প্রিয় তুই পর্ব ৬

0
605

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৬

তিতাস হসপিটালে পৌঁছে দ্রুতপায়ে জরুরি বিভাগের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ তাকে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। কেন, এখনো জানানো হয় নি। তিতাস কল পেয়েই তাড়হুড়ো করে এসেছে। হসপিটাল থেকে ডাকা মানেই জরুরি ব্যাপার, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা তার আছে। এজন্য দ্বিমত করে নি। যে পেশা তার স্বপ্ন সেটাকে হেলা করার দুঃসাহসও তার নেই। সে এপ্রোন শরীরে জড়িয়ে জুরুরি বিভাগে যেতেই একজন নার্স এসে বললেন,
-”স্যার, রোগী বারবার আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছে। শান্ত করা যাচ্ছে না। মুখে অক্সিজেন মাক্সটাও রাখতে চাচ্ছে না, অথচ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এজন্যই আপনাকে জুরুরিভাবে ডাকা হয়েছে।।”
-”কোন রোগীর কথা বলছেন?”
-”ভোর ম্যামের সহকারী রবিন ভাইয়ের কথা বলছি।”
-”কি হয়েছে তার?”
-”গতকাল রাতে বাসার ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছে।”

তিতাস আর কথা না বাড়িয়ে রবিনের কেবিনের দিকে গেল।
রবিনের কথা তাহলে ভোর জানে না। জানলে বাসায় থাকার মেয়ে সে না। তবে রবিন ভোরকে না জানিয়ে তাকে খোঁজার কারণ বুঝতে পারল না। যদি অহেতুক বকে সেও ছাড়বে না। নার্সের সামনে ওর পশ্চাদ্‌দেশে ইনজেকশন পুশ করে দিবে। ব্য’থা’তুর শব্দ করার আগেই আরো একটা দিবে। তখনই সে বুঝবে তিতাস কি জিনিস! এসব ভেবে তিতাস কেবিনে ঢুকে দেখে রবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বুকে আর মাথায় ‘চো’ট পেয়েছে। হঠাৎ কেবিনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে চোখ খুলে তাকাল। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে পুনরায় শুয়ে পড়ল। তিতাস বিরক্ত নজরে তাকিয়ে রবিনের রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ওর মুখ বিরক্তিতে ছড়াছড়ি। যেন কেউ তাকে ধরে বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। রবিন ওকে কিছু বলতে গেলে তিতাস বলল,

-”এই অবস্থা হলো কি করে? মেয়ের পিছু নিয়েছিলে?”
-”না, আসলে..!”
-”আসলে নকলে পরে শুনছি আগে ঝেড়ে কাঁশো।”
-”স্যার, যেভাবেই হোক ম্যামকে বাসা থেকে বের হতে দিবেন না, আগামী এক মাস।”
-”সে কী আমার বউ লাগে যে, রুমবন্দি করে রাখব?”
-”প্রয়োজনে বউ বানিয়ে আঁটকে রাখুন।”
-” তাকে কোন দুঃখে বউ বানাব?”
-” ম্যাম বাইরে সেইভ নয় স্যার।”
-‘তো আমি কী করব?”
-” আয়মান ম্যামকে কিডন্যাপ করার চক্রান্ত করছে। উদ্দেশ্য ম্যামকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার।’
-”আয়মান কে? ওই যে ডান ভ্রুঁ কাঁ/টা/ ছ্যাচড়টা? ভোরকে দেখলেই যে গদগদ করে ।”
-‘হ্যাঁ, উনি ম্যামের ফুপাতো ভাই।”
-‘বুঝলাম, তা এসব তুমি জানলে কী করে?”
-”গতরাতে আয়মানের বলা কথাগুলো শুনে ফলো করতে গিয়ে এক্সিডেন্টটা করেছি।”

তিতাস গম্ভীর হয়ে কিছু ভেবে রবিনের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল। এরা আর শান্তি দিলো না। তারপর নার্সকে ডেকে কিছু বলার আগেই রবিনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে সে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিতাস ঘুরে দ্রুত অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে শ্বাস নিতে ইশারা করল। ধীরে ধীরে রবিন শান্ত হলো। তারপর রবিনকে ধমকে ধামকে বেরিয়ে গেল। রবিন মুখে অক্সিজেন মাক্স নিয়ে মুচকি হাসল। কেন জানি তিতাসকে তার ভালো লাগে। আপনাআপনি তার প্রতি সন্মান চলে আসে। মনে হয়, মানুষ হিসেবে তার মতো হওয়া উচিত। তবে তিতাসের ব্যবহারে যে কেউ মুগ্ধ না হলেও তার উদারতায় হবে। ছেলেটা সর্বদায় মুখে বিরক্ত ঝুলিয়ে রাখে। অথচ এটা তার অভিনয়, নিজেকে আড়াল করার অভিনয়।
তাছাড়া ভোরকে নিরাপদে রাখতে তিতাসই যথেষ্ট। এজন্য সে কথাগুলো আগে তাকেই জানাল। এখন দেখা যাক, সে কতটুকু করে। তিতাস কেবিনের বাইরে গিয়ে ভোরকে কল দিলো। তিনবারের বেলায় ভোর কল রিসিভ করে বলল,

-”রেডি হচ্ছি পরে কথা কথা বলছি।”
-”কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
-”আয়মানের সঙ্গে দেখা করতে, তার নাকি জরুরি কথা আছে।”
-”লাগেজ নিয়ে একেবারে যাচ্ছেন নাকি আবার ফিরবেন?”
-”তুই কি আমাকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিস?”
-”চেষ্টা করে দেখুন যেতে পারেন কি না?”
-”চ্যালেঞ্জ করছিস?”
-”তিতাসের এত খারাপ সময় আসে নি যে বেয়াল ছেড়ে এই চুনোপুঁটিকে চ্যালেঞ্জ করবে? আর পুরুষরা সিংহের জাত।
জানেন বোধহয়, সিংহ চ্যালেঞ্জ করে না সরাসরি গিয়ে থাবা বসায়। আর হ্যাঁ, আজ নয় আগামী দুই মাস আপনি বাসার বাইরে যেতে পারবেন না। হসপিটাল থেকে আপনার ছুটিও নিয়ে নিয়েছি।”

তিতাসের কথায় ভোর চরম আশ্চর্যে কিছু বলতে পারল না। ওর ছুটি তিতাস নিয়েছে, এর মানে কি? তাছাড়া ছুটি নিবে কেন? আর কি যেন বলল, সে চুনোপুঁটি? বেয়াদবটার এত্ত সাহস! আবার পুরুষদের নিয়ে ভাষণও দেওয়া হচ্ছে। ভোর এবার রেগে বলে উঠল,
-‘পুরুষ শুধু সিংহের না গাধার জাতও হয়। যেমন তুই একটা গাধা, রাম ব’ল’দ।”
-”আচ্ছা, ধন্যবাদ।”
ভোর কল কেটে দ্রুতপায়ে বের হলো। তিতাসকে সে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু সদর দরজা অবধি গিয়ে দরোয়ান ওকে আঁটকে দিলো। উনি কোনোভাবেই দরজা খুলে যেতে দিলেন না।বরং জানালেন, তিতাসের কড়া নিষেধ আছে। ভোর নিজের রাগ কনট্রোল করতে না পেরে তিতাসকে কল দিলো। কিন্ত কল রিসিভ হলো না। বরং অটো মেসেজে জানিয়ে দিলো ব্যস্ত আছে। ছেলেটা এবার অতিরিক্ত করছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তার। ভোর গিয়ে তিতাসের বাবা-মাকে বলেও কাজ হলো না। দারোয়ান একই জবাব দিলেন। ভোর রাগে দুঃখে রুমে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে রাখল, তিতাস ফিরলে আজই চলে যাবে। থাকার আর ইচ্ছেও নেই। তাছাড়া বন্দি জীবন কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। একপ্রকার রেগেই সারাদিন রুম বন্দি থাকল ভোর।দুপুরে খেলো না, দরজাও খুলল না।
পরে তিতাসকে কল করতে দেখে ফোনটা সুইচ অফ করে রাখল। বে’য়া’দ’ব’টা’র সঙ্গে কথা বলবে না। তিতাসের বাবা রেগে তিতাসকে ইচ্ছেমতো বকাবকি করলেন। আর জবাবে তিতাস বলল,

-”বাবা, অহেতুক বকবে না। তুমি তোমার প্রাক্তনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলো আম্মুকে কিন্তু জানিয়ে দিবো। তখন বুড়ো বয়সে বউছাড়া হলে আমাকে দোষ দিতে পারবা না।”

-‘” তোর আম্মুকে আমি ভয় পায় নাকি? তোরা মা ও ছেলে মিলে আমাকে জ্বালিয়ে মারলি। এরচেয়ে সুরভি’ই অনেক ভালো ছিলো। ”

একথা বলে উনি কল কেটে মাথায় পানি ঢালতে গেলেন।
রাগে উনার মাথা দপদপ করছে। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়।
ছেলেটার সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলেও শান্তি নেই। সেই খোঁচাবে নয়তো ফাঁসিয়ে দিবো। উনার মতো ভদ্রলোকের ছেলে এত অভদ্র, একথা ভাবলেই উনার বুক চিনচিন করে। ওদিকে,
তিতাস কল রেকর্ডটা ওর আম্মুকে পাঠিয়ে পুনরায় রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাকি কাহিনি বাসায় পৌঁছে স্বচক্ষে দেখবে।

আয়মান ঘন্টা দু’য়েক হচ্ছে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। কোল্ড কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর ফোন স্কল করছে। মুখে মৃদু হাসি। আজকে সে ভীষণ খুশি। কারণ ভোরকে মনের কথা বলবে।
তার প্রগাঢ় অনুভূতির কথা প্রকাশ পাবে। সে দেশে ছিলো না বিধায় ভোরের সঙ্গে পিয়াসের বিয়ে হয়েছিল। নতুবা কারো বুকের পাটা ছিল না এই কাজটা করার। ভাগ্যিস পিয়াস় মরেছিল নয়তো সেই’ই মেরে দিতো। ভোর তার, শুধু তারই থাকবে। তবে তার কানে পৌঁছে গেছে তিতাস নাকি ভোরকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ছেলেটার বুকে পাটা আছে বলতে হবে। তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে থ্রেট দেওয়ার পরেও প্রস্তাবটা বহাল রেখেছে। এবার পাকাপোক্ত কিছু করতে হবে। যাতে বিয়ে করার স্বাদ একেবারে ঘুঁ’চে যায়। নয়তো ছেলেটা ওর আর ভোরের মধ্যে ঢুকে সাজানো পরিকল্পনা ‘ঘেঁ’চে দিবে।
আয়মান এবার অধৈর্য হয়ে ভোরকে কল দিতেই থাকল, ওই একই কথা, বন্ধ। তারপর সে আর না বসে বেরিয়ে পড়ল। ভোর একজন ডাক্তার। হয়তো জুরুরি কাজে আঁটকে গেছে।

__________________

এখন বাজে রাত সাড়ে দশটা। ড্রয়িংরুম থেকে চাচীর কথার শব্দ ভেসে আসছে। হয়তো রোজাকে খুব বকছেন। বাবা-মা উনাদের রুমে চলে গেছেন। ভোর গেস্ট রুমে। আর তিতাস অবসন্ন, ক্লান্ত, শরীরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার শান্ত দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ। সে ভাবতেই পারে নি, বাসায় এসে এমন চমকপ্রদ কিছু ঘটবে। তবে সে খুশি, খুব খুশি। এটাও
সত্যি তার পক্ষ থেকে জোরজবরদস্তি নেই। ভোর যা করল, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে। অবশেষে সেও বৈধতার অধিকার পেয়েই গেল। তার শরীরে লাগল স্বামীর তকমা, এবং ঘাড়ে চাপল দায়িত্বের বোঝা। আজ থেকে ভোর তার বউ। সিনিয়র বউ!

To be continue……!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here