাবী ঘেমে চুবচুবে হয়ে আছে। একটু পর পর ললাটে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম পাঞ্জাবীর হাতা দ্বারা মুছে নিচ্ছেন। আগন্তুক দুইজন উনার বন্ধু। প্রায় পাঁচ মিনিট দুই বন্ধুকে বুঝিয়ে এবার আমার পাশে এসে বসলেন।
দুজনেই নীরব। আমি ভাবছি বাবা-মার কথা। সময় অনেক বাকী, জীবনের বিশেষ সিদ্ধান্তে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছি। মন বলছে, যা করছি ভুল কিন্তু বিবেক বলছে, সেখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো। কিছুক্ষণ পর হাতে উনার হাতের ছোঁয়া মিলে। উনার চোখের দিকে তাকালাম, যেখানে অসীম ভালোবাসা দেখতে পেলাম। তবে আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো, উনি কী সারাজীবন এভাবেই আমাকে ভালোবাসবেন? সঙ্গে সঙ্গে উওর পেয়ে খেলাম। আমার চোখে চোখ রেখে উনি বললেন, –” ভয় পাচ্ছো? কী ভাবছো, সময় ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিবো? কখনোই না,মায়া। আমি তোমার থেকে অনেক বড়ো। ভালো মন্দ বিবেচনা করার বয়স হয়েছে। আমি সজ্ঞানে তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। আমি চাইনা, সমাজের মানুষ তোমাকে কটূক্তি করুক। ভরসা করে দেখো। কথা দিচ্ছি, কখনো কষ্ট দিবো না।”
ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে আমি ভীষণ অসহায়। যাবির ভাইয়া চিবুকে হাত রেখে উনার দিকে ফিরালেন। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, –” শুনো মায়াবিনী, তৈরি হয়ে নাও লাল রঙে। বঁধু বেশে আলতো হেসে। কপোলে টিপ পরে,চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে।”
স্বপ্ন হলেও সত্যি। বাস্তবে, সজ্ঞানে উভয়ের মতামতে বিয়ের কার্য সম্পন্ন হলো। লাল শাড়িতে বিয়ে না হলেও লাল থ্রি পিস পরে কবুল বলে যাবির ভাইয়ার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলাম।
বিকালে পথ হাঁটছি। আমার হাত উনার হাতের বন্ধনে শক্তভাবে আবদ্ধ। অপরপাশে উনার দুই বন্ধু হামিদ এবং নাবিল ভাইয়ার সাথে আলোচনা করছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু হলাম আমি। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী তা নিয়েই আলোচনা করছেন। কথার ছলে নাবিল ভাইয়া বলেন, –” মায়া এখন অনেক ছোট। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ে। তুই যদি কোনো ভাড়া বাসায়ও থাকিস তবে পু’লি’শ কে’স হতে পারে।”
–” নাবিল ঠিক বলেছে। জোর করে তো আমাকে উকিল বাপ বানালি শা’লা। এখন যে বাপের দায়িত্ব পালন করব তারও কোনো উপায় নেই। তোদের বাড়িতে উঠালেই বাবা ঝাঁ’টা হাতে দৌঁড়ানি দিবে।”
শত চিন্তার মাঝেও হেসে দিলাম। হামিদ ভাইয়াও হাসলেন। যাবির ভাইয়ার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে উনারা চলে গেলেন। আব্দুল্লাহপুর বাস কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের এলাকায় বাস,গাড়ি সময়মত কিছু পাওয়া না গেলেও ঢাকা শহরে যানবাহনের অভাব নেই।
দুইটা টিকিট কেঁটে বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছেড়ে দিয়েছে। অচেনা শহর, পথঘাটও অচেনা। একজন মানুষকে ভরসা করে তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। কপালে হাতের ছোঁয়া পেয়ে যাবির ভাইয়ার দিকে ফিরলাম। উনি এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। হঠাৎ উনার কী হলো জানি না। আমার দুই গালেহাত দিয়ে ধরে কপোলে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। আবেশে চোখ বন্ধ করে রইলাম। তখনই কর্ণধারে উনার স্বর ভেসে আসে, –” আমার প্রতি তোমার হাজারো অভিমান জমা হয়েছে। তুলে রাখো, একদিন সব অভিমান ভেঙে দিবো।”
–” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
–” সিরাজগঞ্জ, তোমার শ্বশুর বাড়ি।”
–” সেখানে আমাকে সবাই মেনে নিবেন তার গ্যারান্টি কী?”
যাবির ভাইয়া বাসে গা এলিয়ে দিলেন। আমাকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। দিন শেষে এমন একটা শান্তির স্থান আমার জন্য দরকার ছিল। চোখ বন্ধ করে রইলাম। অপেক্ষা করছি প্রশ্নের উওরের। অবশেষে উনি মুখ খুললেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, –” এক জায়গায় তো মাথা ঠেকাতেই হবে,মায়াবিনী। তোমার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছি তাই বলে তোমার ভবিষ্যত দেখব না তেমন মানুষ নই। তোমার ভবিষ্যত এখনো পড়ে আছে। এজন্য আমার শক্ত খুঁটি প্রয়োজন,যা আমি সিরাজগঞ্জে আমার পরিবারের কাছে পাবো।”
——–
সারাদিনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছি। বড়ো মা জ্বর পট্টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কাছে আসছেন না। বড়ো মার মুখ শুকনো, থমথমে যেন কত বেলা মুখে আহার উঠেনি। আমি হাতের ইশারায় বড়ো মাকে কাছে ডাকছি। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। উফ সে কী যন্ত্রণা! কিছুক্ষণ পর দেখি মা রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনিও দরজার সামনে। কাছে আসছেন না। মালা,মেহেদীর মুখ চেপে ধরে রেখেছেন। আমি চিৎকার করে বলছি, –” মা ওদের ছেড়ে দাও, মরে যাবে তো।”
মা উন্মাদের মত হেসে বলছেন, –” তোকে এত আদর দিয়ে কী লাভ হলো। সেই তো আমাদের মুখে চুনকালি মেখে চলে গেলি। আজ এদের মে’রে ফেলবো। নয়তো বড়ো হয়ে এরাও তোর মত কাজ করবে।”
আমি দুর্বল স্বরে মা বলে চিৎকার করে বলছি, –” আমাকে ক্ষমা করে দাও,মা। আমার দোষের কারণে আমার দুই ভাই বোনকে শাস্তি দিও না।”
মা আমার কথা শুনলেন না। মালা,মেহেদীকে টেনে নিয়ে গেলেন অন্ধকারে। এদিকে আমার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। পানি পানি বলে চিৎকার করে যাচ্ছি কিন্তু কেউ পানি দিচ্ছে না।
কপালে পানির ছোঁয়া পেয়ে সজাগ হয়ে গেলাম। তার মানে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নটা এত ভয়ংকর কেন ছিল? আমি এমন স্বপ্ন আর দেখতে চাই না। খেয়াল করলাম কপালে আমার রুমাল দিয়ে জ্বর পট্টি দেওয়া। বাস থেমে আছে। কোথায় থেমেছে জানা নেই। আশেপাশে তাকালাম। বাসের অনেকেই ঘুমিয়ে আছে, আবার অনেকেই সজাগ। আমার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে। যাবির ভাইয়া নেই। ভয় পেয়ে গেলাম। মনে খারাপ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, উনি কী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? কে জানে, সিট থেকে উঠা চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। প্রচন্ড মাথা ব্যথা এবং জ্বরের কারণে দুর্বল হয়ে বাসের সিটে আবারো বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ অবস্থায় উনার স্বর কর্ণধারে পৌঁছে, –” উঠে পড়েছো? সারাদিন তো কিছু খাওনি। আমিও চিন্তায় কিছুই খাইনি। বিশ্বাস করো, আমার মনেই ছিল না যে আমাদের দুজনেরই পেটে কিছু পড়েনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমাদের পৌঁছাতে আরো তিন-চার ঘন্টা লাগবে। চলো কিছু খেয়ে নিই।”
সত্যিই ক্ষুধা পেয়েছে। যাবির ভাইয়া খাবার এনেছেন। বক্স খুলে দেখি, সাদা ভাত আর ডিম ভুনা। কিন্তু এগুলো খেতে ইচ্ছে করছে না। জ্বরের মুখে এসব খেলে বমি করে দিবো। উনি হয়তো বুঝতে পারলেন, আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, –” খেতে পারবে না তাই ভাবছো, তাই না! আমি খাইয়ে দেই। স্পেশাল ভাবে খাইয়ে দিব। বমি আসবে না।”
এতদিন বড়মার হাতে খেয়ে এসেছি। আজ প্রথম স্বামীর হাতে খাবো। ব্যাপারটা অন্যরকম।
বেশি লেবুর রস দিয়ে ভাত মাখিয়ে আমার মুখে তুলে দিলেন। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে ঢেকুর তুললাম। এরপর উনি নাপা হাতে ধরিয়ে দিলেন সেটাও খেয়ে নিলাম।
মাথা ভার হয়ে আসছে। বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা এলিয়ে দিলাম যাবির ভাইয়ার কাঁধে। উনিও ভাত খেয়ে নিলেন। ইতিমধ্যে বাস ছেড়েছে। জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের গন্তব্য এখন সিরাজগঞ্জ। জানি না সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে ।
ভাগ্য যদি সহায় হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। আর যদি ভাগ্য যদি খারাপ হয় তাহলে বাকি পথ আমাদের একাই চলতে হবে।
চলবে…….