প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
পার্ট :৪
প্রীতি আজ দুই দিন ধরে আবারো সিআইডি তে জয়েন করেছে ৷ যেই কেসের উদ্দেশ্যে প্রীতির ঢাকায় এসেছে ৷ ঐ কেসটাও আজ ওর আওতায় চলে আসবে ৷ প্রীতি নিজের বাইকে করে সিআইডি ভবনে চলে যায় ৷ তাকে সবাই খুশি মনে বরনও করে নেয় ৷
বর্তমানে প্রীতি এসিপি প্রদীপের সামনে বসে আছে ৷ এসিপি প্রদীপ প্রীতিকে বলল ,
“এটা খুবই জটিল একটা কেস ৷ আমরা অপরাধীকে সন্দেহ অলরেডি করেছি ৷ কিন্তু প্রমানের অভাবে গ্রেফতার করতে পারছি না ৷ আর এই কেসটা কেউই এখন আর ঘাটতে চায় না ৷ সবারই তো পরিবার আছে ৷ তাই কেউ সাহস করছে না ৷”
এসিপি প্রদীপের কথার পৃষ্ঠে প্রীতি বলল ,
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না স্যার ৷ আমি আমার জীবন দিয়ে দেবো ৷ তবুও এই কেসটা শেষ করবো ৷ আপনাকে কথা দিলাম ৷”
“তোমাকে যেই ভার্সিটিতে স্টুডেন্ট হিসেবে পাঠানো হচ্ছে ৷ ওখানের কর্তৃকপক্ষকে অলরেডি জানানো হয়ে গেছে ৷ আর ঐ এলাকা থেকে এক বছরে প্রায় একশ মেয়ে গায়েব হয়েছে ৷ এবার মনে হয় নারী পাচারকারী গ্যাং ঐ ভার্সিটাকে টার্গেট করছে ৷ নারী পাচারকারী গ্যাংয়ের লোক ভার্সিটিতে আছে ৷ কিন্তু তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না ৷ আর সাবধানে থাকবে ৷কা রন এই কেসের মূল আসামী দ্বীপ চৌধুরী ৷ খুবই ভয়ংকর একজন ব্যক্তি সে ৷ যে নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে ৷ ভার্সিটিতে অবশ্যই ছদ্দবেশে যাবে ৷ কেউ যেন টের না পায় তুমি সিআইডি অফিসার ৷ আর একটা কথা ৷ আজ তিনটায় কর্নেল ওসমান তোমার সাথে দেখা করতে আসবে ৷”
কর্নেল ওসমান নামটা শুনতেই প্রীতি থমকে গেল ৷ওর চোখ সাদা অংশ লাল বর্নধারন করতে লাগলো আস্তে আস্তে ৷ প্রীতি নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলল,
“আমি অবশ্যই আসবো স্যার ৷ তাদের জন্যই তো আমার এখানে আসা ৷”
এসিপি প্রদীপ কিছু না বোঝার ভঙ্গিতে বলল ,
“মানে !”
প্রীতি কথা এড়িয়ে যেতে বলল ,
“আমি ওনার নাম শুনেছি অনেক ৷ ওনাকে আগে থেকেই দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ৷ ভাবতেই খুশি লাগছে এত বড় মাপের একজন আইনের লোককে আজ দেখতে পাবো ৷”
প্রীতির কথা শুনে এসিপি হাসতে হাসতে বলল ,
“ওহ এই ব্যাপার ! আগে বলবে তো ৷ তাহলে এখন যাও ৷ সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে ৷”
“জ্বি স্যার ৷”
প্রীতি এসিপির রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ৷ প্রীতি নিজের টেবিলে গেল ৷ তারপর নিজের জুনিয়র অফিসার শান্তকে কল দিয়ে আসতে বললো ৷জুনিয়র অফিসার আসতেই প্রীতি বলল,
“আজ পাচঁটার মধ্যে দ্বীপ চৌধুরীর পরিবারের সব তথ্য আমায় দেবে ৷ আমি যেন এসে দেখি সব ক্লিয়ার ৷”
“জ্বি ম্যাডাম আপনি যে ভাবে বলবেন ৷”
“হুমম এবার যাও ৷”
অফিসার যেতেই প্রীতি মুচকি হাসতে লাগলো ৷ তার ভেতরের পৈশাচিক আনন্দ গুলো প্রকাশ পাচ্ছে ৷ বছরের পর বছর বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা প্রতিশোধের তেজ কম নয় ৷ হঠাৎ করে প্রীতির হাসি বন্ধ হয়ে গেল ৷ মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠলো মূহূর্তেই ৷ কাঁচের টেবিল শক্ত করে আকড়ে করে প্রীতি বলল ,
“খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে দ্বীপ চৌধুরী ৷ কর্নেল ওসমান তোমাকে তো আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াবো ৷ রেডি হও নিজেদের মৃত্যুর জন্য ৷”
প্রীতি নিজের অফিসের কাজ একটার মধ্যে শেষ করলো ৷ তারপর যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে চলে গেল ৷ কেননা আজ তার প্রথম শিকার কর্নেল ওসমান আসছে ৷ নিজেকে ঐ নারী লোভী ওসমানের সামনে ঠিক করে প্রেজেন্ট করতে হবে তো ৷ নইলে কেসটা সমাধান করা যাবে না ৷
কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে ৷ প্রকৃতি জুড়ে কিছুটা অন্ধকার নেমে এসেছে ৷ মোমবাতি ধরানো ঝলমলে ঘরে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলো প্রীতিলতা ৷ পুরুষের বুকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া নিজের এই রূপ দেখে প্রীতিলতা হাসে ৷ হ্যা তার এই সুন্দর চেহারা পেছনে একটা হিংস্র বাঘিনী লুকিয়ে আছে ৷ যেটা সবার আড়ালে শিকার করে ৷ আর শিকারের রক্তে রক্তস্নান করে ৷ প্রীতি বাঁকা হেসে বেড়িয়ে গেল ৷
অপর দিকে আবেশ নিজের চাচার সাথে কথা বলছে ৷ আবেশের আপন বলতে এই একজনই আছে ৷ আবেশের অফিসে তার চাচা এসেছে ৷ আবেশ নিজের চাচাকে বলল ,
“এই অসময়ে না জানিয়ে কেন এলেন চাচ্চু ? আমাকে বললেই তো হতো ৷আমি নিজেই চলে যেতাম ৷”
আবেশের চাচা বেশ শক্ত গলায় বলল ,
“তার প্রয়োজন নেই ৷ শুনলাম তোমার সব সম্পত্তি নাকি তুমি তোমার ছেলে , মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছো ৷”
আবেশ হালকা হেসে বলল ,
“জ্বি চাচ্চু ৷ বলা তো যায় না কখন কি হয়ে যায় ৷ তাই এখনই সব ওদের নামে দিয়ে দেবো ৷ বাবাও তো আমাদের তিন ভাই বোনের নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে ছিলেন ৷ আর তার দুই দিন পরেই মারা গেলেন ৷ আল্লাহ কখন কাকে নিয়ে যায় তা তো কেউ বলতে পারে না ৷”
আবেশের চাচা আরো কিছুক্ষন কথা বলে বেড়িয়ে গেল ৷ আবেশের অফিস থেকে বের হয়ে তিনি গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলল
“সব মরবে ৷কাউকে বাচঁতে দেব না আমি ৷ আমার এত দিনের পরিকল্পনা এভাবে নষ্ট হতে পারে না ৷ কিছুতেই না ৷”
সন্ধ্যা সাতটার দিকে কর্নেল ওসমান সিআইডি ভবনে চলে আসে ৷ প্রীতিও আজ কালো স্যুট বুট পড়ে এসেছে ৷ হয়তো নিজের এই কালো রংয়ের পোশাক দ্বারাই ওসমানকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে ৷ আর তারপর নিজের রাজ্যের বন্দি বানিয়ে রাখবে ৷
বর্তমানে প্রীতির দিকে লালসা পূর্ন দৃষ্টিতে কর্নেল ওসমান তাকিয়ে আছে ৷ আর প্রীতির আবেদনমাখা হাসি ব্যবহারের পেছনে হিংস্রতা খেলা ৷ ওসমানের সাথে প্রীতির অনেক ভাব জমে গেছে ৷ ওসমানও যেন প্রীতির দিকে ইচ্ছে করেই বেশি ঘেষছে ৷ দ্বীপ চৌধুরীকে যে নতুন সিআইডির ব্যাপারে সব জানাতে হবে ৷ ঐ দিকে হুশ নেই ওসমানের ৷ সে তো নিজের মেয়ের বয়সী প্রীতির রূপে মজেছে ৷
প্রীতি ওসমানের কাছে যেয়ে আস্তে করে বলল,
” আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোই লাগছে স্যার ৷ ভাবতেও পারি নি এভাবে দেখা হবে ৷ যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি ৷”
ওসমান দাঁত কেলিয়ে জবাবে বলল ,
“হ্যা হ্যা বলো ৷”
“আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেবেন ? ফ্রি থাকলে কল দেব মাঝে মাঝে ৷”
ওসমান যেন মেঘ না চাইতেই জল পেল ৷সে দাতঁ কেলিয়ে বলল ,
“তোমার যখন ইচ্ছে কল করবে ৷ আমি মাইন্ড করবো না বিউটিফুল ৷”
প্রীতি মুচঁকি হাসি দিয়ে চলে গেল ৷ তাদের এই ফিসফিসিয়ে কথা কেউ শুনতেও পেল না ৷ অন্যদিকে দ্বীপ চৌধুরী ওসমানকে কল দিয়েই যাচ্ছে ৷ কিন্তু সে রিসিভ করছে না ৷ কেননা সে তো প্রীতির সাথে ক্লোজ হতে ব্যস্ত ৷
অপর দিকে আবেশ চৌধুরীর চাচা বাসায় এসে ভাংচুর করছে ৷ তার মাথা ঠিক নেই ৷তাকে এই অবস্থা দেখে তার স্ত্রী আর ছেলে দৌড়ে আসে ৷ তার স্ত্রী মিস ডায়না বললেন,
“একি করছো তুমি ? পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি ৷”
“হ্যা আমি পাগল হয়ে গিয়েছি ৷ আবেশ ওর সম্পত্তি নিজের ছেলে মেয়ের নামে করে দিচ্ছে ৷ আর কত সহ্য করতে বলছো আমাকে ? অন্যদিকে ওসমান ফোন ধরছে না আমার ৷ মাথা খারাপ হয়ে যাবে আমার ৷”
আবেশের চাচাতো ভাই দিহান বাবার কাছে এসে বলল ,
“যদি ঐ ছেলে , মেয়েই না থাকে তাহলে ৷”
আবেশের চাচা অবাক হয়ে বলল ,
” মানে !”
দিহান মুচঁকি হাসি দিয়ে নিজের বাবাকে সব বুঝিয়ে দিল ৷
রাত ঘড়িতে দশটা বাজে ৷কর্নেল ওসমান কিছুক্ষন আগে চলে গেছেন ৷ প্রীতি নিজের চেয়ারে বসে আছে ৷ ঠিক তখনই তার ডোর বেল বেজে উঠলো ৷ প্রীতি অনুমতি দিতেই জুনিয়র অফিসার শান্ত ঢুকলেন ৷ তারপর বলল ,
“ম্যাম আপনার কথা মতো দ্বীপ চৌধুরীর পরিবার সম্পর্কে সব তথ্য কালেক্ট করেছি ৷ এখানে সব তথ্য আছে ৷”
অতঃপর শান্ত প্রীতিকে সব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন ৷
“ম্যাডাম এই দেখুন এটা দ্বীপ চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস ডায়না ৷ আর এটা তার ছেলে দিহান চৌধুরী ৷ সারাদিন ক্লাবে পরে থাকে ৷ তার জীবন মেয়ে আর মদের উপরই চলে ৷আর তার মেয়ে দ্বীপা ৷ বড্ড ভালো মেয়েটা ৷ মা , বাবা আর ভাইয়ের একেবারে উল্টো ৷ কোনো খারাপ রেকর্ড নেই ওর নামে ৷ দ্বীপ চৌধুরীর আরো একটা ভাই ছিল ৷ চৌদ্দ বছর আগে পরিবার সহ আগুনে পুড়ে মারা যায় ৷ তার ভাই আয়ান চৌধুরী আর স্ত্রী চারুলতা চৌধুরী ভালোবেসে বিয়ে করেন ৷ তিনটা সন্তান ছিল তাদের সংসারে ৷ দুই ছেলে আর এক মেয়ে ৷ ছোট ছেলে আদিত্য আর মেয়ে প্রীতিলতা সহ চৌদ্দ বছর আগে নিজেদের বাড়ীতে পুরে মারা যায় তারা ৷ তাদের মৃত্যু ঘিরে রহস্য আছে অনেক ৷ আর হ্যা তাদের লাশও পুলিশ খুজে পায় নি ৷
অফিসার থেমে আবারো বললেন ,
” তবে তাদের বড় ছেলে আবেশ চৌধুরী বেচেঁ আছেন ৷”
আবেশ চৌধুরী বেচেঁ আছে কথাটা শুনেই প্রীতি কেঁপে উঠলো ৷
” আবেশের সাথে তার চাচা দ্বীপ চৌধুরীর অনেক ভালো সম্পর্ক ৷ চাচাকে ফেরেশতা মনে করে করে ৷ আবেশ চৌধুরী এখন তার বাবার বিশাল ব্যবসা সামলাচ্ছে ৷ পাচঁ বছর আগে তিনিও বিয়ে করেছেন ৷ তার এখন এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে ৷ স্ত্রীর নাম নিরুপমা ৷
প্রীতি কাপঁছে খুব করে ৷ নিজেকে সামলে শান্তকে সে বলল ,
“শান্ত আপনি যান ৷ আমি পরে এদের ব্যাপারে জানবো ৷ আপনি একটু পরে আসুন ৷”
প্রীতির কথা শেষ হতেই শান্ত চলে যায় ৷ শান্ত যেতেই প্রীতি ফাইলটা হাতে নিল ৷ আবেশ চৌধুরীর ছবিটা জ্বলজ্বল করছে ৷ প্রীতি ছবিটার দিকে হাত বুলাতে লাগলো ৷ তার চোখ থেকে পানি পড়ছে ৷ নিচেই তার ভাইয়ের ছেলে , মেয়ের ছবি ৷ প্রীতি কাপঁছে প্রচন্ড ৷ ছোট ছোট ছেলে , মেয়ের ছবি দেখেই নিজের বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলো প্রীতি ৷ ছবি দুটোতে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলো সে ৷
প্রীতি চোখ মুছে নিল দুই হাতে ৷ তারপর ফাইলটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল দৌড়ে ৷
চলবে……