#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
আজ অনিকের মেহেদী অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই বাসা সাজানোর কাজ চলছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা থেকে৷ তাহনা একবারটি চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর আস্তে করে পা টিপে রিদের রুমের সামনে গেল৷ মাথায় ঘোমটা টেনে দরজায় নক করল। রিদ দরজা খুলে দিতেই তাহনা ভিতরে ঢুকে পড়ে সাথে সাথে।
রিদ তাহনার এমন আচরণে বেশ অবাক হয়ে যায়। তাহনা রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি কি চাইছেন একটু বলবেন প্লিজ? প্রথমত, আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড নন। দ্বিতীয়ত, আপনার সাথে আমার কোনো বিয়ে হচ্ছে না। তাহলে কেন এই মিথ্যে? আর আপনাকে কে এখানে আসার ঠিকানা দিয়েছে? সবচেয়ে বড় কথা, আপনি সে-ই, যে আমাকে ফোন দিয়ে অনিক ভাইয়ার সাথে ছবি দেখে রাগারাগি করেছিলেন। এসব কেন করছেন আপনি?’
রিদ তাহনাকে শান্ত করার জন্য বলে,
‘আস্তে বলো তাহনা। সবাই শুনে ফেলবে।’
‘শুনুক। আপনি তো এমন নন রিদ ভাইয়া। তাহলে কেন এমন করছেন?’
‘তাহনা আসলে, মা আমার জন্য মেয়ে দেখছে। মায়ের শরীরটাও ভালো নয়। অচেনা কাউকে বিয়ে করলে সে কেমন হবে না হবে। তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু মায়ের জন্য, মায়ের অসুস্থতার জন্য আমাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আর আমি ভেবে দেখলাম তুমি ছাড়া আমার চেনা জানা কোনো ভালো মেয়ে নেই। তাই তোমাকে…।’
‘থামুন! তাই আমাকে মানে কি? আমাকে বিয়ে করতে চান তাই তো? আপনি নিজেই বলেছেন আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আমি এখনো ছোট। এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দিতে। এসব বলে ভালোই আমার বাবাকে জ্ঞান দিয়েছিলেন। আর এখন? নিজের স্বার্থের জন্য কথার বিরোধিতা করেছেন?’
‘সরি তাহনা। তুমি ভুল ভাবছ। বিশ্বাস করো আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। পুরো উন্মাদ হয়ে গেছি আমি। একটু মানসিক শান্তি পাচ্ছিনা। আর তুমি আমাকে ভুল বুঝে কথা শোনাচ্ছ? তোমার পড়ালেখার সব দায়িত্ব আমি নিব তাহনা। তোমার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্বও আমি নিব। প্লিজ তুমি শুধু আমার এই কথাটা মানো। তোমার কাছে আমি কিছুই চাইবো না আর।’
তাহনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনিক আর অনু ওখানে ঢুকে পড়ে। তাহনা আর রিদকে একসাথে দেখে অনুর মাথা গরম হয়ে যায়। অনু তেড়ে এসে বলে,
‘এই তাহনা? তুমি তো দেখছি ছেলে দেখলেই ঝুলে পড়ো তার গলায়। একবার এ, একবার ও। আর এখন? ভাইয়ার বন্ধুর গলায়ও ঝুলে পড়েছো? ছিঃ। চরিত্র এতো খারাপ কেন তোমার।’
অনুর কথায় তাহনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। ঠাস করে অনিক অনুর গালে একটা থাপ্পড় মারে। অনু গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে। তাহনা কাঁদতে কাঁদতে ওখান থেকে চলে গেল। রিদ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। অনিক অনুকে বলল,
‘ছিঃ, তুই আমার বোন? একটা মেয়ে সম্পর্কে এসব বলতে তোর লজ্জা করলো না? তাহনার চরিত্র কেমন তুই একাই সব জানিস? রিদ তাহনার কি হয় তোর জানা আছে? তাহনার হবু বর হয় রিদ। আমাদের বিয়ের দিন ওদেরও বিয়ে হবে। আমি জাস্ট ওকে আমার ফ্রেন্ড বলে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আসলে আমি রিদকে চিনিনা ঠিক করে।’
অনু এসব শুনে বেশ অবাক হয়ে যায়। রিদ তার ভাইয়ার বন্ধু নয়? বরং তাহনার পরিচিত। তাহনার হবু বর? কই তাহনার বিয়ের ব্যপারে তো তাহনা আর তার বাবা কাউকে কিছু বলেনি তাহলে?
রিদ ওখান থেকে বিরক্তি নিয়ে বাইরে চলে যায়। তাহনা নিজের রুমে বসে কাঁন্না করছে। ওর জীবনে এতো দুঃখ কেন? কেন বাকি চার পাঁচটা মেয়ের মতো ওর জীবন গোছানো নয়?
এদিকে অনু এসে তার মাকে যাতা বলে দিয়েছে। তার মা এসব শুনে অনিককে জিজ্ঞেস করে। অনিক তার মায়ের সামনেই ওর বোনকে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বসে। অনিক বলে,
‘ওর মন এতো নিচ এতো খারাপ আমি কল্পনাও করতে পারিনি মা। ও তাহনাকে বলেছে তাহনার চরিত্র খারাপ। কিন্তু তুমিই বলো, তাহনার মধ্যে এমন কিছু দেখেছ কি? আর রিদ আমার বন্ধু নয় ঠিকাছে, কিন্তু ও তাহনাকে বিয়ে করতে চায়। আমার বিয়ের দিন ওদেরও বিয়ে হবে।’
অনিকের মা বলেন।
‘তাহনার বাবা তো কিছু বলেনি এ বিষয়ে।’
‘উনি আসুক। তারপর জানানো হবে।’
.
সন্ধ্যার সময় বাসার সবাই একসাথে বসে আছে। শুধু নেই তাহনা। রিদ সেই যে সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে এখনো ফিরেনি। এদিকে তাহনার বাবা কাল আসবেন বলেছেন। ওনাকে এখনো রিদ আর তাহনার ব্যপারে জানানো হয়নি।
বাসায় একটা আনন্দ উৎসব চলছে কিন্তু তাহনা এসব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। মন খারাপ করে ছাদে বসে আছে সে। তাহনা ভেবে পাচ্ছেনা সে কি করবে। তার বাবা কাল আসছেন, রিদকে দেখে উনি যদি রাগ করেন। কিংবা রিদের প্রস্তাবে গায়ে রিদের হাত তুলেন? তাহলে তো মহা ঝামেলা। এসব চিন্তা করে তাহনার মন আরও খারাপ গয়ে গেল।
রিদ অনিকের বাসায় এসে দেখে সবাই হৈচৈ করছে। রিদের চোখ তাহনাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এখানের কোথাও তাহনাকে দেখা যাচ্ছে না। রিদ এবার বাসার সবকটা রুমে ঢুকে তাহনাকে খুঁজতে লাগলো। দেখেনি শুধু অনিকের রুমটা। কিন্তু তাহনাকে খুঁজে পেলনা সে। রিদে একবার অনিকের কাছে গেল।
অনিক রেড়ি হয়ে বসে আছে। একটু পর তার প্রেমিকা আসবে। তাদের একসাথে মেহেন্দি হলুদ হবে। রিদ দরজা ঠেলে অনিকের ঘরে ঢুকে। অনিক রিদকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
‘ব্রো! সকালে যে গিয়েছ এখন আসার সময় হলো তোমার? কোথায় গিয়েছিলে?’
রিদ অনিকের কথার জবাব দিয়ে বলে,
‘তাহনাকে ওই কথাগুলো বলা আমার বোধহয় উচিৎ হয়নি অনিক। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। ওর সামনে আসতে চাইনি তাই চলে গিয়েছিলাম। ভাবছি কাল চলে যাবো। হোক যা হওয়ার।’
অনিক রিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘আমার বোনের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। তাই বলে বিয়েটা না করে যেও না। তাহনা ঠিক রাজি হবে দেখো। আচ্ছা তাহনার সাথে তোমার সম্পর্ক কি করে হলো? আমায় বলবে?’
‘বলবো, কিন্তু তাহনাকে কোথাও দেখছিনা। তুমি জানো সে কোথায়?’
অনিক বেখেয়ালি হয়ে বলল,
‘আছে হয়তো কোথাও।’
‘আমি সব জায়গায় ওকে খুঁজেছি। ওকে দেখছিনা।’
‘আচ্ছা, তুমি আগে বসো। তাহনা কোথায় আমি বলবো। তুমি আগে আমাকে তোমাদের গল্প শোনাও।’
অনিকের কথায় রিদ বিছানায় বসে। পাশে অনিকও বসে। তারপর রিদ বলতে শুরু করে তাহনার সাথে দেখা হওয়ার কথা। কিভাবে তাদের আলাপ হয়েছিল। সবটা শুনে অনিক বেশ অবাক হয়।
‘তারমানে তুমি সত্যিই তাহনার বয়ফ্রেন্ড নও?’
‘নাহ্।’
‘যাহ্। কই কত কিছু ভেবে ফেললাম আমি। তুমি দিলে মুড নষ্ট করে।’
‘আমি তাহনাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’
‘তাহনা বোধহয় ছাদে আছে। যাও কথা বলে এসো।’
রিদ অনিকের রুম থেকে বেরিয়ে গেল ছাদের উদ্দেশ্যে।
*
অনিকের বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে। তাহনা ছাদে বসে নিচের দৃশ্যগুলি দেখছে। রিদ ছাদে এসে দেখে তাহনা একা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কিনারায়। রিদ তাহনার পাশে গেল। তাহনা রিদের উপস্থিতি টের পেয়ে চলে যেতে লাগলো। রিদ পিছন থেকে বলল,
‘তাহনা স্যরি।’
তাহনা থেমে গেল। রিদ তাহনার কাছে এসে বলল,
‘আমি তোমাকে সকালে যা বলেছি তার জন্য স্যরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি তাহনা। আমি কাল চলে যাবো। তুমি ভালো থেকো। তোমাকে আমার ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।’
তাহনা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘এক মিনিট! কিসের ঋণের কথা বলছেন?’
‘ওমা, তুমি না বলেছ, আমার উপকারের প্রতিদান তুমি কখনওই দিতে পারবে না।’
‘আপনি এখন আপনার উপকারের প্রতিদান চাইছেন তাইতো?’
‘নিজের জন্য চাইছি না। তোমার উপর কোনো অধিকারও খাটাবো না শুধু একটা সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই।’
‘আপনি যখন মুখ ফুটে উপকারের প্রতিদান চেয়েছেন বেশ, আমি আমার উপকারের প্রতিদান দিব। আপনি যা বলবেন তাই হবে।’
‘আমাদের বিয়েটা কালই হবে তারা।’
‘কিন্ত আপনার পরিবারের লোকজন?’
‘সব আমি সামলে নিব।’
‘আপনার মা যদি মেনে না নেন? কিংবা আমাকে দোষারোপ করেন?’
‘কিচ্ছু হবে না।’
‘ঠিকাছে।’
.
বড্ড ধুমধামে অনিকের মেহেদী আর হলুদ এর আয়োজন শেষ হলো। তাহনা আর রিদকেও হলুদ আর মেহেদী লাগানো হলো। অনু এক কোণে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর তাহনাকে সহ্য হচ্ছে না। বিশেষ করে রিদের পাশে সে তাহনাকে দেখতেই পারছেনা। সব কিছু সুষ্ঠভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। শুধু ঘুম নেই তাহনার চোখে। জীবনের তরি কোথায় গিয়ে থামবে তার?
চলবে…