প্রিয় তুই পর্ব ৩১

0
687

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_৩১

ভোর আজ তৃপ্তি সহকারে তিতাসের হাতে পেটপুরে খাবার খাচ্ছে। কেন জানি তার ভালো লাগছে, মনে প্রশান্তি অনুভব করছে। কোনোভাবেই দ্বিধা কাজ করছে না। সংকোচে মুখও মলিন হচ্ছে না। বরং স্বপ্নটা দেখার পর থেকে সে তিতাসের প্রতি টান অনুভব করছে। বার বার মনে হচ্ছে, তিতাস তার। আর তাকে ওরই আগলে রাখতে হবে। মায়ার বাঁধনে বন্দি
করতে হবে যেন এই বাঁধন কখনোই ভাঙতে না পারে। ভোর এবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নিজেই এগিয়ে গেল, আরো এক ধাপ। হোক নিন্দা, হোক তীব্র রুপে সীমা লঙ্ঘন। তবুও সে কোনো কিছুর পুরোয়া করবে না। জীবন তার, মর্জি তার। এবার ভালো থাকার প্রয়াসে নেওয়া সিদ্ধান্তও তার। অনেক হলো রাখ ঢাক চুপিচুপি ভালোবাসা বিনিময়। এবার নাহলে উন্মুক্ত হোক ওর প্রণয়কাব্য। তিতাসকে জানিয়ে দিক, সেও হৃদয়ের দ্বার খুলে তিতাসকে সাদরে স্বাগতম জানাচ্ছে। এই কথাগুলো ভোর তিতাসের পানে তাকিয়ে ভাবছিল। তখন
ওকে রাগানোর জন্য তিতাস বলল,

-”কে যেন একদিন বলেছিল জুনিয়র ছেলেকে বিয়ে করবে না। অথচ এখন…!”
-”তো?”
-”প্রমাণ পেলেন?”
-”কিসের প্রমাণ?”
-”এই যে জুনিয়ররাও ভালোবাসতে জানে, বউয়ের আবদার মিটাতে পারে।”
-” একটা আবদার পূরণ করে এত গর্ব?”
-”আরো আছে নাকি?”
-”অবশ্যই সাহেব।”
-”আগে শুনি, কী কী আবদার আছে আপনার?”
-”তুই আমার কে?”
-” সিনিয়র জুনিয়র কাটাকাটি করে শুধুমাত্র প্রিয়তম।”

তিতাসের জবাব শুনে ভোর মনে মনে হেসে তিতাসকে খেয়ে আসতে বলল। তারপর শুয়ে শুয়ে নাহয় ওর আবদারগুলো জানাবে। একথা শুনে তিতাস কথা না বাড়িয়ে খেয়ে আসল। তখন ঘড়ির কাঁটা চারের ঘরে।ভোর শুয়ে ফোন স্কল করছে। তিতাস পাশে শুয়ে ফোনটা কেড়ে ভোরকে তার দিকে ঘুরিয়ে
বলতে ইশারা করল। ভোর আজ সংকোচ দূরে ঠেলে বলল,

-”সর্বপ্রথম আবদার তোকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতে দে। আমার সকল চাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে আমার তোকে’ই চাই।
আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোর সঙ্গ চায়। বয়সে ছোট বড় হিসাব নির্বাসনে পাঠিয়ে একে অপরের পরিপূর্রক হতে চাই। তোকে সঙ্গে নিয়ে সুখরাজ্য গড়তে চাই। রাতের সোডিয়ামের নিয়ত আলোয় তোর সঙ্গে হাঁটতে চাই, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতেও চাই। বিনাসংকোচে তোর প্রশস্ত বুকটা আমার নামের দলিল করতে চাই, তোকে আমার সকল আবদার পূরনের সম্পূরক করতে চাই। তোর কোনো আবদার নেই?”

-”আছে তো। আমারও অনেক আবদার আছে। আর আমার সর্বপ্রথম আবদার, আমি চিরকাল আপনার #প্রিয়_তুই হয়ে থাকতে চাই। ”

-“সম্বোধন এবার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন আমাদের।”

-”আনব তো। এবার আপনি তুই থেকে তুমিতে নেমে আসুন আর আমি আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসি। তবে আগেই বলে দিচ্ছি, চার দেওয়ালে মাঝে আমাদের সম্বোধন আপনি তুইতে সীমাবদ্ধ থাকবে, ঠিক আছে?”

-”কেন?”

-” কারণ আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছে তুই আর আপনিতে। তাছাড়া নিজেরা ঠিক থাকলে সম্বোধনে আর কী এসে যায় বলুন?”

-”হুম।”

এভাবে কথা বলতে বলতে দু’জনে ঘুমিয়ে গেল। তবে আজ ভোরের মাথা রাখার স্থান ছিল তিতাসের প্রশ্বস্ত বুকে। আর সেখানে মাথা রেখে প্রশান্তি লুফে নিয়ে ভোর আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। চটজলদি ঘুমাতে দেখে তিতাস নিঃশব্দে হেসে ওকে
শক্ত করে চেপে ধরেছে বুকের সঙ্গে। পরপর ঠোঁট ছুঁইয়েছে, ভোরের চোখে, ঠোঁট, গালে। সে আজ আবার প্রমাণ পেলো, মেয়েরা হচ্ছে তরল পদার্থ। তাদের যখন যে স্থানে রাখা হবে তারা সেখানেই নিদারুন ভাবে জায়গা দখল করবে। আর এর জলজ্যান্ত উদাহরণ ভোর। এসব ভেবে সেও নেত্রজোড়া বন্ধ করে নিলো।

এর প্রায় মাস দু’য়েক পরের ঘটনা,

এই দুইমাসে সবকিছু ঠিক ভাবেই চলেছে। কোথাও কোনো ভাবে বিপত্তি ঘটতে দেখা যায় নি। তিতাসেরও ইন্টার্নি শেষ। সে এবার পরের ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোর রেগুলার রোগী দেখে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পার করছে। বর্তমানে সে সরকারী ও বেসরকারি দুই হসপিটালেই সময় দেয়। সঙ্গে চলমান প্রাপ্ত ডিগ্রী অর্জনের জন্য পড়াশোনা। রোজাকে নিয়েই তিতাসের মায়ের সময় কেটে যায়। বাসার ঝুটা কাজের বুয়া রেখেছে তিতাস। উনারা সব কাজ করে দিয়ে যান। তিতাসের বাবার ব্যবসাতে বেশ উন্নতি দেখা দিয়েছে। পূর্বের ন্যায় ফুলে ফেঁপে উঠছে উনার ব্যবসা। তবে ছোট্ট রোজা দু’তিনদিন কেঁদেছে আম্মু যাবো বলে। কিন্তু শাহিনা মেয়ের খোঁজে আসে নি। সে মজে আছে নিজের ভুবনে।ঘৃণা/য় কেউ উনার খোঁজও নেয়
নি। যারা টাকার পোকা টাকার লোভ তাদের বিবেক নড়বড়ে করে দেয়। ওরা ডানে বামে যেদিকে যাক লাভের দিক আগে ভাবে। যেমন শাহিনা নিজের অসুস্থ মেয়েটাকে চোখের দেখা ভুল করেও দেখতে আসে না, খোঁজও করে না। তবে ঠিকই তিতাসদের পূর্বের বাসাটা নিজের নামে করে নিয়েছে। সেটা বিক্রি করার ফন্দি এঁটেছে। তিতাস কিছু করতে চায়লে, ওর
বাবা ছেলেকে আঁটকে দিয়েছেন। এসব ঝোটঝামেলা উনার পছন্দ নয়। বাসা নিচ্ছে নিক, তবুও উনার যা আছে তিতাস আর রোজার অভাব হবে না। আর সারার মৃ/ত্যু/র খবরটা কেন জানি ধামাচাপা পড়ে গেছে।পুলিশের টেবিলে রাখা শত শত ফাইলের নিচে চাপা পড়ে গেছে সারার মৃ/ত্যু/র রহস্যও।
এখন সবকিছু ভালোই হচ্ছে। তিতাসের চঞ্চলতায় সকলকে
ভালো রেখেছে।

আজ শুক্রবার। তিতাস আর ভোর দু’জনেই বাসায় থাকবে।
গতরাতে দু’জন রুম নোং/রা করা নিয়ে ঝগড়া করেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়েও ফেলেছে। এই নিয়ম তিতাস জারি করেছে।বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেলেও পাঁচ মিনিটের বেশি ওরা কথা বলা বন্ধ করবে না, রুমও আলাদা না হয়। বরং ঝগড়া শুরু যে করবে তাকেই অপর ব্যক্তিকে আগে জড়িয়ে ধরতে হবে, মান ভাঙাতে হবে। কিন্তু ভোর এর বিরোধিতা করেছে।
তার ভাষ্যমতে, দোষ যারই হোক ‘ সরি ‘ তিতাসকেই বলতে হবে। কারণ এটা ওর বর গত দায়িত্ব। ভালো বরটা সবসময়
নিজেদের হার মেনে নেয়, তিতাসকেও মানতে হবে। তিতাস ভোরের সঙ্গে এই নিয়েও খোঁচাখুঁচি করে পরে নিজেই সরি বলে। পরিশেষে তিতাস রুম গুছিয়ে বেলকনিতে বসে চন্দ্র বিলাস করেছে, সঙ্গে খুনসুটিময় মুহূর্ত। তবে তিতাস আগে খুব আফসোস করতো ভোর আবদার করত না তাই।অথচ
এখন বউয়ের আবদারের ঠেলায় নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে
তাকে। তিতাস সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ওর বাবার কাছে গেল। তারপর বাবার প্রেশার মেপে ওষুধ লিখে কাগজখানা হাতেই ধরে রাখল। ওর বাবা এক হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে বললেন,

-”ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছি ভিজিট দেওয়ার জন্য? ”

-”ভাবতেও অবাক লাগে তুমি আমার বাবা।”

-”মানে?”

-”বিয়ে করেছি সবে কয়েক মাস হলো, বাবা হয়ে হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে তা না করে ঘাপটি মেরে বসে আছো। এটা কী দায়িত্ববান বাবার কাজ, তুমিই বলো?”

-”আমি তো ভোরকে জিজ্ঞাসা করেছি, সে যে বলল এখন ছুটি নিতে পারবে না। পরে কোথাও থেকে ঘুরে আসবে।”

-”সে পুত্রবধূ হয়ে শশুড়কে কীভাবে বলবে, ‘বাবা আপনার ছেলের সঙ্গে আমি হানিমুনে যেতে চাই।’ তোমার শরীরের সঙ্গে বুদ্ধি গুলোই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বাবা।”

-”বেদ্দপ, দূর হ আমার সামনে থেকে।”

-”তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করো নয়তো দেখাবো না কিন্তু? ”

-”কী দেখাবি না?”

-”তোমার নাতি-নাতনীদের চাঁদমুখ।”

-”আশ্চর্য, নাতি নাতনীদের মুখ দেখতে হলে হানিমুনে যেতে হবে? আমি তো তোর মাকে নিয়ে হানিমুনে যায় নি, তোরা তো ঠিকই পৃথিবীতে এসেছিস।”

-”আমার দাদা- দাদীমা তোমার মতো আহম্মক ছিলো না।
এজন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে। তুমি কি করো, আমি ফ্রি হয়ে
রুমের ঢুকলেই তো চেঁচাও, ‘তিতাস পানির বিল দিয়ে আয়, তিতাস ফাইল টা দেখে দে, তিতাস ওমুক কর, তমুক কর। তাহলে কীভাবে কী হবে বলো?তাই বলছি এবার স্পেস চাই, স্পেস দাও।”

-”এক্ষুণি আমার মুখের সামনে থেকে সর, ফাজিল ছেলে।”

তিতাস টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে হেলেদুলে চলে গেল। ছেলের কথায় তিতাসের বাবা থম মেরে বসে রইলেন। তিতাস এবার
ভোরকে খোঁচাতে গিয়ে দেখে ওর আম্মুও সঙ্গে আছে। তাই সেখান থেকে ফিরে এসে রোজার কাছে গেল। রোজা ফোনে গেম খেলছে। তিতাস রোজার চুল টেনে ওর আধখানা মিষ্টি রোজার মুখে পুরে বলল,

-”এই মিষ্টিটাতে বি/ষ মিশানো ছিলো। আমার একা একা মরতে ইচ্ছে করছে না তাই তোকেও খাওয়ালাম।”

-”এটা কি করলে ভাইয়া? আমি ম/রে গেলে আমার পুতুলটা কার কাছে রেখে যাবো?”

-”আমি আমার বউকে রেখে মরতে পারলে তুই পুতুল রেখে মরতে পারছিস না, ছিঃ রোজ ছিঃ।”

তিতাসের কথা শুনে রোজা একগাল হেসে ফোনটা পাশে রাখল। তিতাস ভোরের ফোনটা নিয়ে ভোরের ছবি দেখতে থাকল। ওর চোখে একরাশ মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।
রোজার দৃষ্টিও ফোনের দিকে। হঠাৎ রোজা একটা ছবি দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

-”আরে এই লোকটা তো আমার আম্মু সঙ্গে ঘুমায়।”

-”কোন লোকটা ডান পাশের টা নাকি বাম পাশের টা।”

ভোর তার আঙুল দিয়ে বাম পাশের জনকে দেখিয়ে দিলো। তিতাস কৌতুহলবশত পুনরায় একই কথা জিজ্ঞাসা করল। রোজা পূর্বের মতো বাম পাশের জনকেই দেখিয়ে দিলো। সে এটাও বলল, তার ভুল হচ্ছে না। কারণ ওর আম্মু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম করে ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করতো। প্রায় দিন তাকে একটা রুমে বসিয়ে রেখে তার আম্মু কোথা চলে যেতো। পরে অনেকক্ষণ পর ফিরে আসতো সঙ্গে ওই লোকও থাকত। রোজার কথা শুনে তিতাস ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। কারণ ওর করা এতদিনের অনুমান সব ভুল ছিলো। তাহলে এই খেলার আসল খিলাড়ি নিশান নয় স্বয়ং মিশান চৌধুরী।

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here