প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ১৪

0
582

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

সকালবেলা এমন একজনের মুখ তাহনাকে দেখতে হবে সেটা কখনো ভাবেনি তাহনা। যাকে মন থেকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে আবার তার সামনে আসছে। তাহনার রাগ হচ্ছে। তাহনার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে রিদের। রিদ বার বার হাত মুষ্টিবদ্ধ করছে।

*
খুব ভোঁরে ঘুম থেকে উঠে তাহনা। নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ ছাদে হাটাহাটি করে সে। বাসায় মানুষে গমগম করছে। আজ অনিকের বিয়ের পাশাপাশি তাহনা সাথে রিদের বিয়ে হবে। তাহনা ভাবছে তার বাবার কথা। আজ আসার কথা ছিল। বাবা কি সব মেনে নিবে? এই ভয় তাহনার মনে কাজ করছে। কত মানুষ তাহনাকে ঠকালো। এবার যদি রিদও ঠকায়?

সকালের নাস্তা করে মাত্র রিদ তাহনা আর অনিক মিলে বাইরে যাচ্ছিল। এমন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত একজনকে দেখে তাহনা চমকে উঠে।

তানভির মাত্র নিজের পরিচিত ভাইয়ের বাসায় পা দিয়েছে, কিন্তু এসেই যে তাহনার সামনে পড়বে সে নিজেও কল্পনা করেনি।

তাহনা তানভিরকে দেখে চ্যাঁচিয়ে বলে,

‘আপনি? এখানেও চলে এসেছেন? আর কি চাই আপনার? আমার জীবনটা তো একেবারে শেষ করেই দিয়েছেন। এখন এখানে এসেছেন আমাকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে? আপনার লজ্জা করে না?’

অনিকসহ বাসার সবাই তাহনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। অনিক তাহনাকে থামানোর জন্য বলে,

‘তাহনা এসব কি বলছো তুমি?’

‘আপনি থামুন ভাইয়া। আমাকে এই লোকটার সাথে কথা বলতে দিন।’

অনিক চুপ করে তাকিয়ে রইলো তাহনার দিকে। এদিকে রিদ সোজা তানভিরের কলার চেপে বলে,

‘আর একবার যদি তাহনার আসেপাশে তোমায় দেখেছি, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। যাও এখান থেকে।’

অনিক রিদকে থামানোর জন্য বলে,

‘রিদ, ও আমার ছোট ভাই হয়। ছাড়ো ওকে।’

রিদ তানভিরের কলার ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়।

তাহনা অনিককে বলে,

‘এরকম নোংরা মনের লোক কি করে আপনার ভাই হতে পারে অনিক ভাইয়া? আমি ভাবতেও পারছিনা আমার ভাইয়া এই লোকটার পরিচিত কেউ।’

অনু ভেংচি কেটে তাহনাকে বলে,

‘দুনিয়ার সব ছেলেই তো তোমার পরিচিত তাইনা তহনা?’

তাহনা এবার আরও বেশি খেপে যায়। সে অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আমি চুপচাপ থাকি বলে ভেবো না অপমানের জবাব দিতে পারিনা। তোমার কি লজ্জা করে না নিজের বোনকে এভাবে অপদস্ত করতে?’

‘তুমি আমার সৎ বোন হও তাহনা।’

‘যেহেতু আমি তোমার নিজের কেউ নই, সেহেতু আমার কোনো কাজে তোমারও হস্তক্ষেপ চলে না অনু।’

তাহনার এমন আচরণের বাসার সবাই ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে অনুর ব্যবহারে তাহনার মামা মামি তাকে বকা দিচ্ছেন। তাহনা আবার তানভিরের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আমি আপনাকে এখানে দেখতে চাইনা। আপনি এখানে থাকলে আমি এখানে থাকবো না।’

রিদ বলে,

‘মানুষের লজ্জা থাকলে সে এখানে থাকতো না, কিন্তু অমানুষকে বলে লাভ নেই তাহনা।’

তানভির কানে হাত দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,

‘প্লিজ থামুন আপনারা। আমাকে একটা সুযোগ দিন কথা বলার।’

শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে পুরো বাসায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এবার যা বলার তানভির বলবে। তানভির স্বাভাবিক হয়ে বলে,

‘কাউকে ঠকালে একদিন নিজেকেও ঠকতে হয় অন্য কোনোভাবে। এটা আমি এতোদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছি তাহনা। তোমার সাথে বাজিতে প্রেমের অভিনয় করতে গিয়ে আমার নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আমি হারিয়ে বসলাম। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার ফল আমি পেয়ে গেছি তাহনা। তুমি জানো, আমার এতোদিনের ভালোবাসার মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা। জানো তাহনা, সে যাওয়ার আগে বলে গেছে যদি কখনো তোমার সাথে দেখা হয় তাহলে তোমাকে যেন বলি তাকে ক্ষমা করে দিতে। আর আমাকেও। কিন্তু আমি কোন মুখে তোমার সামনে যেতাম বলো? আমি আমার মানুষটিকে হারিয়ে বুঝেছি আমি তোমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা করে দাও তাহনা। আমার মানুষটিকেও ক্ষমা করে দাও।’

কথাগুলো বলেই তানভির কাঁদতে লাগলো। তাহনা বিস্মিত হলো। তানভিরের গার্লফ্রেন্ড আর বেঁচে নেই? বিষয়টা খারাপ লাগলো তাহনার। তানভিরের কথা শুনে রিদের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। পুরনো কিছু কথা মনে হতে লাগলো। তানভির আবার বলতে লাগলো,

‘অনিক ভাইয়া আমার পরিচিত। এইতো আমার ফুফুর বাসা ওনাদের বাসার সাথেই। ছোটবেলায় যখন আসতাম তখন অনিক ভাইয়ার সাথে অনেক খেলতাম দৌড়াদৌড়ি করতাম। আমাদের তেমন যোগাযোগও নেই। সেদিন অনিক ভাইয়া ফুফুর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমাকে কল দিয়ে তার বিয়ের কথা জানায়। আমি তো একা হয়ে গেছি। ভাবলাম নিজের মনকে হালকা করি। সবার সাথে মিশলে হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারবো। সেই ভেবে এখানে আসা। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি জানতাম না তুমি এখানে আছো। জানলে আসতামই না। তোমাকে মুখ দেখানোর অবস্থা আমার নেই।’

অনিক শান্ত হয়ে বলে,

‘তাহনা আমি ঠিক জানি না কি হয়েছে, আমি জানতেও চাইনা। তুমি প্লিজ এখানে আর সিনক্রিয়েট করো না। আর রিদ তুমিও প্লিজ।’

তানভির অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘সমস্যা নেই অনিক ভাই। আমি চলে যাচ্ছি। ওনাদের আর বিরক্ত করতে চাইনা।’

তাহনা বলে,

‘সমস্যা নেই থাকুন আপনি আপনার মতো।’

এদিকে রিদের আরো রাগ উঠছে, চলেই তো যাচ্ছিল। আবার কেন তাহনা তাকে বাঁধা দিল?

তাহনার হাত ধরে একপাশে তাহনাকে নিয়ে আসে রিদ। রিদ বলে,

‘সমস্যা কি তোমার? ওকে তাড়িয়ে দিলে না কেন?’

‘আমি ওনার মতো না। উনি আমাকে ঠকিয়েছেন ঠিকি, কিন্তু ওনাকেও আল্লাহ শাস্তি দিয়েছেন। এখন আমি যদি ওনার উপর প্রতিশোধ নিতে যাই তাহলে ওনার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি থাকলো?’

*
সকাল ১১ টার দিকে তাহনার বাবা এসে উপস্থিত হন অনিকদের বাসায়। সেখানে রিদকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যান তিনি। রিদ তাহনার বাবার হাত ধরে ওনাকে একটা খালি রুমে নিয়ে আসে।

‘আরে রিদ বাবা কি করছ।’

‘আংকেল, একটা জিনিস চাইবো আপনার কাছে, দেবেন?’

‘কি জিনিস বাবা? আমার সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই দিব। কিন্তু তুমি এখানে কেন?’

‘আংকেল, আমি আপনার মেয়ে চাই। বিশ্বাস করেন আমি ওকে ঠকাবো না। আপনি আপনার মেয়ের হাতটা আমার হাতে তুলে দিবেন?’

রিদের হাত ছেড়ে তাহনার বাবা বলে,

‘তোমার মা বাবা জানেন? এসব কি বলছ তুমি? আমি ছোট হতে পারবো না স্যারের কাছে।’

‘আপনি ছোট হবেন না। প্লিজ আংকেল। কথা দিচ্ছি আগলে রাখবো। আমার এ সময়টায় আপনার মেয়েকে বড্ড প্রয়োজন আমার।’

‘তাহনার অনুমতি ছাড়া আমি কিভাবে তোমাকে কথা দিব? আর এভাবে তোমার মা বাবা না জানিয়ে এসব করা কি ঠিক হবে?’

‘তাহনা রাজি আংকেল। মা বাবাকে আমি দেখে নিব।’

‘আমার ভয় হচ্ছে রিদ বাবা। আমি তাহনাকে বলেছিলাম বিয়ের জন্য জোর করবো না।’

‘আপনি তো জোর করছেন না আংকেল। তাহনা নিজেই রাজি হয়েছে।’

‘ঠিকাছে বাবা। কিন্তু আমার মেয়েকে দেখে রেখো তুমি। মা মরা মেয়েটার আমি ছাড়া আর কেউ নেই।’

‘চিন্তা করবেন না আংকেল। আমি তাহনাকে ভালো রাখবো।’

তাহনার বাবা ওখান থেকে প্রস্থান করেন। রিদ মনে মনে বলে,

‘আমাকে ক্ষমা করো তাহনা। আমি আসলে এভাবে তোমায় বিয়ে করতে চাইনি। আমি কখনোই কোনো কিছুর প্রতিদান কারো কাছ থেকে চাইনা। তুমি আমায় ভুল বুঝো না।’

*
দুপুর দুইটা বেজে দশ মিনিট। চারজন বসে আছে একসাথে। একদিকে রিমি-অনিক। অন্যদিকে তাহনা-রিদ। কাজি সাহেব ওদের বিয়ে পড়াচ্ছেন। তাহনার দ্বিতীয়বার বউ সাজা হলো। আড়চোখে তানভিরের দিকে সে তাকালো। দূর থেকে তানভির ওকে দেখছে। তানভিরকে দেখিয়ে রিদের খুব কাছেই বসলো তাহনা। সে দেখুক তাকে কষ্ট দিলেও তার জীবন কেমন চলছে। বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই ওদের দাম্পত্য জীবন সুখের জন্য দোয়া করে।

*
অনিকদের একটা ঘরে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তাহনা আর রিদকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। এশার নামাজ পড়ার পর তাহনা দেখে রিদ এসেছে। তাহনা বলে,

‘বিয়ের দিন রাতে স্বামী আর স্ত্রী একসাথে নামাজ পড়ে। তাদের বিবাহ জীবন সুখী হওয়ার জন্য রবের কাছে প্রার্থনা করে। আপনি কি নামাজ পড়তে ইচ্ছুক?’

‘যেহেতু নামাজের বিষয় আমি না করতে পারি না।’

তাহনা আর রিদ মিলে তাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রার্থনা করে। নামাজ শেষে রিদ তাহনাকে বলে,

‘কিছু কথা বলার আছে। বিয়েটা অনেক তাড়াহুড়োয় হলো। তোমার মনে আমাকে নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। আমরা আজ থেকে স্বামী স্ত্রী। তুমি আমার পরিবারের দেখাশোনা করবে আর তোমার দেখাশোনা করবো আমি। তোমার প্রয়োজনীয় সব কিছু তুমি হাতের কাছেই পাবে। প্রয়োজন হলে মুখ ফুটে একবার চাইবে। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালো হতে হবে। একটা সুন্দর সংসার করতে হলে বোঝাপড়াটা খুব বেশিই জরুরি। তোমার কাছে আমার বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই তাহনা। ভালোবাসার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। তুমি শুধু তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করো৷ সবসময় তোমার পাশে থাকবো আমি। তোমার ছায়া হয়ে তোমায় আগলে রাখবো। তুমি মন থেকে আমায় বিয়ে করোনি। তাই আমাকে মানতে তোমার অনেক সময় লাগবে। তোমার সময়ের মূল্য আমি দিব তাহনা। রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পড়ো।’

তাহনা শুধু টলমল চোখে রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর করে স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারটা বোজালো রিদ। তাহনার মনে যত সংশয় ছিল সব মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। তাহনার মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়। এ অন্তত ভরসার হাত ছাড়বে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here