প্রিয় তুই পর্ব ৯

0
526

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৯

তিতাস বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে বাসার পথে রওনা হলো। তার মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত রুপ ধারণ করেছে। মস্তিষ্কে ঘুরছে চিন্তার পাহাড়। তার একটাই প্রার্থনা, ভোর যেন পাল্টি না খায়। তাহলেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তখন
সবটা একা সামলানো তার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। আর এই মুহূর্তে ভোরকে তার বাবা-মায়ের কথা জানানো উচিত।
এটা লুকিয়ে রাখার ব্যাপার নয়। তবুও সে চেপে গিয়েছিল, পূর্বের কথা ভেবে। তাছাড়া ভোরের বাবা মায়ের সঙ্গে যখন তখন ভালো ম/ন্দ কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।উনারা প্রতি
সেকেন্ডে বাঁচার জন্য যু/দ্ধে করে যাচ্ছেন। হয়তো হাল ছেড়ে দেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। অবস্থার উপর ভিত্তি করে, সে চায়লেও আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এরচেয়ে এখন জানানোই শ্রেয়। এসব ভেবে সে বাসায় গিয়ে কাউকে পেলো না। ঘড়িতে তখন ছয়টা ছাব্বিশ।পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, ভোরের আগমনী বার্তা। সিগ্ধ শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে পৃথিবীর বুকে। কিন্ত কিছু মানুষ পারছে না, এই আবহাওয়া উপভোগ করতে, প্রশান্তি টুকু লুফে নিতে। তিতাস অস্থির চিত্তে একে একে সবাইকেই কল দিলো। কিন্তু কেউই রিসিভ করলেন না। কল হতে হতে কেটে গেল। এবার সে দ্রুতপায়ে গেল দারোয়ানের কাছে। উনি হয়তো কিছু বলতে পারবে, তিতাসকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে দারোয়ানই তড়িঘড়ি করে উঠে আসলেন। না জিজ্ঞাসা করার আগেই জানালেন, সবাই হসপিটালে গেছে।
উনাদের যাওয়া ঘন্টা দু’য়েক হচ্ছে। তারমানে তিতাস আসার পরপরই তারা হসপিটালে পৌঁছেছে।তিতাস যা বোঝার বুঝে গেল।সে তড়িঘড়ি পোশাক বদলে আবার ছুটল হসপিটালের পথে। না জানি ওখানকার কি অবস্থা!

তিতাসের বাবা- মা চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছেন। চাচী রোজাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। তখন তিতাস দ্রুতপায়ে হেঁটে সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে ওর মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
-”এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? ভোরের বাবা-মা..।’
-”জানি, ভোর কোথায়?”
-”ভেতরে।”
-”আচ্ছা দেখছি।”
একথা বলে তিতাস দৌড়ে ভেতরের দিকে ছুটে গেল। ভেতর বোর্ড বসানো হয়েছে। ভোর বাবা-মায়ের উন্নত চিকিৎসার
ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে ডাক্তার আনা হোক, নয়তো জুরুরিভাবে উনাদের বাইরের দেশে পাঠানো হোক। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা একথায় দ্বি-মত পোষণ করলেন।
কারণ রোগী এত ধকল সহ্য করতে পারবে না। এমনও হতে
পারে যাওয়ার পথেই সব শেষ।একথা শুনে ভোর নেত্রজোড়া
বন্ধ করে ঢোক গিলল।একবুক সাহস নিয়ে শেষ চেষ্টা করার
আগ্রহ দেখাল। তিতাস অদূরে দাঁড়িয়ে ভোরকে দেখছে। কী সুন্দরভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। অথচ বাবা-মায়ের জন্য তার প্রাণ কাঁদছে, পু/ড়/ছে। আলোচনার শেষ পর্যায়ে একজন নার্স ছুটে এসে খবর দিলেন, ভোরের বাবা রেসপন্স করছেন না। একথা শুনে ভোর দৌড়ে গিয়ে চেক করে, একবার, দুইবার, বহুবার, সত্যিই তার বাবা নেই।
তবুও সে তিতাসকে আরেকবার দেখতে বলল। তিতাস দেখে না বোধক মাথা নাড়াল অর্থাৎ নেই, উনি মারা গেছেন। ভোর
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। জোরে জোরে বার কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে স্থির দৃষ্টিতে বাবার মুখপানে চেয়ে থাকে।কিন্তু তিতাসের কপালে ভাঁজ পড়ল অক্সিজেন মাক্স বেডের নিচে পড়ে থাকতে দেখে।সে নিজে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে নার্সকে
বারবার খেয়াল রাখতে বলে তারপর বেরিয়েছিল। তাহলে কেউ সেটা খুলে দিলো?নাকি ছটফট করাতে পড়ে গিয়েছে? তিতাস পরখ করতে দুই ধাপ এগোতেই ভোর বলল,
-”তিতাস!”
-”হুম।”
-”বাবা মারা গেলেন কেন জানিস?”
-”কেন?”
-”আমি লাল শাড়ি পরেছি তাই। আমি আর কখনো লাল শাড়ি পরব না। নয়তো তুইও….! ”

তিতাস জবাবে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। মেয়েটা পুনরায় মনে ভুল ধারণা পোষণ করল। তবে এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না তাই চুপ রইল। ভোর তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে, এটা দেখে তিতাস কিঞ্চিৎ খুশি হলো। তবে সেই খুশি প্রকাশ না করে গোপনে নিজের কাছেই রেখে দিলো। ঘন্টা খানিক পরে, ভোর এই দুঃসংবাদটা তার ভাইদের জানাল। উনারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল আর ভোর নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেল। ভোরের ছোট ভাই নিশাদ ইতালিতে থাকে। আর বড় ভাই মিশান নিজের ব্যবসার কাজে কাতারে গিয়েছেন। উনারা কেউই আসতে পারবেন না। এজন্য তিতাসই নিজের দায়িত্বে লা/শ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। তারপর সে
ভোরকে নিয়ে গেল ভোরদের বাসায়। সেখানে ভোরের ভাবি আর ভোম্বল ছাড়া কেউ নেই। ভোম্বল দাদুকে দেখে চিৎকার করে কাঁদল। কোলে যাওয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়েও দিলো।
তবুও কোলে নিচ্ছে না দেখে ভোরকেও অভিযোগ জানাল।
তারপর নিকট আত্নীয়দের উপস্থিতিতে আসর পরে ভোরের বাবার দাফনকার্য সম্পূর্ণ করা হলো। একে একে সবাই বাণী ছড়িয়ে বিদায় নিলো। তবুও ভোর কাঁদল না, শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখে গেল।স্বচ্ছ দিন পেরিয়ে রাতের আগমন হলো। ধীরে ধীরে সময় বাড়তে লাগল। বড় ভাবির বাবা-মাকে ভাবির কাছে থাকতে বলে পুনরায় হসপিটালে এলো, রাত আর তিতাস। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা।তিতাস ভোরকে তার আম্মুর কেবিনে রেখে নিজের কাজে চলে গেল। আর ভোর ওর আম্মুর হাতখানা কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। আর ওর দু’চোখ দিয়ে ঝরে গেল অবাধ্য নোনাজল।

এর ঘন্টা দু’য়েক পর, তিতাস নার্সের সঙ্গে কথা বলে ভোরের পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে ভোরকে ডেকে বাইরে যাওয়ার ইশারা করল। ভোর আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে
গিয়ে দাঁড়াতেই তিতাস বলল,
-‘গাড়ি এসে গেছে বাসায় চলুন।”
-”আমি আজ এখানে থাকব।'”
-”ভোর অহেতুক জেদ করবেন না, যেতে বলছি যাবেন।”
-”এ ব্যাপারে কথা বাড়াস না, ভালো লাগছে না।”

তিতাস আর কথা বাড়াল না। ভোরের বাহু ধরে বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। ভোর ছাড়াতে চায়লেও পারল না। ওরা গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা বাচ্চা পথ আগলে দাঁড়াল। তার
বয়স দশ থেকে বারো। হাতে চায়ের ফ্লাক্স। হয়তো ঘুরে ঘুরে
চা বিক্রি করে। তখন তিতাস বলল,

-”সমস্যা কি ছোটভাই?”
-”চা খাবেন?”
-‘না অন্যদিন, এখন মন ভালো নেই।”
-”এই নিন, এটা আপনাকে দিতে বলেছে।”
-”কে দিতে বলল, আর কি এটা?”
-”কাগজের চিঠি।”

তিতাস ভোরের বাহু ছেড়ে চার ভাঁজ করা চিরকুটটা খুলে পড়ল,

-”আমার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিস বুঝি? আহারে, বেচারা! তা ওকে আর কতদিন এভাবে রাখবি? না নিজে খাচ্ছিস আর না আমাকে খেতে দিচ্ছিস! এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না, ছোটভাই। এরচেয়ে পাখিটাকে আমার হাতে তুলে দে, আমি আমার ইচ্ছে মেটায়।”

তিতাস চিরকুটটা পড়ে ছিঁড়ে বিরক্ত মুখে ভোরকে বলল,

-”আমাকে দেখে কার যেন খুব খুব পছন্দ হয়েছে। সে নাকি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমার রুপে সে পাগল দিওয়ানা।
ফোন নাম্বার চাচ্ছে। নয়তো বাসায় যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এর কোনো মানে হয়? কিছু কিছু মেয়ে এত্ত হেং/লা বলার বাইরে। একথা আবার চিরকুটে লিখে পাঠাচ্ছে। ছিঃ! এখন
আমারই লজ্জা লাগছে, দেখুন তো লজ্জায় আমার গাল লাল হয়েছে নাকি? হয় নি, না? বোধহয় একটু পরে হবে।”

তারপর ভোরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে থাকল নির্দিষ্ট পথ ধরে। ভোরকে সন্দেহ করা সুযোগও দিলো না তিতাস। তবে সে রাগে ফেটে পড়ছে।
মনে হচ্ছে, সবকিছু ভেঙে গু/ড়ি/য়ে দিতে। অথচ ওর রাগের বর্হিপ্রকাশ নীরব, নিশ্চুপ। ভোর সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে।
মলিন মুখ, বন্ধ চোখ।তিতাস ভোরের দিকে সরে বসে মাথায় হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিতে থাকল।ভোর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাল। বয়সে ছোট, অথচ ছেলেটা দায়িত্ব পালনে তৎপর। আজ সারাদিন তার ছত্রছায়া হয়ে থেকে তিতাস। কোনোভাবেই তাকে একা ছাড়ে নি। তখন ভোরকে নিশ্চিত করতে তিতাস বলল,

-”আন্টিকে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। নার্সরাও সজাগ। তাছাড়া ঘন্টা দু’য়েক পরে আমি আবার আসব। আজকের রাত সেখানেই থাকব তাই দুঃচিন্তার কিছু নেই।”

ভোর এই মুহূর্তে গভীরভাবে অনুধাবন করল,দুঃসময়ে এমন কথা বলার একজন মানুষের বড্ড দরকার। যার শক্ত হাতটা আঁকড়ে ধরে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর সাহস হবে। তার বিশ্বস্ত কাঁধে মাথা রেখে শান্তি খোঁজা যাবে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলে অজুহাত দেখিয়ে একটু কেঁদে নিতে পারবে। সময় অসময়ে
প্রশস্ত বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে নিজের অবস্থানটা পরিমাপ করা যাবে। যার হৃদস্পন্দের গতিতে নিজের নাম অনুভব করতে পারবে।এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের চোখজোড়া এমনিতেই বুজে এলো। মাথা ব্যথায় জর্জরিত ভোর আরাম পেয়ে ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমাল। শ্বাস-প্রশ্বাসও ঘন হলো। তখন তিতাস অতি সন্তর্পণে ভোরের মাথাটা তার বুকের উপর রাখল। এক মিনিট, দুই মিনিট, করে কিছু সময় অতিবাহিত হলে ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে তিতাস বলল,

-”ভালোবাসার অভিনয়ে মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও পারদর্শী।
এর জলজ্যান্ত প্রমান, আমি।”

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here