#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব_____৪
ইলহাম একটা চেয়ার টেনে বসলো। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে। প্রেজেন্টেশন নিয়ে প্রথমে একটু ভ/য় থাকলেও ক্রমশ কেটে গেছে তা। অবশ্য এই বিষয়ে রাফি স্যার তার আইডল। মানুষটা ঠিক বাবার মতো তাকে সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করে। যেকোনো কাজে সমান উৎসাহ যোগাতেও ভুলেনা। সব ধরনের মেন্টাল সাপোর্ট, হেল্প সকল ক্ষেত্রেই রাফি স্যার সবার ঊর্ধ্বে। আর সত্যি বলতে তার ন্যাচারই এমন। তিনি কেবল ইলহামের বেলাতেই নয়,প্রত্যেক স্টুডেন্টের সাথেই ভীষণ মিগধ থাকেন। পিতার মতো বটগাছের ছায়াতলে রেখে সঠিক গাইডলাইন দিয়ে যান।
ইলহাম প্রেজেন্টেশনের ফাইলটা টেবিলের রাখতে রাখতে পাশে বসে থাকা লোকটার পানে একবার দৃষ্টিপাত করলো। লোকটার মুখটা তখনও স্পষ্ট দেখতে পারছেনা সে। মাথায় চড়ানো হুডির আড়ালে ঢেকে আছে তার মুখটা। ইলহাম কৌতুহল বশত একটু ঝুঁকে তাকালো। ঠিক তখনই ঘটলো অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা। কেননা, তার পাশের চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, স্বয়ং মিহাদ আবরিশাম রাদ। ইলহামের হেঁচকি উঠে গেলো মুহুর্তেই। রাদ মাথার হুডিটা সরিয়ে বাঁকা হেসে তাকালো ইলহামের পানে। ইলহাম হেঁচকি তুলতে তুলতে দাঁড়িয়ে গেলো। রাদ পূর্বের ন্যায় হেসে ভ্রু চুলকোলো। অতঃপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
—-“আব… জল? খাবে।”
রাফি স্যারের টেবিলের উপর রাখার জলের গ্লাসটা ইশারা করে বলল রাদ। ইলহাম তটস্থ হয়ে তাকালো। হেঁচকি পর হেঁচকি দিতে দিতে না সূচক মাথা নাড়লো। রাদ হেসে ফেললো তার ভাব ভঙ্গিতে। অতঃপর আর কিছু না বলে জলের গ্লাসটা এগিয়ে এনে উঁচিয়ে ধরলো ইলহামের পানে। ইলহাম আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো দু’পা। রাদ চোখ সরু করে তাকালো তার পানে। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—-“কি!”
ইলহাম দু’হাতে মুখ চেপে ধরে উল্টো দিকে ফিরে দৌড় দিতেই রাদ তার হাত টেনে ধরলো। যার দরুন তার দৌঁড়ানোর গতি থাকলেও জায়গা পরিবর্তন করার বিন্দুমাত্র শক্তি হলো না। রাদ দাঁড়িয়ে পড়লো। হেঁচকা টানে কাছে টেনে আনলো ইলহামকে। ইলহামকে আতংকে বিমূঢ় হয়ে পড়লো। লোকটাকে যতটা শান্ত ভেবে ভুল করেছিলো, তার চেয়েও দিগুন খা/রাপ এবং দুঃসাহসিক বলে ঠাওর হচ্ছে দিনের পর দিন। আর অস/ভ্য/তামো করা তো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
—-“শাড়ি পরেছো কেন?”
সপ্তম আসমানের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রশ্ন। শাড়ী পরেছো কেন?’ তো? কি হয়েছে? তার শাড়ী পরার অপরাধে কি ভারত-বাংলাদেশের যু/দ্ধ বেঁধেছে? বাঁধেনি তো! তাহলে তার কেন এতো সমস্যা হচ্ছে?
—-“প্রেজেন্টেশনে মেয়েদের ফর্মাল ড্রেস একমাত্র শাড়ী! এই গাধার মতো বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই তোমার?”
রাদ আবারও বলে উঠলো। কিন্তু এবার তার কথাটা হলো ইনসাল্ট মূলক। যা মস্তিষ্কে বিঁধে যেতেই ক্ষেপা বাঘিনীর ন্যায় তাকালো ইলহাম। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রাদ করে বসলো এক ভ*য়ানক কান্ড। ইলহামের কোমর জড়িয়ে কাছে এনেই মুখ ডুবিয়ে দিলো তার গলায়। ইলহাম ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো। মুহুর্তেই তার সমস্ত অনুভূতি শক্তি যেন থমকে গেলো। আঁটকে গেলো একই গোলকধাঁধায়। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো শীতল র/ক্ত/স্রো/ত। ধড়ফড় করতে করতে বেড়ে গেলো হৃদপিণ্ডের নাচন। কেবলই ধুকপুক ধুকপুক শব্দের ছন্দ বহমান হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ঘটনার এক মিনিট গড়াতেই ঘাড়ের কাছে চিনচিনে ব্যা*থা করে জ্ব/লতে আরম্ভ করতেই ইলহাম চাপা আ/র্তনাদ করে উঠলো। ইলহামের স্বর কানের পর্দায় বারি খেতেই তাকে আলগা করে দিলো রাদ। আর ওমনি ইলহামের হাতে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে পড়লো অনেক খানি জায়গা নিয়ে। ইলহাম টলমল চোখে চেয়ে ছিলো তার পানে। গলার কাছটাতে মরিচের মতো জ্ব/লতে লাগলো। সে আর কিছু না ভেবে সামনের বড় মিরোরটার দিকে তাকালো। ওমনি তাকে থমকাতে হলো আরও একবার। বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে পড়লো। একি অবস্থা করেছে লোকটা? দেখে মনে হচ্ছে দাঁত দিয়ে পুরো জায়গা জুড়ে চামড়া ছিঁড়ে নিয়েছে! অ/মানুষ একটা! লোকটা নির্ঘাত মানসিক ভাবে অসুস্থ। তা না হলে..;
ইলহাম পুরো কথাটা ভাবার পূর্বেই রাদ তার গলায় পরিয়ে দিলো স্টোন পাথরের কাজ করার একখানা ভারী নেকলেস। ইলহাম আবারও থমকালো। এ যে কোনো সাধারণ নেকলেস নয়! উপরের আলো এসে পাথরের উপর পড়তেই ঝলমল করে উঠলো তা। ইলহাম বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের দিকে। ঠিক তখনই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো রাদের প্রেমমূলক স্বর,
—-“জানো সুইটহার্ট? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য্যেও কলঙ্কের দাগ আছে। তবে,সে কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে সেই কলঙ্কের দাগ নিয়েই গর্ব করে জুড়ে থাকে ঐ বিশাল আসমানে। কই তার তো কোনো আফসোস নেই। বরং এক বুক গর্ব আছে। আমি চাইনা তোমারও কোনোরূপ আফসোস থাকুক। তুমিও গর্ব নিয়ে থাকো। আমার তরফ থেকে তোমার জন্য এই প্রথম উপহার। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত তুমি কিছুতেই রাখবে না আমার দেওয়া কোনো উপহার। হয়তো আমার সামনে থেকে খুলবে না। কিন্তু আড়াল হলে নিশ্চয়ই ছুঁড়ে ফেলবে ময়লার স্তূপে। তাই তোমায় হার্ট করেই আমায় এই উপহারটা তোমায় দিতে হয়েছে। আর এখন তুমি চাইলেও খুলতে পারবেনা এটা। তখন কিন্তু লোকে তোমায় কলঙ্কিত বলে দুচ্ছাই করবে। সে বেলায় আবার আমায় দায়ী করতে এসোনা এই বলে দিলাম।”
ইলহাম রা/গে ফোঁস করে উঠলো। না পারলো কিছু বলতে আর না পারলো কিছু করতে। ঠিক তখনই এসে হাজির হলেন রাফি স্যার। রাফি স্যারকে দেখতেই ইলহাম তটস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো। লুকিয়ে নিলো নিজের সমস্ত রাগ এবং অভিযোগ। লোকটাকে পরে দেখা যাবে। আগে রাফি স্যারের সাথে সমস্তটা ডিসকাস করে নিতে হবে। ]
ইলহাম দম বন্ধ করে নিয়ে সেদিনের মতো করেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো রাদকে। রাদ ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে যেতেই বারি খেলো দরজার কপাটের সাথে। ডান হাতের কনুই এবং পিঠে বেশ ভালো ভাবেই লাগলো তার। তাই না চাইতেও মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অস্পষ্ট স্বরের উচ্চরব! যা দেখে ইলহামের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আতংকিত মনে ছুটে গিয়ে ধরলো তাকে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
—-“আ-আপনার লেগেছে? আ’ইম সরি! আমি আসলে ওভাবে দিতে চাইনি!”
ইলহামের ব্যকুল কন্ঠে রাদ স্নিগ্ধ নয়নে তাকালো। ইলহামকে দেখে কখনোও মনে হয়নি সে তাকে ভালোবাসেনি। বরং এটাই মনে হতো প্রিয়দর্শিনী তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছে। কিন্তু পার্থক্য কেবল, সে প্রকাশ করতে জানে। আর প্রিয়দর্শিনী চেপে রাখতে জানে।
কথাটা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাদ। হিমশীতল কন্ঠে বলল,
—-“ভালোবাসি প্রিয়দর্শিনী! খুব খুব ভালোবাসি তোমাকে।”
ইলহাম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকে ছেড়ে দিয়ে সরে এলো পেছনে। অনন্তর রাগান্বিত স্বরে আওড়ালো,
—-“আপনি নিজেকে কি ভাবেন বলুন তো?”
—-“প্রেম-পিয়াসী! তোমার প্রেমে পিপাসু এক পথিক আমি। প্লিজ আমার হয়ে যাও,প্রিয়দর্শিনী। আমার হয়ে যাও।”
রাদ কথাগুলো বলতে বলতে হাত জোড়া বাড়িয়ে দিলো ইলহামের পানে। রাদের এহেম আকুতিপূর্ণ স্বরে ইলহাম যেন কাতর হয়ে পড়লো। তার বেদনপূ্র্ণ মন গলে গেলেও হঠাৎ সামনে নিলো নিজেকে। উপরে উপরে কঠিন রাখলো নিজের ভাবমূর্তি।
—-“অনেক হয়েছে আপনার পা/গলামি। এবার দয়াকরে নিজের ঘরে যান। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আ..আমি ঘুমোতে চাই প্লিজ।”
ইলহামের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না রাদের। সে নিশ্চুপ, নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রস্থান করলো ইলহামের রুম থেকে। ইলহাম তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর দরজা লক করে দীর্ঘসময় নিয়ে বসে রইলো দরজার সামনে।
__________
সকালে নাস্তায় সবাই থাকলেও ইলহামের দেখা মিললো না। রাদ অবশ্য নীচে আসার পূর্বে একবার ডেকেছিলো তাকে। কিন্তু সে এলো না। না আসাতে রাদ পূণরায় গেলো ডাকতে।
দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ আসতেই ভেতর থেকে জবাব এলো ইলহামের,
—-“কে?”
রাদ জবাব দিলো,
—-“নাস্তা রেডি। খেতে এসো?”
রাদের গলা পেয়ে দরজা খুললো ইলহাম। তার মুখটা ভীষণ ফ্যাকাসে। তা দেখে রাদ চিন্তান্বিত নয়নে তাকালো। বলল,
—-“এভরিথিং ইজ অলরাইট? তোমার মুখটা এমন লাগছে কেন?”
—-“আমাকে প্লিজ আমার বাড়িতে দিয়ে আসবেন, রাদ? গতকাল রাতে মামার ফ্লাইট ছিলো। মামা এসে পরেছেন বাংলাদেশে। আর মামা ফিরতেই মামী মামাকে সবটা বলে দিয়েছেন। সবটা শুনে মামা রাতেই আমাকে কল করেছিলেন! মামা আমাকে…”
—-“কি বলেছেন?”
ইলহাম পুরোটা কথাটা শেষ করলো না। তার গলায় আঁটকে এলো কথা। মামা তাকে কল করে নিশ্চয়ই ভালো কিছু শোনাননি। যার দরুন ইলহামের মুখটা ওমন পানসিটে হয়ে আছে।
—-“ত..তেমন কিছু নয়। আপনি প্লিজ আমায়..”
—-“খেতে এসো। খাওয়ার পর আমরা ডিসকাস করবো।”
—-“প্লিজ রাদ!”
ইলহাম মিনতি করে বললো। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। রাদ কোনো কথাই শুনলো না। উল্টে তার হাত ধরে নিয়ে গেলো নীচে। নিহার শাশুড়ী বাঁকা চোখে দেখছিলো দু’জনকে। কি লজ্জার কথা! বিয়ের আগে কিনা কোনো ছেলে মেয়ে এমন লাজ শরমের মাথা খেয়ে এক ঘরে রাত কাটায়। তিনি নিজ চোখে দেখেছেন গত রাতে! এরা দু’জন একত্রেই ছিলো সারারাত।
—-“বসো এখানে। মা? ইলহামের নাস্তাটা দাও।”
ছেলের কথার পৃষ্ঠে মান্নাত বেগম ইলহামের জন্য বেড়ে রাখা খাবারটা এগিয়ে দিলেন। ইলহাম দাঁতে দাঁত চেপে থাকলো। মানুষটাকে ভালো কথা বলে কখনো বোঝানো গেলোনা। তার সাথে ওমন রুঢ় আচরণই একদম পার্ফেক্ট। আর কিছু বলার প্রয়াস অব্দি করলো না সে। চুপচাপ বসে পরলো খেতে। না জানি এই খাঁচা থেকে কবে মুক্তি হবে তার।
—-“আপু? নাস্তার পরে তুমি কি ফ্রী থাকবে?”
নিহা মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে তাকালো রাদের পানে। উপর-নীচ করে মাথা নেড়ে বলল,
—-“হ্যাঁ ফ্রীই আছি। কেনো বলতো?”
—-“ওর জন্য কয়েকটা নতুন ড্রেস এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস লাগতো। আমি তো এখন সময় বের করতে পারবোনা। তাই তুমি যদি ওকে নিয়ে..”
রাদ কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই নিহা হাস্যজ্বল মুখে বলে উঠলো,
—-“বুঝে গেছি। হ্যাঁ আমি পারবো। ইলহাম তুমি খেয়ে তৈরি হয়ে নিও?”
ইলহাম জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে মাথা কাত করলো। রাদ দেখলো আঁড়চোখে একবার। অতঃপর খাওয়াতে মনোনিবেশ করতে করতে বলল,
—-“আর হ্যাঁ! ১২টার দিকে ওকে ওর ভার্সিটিতে ছেড়ে দিও। ক্লাস করে ২টার দিকে সোজা বাসায় চলে আসবে (ইলহামকে উদ্দেশ্য করে)। গাড়ি চলে যাবে।”
ইলহামের বিস্ময়ে বিষম লেগে গেলো। সে ভার্সিটিতে যাবে? এটা রাদ বলল? সে কি ঠিক শুনছে? নাকি ভুল!
ইলহামের বিষম লেগে পড়াতে হকচকিয়ে তাকালো রাদ। একই সাথে মান্নাত বেগমও। দু’জনেই পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
রাদ বিদিব্যস্ত হয়ে পড়লো কি করবে ভেবে! ঠিক তখনই মান্নাত বেগম বলে উঠলেন,
—-“বাবা, ওর পিঠের উপর হাত চাপড়ে দে। মা, পানি টা খাও!”
মায়ের কথায় রাদ ইলহামের পিঠ চাপড়ে দিতে লাগলো। আর এদিকে মান্নাত বেগম হাতে ধরে পানিটা খাইয়ে দিলো তাকে। মা-ছেলের কান্ড দেখে ইলহাম এক মুহুর্তের জন্য ভেবে ফেলল, এই তো তার পরিবার! তার আপনজন! তার মা এবং তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা। কিন্তু এসব কি আদৌও কখনোও সম্ভব হবে?
#চলবে______♥