#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।
পরদিন সকালে পৃথার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে একটু বেলা হয়ে গেল। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল, তার বাবা আজ অফিসে যাননি। তিনি লেপটপ নিয়ে ডাইনিং এ বসে কাজ করছেন। পৃথা কিছু না বলেই ডাইনিং এর একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর খালাকে ডেকে বলল,
‘খালা, আমার নাস্তা দিন।’
পৃথার বাবা কিছুক্ষণ কাজ করে লেপটপ টা সাইডে রেখে পৃথার দিকে মনোযোগের সহিত চাইলেন। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন যেন বসে গিয়েছে। রাতে হয়তো খুব কেঁদেছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েকে কিছু বুঝিয়েও পারেন না। এই বিয়েটা হলে তো সবদিক দিয়ে লাভ। কিন্তু, এই কথাটা উনার মেয়েকে এখন কে বোঝাবে? পৃথা চুপচাপ, কোনো কথা বলছে না দেখে তার বাবারও কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তিনি একপর্যায়ে আর থাকতে না পেরে বললেন,
‘এইটুকু একটা বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে?’
পৃথা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বাবার দিকে চাইল। তারপর বিষন্ন সুরে বলল,
‘ব্যাপারটা মোটেও এইটুকু না, বাবা। ব্যাপারটা অনেক বড়ো। আমি পারবনা। আমার মন কোনোভাবেই ঐ লোকটাকে মেনে নিতে চাইছে না। প্লীজ বাবা, আমাকে জোর করো না তুমি। আমার কষ্ট হয়।’
কথাটা শেষ করতেই পৃথার চোখের কোণে আবারও জল জমে। মা থাকলে হয়তো আজ তার পক্ষ নিয়ে বাবাকে বোঝাত। কিন্তু, এখন বাবাকে বোঝানোর মতোও একটা মানুষ নেই।
পৃথার বাবা মনে মনে যে ছক কষছেন তা কোনোভাবেই ভেস্তে দেওয়া যাবে না। ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবেই হোক এই বিয়েটা দিতেই হবে। নয়তো উনার অনেক লস হয়ে যাবে।
তিনি অনেকক্ষণ নিরব থেকে বললেন,
‘তাহলে তুমি কাকে বিয়ে করবে বলো? তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?’
মিটমিট করে ভালো ভাবে চাইল পৃথা। পছন্দ? হ্যাঁ, তারও তো নিজস্ব পছন্দ আছে। আর সেই পছন্দের কথা উঠতেই তার যেন মনে পড়ল, অর্ণবের কথা। অর্ণবকে সে আদৌ সেরকম ভাবে পছন্দ করে কিনা সেটা সে বুঝতে পারছে না। তবে বাবা যখন পছন্দের কথা বলছেন, তখন তো অর্ণবের কথা বাবাকে একবার বলাই যায়। পৃথা মনে মনে সাহস নিয়ে বলল,
‘একটা ছেলে আছে বাবা, খুব ভালো। আমার সাথে সাজেকে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল। উনি আমাদের ভার্সিটিরই। উনার কথাবার্তা, চালচলন আমার সবই ভালো লেগেছে। বিয়ের কথা যখন বলছই, তখন একবার উনার পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে পারো।’
পৃথার বাবা তার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। ছেলেটা পৃথার ভার্সিটির? মনে খটকা লাগল উনার। তিনি চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘নাম কী ছেলেটার?’
‘অ….’
‘আআআআআআ’
নাম বলার আগেই রান্নাঘর থেকে জোরে চিৎকারের শব্দ এল। পৃথা আর পৃথার বাবা হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে দেখল, তাদের খালা মাটিতে বসে চেঁচাচ্ছেন। প্রথমে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। পরে তার পাশেই তেলের বড়ো কড়াইটা পড়ে থাকতে দেখে পৃথা বুঝে যায় যে, উনার পায়ে গরম তেল পড়েছে। পৃথা ভয় পেয়ে ছুটে যায় খালার কাছে। খালার পা প্রচন্ড জ্বলছে। উনি চিৎকার করে কেঁদে চলছেন। পৃথা তখন বাবার দিকে চেয়ে বলল,
‘বাবা, ওয়াশ বেসিনের উপর থেকে টুথপেস্ট টা নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি টুথপেস্ট লাগাতে হবে, নাহলে ফোসকা পড় যাবে।’
,
খালাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, পৃথা তার বাবার পরিচিত একজন ডাক্তারকে কল করল আসার জন্য। তিনি এসে কিছু ঔষধ আর একটা মলম দিয়ে গেলেন। পৃথা খালার পায়ে সেই মলমটা লাগিয়ে দিতে গেলেই খালা পা সরিয়ে বললেন,
‘না না খালা, আপনি আমারে দেন, আমি লাগাইতে পারমু।’
‘আপনি যে পারবেন সেটা আমিও জানি। কিন্তু, আপনি এখন অসুস্থ। আমি যেমন অসুস্থ হলে আপনি আমার সেবা করেন, তাই এখন যেহেতু আপনি অসুস্থ সেহেতু আমি আপনার সেবা করব। তাই আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকুন।’
খালা শুয়ে থাকে। পৃথা খুব যত্ন করে উনার পায়ে মলমটা লাগিয়ে দেয়। খালা মনে মনে মেয়েটার জন্য অনেক দোয়া করে। এই ভালো মনের মেয়েটাকে যেন আল্লাহ আর কষ্ট না দেয়। এবার যেন মেয়েটা একটুখানি সুখ পায়।
খালার রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই পৃথা দেখে তার বাবার খাবার সাজিয়ে রাখছেন। পৃথা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘খাবারগুলো তুমি বানিয়েছ, বাবা?’
‘তো, আর কে বানাবে? তোমার বাবা যে একজন বড়ো মাপের শেইফ সেটা তো জানো না তুমি। খাবার গুলো একবার খেয়েই দেখো, যা টেস্ট হয়েছে না।’
পৃথা হেসে হেসে চেয়ার টেনে বসল। তারপর খাবার মুখে দিয়ে বলল,
‘আসলেই তো, খুব মজা হয়েছে।’
,
বিকেলের দিকে রুহা ঘুমাচ্ছিল। সেই সময় অর্ণব তাকে কল দেয়। ঘুমের ঘোরেই রুহা কল রিসিভ করে। অর্ণব তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘তোমরা কাল কোন হসপিটালে গিয়েছিলে, রুহা?’
‘ঐ তো মাদার কেয়ারে।’
অর্ণব ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কিন্তু, ঐখানে তো সব গাইনী ডক্টর বসেন। পৃথাকে নিয়ে ঐ হসপিটালে কেন গিয়েছ?’
রুহা ঘুমে ঠিক মতো তাকাতেও পারছে না। অর্ণবের বলা কথা সে অর্ধেক বুঝছে তো অর্ধেক মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অর্ণব বলল,
‘কী হলো, কিছু বলছো না কেন?’
রুহা বিরক্ত হয়ে উঠে বসল।
‘কী বলব?’
‘পৃথার এক্সেক্ট হয়েছেটা কী বলতো? তুমি ওকে নিয়ে গাইনী ডাক্তারের কাছে কেন গিয়েছ?’
‘ঐসব মেয়েদের সমস্যা, আপনি বুঝবেন না।’
অর্ণব জোরে নিশ্বাস ছেড়ে ফিচেল গলায় বলল,
‘মেয়েটা তো আমার বউ লাগে, না বুঝলেও আমাকে বুঝতে হবে। বলো তুমি।’
রুহা বড়ো করে হাই তুলে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
‘কী বলব?’
অর্ণব এবার ক্ষেপে যায়। রুহাকে ধমক দিয়ে বলে,
‘এই মেয়ে তুমি আগে ঘুমিয়ে নাও, তারপর ঘুম ভাঙলে আমাকে কল দিও। রাখছি।’
অর্ণব কল কাটার পর রুহা আবারও সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। যেন আজ না ঘুমালে সে আর বাঁচতেই পারবে না।
__________________________________________
আজকে রিপোর্ট আনতে যেতে হবে। সকাল থেকেই রুহার পেটে মোচড় দিচ্ছে। অন্যদিকে অর্ণব ও তাকে কল দিতে দিতে জ্বালিয়ে মারছে। তার কথা হলো, রিপোর্ট আনতে সে আর রুহা যাবে শুধু, পৃথা যেন সেটা জানতে না পারে। কিন্তু, তা কী করে হবে? পৃথা তো আজ সকাল থেকেই অস্থিরতা দেখাচ্ছে যে কখন তারা রিপোর্ট আনতে যাবে। এখন ওকে না নিয়ে রুহা কী করে যাবে? অন্যদিকে অর্ণবও থাকে চাপ দিচ্ছে। বেচারা রুহা পড়েছে মসিবতে। না এইদিকে যেতে পারছে না ঐদিকে।
সারাদিন ভেবে রুহা সিদ্ধান্ত নিল, সে অর্ণবকে নিয়েই রিপোর্ট আনতে যাবে। কারণ, এমনিতেও অর্ণবকে সব সত্যি বলতেই হতো। এখন না হয় সে রিপোর্ট দেখেই সব জানতে পারবে। আর অন্যদিকে পৃথাকেও রুহা এখনই সব জানাতে চাইছে না। আগে অর্ণবের সাথে তার বন্ডিং টা আরেকটু স্ট্রং হোক, তারপর তাকে আস্তে ধীরে সবকিছু জানানো যাবে।
পৃথাকে বিকেলের কথা বলে রুহা অর্ণব কে নিয়ে দুপুরের দিকেই হসপিটালে চলে যায়। অর্ণব কে খুব কষ্ট করে ম্যানেজ করে সে একাই ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করে। ডাক্তার তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘পেশেন্ট আসেনি?’
রুহা মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না।’
তারপর ঢোক গিলে বলে,
‘রিপোর্ট কী এসেছে?’
ডাক্তার তার দিকে রিপোর্ট টা এগিয়ে দেয়। রুহা এখনও মনে মনে দোয়া করছে রিপোর্ট যেন নেগেটিভ আসে।
সে রিপোর্ট টা না খুলে হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার বললেন,
‘খুলে দেখুন।’
পৃথা ভয়ে ভয়ে বলল,
‘না, আপনি মুখেই বলে ফেলুন না।’
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘আপনার সন্দেহই ঠিক। উনি প্রেগন্যান্ট।’
রুহা স্তব্ধ। বাইরে গিয়ে সে কী বলবে, সেই টেনশনেই তার এখন হাত পা কাঁপছে। অর্ণব কীভাবে ব্যাপারটা নিবে? এমনিতেই উনি যা হাইপার হয়ে আছেন। এখন আবার এসব শুনে বেশি উত্তেজিত হয়ে কী থেকে কী করে বসবেন কে জানে?
চলবে….