প্রেম পিয়াসী পর্ব ৬

0
660

#প্রেম_পিয়াসী❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব______৬

ইলাহামকে বাসায় দিয়ে রাদ চলে গেলো অফিসে। ইলহাম দুপুরের পর থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে নিজের বরাদ্দকৃত রুমে। রাদের মা দু’বার এসেছিলেন খাবারের কথা বলতে। ইলহাম শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে যায়নি খেতে। শিরিন নামের মেয়েটাকে দিয়ে আরও দু’বার খাবার দিয়ে পাঠালেন মান্নাত বেগম। ইলহাম তখনও বলল, শরীর খারাপ।শিরিন হলো মান্নাত বেগমের হেল্পিং হ্যান্ড।

তখন ঘড়িতে ৫টা বেজে ১০মিনিট। শিরিন এসে দাঁড়াল ইলহামের রুমের সামনে। দরজায় হাত ঠেকিয়ে কতক্ষণ উঁকিঝুকি মা/র/লো তার রুমে। তবে ইলহামের দেখা মিললো না। তাই অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঢুকে পড়লো রুমে। ইলহাম ব্যালকনিতে ঝুলন্ত দোলনাটার উপর গুটিশুটি মে/রে বসে আছে। বারবার হাওয়ায় দুলছে দোলনাটা। হাওয়ার সাথে দুলছে ইলহামও। অন্যমনস্ক মনে কিছু ভাবছে সে। তাকে খুঁজতে খুঁজতে শিরিন এসে দাঁড়াল ব্যালকনির থাই ধরে।

—-“ভাবি? আফনার কি ক্ষিদা লাগেনাই?”

হঠাৎ কারোর গলা পেয়ে চমকায় ইলহাম। তার চমকে ওঠার কারন অবশ্য দুটো। প্রথম কারন, আকস্মিক শিরিনের আগমন এবং দ্বিতীয় কারন, শিরিন তাকে ভাবি বলে সম্মোধন করেছে বলে। যা শুনতেই মস্তিষ্কে ধারালো কিছু বিঁধে গেলো ইলহামের। যার দরুন টান পড়ার মতো তীক্ষ্ণ ব্যা*থা অনুভব হলো। ইলহাম নড়েচড়ে বসলো। বলল,

—-“আমায় ভাবি ডাকবেনা। আমি তোমার ভাবি নই।”

—-“তয় কি ডাকুম?”

শিরিন নিরীহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। ইলহাম গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এখানে শিরিনের কোনো দোষ নেই। কারন, এ বাড়িতে কেবল রাদের হুকুম চলে। আর রাদই তাকে বলেছে ইলহামকে ভাবি ডাকবি। তাই শিরিন তাকে ভাবি ডাকছে।

—-“আপা ডাকবে। আমি তোমার বড় বোনের মতো।”

ইলহাম রাগী রাগী স্বরে বলল। শিরিন হ্যাঁ বা না কোনোরূপ জবাব দিলো না। কয়েক মুহুর্ত কিছু ভাবলো। অতঃপর হঠাৎ বলে উঠলো,

—-“জে আচ্ছা, ভাবি।”

—-“শিরিন, তুমি আবারও ভাবি ডাকছো!”

—-“আর ডাকুম না ভাবি!”

ইলহাম পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো। শিরিন হাবাগবা চাহনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম বুঝতে পারলো শিরিনকে সে তার কথাটা বেঝাতে পারেনি। শিরিনের এহেম কাজকেই হয়তো বলে সব দিক রক্ষা করে চলা। ইলহাম আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দোলনা থেকে পা নামিয়ে বসলো। অনন্তর একবার খোলা আকাশের পানে মুখ তুলে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস নিলো।

—-“ভাবি আফনার কি মন খারাব?”

শিরিনের কথায় পাশ ফিরে তাকালো ইলহাম। মৃদু হেসে বলল,

—-“বসো এখানে।”

সামনের মোড়াটা ইশারা করে ইলহাম তাকে বসতে বলল। শিরিন খুব খুশি হলো। আগে-পরে কিছু না ভেবে দ্রুত বসে পড়লো। অতঃপর অতি আগ্রহের সাথে তাকালো ইলহামের পানে। বলল,

—-“আফনার মন খারাব কেন ভাবি? ভাইজান কি আফনারে বকঝকা করছে?”

শিরিনের কন্ঠে ভরপুর কৌতুহল। ইলহাম না সূচক মাথা নেড়ে বলল,

—-“তোমার ভাইজান বকবে? সেটা কি সম্ভব! ওমন ফেরেশতার মতো মানুষটা!”

শিরিনের মুখখানা চুপসে গেলো। মুখখানা বাঁকা করে তুচ্ছজ্ঞান ভঙ্গিতে বলল,

—-“তাইলে তো কইমু আফনে ভাইজানরে অহনো চিনবারই পারেন নাই। হ্যায় নাকি ফেরেশতা! দিনে-রাইতে মানুষ খু/ন করে ভাবি। আমি নিজ চক্ষে দেখছি।”

—-“কি বলছো? এসব সত্যি নাকি?”

ইলহাম অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠলো। শিরিন যেন আরও উৎসাহ পেলো রাদের নামে ঝাঁঝ মেটাবার। সে আরও রসিয়ে বলল,

—-“হ ভাবি! আর কি কই তাইলে? আচ্ছা ভাবি এক্ষান সত্যি কথা কইবেন?”

ইলহাম ভ্রু নাচায়। শিরিন মুহুর্তেই আবার বলে ওঠে,

—-“ভাইজান কি আফনারে তুইলা আনছে?”

ইলহাম হেসে উঠলো। শিরিনের কথার ধরন বদলেছে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো গোয়েন্দা বিভাগের সিক্রেট মেম্বার। এখানে একান্তই তার আসার মূখ্য উদ্দেশ্য রাদের ডার্ক সাইট সম্মন্ধে সমস্ত ডিটেইলস নেওয়া। ইলহাম কেশে উঠলো। গলা পরিষ্কার করে বলল,

—-“না। আমি নিজেই এসেছি।”

শিরিনের মুখটা আবারও চুপসে গেলো। পানসে গলায় বলল,

—-“তাইলে কি লভ, ভাবি?”

—-“লভ কি?”

ইলহাম ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়। শিরিন বলে,

—-“লভ চিনেন না?”

ইলহাম না সূচক মাথা নাড়ে। শিরিন কপাল চাপড়ে বলে,

—-“আরে ভালোবাসা। লভ,লভ।”

কথাটা বেশ রসানো গলায় বলে শিরিন। ইলহাম এবার না হেসে পারেনা। হাসতে হাসতে বলে,

—-“ওটা লভ নয় শিরিন,ওটা হবে লাভ। লা-ভ।”

শিরিন লজ্জা পায়। জিভ কেটে মাথায় হাত রেখে বলে,

—-“থুরি থুরি।”

ইলহাম হাসে। শিরিন আবারও জিজ্ঞেস করে,

—-“ভাবি? কন না?”

—-“কি বলবো?”

—-“আফনে কি ভাইজানরে লাভ কইরা আইছেন?”

ইলহাম নিশ্চুপ হয়ে যায়। এ কথার জবাব না দিয়ে বলে,

—-“ছাদে ওঠার সিঁড়িটা কোনদিকে জানো তুমি?”

—-“হ, জানমু না ক্যান। আহেন আমার লগে।”

ইলহাম উঠে দাঁড়ায়। শিরিন হেঁটে বেরিয়ে গেলে ইলহামও যায় তার পেছন পেছন। শিরিনকে নিয়ে প্রায় অনেকটা সময় ছাঁদেই পার করে সে। বিশাল জায়গা জুড়ে সচারাচর মেলা দুর্লভ,এক কথায় অসাধারণ ছাঁদ এ বাড়ির। ছাঁদে উঠতেই ইলহামের মন খারাপ ভাবটা কেটে গেলো। ছাঁদের চারকোনের পুরোটাই গার্ডেন দিয়ে ভর্তি। এমনকি ছাঁদে ফ্লোরে কৃত্রিম ঘাস লাগানো। যার উপর পা ফেলতেই মানুষ আপনাআপনিই হারিয়ে যাবে এক অসামান্য প্রকৃতির রাজ্যে। ঠিক তার চেয়েও বেশি কিছু অনুভব করলো ইলহাম। ঘাসের পা রাখতেই বিভ্রান্ত হলো,এটা কি সত্যিই কৃত্রিম নাকি বাস্তবিক। পুরোটা সময় সে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ালো গার্ডেন বিশিষ্ট ছাঁদে। পেয়ারা গাছ থেকে ডাঁসা দেখে পেয়ারা ছিঁড়ে খেলো। গাছের ফলমূল দেখতেই হঠাৎ সারাদিনের ক্ষিধেটা একবারে পেয়ে বসলো তার। তাই পেয়ারা,স্ট্রবেরি, পাকা আম,আঙ্গুর কোনোকিছু খেতে বাদ রাখলো না। এবার পেটও শান্তি। মনও শান্তি।

__________

মাঝরাতে বাসায় ফিরলো রাদ। ঘর্মাক্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মুঠো ফোনটা বেজে উঠলো হাত কাঁপিয়ে। রাদের আর ইচ্ছে হলো না চোখ মেলে চেয়ে দেখতে। সে না দেখেই ফোনটা কানে তুললো।

—-“বস, একটা খবর আছে। মিশা সরকার আজ রাত ৩টার ফ্লাইটে বিডি-তে আসবে। পাক্কা খবর বস। অনেক কষ্টে শা*লা*র খোঁজ বের করতে পারছি।”

ফোনের ওপাশ থেকে প্রত্যাশিত কন্ঠে অপ্রত্যাশিত কোনো খবর পেতেই রাদের ক্লান্ত শরীরে যেন র/ক্ত ছিটকে উঠলো। সে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো। উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,

—-“কি বলিস?”

—-” হ বস। পাক্কা খবর।”

রাদ ডেবিল হাসলো। মুখ উঁচিয়ে ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো সময়ের আন্দাজ করতে। ঘড়িতে এখন ২টা বেজে ১৫ মিনিট। রাদ আর এক মুহুর্তও বসলো না। ফোনের ওপাশে তার হুকুমের অপেক্ষায় থাকা লোকটাকে হুকুম করা স্বরে বলল,

—-“তো? কিসের অপেক্ষা এখনও? ওয়েলকাম হিম। গো? আর হ্যাঁ,খেয়াল রাখবি কোনো ভুল-ত্রুটি যেন না হয়। আমি আসছি।”

ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হেসে হুকুম দিলো রাদ। তাকে ওয়েলকাম করা মানেই তার জীবনের উল্টো দিন গোনা শুরু। অনেক ঘুরিয়েছে তাকে। আজ সময় তার। তো? প্র-তিশো-ধ কি মোটেও হবেনা?

রাদ উঠে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় ছাড়লো। জলপাই রঙের একটা টি-শার্টের সাথে ব্ল্যাক-হোয়াইটের কম্বিনেশনের একটা ট্রাউজার পরলো। দরকারী কাগজপত্র একটা ফাইলে তুলে ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হতেই সামনে এসে দাঁড়াল ইলহাম। রাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পরলো। রাতের মধ্যপ্রহরে ইলহামকে হঠাৎ তার ঘরে আসতে দেখে কিঞ্চিৎ হকচকালোও বটে। সব কিছু ঠিকাছে তো?

—-“সুইটহার্ট? তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন? এভরিথিং ইজ অলরাইট না?”

কোমল স্বরে শুধালো রাদ। ইলহাম মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার চোখ মুখ বেশ শুঁকনো। বোঝাই যাচ্ছে কোনো এক বিষয় নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছে সে।

ইলহামের কোনোরূপ জবাব না রাদ হাতের ফাইল এবং ফোনটা নামিয়ে রাখলো। চিন্তিত নয়নে একবার দেখলো ইলহামের আপাদমস্তক। অতঃপর আর কিছু না বলে তার হাত ধরে এনে বসালো বিছানার উপর। সে হাঁটু মুড়ে বসলো তার ঠিক সামনে। তার হাত দুটো আলতোভাবে মুঠো বন্দী করে নিয়ে পূণরায় বলতে লাগলো,

—-“এতো রাত অব্দি জেগে থাকা মোটেও ভালো কাজ নয়। ঘুমাও নি কেন?”

—-“ঘুম আসছিলো না। ভয় করছে একা একা।”

ইলহামের বাচ্চাসুলভ কন্ঠে রাদ প্রেমে পড়ে গেলো যেন। হা করে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামাল দিলো। অতঃপর বলল,

—-“মা-কে ডেকে নিতে?”

—-“আন্টির শরীর ভালো নেই। বিকেল থেকেই নিজের ঘরে ছিলেন। আর আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো, কাউকে ডেকে নিতে। আর আপনিও তো সারাদিন বাসায় ছিলেন না।”

—-“আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”

মাতাল হেসে বলে রাদ। ইলহাম ক্ষেপে ওঠে। রেগেমেগে কিছু বলতে যায়, কিন্তু তাতেও কথার তাল ঘেঁটে যায়। তাই আমতাআমতা করেই আওড়ায়,

—-“বয়েই গেছে আপনার মতো মানুষকে মিস করতে। আপনাকে মিস করিনি। প্রয়োজন ছিলো সামান্য। এ বাড়িতে আমায় কে এনেছে? আপনিই তো! তাহলে আমার প্রয়োজনে আমি কাকে খুঁজবো…”

রাদ ইলহামের কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিলো। বাধ্য প্রেমিকের ন্যায় কানে ধরলো। নিজের দোষ স্বীকার করে বলল,

—-“ঘাট হয়েছে। এরপর থেকে তোমার যেকোনো প্রয়োজনে আমাকেই পাবে সর্বপ্রথম। এই প্রমিজ করলাম। এবার বলো,কি প্রবলেম হয়েছে।”

ইলহাম শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এসব কথা রাদকে কি করে বলবে সে? শিরিনকেও তো বলতে পারতো। কিংবা নিহা আপু? অবশ্যই বলতে পারতো। কিন্তু কেন বলেনি, এর কারন সে নিজেও জানেনা। তার হঠাৎ করে সব অদ্ভুত রকমের ইচ্ছে করলো। যেসব ইচ্ছের কোনো মানেই হয়না।

—-“চুপ করে আছো কেন বাবা! আমি প্রমিজ করলাম তো। সত্যি সত্যি প্রমিজ। আর কখনও এমন হবেনা। এবার বলো?”

ইলহাম পূণরায় ঢোক গিলে। সেই প্রথম থেকেই তার দৃষ্টি মেঝেতে। লজ্জায়, ভয়ে সে মুখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছেনা। এসব কথা রাদকে কি করে বলবে, সে কথাও মাথায় আসছে না।

ইলহামের নতশির দেখে রাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। ইলহাম এমন নতজানু ধরনের মেয়ে নয়। কোনো বিশেষ কিছু না ঘটলে সে কখনো তার নিকট আসবেনা। এমনকি এমন অস্বস্তিতেও পরবেনা। রাদ কিছু একটা আন্দাজ করলো। আকস্মিক কিছু না বলে ইলহামের পেটের উপর হাত রাখলো। ইলহাম কেঁপে উঠলো রাদের আলতো স্পর্শে। মুখ উঁচিয়ে রাদের পানে তাকাতেই রাদ সর্বজ্ঞ স্বরে বলে উঠলো,

—-“পেইন হচ্ছে? ডক্টরের কাছে যাবে?”

ইলহামের নিঃশ্বাস ভারী পরলো। তার চোখের ভারী পল্লব একাধারে কাঁপতে লাগলো। পূণরায় মাথা নীচু করে ফেললো ইলহাম। রাদ আবারও বলল,

—-“চলো। আমার এক পরিচিত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডক্টর আছে। আমার স্কুল ফ্রেন্ড। নাম, মালিহা। এসব বিষয়ে পাকা জ্ঞানী। অবশ্য ওর পড়াশোনা তো এসবের উপরেই ছিলো। আই থিংক, ওর প্রেসক্রিপশন ফলো করলে তোমার সব পেইন উধাও হয়ে যাবে।”

ইলহামের প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। একই সাথে অদ্ভুত রকমের এক ভালো লাগাও কাজ করছে। মানুষটা সত্যি বড় অদ্ভুত। কিছু না বলতেও অদ্ভুত ভাবেই বুঝে যায় সবটা! এর নাম সে কি দিবে? ভালোবাসা?

#চলবে______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here