প্রিয় তুই পর্ব ৭

0
559

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৭

-”আম্মু একগ্লাস পানি দাও।’

কথাটা বলে তিতাস বসল। ঘামে ভেজা শার্টের দু’টো বোতাম খুলে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিলো। ক্লান্তিতে দেহখানা ভেঙে আসছে। রোজ কতশত রোগীরা বিদায় হচ্ছে, পরক্ষণে তিন গুন এসে জায়গা দখল করছে। দম ফেলাবারও উপায় নেই। হাও কাউ চেঁচামেচি তো আছেই।তাছাড়া আজকাল যেভাবে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে, না এসেই বা উপায় কি! পন্ডিত কিছু
ব্যক্তিরা, একবেলা খাওয়া বন্ধ রাখবে তাও বাচ্চা উৎপাদন করা থামাবে না। তাদের যুক্তিও তৈরি করা আছে, খাওয়াবে তারা, পালবে তারা, ডাক্তারের কথায় কেন বাচ্চা নিবে না?
ডাক্তার কি একবেলা খেতে দিবে? নাকি ভিজিট ছাড়া রোগী দেখে দিবে? মূলত এদের বোঝানোই দায়। তাছাড়া হতভাগা
কিছু ডাক্তার তো আছেই সেবা প্রদান করতে। দিন রাত এক করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে হাড় মাস ক্ষয় করতে। একদল মানুষ বলে, ‘আহা, ডাক্তারদের জীবন কতই না সুখের! শুধু টাকা আর টাকা। এদের টাকার রাখার অভাব নেই। ‘ অথচ কত ঠ্যা’লা’ সামলে ডাক্তার হয় এই কষ্ট চোখে পড়ে না। এই সমাজও তাই, সর্বদা চোখের সামনে যা আসে তাইই বিশ্বাস করে। আগে পিছে ভালো মন্দ কিছু থাকে ভেবেও দেখে না।
যেমন আজ বিকেলের ঘটনা, হসপিটালে এক মহিলার ছয় নাম্বার বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে। দু’জনে ভালো
আছেন। তবে উনার পূর্বের ছয়টা মেয়ে আছে, আর এবারও মেয়ে হয়েছে। মহিলার স্বামী তখন বিরস মুখে বসে ছিলেন। উনি আশা করেছিলেন ছেলে হবে, আশা ভঙ্গ হওয়াতে মুখ মলিন হয়ে আছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ থম মেরে বসে সদ্য জন্মানো মেয়েটিকে কোলে নিলেন, কপালে, গালে, আদর দিলেন। আলতো স্পর্শে নাক ছুঁয়ে হেসে বললেন,”পরেরবার তোমার ভাই হবে, তাই না মা?”
অর্থাৎ উনি নতুন উদ্যমে আবার বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তিতাস তখন নাস্তা সারতে যাচ্ছিল। তার অভ্যাস, নতুন বাচ্চা কোলে নেওয়া পর বাবারা কিভাবে খুশি প্রকাশ করে, সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা। কেন জানি ভালো লাগে তার। মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য এটা।
এতদিনে ওর ভালো মন্দ সব রকমের অভিজ্ঞতায় হয়েছে। কাউকে বাচ্চা কোলে নিয়ে খুশিতে কাঁদতে দেখেছে। কাউকে হেলা করে দূরে সরিয়ে দিতে দেখেছে। এমনও দেখেছে, দুই মেয়ে হওয়াতে অন্যকে বাচ্চা দিয়ে দিতে। বিনিময়ে টাকা নিতে। কতটা পাষাণ, নির্দয় তারা! এসব চোখে দেখেও কিছু বলার থাকে না। কিন্তু আজকের ঘটনা দেখে সে লোকটার কাছে গিয়ে বলেছে,
-”ভাই, ট্রেনের বগির মতো একের পর এক বগি বানাতেই আছেন দেখছি। তবে দোয়া করি, আপনার উদ্দেশ্য যেন সফল হয়। পুরো দমে ষোলোটা বগি নিয়ে যেন একটা ট্রেন বানাতে পারেন। বউ মরলে মরুক, তাও উদ্দেশ্য ভুলবেন না, ঠিক আছে?’

একথা শুনে লোকটা কথা মাথা নিচু করে ফেলেছে। ডাক্তার
জেনে কথা বাড়ায় নি। তবে তিতাসের করা অপমান ঠিকই বুঝেছে। তিতাস তার কাজ সেরে আজ তাড়াতাড়িই ফিরতে চেয়েছিল, হলো কই। রবিনের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়েছিল, তখন আবার রোগী আসল। রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সময় গড়িয়ে দেরিও হয়ে গেল। তবে আজ বাসার পরিবেশ
দেখে অবাক হলো। বিশেষ করে ড্রয়িংরুমের টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল চলছে না। তার মা ও চাচীকে আশেপাশেও দেখছে না। ভোরের রুমের দরজা বন্ধ। রোজাও সাড়াশব্দ নেই। সে পানি চায়ল তবুও কেউ আসল না। আশ্চর্য আজ হলো কি!
এমনিতেও বাসায় যুদ্ধ হওয়ার কথা। বাবা-মায়ের মধ্যে খুব ভালো মতো প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছে। সে আসার আগেই সব যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল নাকি? তাছাড়া বাবা কি বাসায় আছেন? নাকি উনাকে বের করে দেওয়া হয়েছে? ঠিকই আছে, বলবে আর প্রাক্তনের সঙ্গে কথা? বেশ হয়েছে। তার নামে বদনাম করা না, আর করবে? না এভাবে ঠিক জমছে না ব্যাপারটা, বাবা না খোঁচালে বসেও শান্তি পাচ্ছে না। তিতাস এবার তার বাবাকে কল দিলো কিন্তু উনি রিসিভ করলেন না। বরং কল কেটে দিলেন। তখন ভোর দরজা খুলে এসে তিতাসকে পানি দিলো। মুখ থমথমে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। তিতাস বিরক্ত হলো। মেয়েটা আবার কেঁদেছে। কান্না ছাড়া বোধহয় এর কাজ নেই। একে কিছু কাজ দিতে হবে কাল থেকে। যেন কান্নার সময়টুকু না পায়। যখন অতিরিক্ত কান্না পাবে তখন যেন তাকে বলে, ”একটু সময় দে তো তিতাস, আমার না খুব কান্না পাচ্ছে। একটু কেঁদেই বাকি কাজ গুলো করব।” এসব ভেবে সে মুখের পানি গিলতে যাবে তখন ভোর বলল,
-”এখন বিয়ে করবি আমায়?”

ভোরের এ কথা শুনে তিতাসের গলায় পানি আঁটকে কাঁশতে
শুরু করল। কাশির চোটে চোখে পানিও এসে গেল। তবুও কাশি থামল না। তারপর নাক চেপে ধরে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। ভোর তখনো ওর উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তিতাসের দিকে নিবদ্ধ। তখন তিতাস নিজেকে সামলে বলল,

-” কি যেন বললেন?”
-”চল উঠ, কাজি ডাক, আমরা এই মুহূর্তে বিয়ে করব।”
-” মাথা ঠিক আছে?”
-”বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে এখন বুঝি বিবেকে বাঁধছে?”
-”কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
-” জবাব দে, নয়তো আমাকে বাসায় যেতে দে।”
-”রাগ, জেদ, মানুষকে ক্ষতির মুখে ধাবিত করে। কি হয়েছে, আমাকে বলুন? আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

ভোর জবাব না দিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু তিতাসও আসল। সদর দরজায় তালা, ভোর বের হতে না পেরে সমানে চেঁচাচ্ছে। দারোয়ান মুখ কাচুমাচু করে অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি বুঝছেন না এখন কী করবেন। তবে তিতাসকে দেখে একটু ভরসা পেলেন। যা করার তিতাস করুক। তখন তিতাস এসে বিনাবাক্য ভোরকে টেনে বাসার দিকে হাঁটা ধরল। ভোর কিছুতেই তার হাত ছুটাতে পারল না।
বরং শক্ত পুরুষালি হাতের চাপে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল।
তিতাস তাকে সোজা ড্রয়িংরুমের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। তারপর পুনরায় জানতে চায়ল এমন করার কারণ।
তখনো তিতাসের কন্ঠস্বর, শান্ত, স্থির। ভোর শক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে কষ্টে তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু করছে। যেতে পারলে সকালেই চলে যেতো। তার এখানে আসার শখ মিটে গেছে। না আসলে এতকিছু হতো না, আর না তাকে এভাবে অপমান করার সাহস পেতো। বার বার তার ক্ষ’তে’ এভাবে খোঁচানোর মানেই হয় না। এমনিতেই তার ভেতরটা অদৃশ্য অনলে ঝ’ল’সা’নো’। তখন তিতাস তার মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল,

-” রোমান্টিক মুভি টুভি দেখেছেন নাকি বিয়ে বিয়ে করছেন যে হঠাৎ?”
-”থাপ্পড় খেতে না চায়লে ফাজলামি বন্ধ রাখ।”
-”আরে বাবা, সমস্যা না বললে বুঝব কিভাবে?”
-”কি বলব হ্যাঁ, কি শুনবি তুই?”
-”আমার অনুপস্থিতিতে যা ঘটেছে তাই বলুন।”
-”তোর বোন সারা আমাকে কল করে বলেছে, আমি ন’ষ্টা’মি’ করতে এখানে এসেছি। পিয়াস আমার দেহের ক্ষু’ধা মেটাতে পারে নি, এজন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে গোপনে তোকে পটিয়েছি!
তোর সংস্পর্শে দিন দিন সুন্দর হচ্ছি। শরীরের ভাঁজ দেখিয়ে
তোর মাথা ঘুরিয়েছি, তাই তুই আমাকে বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিস। না জানি তুই ছাড়া আরো কতজন ডাক্তারের সঙ্গে শু’য়ে’ছি। আর শুনবি, বলব?'”

তিতাস কানে কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে নিলো। তারপর আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,

-”এমন কথা এতদিন যাবৎ অনেক শুনে এসেছেন। তাহলে আজ কেন এত সিরিয়াস হচ্ছেন? ”
-” কারণ আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না।”
-”আমি রাজি বিয়েতে তবে শর্ত আছে?”
-”এখানে শর্ত আসছে কেন?”
-”স্বার্থের কারণে শর্ত আছে।”
-‘”তিতাস ভুলেও ভাবিস না আমি পানিতে পড়ে গেছি? আমি
মূল্যহীন। তুই ছাড়া আর ছেলে পাবো না, এ জীবনে আমার
বিয়ে হবে না, সংসার জুটবে না। এমন অবান্তর ভাবনা ভেবে বোকামি করিস না। এই ভোর তুচ্ছ নয়। চুপ থাকি বলে দূর্বল
ভাবিস না। মনেও করিস না, আমি জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া
নাবিক। আর নিজের মুখে বিয়ের কথা কেন বললাম, গিয়ে তোর মাকে জিজ্ঞাসা কর। শর্তের কথা বললি তো, যা বিয়ে বাদ। তুই আমি আর কেউই বিয়ের কথা মুখে আনব না। এই মুহূর্ত থেকে তোর পরিবারের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।
দারোয়ানকে বল যেতে দিতে, নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

ভোরের চোখ আর কন্ঠ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। মারাত্মক রেগে আছে সে। তিতাস হাসল। ভোরের এই রুপ তার কাছে অপরিচিত নয়। এর আগেও সে ভোরকে রাগতে দেখেছে।
এজন্য তেমন অবাক হলো না। তবে ভোরের চোখে চোখ রেখে খুব আদুরে কন্ঠে বলল,

-”এত রাগলে চলে? এমন রাগ সবার সামনে দেখাতে নেই।
এই রাগান্বিত রক্তিম মুখখানা দেখে কারো কারো হৃদয়ে সুর বেজে ওঠে। প্রেমেরা হইহই করে ওঠে। ভালোবাসারা দলবদ্ধ ভাবে এসে কড়া নাড়ে মনের কুঠুরিকে। বাধ্য করে প্রেমের জীবাণু শরীরে মাখতে। বুকপাঁজরে অঘোষিতভাবে রচিত করে প্রেম প্রেয়সীর নাম। তখন অবেলা প্রেমিক পুরুষটাও বোধ হারিয়ে ফেলে। চৈতন্য খুয়ে ফেলে বিবেক ও মস্তিষ্কের।
তখন অনিচ্ছায় পান করে প্রণয়ের সুধা।”

ভোর ভ্রু কুঁচকে পুরো কথাটা শুনে তিতাসের কলার ঝাঁকিয়ে বলল,

-”আমি তোর প্রণয়বাক্য শুনতে দাঁড়িয়ে নেই। দারোয়ানকে বল আমাকে যেতে দিতে। নয়তো আমি কিছু একটা করে ফেলব। লাস্ট বার বলছি, আমাকে যেতে দে।’

-”এসেছেন নিজের ইচ্ছায় তবে যাবেন আমার ইচ্ছায়। আর শর্ত মেনেই আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আমি নিজেই বাধ্য করব আপনাকে। এই কথার একচুলও পরিমান নড়চড় হবে না।”

এ কথা বলে তিতাস বাসার সবাইকে উচ্চশব্দে ডাকতে লাগল। ওর বাজখাঁই গলা শুনে সকলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলেন। তারপর ড্রাইভারকে দিয়ে কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হলো। ততক্ষণে ভোরের বাবা-মা চলে এসেছিলেন।
তিতাস নিজে উনাদের তড়িঘড়ি আসার কথা জানিয়েছিল।
এ ব্যাপারে উনাদের দ্বি-মত নেই। তাই উনারা মেয়েকে রাজি হতে আশ্বাস দিলেন। তারপর সকলের উপস্থিতিতে দু’জনে বাঁধা পড়ল পবিত্র এক বন্ধনে। ভোর অবাধ্য অশ্রু ঝরিয়ে পুনরায় বিয়ে নামক শেকলে আঁটকে গেল। নতুন করে স্বামী নামক মানুষটা তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তিক্তপূর্ণ
বিধবা তকমাকে উচ্ছেদ করে সধবা তকমা শরীরে লেপ্টে নিলো। সেই সঙ্গে, বয়সে ছোট একটা ছেলেকে বেছে নিলো জীবনসঙ্গী রুপে।

To be continue…..!!
(বিঃদ্র:- গল্পের ব্যাপারে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে বলতে পারেন, আমি শুধরে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here