প্রীতিলতা আসবে বলে(পর্ব ৩)

0
638

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
পার্ট :৩

সকালের সোনালী আলো চোখে পড়তেই প্রীতিলতার ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷ নিজেকে বারান্দার এক কোনায় আবিষ্কার করে প্রীতি ৷ কিন্তু বিন্দু মাত্র অবাক হয় না সে ৷ কেননা এই অবস্থায় নিজেকে শতবার আবিষ্কার করেছে সে ৷ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রীতিকাল ৷ যাদের কষ্ট প্রকাশ করার কোনো মাধ্যম নেই ৷ তাদের জন্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস একমাত্র সম্বল ৷ নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার জানিয়ে প্রীতি ফ্রেশ হতে চলে যায় ৷

প্রীতি ফ্রেশ হয়ে অফিসের পথে রওনা হয় ৷ অফিসের সবাই তাকে অনেক ভালোবাসে ৷সবার দুঃখে প্রীতি যেন ছায়ার মতো পাশে থাকে ৷ কিন্তু কারো সাথে কখনো খুব একটা কথা বলে না ৷ কেউ কখনো প্রীতিকে হাসতে দেখে নি ৷ প্রীতির বাড়ীতেও কেউ যায় নি আজ অবধি ৷ বরাবরের মতোই বড্ড রহস্যময়ী সে ৷ সে যেন চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য ৷ হাতের কাছে থেকেও প্রীতি যেন ধরা ছোয়ার বাইরে ৷

প্রীতি সেল্ফ থেকে কিছু ফাইল বের চেক করছিল ৷ হঠাৎ একজন অফিসার তার সামনে এসে মাথা নিচু করে বলল ,

“ম্যাডাম আপনাকে এসিপি স্যার জরুরী ভাবে ডেকেছেন ৷”

প্রীতি মুখে কিছু বলল না ৷ এসিপির রুমের দিকে হাটা দিল ৷ দরজার সামনে যেয়ে বেল বাজাতেই ওপর পাশ থেকে আওয়াজ এলো ৷

“ভেতরে আসো ৷”

প্রীতি ভেতরে ডুকতেই বৃদ্ধ এসিপি গম্ভীর গলায় বললেন ,

“কেন তুমি ঢাকাতে যেতে চাইছো ? আর তুমি যেই কেসটার জন্য যাচ্ছো ৷ ওটা কোনো সাধারন কেস নয় ৷ কেউ যদি ভুলেও ঐ কেসে হাত দিয়েছে ৷ তাহলে আবার একদিনের মধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে ৷ আমি তোমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসি প্রীতি ৷ তুমি আমাকে বাবা হিসেবে না মানলেও আমি তোমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসি ৷ দয়া করে থেকে যাও ৷ আমি চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক ৷ বড় বড় ক্রিমিনালদের হাত অনেক লম্বা ৷ মন্ত্রী ,মিনিস্টার তারা হাতের ইশারায় নাচায় ৷ সেখানে আমরা তো পুটি মাছ ৷ তাই কৌতুহলের বশে নিজের জীবন ঝুকিতে ফেলো না তুমি ৷”

প্রীতিলতা এসিপির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,

“যেসব পুলিশ অফিসাররা ক্রিমিনালদের ভয়ে কেস ছেড়ে দিয়েছে ৷ তাদের সবার পিছুটান আছে ৷ কিন্তু আমার কোনো পিছুটান নেই ৷ ক্রিমিনালরা সব সময় বিপরীত পক্ষের ভালোবাসার জায়গায় আঘাত করে ৷ আমার তো ভালোবাসার মতো কিছু নেই ৷ তাহলে আঘাত করবে কিভাবে আমাকে ? আমার পাথর হৃদয় নরম করার মতো কোনো বস্তু জগৎ সংসারে নেই ৷ তাহলে আমার কিসের ভয় স্যার ?”

এসিপি হতাশ হলো প্রীতির কথা শুনে ৷ প্রীতির দিকে মায়াভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি বললেন ,

“আর কত দিন তোমাকে বলবো আমাকে স্যার ডাকবে না ? আমাকে বাবা ডাকতে পারো না ৷ তোমার ব্যাপারে কত বার জিঞ্জাসা করলাম ৷ কিন্তু কখনো কিছুই বলো না ৷ আমাদের সাথে বাড়িতেও থাকো না ৷ কি করো একা একা সারাদিন ? এখন আবার সিলেট ছেড়েও চলে যেতে চাইছো ৷ তোমাকে চারদিন পর প্লেনের টিকিট কেটে দিয়েছি ৷ কিন্তু তুমি তো কালকের মধ্যেই চলে যাবে ৷আমার কোনো কথা তুমি শোনো না ৷”

প্রীতি এসিপির চোখের দিকে তাকাতে পারে না ৷ এই লোকটার সামনে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখার চেষ্টা করে সে ৷ এই বৃদ্ধ লোকটার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র সাহস দেখায় না প্রীতিলতা ৷ কারন সে জানে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ৷ প্রীতি সেই বেদনা আর ভোগ করতে চায় না ৷ নিজের পাপের তৈরি প্রাসাদের নিচে ভালোবাসার মানুষদের দাফন করতে চায় না সে ৷ কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে অন্ধকার প্রাসাদের ভেতরেই দাফন করে রাখতে চায় সারাজীবন ৷ নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করে প্রীতি বলল ,

“আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি ৷ কারন আমি আপনাদের ভালো চাই ৷ আমি চাই না কোনো কালো ছায়ার আঘাত আপনাদের গায়ে লাগুক ৷ আমার অন্ধকার রাজ্যের ছায়া আপনাদের ওপর ফেলতে চাই না ৷ আর আমার সম্পর্কে সময় হলেই জানতে পারবেন ৷ আর হ্যা ঢাকাতে যাওয়ার পর আমি সময় মতো যোগাযোগ করবো ৷ তাই আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ৷”

এসিপি অসহায়ের মতো প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল ,

“না গেলে হয় না ৷এখানের সবাই তোমাকে ভালোবাসে ৷”

প্রীতি কিছু বলল না ৷এসিপি আবারো বলল ,

“আমার একটা কথা রাখবে প্রীতি মা ৷”

প্রীতি মাথা নিচু করে বলল ,

“চেষ্টা করবো বলুন ৷”

“সিগারেট আর না খেলে হয় না ৷ প্রতিদিন এত এত সিগারেট খাও কেন ? তোমাকে অনুরোধ করছি ছেড়ে দাও ৷”

প্রীতি মাথা নিচু করেই জবাবে বলল ,

“এটা ছাড়া সম্ভব না ৷”

“কেন সম্ভব না ?”

হঠাৎ করেই প্রীতির চোখ লাল হয়ে উঠলো ৷ ওর হাত , পা কাপঁতে লাগলো ৷ ভয়ংকর কিছু অতীত চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো ৷ চোখের কোনায় পানি এসে জমা হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে৷ আহ কি সেই কষ্ট ! প্রীতি নিজের প্যান্টের ভেতর থেকে খুব দ্রুত একটা সিগারেট বের করে ৷ লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে প্রীতি টানতে লাগলো ৷

এসিপি প্রীতির কাছে এসে অনুরোধ করে বলল ,

“আমাকে একটু খুলে বল না মা ৷ কি হয়েছে তোর ? এত গুলো বছরে কি একটুও ভরসা করতে পারিস নি আমাকে ?”

প্রীতি অস্বাভাবিক আচরন শুরু হয়ে গেল ৷ সিগারেটে টান দিতে দিতে প্রীতি বলল ,

“স্যার একটা ছয় মাসের বাচ্চাকে যদি এই সিগারেট দিয়ে পোড়ানো হয় ৷ তাহলে তার কেমন লাগবে স্যার ? খুব কষ্ট হবে তাই না স্যার ৷ একটা মেয়েকে সাত , আট জন মিলে ধর্ষনের পর যদি এই সিগারেট দিয়ে তার দেহে ছেকা দেওয়া হয় ৷ তাহলে তার কেমন লাগবে স্যার ? আচ্ছা আপনি এমন দৃশ্য কখনো নিজের চোখে দেখেছেন ? আর তাও যদি আপনারই পরিবারের সাথে এমন হয় ৷ তাহলে আপনার কেমন লাগবে স্যার ? ”

প্রীতির কথা শুনে এসিপি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ৷ সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ৷ এসিপিকে চুপ থাকতে দেখে প্রীতি বলল ,

“এটা সিগারেট নয় স্যার ৷এটা আমার প্রতিশোধের একটা মাধ্যম ৷ যেটা আজ দশ বছর ধরে আমার সঙ্গী হয়ে আছে ৷ এই সিগারেট আমাকে অতীত মনে করায় ৷ আমাকে বাচঁতে শেখায় শত্রুদের জন্য ৷ ”

এসিপির শরীর যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো চোখের পলকেই ৷ এসিপি প্রীতির কথার ধরন বুঝতে না পেরে বলল ,

“কি সব পাগলের মতো বলছো ? কে কাকে সিগারেট দিয়ে পুড়েছে ? আর কিসের প্রতিশোধ ?”

প্রীতি আস্তে আস্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় ৷ যথেষ্ট স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে সে ৷ এখনকাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না ৷ তাকে যে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকতে হবে ৷

প্রীতি উঠে দাড়ায় চেয়ার থেকে ৷ তারপর সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল ,

” আমাকে যেতে হবে স্যার ৷ ভালো থাকবেন ৷ আর চৌদ্দ বছর আমাকে মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন ৷ আপনার ঋন এই জীবনে শোধ করতে পারবো না ৷ চলি আমি ৷ নিজেদের খেয়াল রাখবেন ৷ আমার ফিরে যাওয়া উচিত কিছু মানুষের জন্য ৷ কোনো একজনকে চোখের ভাষায় কথা দিয়ে ছিলাম ফিরে যাওয়ার ৷ সেই কথা রাখতে হবে আমাকে ৷”

প্রীতিলতা বেড়িয়ে গেল নিজের গন্তব্যে ৷ আর এসিপি তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে ৷

পরের দিন প্রীতিলতা খুব ভোরে সিলেট থেকে ঢাকার জন্য বের হয়ে গেল ৷ গাড়ী চলছে দ্রুত গতিতে ৷ আর প্রীতিলতার মনে পৈশাচিক আনন্দ যেন বেড়েই চলেছে ৷ প্রীতিলতার হাসি মানেই রক্তের বদলে রক্ত ৷ প্রীতিলতার হাসি মানেই খুনের বদলে খুন ৷

রাত হয়ে গেছে ৷ ছোট একটা বাসায় প্রীতি উঠেছে ৷ তার একা থাকার জন্য বেশ চলে যাবে এখানে ৷ একদম নিরিবিলি একটা বাড়ি ৷ কিন্তু তার বাসায় মন বসছে না ৷ সে জানে কোথায় তার মন পরে আছে ৷ না এখনই তাকে যেতে হবে ৷একটু আগের কেনা নতুন বাইকটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল প্রীতিলতা ৷ কেননা তাকে ফিরতে হবে ফেলে আসা অতীতে ৷

অপর দিকে আবেশ চৌধুরী নিজের হাতে একটা ফটো এ্যালবাম নিয়ে বসে আছে ৷ হাত দিয়ে চোখের পানি মুচছে উনি বারবার ৷ আবেশ চৌধুরী নিজের চার বছরের ছেলে আর তিন বছরের মেয়েকে বললেন ,

“এটা তোমার দাদু বুঝলে ৷ অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন ৷ আর এটা তোমার দিদুন ৷ অনেক বড় ডাক্তার ছিলেন সে ৷

আবেশের ছেলে মেয়ে দুটো একটা মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বলল ,

“বাবাই আর এইটা কে ?”

আবেশ চৌধুরী চোখ মুছে বলল,

” এটা তোমাদের ফুপি ৷খুব দুষ্টু ছিল ৷ আমার সব জিনিস কেড়ে খেয়ে নিত ৷ সারা দিন দৌড় করাতো আমাকে ৷এ ত দুষ্টু ছিল যে সব সময় বকা দিতে হতো ৷ কিন্তু দেখ এখন আর দুষ্টুমী করে না ৷ ঐ সর্বনাশা আগুন সব শেষ করে দিল ৷”

অন্যদিকে প্রীতি দাড়িয়ে আছে তার বাবার তৈরি বাড়ীর সামনে ৷ চৌদ্দ বছর আগের তাদের চকচক করা বাড়ির লোহার গেটটা মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে ৷ এখন সেটা ভেঙ্গে নিচে পরে আছে ৷ প্রীতি সামনে এগিয়ে গেল ৷ বাগানের পাশেই বিরাট বড় একটা দোলনা বাবা বানিয়ে দিয়ে ছিল তাকে ৷ ওটার ভাঙ্গা অংশ ছড়িয়ে আছে চারপাশে ৷ চারিদিকে ঘন অন্ধকার ৷ প্রীতি বাড়ির সদর দরজার কাছে গেল ৷ দরজাটা মাকড়সার জালে পেচিঁয়ে আছে ৷ জাল গুলো সরিয়ে সে ভেতরে চলে গেল ৷ পুরো বাড়ী অন্ধকার ছেয়ে আছে ৷ এতটুকু আলো নেই কোথাও ৷ কালো ধোয়া আর ময়লায় এটা ভুতুড়ে বাড়ীর মতো হয়ে গেছে ৷ সিড়ি গুলো প্রায় ভেঙ্গে গেছে ৷ প্রীতি সাবধানতার সাথে উপরে উঠে গেল ৷ একটা ঘরের সামনে এসে সে থেমে গেল ৷ তাকিয়ে রইলো প্রীতি একদৃষ্টিতে ৷ প্রীতি দৌড়ে ঘরটাতে ঢুকে যায় ৷একটা দেওয়ালের কাছে যেয়ে হাউমাউ করে কেদেঁ দেয় সে ৷ হ্যা এই জায়গাটাতেই তার ছোট ভাইটাকে সবাই মিলে আছড়ে মেরেছে ৷ ফ্লোরের হাত দিয়ে কাদঁতে লাগলো সে ৷ হ্যা এখানেই তার ভাইয়ের মগজ গুলো ছিটকে পরে ছিল ৷আর একটু দুরে যেয়ে চিৎকার করে কাদঁতে লাগলো প্রীতি ৷ হ্যা এখানেই তার বাবাকে ওরা নির্মম ভাবে মেরেছে ৷ তার বাবার পায়ের কাছেই ছোট ভাইটার লাশ পরে ছিল ৷ মায়ের লাশটা ছিল নরম বিছানার উপর ৷ যেই জায়গাটা এখন শূন্য ৷

প্রীতিলতা কাদঁতে লাগলো চিৎকার করে ৷ চিৎকার করতে করতে প্রীতি বলল ,

“তোমরা কেন এভাবে চলে গেলে বাবা ? আমি ভালো নেই ৷ আমি একটুও ভালো নেই ৷আমার জীবনে কোনো সুখ নেই বাবা ৷ আমি ঘুমাতে পারি না ৷ আমি ওদের ছাড়বো না ৷ ছাড়বো না আমি ৷ ওদের কাউকে ছাড়বো না আমি ৷”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here