ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ১৬ + ১৭

0
299

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|ষোল তম পর্ব |+| সতেরো তম পর্ব |

শখের পলাশ ফুল শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লাল জামা ছিঁড়ে দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে আছে বিছানার একপাশে। অলংকারগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট পাটকেলে তৈরি জমিনের উপরে। নিজেকে ছন্নছাড়া লাগছে, পাগল মনে হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে যাবির ভাইয়ার কথা। উনার মিথ্যা ভালোবাসার কথা। উনি চলে গিয়েছেন দূর অজানায়। সায়মার কথাই কী তাহলে সত্যি? উনার মনে কী অন্য কারো বসবাস? উনি কী পর নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে গেছেন? তাহলে কেন আমাকে স্বপ্ন দেখালেন? কেন আমাকে পথের পথ তার সাথে হাঁটতে বাধ্য করলেন? কেন অপেক্ষা করতে বলেছেন শেষ সময় পর্যন্ত?
কিশোর বয়সে ধাক্কা নাকি অনেক সহ্য করতে পারে আবার অনেকেই সহ্য করতে পারে না। যারা সহ্য করতে পারে না তারা অন্য পন্থা অবলম্বন করে, মৃত্যুকে বেছে নেয়। আর যারা সহ্য করতে পারে তারা জীবিত হয়েও মৃত হয়ে বেঁচে থাকে।
সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগে। নীল আকাশে লালা আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছি। এমন সময় বড়ো মা ঘরে প্রবেশ করেন। হাতে খাবারের পাত্র। সকালে নাস্তা করে স্কুলে গিয়েছিলাম এরপর আর দানাপানি পেটে পড়েনি। বড়মা এসে নিঃশব্দে আমার পাশে বসলেন। মায়া বলে দুই তিন বার ডাক দিলেন। কিন্তু আমি উত্তর দিলাম না। বড়মার সাথে খুব অভিমান হয়েছে। কেন করলেন আমার সাথে? উনি কি করে পারলেন এমনটা করতে? বড়ো মা সত্যিই আমায় ভালবাসেন? শুনেছি মায়েরা নাকি সন্তানের চেহারা দেখেই বুঝতে পারে সন্তানের মনের সকল কথা। বড়ো মা কী আমার মনের কথা বুঝতে পারেনি? আমি যে সেখানে বিয়ে হলে সুখী হবো না তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি? মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বড়ো মা বিছানায় পড়ে থাকা পলাশ ফুল, জামা এবং গয়না একপাশে তুলে রাখলেন। আমাকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। শান্তির স্থানে মাথা রাখতে পেয়ে কান্না গুলো আরো দলা থেকে বের হয়ে আসলো। অঝোরে কান্না করছি। বড়ো মাকে ঝাপটে ধরে কান্না করছি। আহাজারি করে বলছি, –” কেন করলে বড়ো মা? মা শব্দের আগে বড়ো যুক্ত করেছি এজন্যই কি আমি তোমার পর হয়ে গেছি? তোমাকে আপন মায়ের স্থানে স্থান দিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার মনের কথা বুঝলে না। এভাবে পর করে দিলে?”

বড়ো মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, –” কিছু কিছু সময় আমাদেরকে স্বার্থপরের মত কাজ করতে হয়। সন্তানের ভালোর কথা ভেবে স্বার্থপর সাজতে হয়। তোর ভালো চাইছি বলেই স্বার্থপরের মত কাজ করলাম। আমাকে ভুল বুঝিস না মা! দেখবি একদিন তুই ঠিকই অনেক সুখী হবি।”

বড়ো মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। চিৎকার করে বললাম, –” আমি সুখী হতে চাই না। আমার কতটুকুই বা বয়স। পড়াশোনা করব, প্রতিষ্ঠিত হবো তারপর বিয়ের কথা ভাববো। কিন্তু তার আগেই তোমরা আমাকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছো! গ্যারান্টি কি তারা আমাকে বিয়ের পর পড়াবে, চাকরি করতে দিবে?”

–” এতকিছু বুঝলে তুই দিবালোকে পর ছেলের সাথে দেখা করতি না। গোপনে ফোনে কথা বলতি না। আমি এতকিছু বুঝি না। এছাড়া সুরজাহান বলেছে, তুই যদি বিয়ের জন্য রাজি হোস তাহলে সে ভালোভাবে সংসার করবে নয়তো বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। আমি চাইনা চৌধুরী পরিবারের মানসম্মান নষ্ট হয়ে যাক তোর মায়ের কারণে। একটি সত্যি কথা বলতে, আমি এই জন্য স্বার্থবাদী হয়ে গেছি। আমি চাই বিয়েটা করে নে। চৌধুরী বাড়িতে যেন শান্তি চলে আসে এটাই চাই।”

বড়ো মা কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ইনি কী আমার সেই বড়ো মা যে নাকি সন্তানের কথা ভাবতো। স্বামী, সংসার কিছুই চাইতো না। সেই বড়ো মা নাকি সংসারের কথা ভাবছে, স্বামীর কথা ভাবছে। এমনকি সারাজীবন বড়ো ভাকে অপমান করেছে যে সতীন তার কথা ভাবছে। সত্যি, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনও পরিবর্তন হয়ে যায়। তার উদাহরণ বড়ো মা।

বড়ো মা আবার আমার কাছে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, –” নে মা ভাত খেয়ে নে।”

খাবো না বলতে যাব তখনই বাবা আমার ঘরে প্রবেশ করেন। বাবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। যেন উনি এই সম্পর্কে খুবই খুশি। কিন্তু একটা বিষয় আমার খুব কষ্ট লাগছে। বাবা একবারও আমার মতামত চাইলো না। নিজে যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। বাবা আমার কাছে এসে বললেন, –” রাগ করে না মা। তুমি এখন কিছু বুঝতে পারছ না তাই না! মেয়েরা বাবার কাছে রাজকন্যা হয়ে থাকে। বাবারা সবসময় চায় তার রাজকন্যার গায়ে কোনো আঁচড় যেন না লাগে। তার জন্যই জেনে শুনে সঠিক পাত্র নির্বাচন করেন রাজকন্যার জন্যে। আমি আমার রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসি। তার সুখে আমি সুখী।”

নিঃশব্দে কাঁদছি। বাবা ভেবেছেন উনাদের থেকে দূরে চলে যাবো বলে কাঁদছি। কথাটা আংশিক সত্যি। বাকী আংশিক সত্যিটা হচ্ছে যাবির ভাইয়া। উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে মনে স্থান দেওয়া অসম্ভব।
——–

তমসাচ্ছন্ন রাত। নিশাচর প্রাণীরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। অদূরে রাস্তার কুকুররা ঘেউঘেউ করে ডাকছে। গায়ে চাদর মুড়িয়ে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম। পিছনে ফিরে ঘুমন্ত বড়ো মার চেহারা আরো একবার দেখে নিলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। অশ্রুপাতে চোখে ঝাপসা দেখছি। অন্তরে পীড়া হচ্ছে। আমি শুধু জানি এই অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করার আমার ক্ষমতা নেই। যাকে ভরসা করেছি সেও আমার পাশে নেই আর যাদের বিশ্বাস করেছি তাদের আমার উপর ভরসা নেই। ঘরের আসবাবপত্র ছুঁয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। অন্ধকারে পথ হাঁটছি। জানিনা কোথায় যাচ্ছি। দুচোখ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই আগাচ্ছি। বারবার পিছে ফিরে দেখছি কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কিনা না, তেমন কেউ নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে থেমে যাই। কিছু রাস্তার কুকুর দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখামাত্র জিহ্বা বের করে দিয়েছে। সামনে আগানোর আর কোনো পন্থা অবশিষ্ট নেই। উলটো পথে অর্থাৎ যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথেই দৌঁড়াতে শুরু করলাম। পা আর চলছে না, অবশ হয়ে আসছে। জুতো জোড়া সে কখন দৌঁড়াতে গিয়ে খুলে গিয়েছে, পুনরায় জুতো পড়ার সময়টুকু ছিল না। এ অবস্থায় পিচ ঢালা রাস্তায় দৌঁড়াচ্ছি। আমার পিছনে রাস্তার কুকুরগুলো এখনো ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করে দৌড়ে আসছে। আমার প্রাণ ভোমরা যেন বের হয়ে আসছে। ভয় কী করব কীভাবে চলবো বুঝতে পারছি না। অন্ধকার একটা গলি দেখতে পেলাম সাথে নিজেকে কুকুরের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য একটা স্থানও পেয়ে গেলাম। সেখানেই লুকিয়ে পড়লাম
কুকুর গুলো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সামনে চলে গেলো।

চোখ বন্ধ করে হাঁপাচ্ছি। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছি। এ যাত্রায় তো বেঁচে গেলাম কিন্তু আমার শেষ পথ কোথায়? কোথায় যাব? এই অন্ধকারে ভালোভাবে দেখাও যাচ্ছে না। যাবির ভাইয়ার কাছে যাব তারও কোনো উপায় নেই। আমিতো জানি না উনি আদৌও বাড়িতে আছে কি নেই। যদিও বাসায় থেকে থাকে তাহলে গিয়ে কি বলব? ভাবি যদি আমাকে প্রশ্ন করে, তাহলে কি উত্তর দিব? বলব যে, ‘আমি পালিয়ে এসেছি। যাবির ভাইয়াকে ভালোবাসি।’ আমাকে ভাবী কি মনে করবেন? না আর ভাবতে পারছি না। অন্ধকারে গলিতেই বসে পড়লাম। হাঁটুতে মুখ গুঁজে রইলাম। এখন বাড়ি ফেরা সম্ভব না। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বড়ো মার টের পেয়ে গেছে এবং বাবাকে সব বলে দিয়েছে। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। আমি আমার জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। এই নিস্তব্ধ রাতে মাতাল, নেশাখোর লোকদের অভাব নেই। একা এত রাতে একজন মেয়েকে পেয়ে নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবে না। মাথা তুলতেই গালে আঘাত অনুভব করলাম। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটি আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে। ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম চোখ মুছে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম বড়ো মা।
বড়ো মা রাগে থরথর করে কাঁপছে। আমার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির পথে। আমি চিৎকার করে কাঁদছি বারবার বলছি, ” বাসায় যাব না। বিয়ে করব না।”
বড়ো মা শুনছে না। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তিনি থেমে গেলেন। আমার দিকে ফিরে শক্ত করে বললেন, –” এমন একটা কাজ কী করে করতে পারিস? তোর কি একটুও বুক কাঁপল না? আমাদের কথা একটুও ভাবলি না। এত বছর যে আমি তোকে শাসনে আদরে বড়ো করেছি তার মান রাখলি না। এই তোর ভালোবাসা? এই তুই তোর বড়ো মাকে ভালোবাসিস! আমার তোকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে। তুই কি চাস সারারাত বসে বসে তোকে পাহারা দেই? তাহলে তাই হবে, আজ থেকে তোকে এক মুহূর্তের জন্য চোখে হারা করব না। আমি আর তোর মায়ের কাছে অপদস্থ হতে চাই না। তুই যদি পালিয়ে যাস সর্বপ্রথম তোর মা আমার উপর আঙ্গুল তুলবে। আজকে যা করেছিস তো করেছিস। আর কোনদিন করতে যাবি না। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”

বড়ো মার থেকে হাত ছড়িয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” আমি বাড়ি যাব না। তোমরা জোর করে আমাকে বিয়ে দিচ্ছো। আমি বারবার বলেছি আমি যাবির ভাইয়াকে ভালোবাসি। উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা অসম্ভব।”

–” তুই এখন কি করতে চাস? ঐ ছেলের কাছে যেতে চাস? কি আছে ঐ ছেলের মাঝে? না আছে চাকরি না আছে ঘর। বাস্তবতা খুবই কঠিন। আমি সুস্থ থাকতে চাইব না তুই যাবিরের কাছে যা। কারণ আমি তোর মা। সর্বপ্রথম আমি তোর ভালো চাইবো।”

কান্না থামিয়ে দিলাম চোখ মুছে বড়ো মাকে শান্ত গলায় বললাম, –” এতটাও ভালো করোএ যেয়ো না, মা। কখন না সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে মেয়েকেই হারিয়ে ফেলো।”

বড়ো মা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বাড়িতে এসে গায়ের উপর থেকে পাতলা চাদর সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আর কাঁদবো না, আর পথ চলবো না। এভাবেই থাকব। যেভাবে চলছে সেভাবে চলুক। যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে অবশ্যই উনার সাথে আমার দেখা হবে।
—————-

সকাল সকাল স্কুল এসেছি। একা আসিনি, বড়ো মা সাথে এসেছেন। মা অনেকবার নাস্তা করে আসতে বলেছেন কিন্তু আমার গলা দিয়ে নাস্তা নামেনি। ক্লাস রুমে বসে আছি। অন্যদিনে মাঠে বসে কিছুক্ষণ খোশগল্প করি। আজ আর ইচ্ছে হচ্ছে না। ক্লাসরুমে বসে ব্যাগ থেকে যাবির ভাইয়ার দেওয়া আংটিটা বের করলাম। এনগেজমেন্টের আংটিটা খুলে আগের আংটিটা পরে নিলাম। এই আংটি টাই আমার জীবনের পরম শত্রু। যখন থেকে এই আংটিটা আমার হাতে পরানো হয়েছে তখন থেকে আমার পৃথিবী উলটপালট হয়ে গিয়েছে। আপনজন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কিছু মুখোশধারী মানুষদের আসল চেহারা চোখের সামনে ভেসে আসছে। ইচ্ছে করছে জানালা দিয়ে ফেরে দিতে কিন্তু তার করলাম না। ব্যাগের ভিতর রেখে দিলাম। ইতিমধ্যে মাঠের এক প্রান্তে দেখতে পেলাম বড়ো মা ইংলিশ টিচারকে কি যেন বলে, চলে যাচ্ছেন। সেদিকে আর খেয়াল করলাম না। বেঞ্চের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। মনে মনে যাবির ভাইয়াকে স্মরণ করছি। হঠাৎ উনি কোথায় হারিয়ে গেলেন? আমাকে না দেখে তো উনি ঠিক থাকতে পারেন না। কিন্তু বিগত দুই মাস উনি কোথায়? কেন আসছেন না। উনি কেন আমাকে কষ্টে রেখেছেন? যেদিন আমার সামনে আসবে সেদিন খুব করে বকে দেবো এবং জিজ্ঞেস করব, কেন এত দূরত্ব আমাদের মাঝে।

আজও সায়মা দেরিতে ক্লাস রুমে এসে পৌঁছায়। আমার পাশে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, –” আর বলিস না মায়া, আমার যা ঘুম! একবার ঘুমালে দিন দুনিয়া কিছুই খেয়াল থাকে না। মা তো আমাকে টেনে টেনে উঠিয়েছে। নয়তো আজকেও ক্লাস মিস যেতো। এমনিতেই মাসে তিন দিন আসি না তার জন্য কতবার কে নালিশ করেছে স্যার, হিসেব নাই।”

সায়মা নিজ মনে বকবক করে যাচ্ছে হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই থেমে যায়। জিজ্ঞেস করে, –” কি ব্যাপার মায়া, কাঁদছিস কেন?”

আমার প্রাণের প্রিয় বান্ধবী হচ্ছে সায়মা। আমার সাথেঘটে যাওয়া গতকালের ঘটনা পুরোটাই বললাম। আমার কথা শুনে সাইমা মুখে হাত দিয়ে রইল এবং বলল, –” এত কিছু হয়ে গেছে আর আমি কিছুই জানিনা। উনি কোথায়? তোর এই সময়ে তো উনাকে খুব প্রয়োজন। যাবির ভাইয়া কী তোকে সত্যি সত্যি ভালবাসে, মায়া।”

–” আমি কিছুই জানি না সায়মা। আমি শুধু উনাকে চাই। উনার কাছে থাকতে চাই। আমার কিছুই ভালো লাগেনা।”
–” তোর বড়মা যে এভাবে পোল্টি খাবে, তা তো সপ্নেও ভাবতে পারছি না।”

–” আমার মনে হচ্ছে, উনি উনার জায়গায় ঠিক। এমনিতে উনার কম দোষ না এই সংসারে। উনি যাচ্ছেন শুধু শান্তিতে থাকতে।”

–” তুই এখনো এসব বলবি?

আমি আর সায়মাকে কিছু বললাম না। জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সময়ের সাথে সাথে সবাই পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমনটা পরিবর্তন হয়েছে যাবির ভাইয়া এবং আমার বড়ো মা। দুইজনকে আমি খুব ভালবাসতাম এখন দুজনই আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। ক্লাস শুরু হতে এখনো দশ মিনিট বাকী। আমাদির শ্রেণীকক্ষের জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। স্কুলেল পাশে বিরাট বড় কলা গাছের বাগান রয়েছে। সেখানে প্রায় সময় দেখা যায় চোরেরা কলা চুরি করতে আসে। আমরা অনেক সময় চিল্লাপালা করি অনেক সময় দেখেও চুপ করে বসে থাকি। চোখের পানিতে ঝাপসা দেখছি, কলা বাগানে কেউ এসেছে। হঠাৎ মনে হলো আগন্তুক মানুষটা যাবির ভাইয়া। চোখ মুছে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই উনি। কেননা আমার জীবদ্দশায় একমাত্র একজন মানুষকে দেখেছি যে কিনা সব কালে পাঞ্জাবী পরিহিত থাকে।
মুখে হাসির দেখা ফুটে উঠল। যাবির ভাইয়া হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে, বলছে উনার কাছে যেতে। আজ কোন কিছু চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না।ব্যাগ বুকে জড়িয়ে সায়মাকে আসছি বলে বের হয়ে গেলাম ক্লাস রুম থেকে। পিছনে আমাকে কে দেখেছে তার হুঁশ নেই। আমি প্রাণ পনে দৌঁড়াচ্ছি।
কলাবাগানে পৌঁছাতেই উনি আমাকে টেনে অপর অন্যপাশে নিয়ে গেলেন। এরপর সেখানে বসে আমার মাথা আস্তে করে উনার বুকে রাখলেন।
ফুপিয়ে কান্না করছি। উনার বুকে ইচ্ছা মত কি’ল’ঘু’ষি দিচ্ছি আর অস্পষ্ট স্বরে বলছি, –” কেন আসেননি? এতদিন কোথায় ছিলেন? আমার কথা কী একবারও মনে পড়েনি? নাকি নতুন কাউকে পেয়েছেন?”

–” তুমিহীনা পরনারী আমার চোখে বোন। তুমি আছো এ হৃদয়ে, থাকবেও আজীবন।”

অনেক সময় কান্না করার ফলে গলা ভেঙে গেছে। চোখের পানিও শুকিয়ে আসছে। যাবির ভাইয়া পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, –” তোমার বাবা সবটা জেনে গেছে বিধায় মালা মেহেদীকে পড়াতে নিষেধ করেছে। আমাকে হু’ম’কি দিছে যেন তোমার আশেপাশে না থাকি। আমাকে খুব অপমান করেছে। আমার নাকি কোনো যোগ্যতা নেই তোমাকে ভালোবাসার। তুমি নাকি আমার খানিক সময়ের মোহ মাত্র। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার থেকে দূরে থাকতে। এই দুইমাস চাকরি করেছি। টাকা জমিয়ে একদিন বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। তুমিহীনা আমি অসহায় মায়া। জানি তুমি এখন অনেক ছোট। ভালো মন্দ কিছু বুঝতে পারছ না। কিন্তু আমার যে তোমাকেই চাই, মায়া। ”

যাবির ভাইয়া চুপ করলেন। হঠাৎ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–” আজ, এই মুহূর্তে আমাকে বিয়ে করবে,মায়া?

চলবে……..

[আমাকে ব’কা দিয়ে লাভ নেই। গতকাল আমার বাচ্চা ফোন ধরতেই দেয়নি। লিখতে বসলেই কান্না শুরু করেছে নয়তো ফোন নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। আজ দুই পর্ব দিয়েছি। খুশি?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here