প্রেমাঙ্গনা পর্ব ১১

0
426

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।

ঘড়ির কাটায় তখন দুইটা বেজে পনেরো মিনিট। পুরো শহর যখন ঘুমে নিস্তব্ধ তখন একজন উদাসী রমনী রুম জুড়ে পায়চারি করে চলছে। দু চোখে তার ঘুমের ছিটে ফোঁটাও নেই। চোখ ফুলে আছে। নাক টকটকে লাল। সে যে কেঁদে কেটে অস্থির তা এখন যে কেউ একবার দেখেই বলে দিতে পারবে।

এত ভেবেও কোনো সমাধান যে বের করতে পারছে না। মনকেও বোঝাতে পারছে না। মন কোনোভাবেই ঐ ফরহাদকে জীবন সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে চাইছে না। কী করবে? কার কথা শুনবে? বাবা? নাকি মনের?
অনেক সময় নিয়ে মনকে বুঝিয়েও যখন লাভের লাভ কিছু হলো না, তখন পৃথা রুহাকে কল দিল। তার সকল সমস্যার সমাধান যেন এই মেয়েটার কাছেই আছে।

রুহা ঘুমিয়ে পড়েছিল। এত রাতে পৃথার কল দেখে সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। কল রিসিভ করেই অস্থির হয়ে বলে,

‘কী হলো, পৃথা? তুই ঠিক আছিস?’

‘না, ঠিক নেই। বিশাল বড়ো সমস্যাই আছি।’

‘কেন, কী হয়েছে? শরীর কি অনেক বেশি খারাপ লাগছে?’

পৃথা ঠোঁট উল্টে বলল,

‘শরীর না মন। মনের আজ ভীষণ শরীর খারাপ।’

‘কী হয়েছে, বলবি তো?’

‘বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, ফরহাদের সাথে।’

রুহা চকিত হয়ে বলল,

‘কী?’

‘হ্যাঁ, এখন বল আমি কী করব? আমি আমার মনকে কোনোভাবেই মানাতে পারছি না। বারবার মন বলছে ঐ ছেলেকে তার একেবারেই পছন্দ না। এখন যাকে পছন্দ না, তাকে বিয়ে করব কী করে?’

রুহা মাথায় হাত দিয়ে বসে। একের পর এক ঝামেলা কেবল লেগেই চলছে। এই ঝামেলার শেষ কোথায়?

‘কিরে রুহা, বল কিছু; চুপ করে আছিস কেন?’

‘তুই আংকেল কে বারণ করে দে, বল তুই বিয়ে করবি না।’

‘বলেছি তো। আমি বলেছি বাবাকে, যে ঐ ছেলেকে আমার পছন্দ না, ওকে আমি বিয়ে করব না। কিন্তু, বাবা বলেছেন, উনি নাকি আমার আর কোনো কথা শুনবেন না। জোর করেই নাকি আমাকে এবার বিয়ে দিবেন। আমি এখন কীভাবে এই বিয়ে আটকাবো? একটা উপায় বল না, দোস্ত।’

রুহা চোখ বুজে ভাবতে থাকে এবার তার কী করা উচিত। এইসব কিছু এখন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথাকে এবার সব সত্যি বলতেই হবে।

রুহা বলে,

‘পালিয়ে যা।’

‘পালিয়ে যাব কোথায়? তোর কাছে আসব? বাবা ইজিলি আমাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারবেন।’

‘একা একা পালালে তো হবে না। কারোর সাথে পালাতে হবে।’

‘কিন্তু, কার সাথে পালাবো?’

রুহা শক্ত হয়ে বলল,

‘অর্ণব ভাইয়ার সাথে।’

পৃথা নাক মুখ কুঁচকে বলে,

‘মাথা খারাপ তোর? উনার সাথে আমি কেন পালাতে যাব? উনি কি আমার বয়ফ্রেন্ড হোন যে আমি এখন সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে উনার সাথে পালাব?’

‘তাছাড়া আর উপায় নেই, পৃথা। তোকে আবার পালাতে হবে। ঐ বাড়িতে থাকলে তোর বিয়ে ফরহাদের সাথেই হবে। এই বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না।’

পৃথা খানিক চুপ থেকে বলল,

‘আবার পালানোর কথা বলছিস কেন? আমি কি এর আগে কখনো পালিয়েছি নাকি?’

রুহা ঢোক গিলে বলল,

‘জানি না আমি, তোর এত প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। এখন যেটা বলছি, সেটা কর। পালিয়ে যা। অর্ণব ভাইয়াকে এখন কল দে। কল দিয়ে সব খুলে বল উনাকে। তারপর উনিই সব ব্যবস্থা করবেন।’

পৃথা বুঝে উঠতে পারে না কিছু। অর্ণবই বা কেন তার সাথে পালাতে রাজি হবে? সে না হয় পৃথাকে পছন্দ করে, তাই বলে হুট করে বললেই কেউ কারোর সাথে পালিয়ে যাবে নাকি? আশ্চর্য!

পৃথা বিরক্ত গলায় বলে,

‘তোর মাথা খারাপ? উনার সাথে আমার ভালো করে একদিন কথাও হয়নি, আর আজ আমি উনাকে কল দিয়ে বলব, “চলুন, পালিয়ে যাই” আর উনিও তখন নাচতে নাচতে বলবেন, “হে হে, চলো।” তোর কি তাই মনে হয়?’

‘আমার শুধু মনে হয় না। আমি সিউর। উনি আমাকে বলেছেন, উনি তোকে ভালোবাসেন। তুই এই সুযোগটা কাজে লাগা, পৃথা। পরে নয়তো পস্তাবি।’

পৃথার মাথা ঘুরাচ্ছে। কী করছে, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অর্ণব কে হুট করে পালিয়ে যাওয়ার কথা সে কী করে বলবে? তার উপর ছেলেটাকে তো সে ভালো করে চেনেও না। এভাবে হুট করে কারো সাথে পালিয়ে যাওয়া যায় নাকি? না, রুহার এই আইডিয়াটা পৃথার একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাই সে তেঁতো মুখে বলে,

‘আচ্ছা, তুই ফোন রাখ; আমি ভেবে দেখছি।’

এই বলে সে নিজেই কল কেটে দেয়। রুহা ঐদিকে আর বিলম্ব না করে দ্রুত অর্ণবকে কল করে। সে তাকে সবকিছু খুলে বলে। সব শোনার পর অর্ণবের সেই দমে যাওয়া রাগ পুনরায় তড়তড় করে মাথায় চড়ে উঠে। সে তখনই রুহার কল কেটে পৃথাকে কল দেয়। পৃথা নাম্বারটা দেখেই চিনতে পারে। অর্ণব এই সময় কল দেওয়ায় সে বুঝে ফেলে যে রুহা তাকে সব বলে দিয়েছে। তাই সে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে অর্ণবের ঝাঁঝাল স্বর শোনা যায়। সে বলে উঠে,

‘কালকে বিকেলে সবকিছু গুছিয়ে তৈরি থাকবেন, আমি আপনাকে নিতে আসব।’

‘কেন?’

‘কেন মানে? আপনি কি তাহলে ঐখানে থেকে ফরহাদকে বিয়ে করবেন?’

‘না, ঐ ছেলেকে আমি বিয়ে করতে চাই না।’

‘তাহলে এত কথা না বলে যা বলেছি তাই করবেন।’

‘কিন্তু, আমি আপনার সাথে পালাতেও চাই না। আপনার সাথে পালালে আমার বাবা কষ্ট পাবেন। আর তাছাড়া আমি আপনাকে চিনিও না।’

পৃথার কথা শুনে অর্ণব কিছুক্ষন থ মেরে বসে থেকে বিষন্ন সুরে বলে,

‘আপনি আমাকে চিনেন না?’

‘না, আপনার সাথে তো আমার খুব একটা কথাও হয়নি। আপনার সম্পর্কে তো আমি তেমন কিছুই জানি না। আর আপনিও তো আমাকে ভালোভাবে চেনেন না। এভাবে না চিনে, না জেনে কারোর সাথে পালিয়ে যাওয়া যায় নাকি?’

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘জানেন, একদিন আমাকে একজন বলেছিল, ভালোবাসার জন্য নাকি চেনা জানার প্রয়োজন নেই। ভালোবাসা তো এমনই হয়। সবসময় পরিচয়ে পরিনয় হয় না। মাঝে মাঝে অপরিচিতের মাঝেও প্রণয় মেলে। কথাটা কিন্তু সত্যি। আপনি আমায় চেনেন না, তাই বলে কি ভালোবাসা যায় না? অপরিচিত থেকেই তো পরিচিত হয়, হাত না বাড়ালে হাত ধরার মানুষ কোথায় পাবেন? আর বাকি আমার আপনাকে চেনার কথা? সেটা তো আমি আরো আগেই চিনে ফেলেছি। হাজার অপরিচিতের ভিড়েও আমি আপনাকে চিনতে পারব। তাই আপনাকে আর আমার নতুন করে চেনার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও যদি আমাকে আপনার বিশ্বাস না হয়, তাহলে ঐ ফরহাদকেই বিয়ে করে নিন।’

পৃথা জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। গালে হাত দিয়ে ভাবে, কী করবে সে। এই লোকটা, এত অপরিচিত তাও লোকটাকে তার কত আপন মন হয়। মনে হয়, লোকটার কাছে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। মনে হয় যেন তাকে চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করা যায়। অন্য কাউকে তো সে এত সহজে বিশ্বাস করতে পারে না, তাহলে এই লোকটাকেই কেন মন এত সহজেই ভরসা করতে চাইছে? কেন তার প্রতি কোনো সন্দেহ হচ্ছে না? আচ্ছা, লোকটা কি তার পরিচিত কেউ? যাকে সে হয়তো চিনে, কিন্তু মনে করতে পারছে না?

অর্ণব বলে,

‘তো,কী সিদ্ধান্ত নিলেন? পালাবেন, নাকি বিয়ে করবেন?’

‘বিয়ে তো আমি মরে গেলেও করব না। আর পালাব কিনা সেটা এখনও বলতে পারছি না। আমার দুদিন সময় লাগবে।’

‘ঠিক আছে, সময় নিন। তবে বেশি দেরি যেন না হয়।’

অর্ণব কল কেটে দেয়। আর পৃথা, বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবতে থাকে, এবার তার কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here