প্রেমাঙ্গনা পর্ব ১৩

0
456

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

অর্ণবের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে রুহা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। অর্ণব সেই কখন থেকেই রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বসে আছে। কিছু বলছে না। রুহাও তাই বুঝতে পারছে না যে তার মনে এখন কী চলছে। সে বিব্রত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কেবল।

অনেকটা সময় এভাবেই পার হয়। কিন্তু, রুহা সাহস করে কিছু বলে উঠতে পারে না। বাইরে রোদ কিছুটা কমেছে। অর্ণব এবার উঠে দাঁড়ায়। রুহার দিকে চেয়ে শক্ত গলায় বলে,

‘আমি এখন এই রিপোর্ট নিয়ে ডিরেক্ট পৃথার বাবার কাছে যাব। তারপর যা হবে দেখা যাবে।’

রুহা অস্থির হয়ে উঠে। বলে,

‘এমনটা করবেন না, ভাইয়া। হিতে বিপরীত হবে। অনেক বড়ো ঝামেলা লেগে যাবে। এমনিতেই আংকেল আপনাকে সহ্য করতে পারেন না, এখন আবার এসব জানলে আরো বেশি রেগে যাবেন উনি। ঠান্ডা মাথায় আমাদের ভাবতে হবে। এত উত্তেজিত হয়ে কিছুই করা যাবে না।’

‘তুমি আমাকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে বলছো? এতকিছুর পরও তুমি আমাকে ঠান্ডা মাথায় থাকার কথা কী করে বলছো? জানো, আমাকে নিজের কাছে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। আমি এমন এক অসহায় স্বামী, যার স্ত্রী তাকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে, তার উপর এখন আমি এতটাই অসহায় যে, আজ আমি বাবা হতে চলছি জেনেও খুশি হতে পারছি না, নিজের স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছি না, ও আমাকে পৃথিবীর সেরা সুখটা দিয়েছে। এত অসহায়ত্বের পরও তুমি আমাকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে বলছো? কী করে এখন নিজেকে আমি শান্ত রাখব বলো? এমন একটা পরিস্থিতিতে কে শান্ত থাকতে পারে? বলো, রুহা।’

রুহা বাকরুদ্ধ। সে কী বলবে? অর্ণবের চোখমুখ দেখে তো তারও মায়া হচ্ছে। আল্লাহ এত কেন পরীক্ষা নিচ্ছেন? এবার এর একটা সমাধান হোক না। এই মানুষ দুটোর কষ্ট যে আর দেখা যাচ্ছে না।

অর্ণব নিজেকে শান্ত করে। মাথা ঠিক কাজ করছে না তার। শরীর, মন সব ভার ভার লাগছে। সে শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলে,

‘এবার আমাকে একটা স্টেপ নিতেই হবে, রুহা। আমাকে তোমরা আর আটকিও না। তোমাদের কথা শুনেই আমি পৃথাকে ওর বাবার কাছে পাঠিয়েছিলাম। ওকে যদি এখন আমার কাছে রাখতাম, তাহলে কিছুটা হলেও আজ শান্তি পেতাম। কিন্তু ও ওর বাবার কাছে থেকে প্রতিনিয়ত আমার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আমি কোনোভাবেই আর ধৈর্য রাখতে পারছি না। আমার দ্বারা আর এসব সহ্য করা সম্ভব না।’

রুহা ঢোক গিলে বলল,

‘ভাইয়া, আমাকে আর দুইটা দিন সময় দিন। এই দুই দিনের মধ্যেই আমি পৃথাকে আপনার কাছে আসার ব্যবস্থা করে দিব। শুধু দুইটা দিন।’

‘কী করবে এই দুই দিনে তুমি?’

‘কিছু একটা করব। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। আংকেলের ইনটেনশন ভালো না। পৃথাকে উনি বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু, আমি জানি পৃথা মরে গেলেও ঐ ফরহাদকে বিয়ে করবে না। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে আমি পৃথার মনে আপনার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করব। ওকে যদি একবার বাড়ি থেকে বের করে আনতে পারি, তাহলেই আস্তে আস্তে আমরা সবাই ওকে সবটা সত্যি বলতে পারব। আর তার আগ পর্যন্ত আপনাকে আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে। পৃথাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। ও একটু পর রিপোর্টের জন্য আসবে। আমি ভেতরের ডাক্তারকে বলে রেখেছি, ও আসলে কী কী বলতে হবে। উনি বলেছেন আমাকে সাহায্য করবেন। আপনি এখন আর এসব নিয়ে টেনশন না করে ফিরে যান। এইদিকটা আমি সামলে নিব।’

অর্ণব রুহার মাথার উপর হাত রেখে বলল,

‘তোমার মতো একটা ছোট বোন আছে বলেই আমি এখনও নিশ্বাস নিতে পারছি। নয়তো এতসব ঝামেলার মাঝে পড়ে কবেই দম আটকে মারা পড়তাম। আচ্ছা, তুমি যা বলেছ তাই হবে। তবে যদি পৃথার বাবা কোনোরকম বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করেন, তাহলে কিন্তু আমি আর চুপ থাকব না।’

‘ঠিক আছে, ভাইয়া।’

রিপোর্টটা নিয়েই অর্ণব হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। আর রুহা হসপিটাল থেকে সরাসরি গেল পৃথার বাসায়।
কিন্তু, তাদের বাসার গেইটের সামনে যেতেই দাঁড়োয়ান তাকে আটকে ফেলল। রুহা অবাক হয়ে বলল,

‘মামা, আপনি আমাকে আটকাচ্ছেন কেন? আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি রুহা, পৃথার বান্ধবী।’

দারোয়ান মামা বললেন,

‘জি, আপনারে আমি চিনতে পারছি। কিন্তু, আপনারে আমি ভেতরে যাইতে দিতে পারমু না। সাহেব নিষেধ করছেন। উনি ব্যতিত যেন এই বাসায় আর কেউ না ঢুকে। আমি এহন সাহেবের কথা অমান্য করতে পারমু না, মামা। আপনি কিছু মনে কইরেন না।’

রুহা বুঝতে পারল, কেন পৃথার বাবা এসব করছেন। তাই সে এখানে আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে গিয়ে পৃথাকে কল করল। পৃথা কল রিসিভ করলে সে পৃথাকে সবকিছু খুলে বলে। সব শুনে পৃথার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। তার বাবা তার বন্ধুদের আসতেও নিষেধ করেছে? সে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। গেইটের সামনে এসেই দারোয়ান কে বলে,

‘এটা কী হলো, মামা? আপনি রুহাকেও ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না?’

‘আমার কোনো দোষ নাই, মামা। সাহেব বারণ করছেন।’

‘সাহেবকে বলবেন, সাহেবের মেয়ে আপনাকে অনুমতি দিয়েছে।’

এই বলে সে রুহার দিকে চেয়ে বলল,

‘এই রুহা, তুই ভেতরে আয়।’

রুহা ভেতরে যায়। পৃথা দারোয়ানের দিকে চেয়ে বলে,

‘আপনি ভয় পাবেন না, মামা। আমি বাবাকে ম্যানেজ করে নিব।’

এই বলে সে পৃথাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। তারা ভেতরে চলে যাওয়ার পরই দারোয়ান পৃথার বাবাকে কল দিয়ে সব জানিয়ে দেন। সব শুনে পৃথার বাবা বলেন,

‘ঠিক আছে, তুমি রাখো। আমি আসছি।’

রুহাকে চা বানিয়ে দিয়ে পৃথা রেডি হচ্ছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতেই সে বলল,

‘তোর কী মনে হয় রুহা, আমার রিপোর্ট নরমাল আসবে তো?’

রুহা আলতো হেসে জবাবে বলে,

‘একদম নরমাল আসবে, তুই দেখিস।’

পৃথা মুখ কুঁচকে বলল,

‘আমার না কেমন যেন ভয় হচ্ছে।’

‘ধুর বোকা, ভয় পাওয়ার কী আছে? তোর কিছু হয়নি। দেখবি ডাক্তারও এটাই বলবে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হো, বেরুতে হবে তো।’

এর মাঝেই তারা বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। পৃথা অবাক হয়ে বলল,

‘বাবা? এসময়?’

পৃথা আর রুহা দরজার কাছে যেতেই পৃথার বাবার এসে তাদের মুখোমুখি দাঁড়ান। কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করেন,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

পৃথা নির্দ্বিধায় বলে উঠে,

‘একটু শপিং এ, বাবা।’

‘না, যেতে হবে না। শপিং এখন বাসায় বসেই করা যায়। অনলাইনে করো।’

পৃথা অদ্ভুত ভাবে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমি কি এখন বাইরে গিয়ে একটু শপিং ও করতে পারব না?’

‘আপাতত পারবে না। এখন বাসায় বসে শপিং করো। বিয়ের পর বাইরে গিয়ে শপিং করবে।’

পৃথার খুব রাগ হলো কথাটা শুনে। সে নাকের পাল্লা ফুলিয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলল,

‘বলেছি না আমি বিয়ে করব না? বারবার তাহলে এক কথা কেন বলছো?’

পৃথার বাবা তার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি রুহার দিকে চেয়ে বললেন,

‘তুমি তোমার বাড়ি যাও। আর এমন হুটহাট করে এখানে চলে আসবে না। নয়তো পরের বার গেইটের সামনে থেকেই বিদায় হতে হবে।’

পৃথা চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘বাবা, রুহার সাথে তুমি এমন ব্যবহার করছো কেন?’

পৃথার বাবা তাকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘তোমার ভালোর জন্যই করছি।’

রুহাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। খুব খারাপ লাগে তার। ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বাসায় চলে যায়।

অন্যদিকে পৃথা বাবার এই আচরণ হজমই করতে পারছে না যেন। রাগে, ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছে সে। কিন্তু, তার বাবা সেসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তিনি উল্টো সহজ ভাষায় তাকে বলে দিলেন,

‘কাল তোমাকে দেখতে ফরহাদের বাড়ির লোক আসবে, আর আমরা কালই তোমাদের বিয়ের ডেইট পাকা করব।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here