প্রেয়সী পর্ব ৬

0
1476

#প্রেয়সী
#পর্ব:৬
#তানিশা সুলতানা

আহামেদ শরীফ বাবা মায়ের বড় ছেল। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত টেনেটুনে পড়ালেখা করেছে। এলাকার বাজারে কাপড়ের দোকান করে। তিন ভাই আর এক বোন তারা। তার বয়স যখন ১৪ বছর তখন তার বাবা ট্রাক এক্সিডেন্টে একটা পা হারায়। সংসারের হাল ধরতে হয় শরীফকে। ছোট দুটো ভাই বোনের পড়ালেখা বাবার চিকিৎসা সব কিছুর দায়িত্ব তার।
ছোট বয়সে সংসারের হাল ধরে বেশ হিমশিম খেয়ে যায় শরীফ। বাবার প্রচুর জমিজমা ছিলো। কিন্তু সে চাষাবাদ করতে জানতো না।
শেষে বাবার সাথে পরামর্শ করে কিছু জমি বিক্রি করে এলাকার বাজারে দুটো কাপড়ের দোকান দেয়। আর বাকি জমিগুলো বছর চুক্তিতে বিক্রি করে। এভাবেই সংসার চলতে থাকে তাদের।
ছোট ভাই দুটোকে বি এ পাশ করিয়েছে। বোনটাকে ইন্টার পাস করার পরে নিজের চাচাতো ভাইয়ের সাথেই বিয়ে দিয়েছে।
অশিক্ষিত রয়ে গেছেন কেবল তিনি।
তারপর বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে এইচএসসি পরিক্ষার্থী মাহমুদাকে। বাবা মা দু’জনই বলেছিলো বউকে আর পড়ানোর দরকার নেই।
শরীফ শুনে না। বড় ছেলে মাহিম দুনিয়াতে আসার পরে বউকে অনার্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। ভালোবাসার কমতি ছিলো না তাদের সংসারে। এলাকায় শরীফের ভালো একটা নাম ডাক তৈরি হয়ে যায়।
ছোট ভাই আরিফ তার পছন্দ মতো বিয়ে করে। রাকিব বিদেশে চলে যায়। তখন মাহিমের বয়স চার বছর আর মুহিতের দুই বছর।
আরিফের বউ রোজিনা ভীষণ আদর করতো তার দুই ছেলেকে। আরিফ ঢাকায় নামকরা একটা কোম্পানিতে চাকরি পায়। বেতনও অনেক।
ততদিনে মাহমুদা অনার্স পাশ করেছে।
দুই বছর ঘুরতেই রোজিনা সু খবর দেয় সবাইকে। সে মা হতে চলেছে। বাড়িটা খুশিতে ভরে ওঠে।
বছর ঘুরতেই কোল জুড়ে আসে অধরা। বাড়ির সবার চোখের মনি সে। অধরা দুনিয়াতে আসার কয়েকদিন পরেই মাহমুদা তৃতীয় বার প্রেগন্যান্ট হয়।
অধরার নয় মাস বয়সে জন্ম হয় মিথির।
রাকিব বাড়িতে ফিরে। তাকেও বিয়ে করানো হয়।

এই সুখের সংসারে আগুন লাগে তখন যখন মাহমুদা কলেজে চাকরি পায়। রোজিনাও কেমন বদলে যেতে থাকে। পাশের বাড়ির একটা ছেলের সাথে তার মেলামেশা বেড়েছে সবাই বুঝতে পারতো কিন্তু কিছু বলতো না। এই না বলাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়।

আজকে তাদের সুখের সংসারটা ভেঙে গেছে। স্ত্রী সন্তান থাকতেও শরীফ একা। নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। আরিফ ঢাকার শহরে একা একা দুমড়ে মরছে।
বাবা মায়ের দেখা শোনার জন্য বোন আর বোনের ছেলেমেয়েদের নিজের বাড়িতে এনে রেখেছে শরীফ। ছোট ভাইয়ের বউটা একা দায়িত্ব নিতে পারে না। তার বয়স অল্প।

তার কাপড়ে ব্যবসায় আজকে শুধু তার এলাকা না আরও দশটা এলাকায় তার সুনাম ছড়িয়েছে। দুই ভাই মিলে ব্যবসায় টাকে বড় করে তোলে।

বাড়ির সামনে রিকশা থামে। অটোতে আসলে আরও আগে আসা যেতো কিন্তু মাহিম ইচ্ছে করেই রিকশা নিয়েছে। অধরার সাথে একটু বেশি সময় কাটানোর জন্য।
অধরা নিজের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রিকশা থেকে নামে।
মাহিম ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। অধরা উঁকি দেয় পাশের বাড়িতে৷ সেখানে তার মা থাকে। শুনেছে এখন রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ করে সে। যে ছেলেটার হাত ধরে পালিয়েছিলো সেই ছেলেটার বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। রিকশা চালায় সে।

অধরা উঁকি দিতেই দেখতে পায় রোজিনা কাপড় ধুচ্ছে। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। কেমন শুকিয়ে গেছে। রোদে পোরা শরীর তার৷ বয়সের ছাপও পড়েছে চেহারায়। আর ওই লোকটা। উঠোনে বসে গামলায় করে ভাত খাচ্ছে। অধরার চোখ ভিজে ওঠে।
এই জন্যই সে দাঁত কামড়ে পড়ে ছিলো কাকিমার বাড়িতে। সে মারধর করলেও এই রকম যন্ত্রণা পোয়াতে হতো না। মানসিক শান্তি ছিলো সে।

মাহিম গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পেছন ঘুরে তাকায় অধরার দিকে। অধরাকে ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলে ওঠে

“ওই দিকে কি?

অধরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। এক দৌড়ে মাহিমের কাছে চলে যায়। একটু হাসার চেষ্টা করে পা মেলাতে থাকে মাহিমের সাথে।
” যে জিনিসটা আমাদের কষ্ট দেয়। আমাদের উচিত সেই জিনিসটা ঘৃণা করা। তার সাথে সম্পর্ক শেষ। তুই কেনো উঁকি দিয়ে তাকে দেখবি? কে সে? ভেবে নে তোর মা মারা গেছে। নেক্সট টাইম যেনো এমন না দেখি।

অধরা মাথা নারিয়ে সম্মতি দেয়।

বেশ বড় বাড়ি বানিয়েছে শরীফ। দুই তালা সাদা রং করা বাড়িটা। এই এলাকায় এই একটা মাত্র বিল্ডিং করা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে উঁচু দেয়াল। বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়িটা তৈরি। চারপাশে বিভিন্ন ফুলের বাগান।
এই বাড়িটা তৈরি হয়েছে আরও চার বছর আগে। মাহমুদা ছেলে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার পরেই গড়েছে বাড়িটা। প্রাণ প্রিয় স্ত্রীর পছন্দ মতো বানিয়েছে বাড়ি। কিন্তু আফসোস তাকে দেখাতে পারলো না।

মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো শরীফ। আজকে তার ছেলে আসবে অধরাকে নিয়ে এটা তিনি জানতেন। মূলত প্লানিংটা তারই। দুই বাবা ছেলে মিলে বিশাল বড় ছক এঁকেছে।

অধরা চাচাকে দেখে মুচকি হাসে। এক দৌড়ে গিয়ে চাচার সামনে দাঁড়ায়। শরীর মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“কেমন আছে আমার বড় মা?
” ভালো চাচ্চু। তুমি?
“আমিও ভালো।

অধরা পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে। তার দাদি দাঁড়িয়ে আছে। দাদি তাকে দেখতে পারে না। মা চলে যাওয়ার পর থেকেই সে অধরাকে তাচ্ছিল্য করে। ফুপি রান্না ঘরে ছিলো। সে খুনতি হাতে বেরিয়ে আসে।
অধরা হেসে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে।

মাহিম অধরাকে দিয়েই চলে যেতে চাইছিলো৷ কিন্তু শরীফ আটকে দেয়। আজকের দিনটা এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার আবদার করে। বাবার আবদার ফেলতে পারে না মাহিম। থেকে যায়।

শীলার দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটা মুহিতের সমবয়সী। আর মেয়ে দুটো টুইন। সবে সাত বছর। তিন্নি আর তুসি। মূলত এরাই বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে। শীলার বর শরীফের সাথে দোকানে সাহায্য করে।

দাদিমা মাহিমকে ইচ্ছে মতো আদর করে। এতে অধরার মন খারাপ হয়। তাকে কেনো আদর করে না?
মনি অধরার মাথায় হাত রাখে
” কি রে মন খারাপ কেনো?

অধরা ছোটমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মানুষটার বেবি হয় না। বিয়ের এতো বছর পরেও সে নিঃসন্তান। একটা বাচ্চা দত্তক আনবে ভাবছে এখন।
“খিধে পেয়েছে।
মনি এদিক ওদিক তাকিয়ে সবার পজিশন বুঝে নেয়। আপাতত এদিকে কারোর মন নেই। সে ফিসফিস করে অধরাকে জিজ্ঞেস করে
” তোকে না কি বড় ভাবী মারধর করতো?

অধরা মাথা নিচু করে ফেলে। বড় মাকে সে ভালোবাসে। তার নামে বদনাম করতে পারবে না।
সে হাসার চেষ্টা করে বলে
“ভুল করলে ধমক দিতো। যেমনটা মিথিকে দেয়।

মনি বুঝে যায় অধরা বলবে না। তিনি এমনটাই আশা করেছিলো। অধরার মতো একটা মেয়ে কখনো কারো গীবত গাইতে পারে না।
” চল খেতে দিচ্ছি

অধরার হাত ধরে নিয়ে যায় মনি।
মাহিম ততক্ষনে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। আজকে বাবার সাথে বসে খাবে।
মাহিমের দাদা মোতালেবও এসেছে লাথি ভর দিয়ে।
সবাই মিলে বসেছে খেতে। মাহিমের পাশে অধরা। আর মুখোমুখি শরীফ। শরীফের পাশে আসিফ (শীলার ছেলে) আর মোতালেব বসেছে মাহিমের আরেক পাশে।
“গিন্নি আমার সাথে দেখা করতে গেলো না যে? বুড়ো দাদুকে ভালো লাগছে না?
অভিমানের সুরে বলে মোতালেব। অধরা মিষ্টি হেসে বলে
“ভেবেছিলাম খাওয়া দাওয়া সেরে যাবো। অনেকখান আড্ডা দিবো।

শরীফ আফসোসের সুরে বলে
” এখন যদি মুহিত থাক

তার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই মুহিত এক দৌড়ে এসে অধরার আরেক পাশে বসে পড়ে। চমকে ওঠে সবাই। মনির হাত থেকে তরকারির বাটি পড়ে যায়। মাহিম চোয়াল শক্ত করে ফেলে।

মুহিত হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
“পাপা চলে এসেছি। আই নো দ্যাট তুমি মিস করছিলে আমায়।
দাদুও মিস করছিলো। ছোট মাম্মা ফুপি দাদিমা আসিফ আর আর অধরাও মিস করছিলো আমায়।

শরীফ হেসে ফেলে। মোতালেবও হাসে। মনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা বড় হয়েছে কিন্তু বাঁদরামি কমে নি।
অধরা মাহিমের দিকে অসহায় চোখে তাকায়।
মুহিত বলে
” অধরা আমি এখানে। ভাইয়াকে আমি ভেবেছিলে তাই না।

অধরা শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে। মাহিম উঠে দাঁড়ায়

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here