#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকাল সাড়ে আটটার দিকে বারান্দায় বসে হালকা নাশতা করছিল তাহনা। খুব ভোঁরে উঠে নামাজ পড়ে এক কাপ চা খেয়েছিল সে। তারপর থেকে আর কিছুই খাওয়া হলোনা। অনিকের মা অনেকবার বলেছেন তাদের সাথে বসে নাশতা করতে। কিন্তু তাহনা বলেছে পরে ঘরে খেয়ে নিব। এখন তাই খাচ্ছে।
তাহনার খাওয়ার মাঝেই অনু তাহনার মোবাইল নিয়ে এসে বলে,
‘তাহনা, তোমার ফোন অনেক্ক্ষণ থেকে বেজে চলেছে। তুমি বোধয় শোননি। বালিশের নিচে চাপা পড়ে ছিল।’
তাহনা চট করে অনুর থেকে ফোন নিয়ে বলে,
‘ধন্যবাদ অনু। বাবার কল হতে পারে।’
‘এটা আননোন নাম্বার।’
তাহনা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই একটা আননোন নাম্বার। তাহনা কিছু না ভেবে কল রিসিভ করে সালাম দেয়। কিন্তু সালামের জবাব পায়না বরং উল্টো একটা ধমক শুনে সে।
‘ফোন ধরতে এত সময় লাগে?’
তাহনা বুঝতে পারছে না কে তাকে কল দিয়েছে। একটা পুরুষালী কন্ঠ। তাহনা জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কে?’
ওপাশ থেকে বলে,
‘আগে এটা বলো যে, ওই ছেলেটা কে? কার সাথে তুমি পাহাড়ে উঠে ছবি উঠিয়েছ?’
তাহনার আশ্চর্য লাগলো। এদিকে অনু তাহনাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে দাঁড়িয়ে আছে সবটা শোনার জন্য বা বোঝার জন্য।
‘আপনি আগে পরিচয় দিন আপনি কে। আর আমি কার সাথে ছিলাম তা জেনে আপনি কি করবেন?’
তিব্র ধমকে তাহনার কান যায় যায় অবস্থা। ওপাশ থেকে লোকটা হুৎকার দিয়ে বলে,
‘তুমি বাধ্য আমার প্রশ্নের জবাব দিতে। বল আমাকে কে ওই ছেলে?’
তাহনা জবাব দেয়,
‘আমার কাজিন ভাইয়া।’
‘আর কখনো যেন না দেখি ওর সাথে।’
‘আমি কার সাথে মিশবো না মিশবো সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি কেন হস্তক্ষেপ করছেন?’
‘তোমাকে তো আমার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর তা নাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে।’
তাহনার বিরক্তির সীমা নেই। সে প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে,
‘দেখুন, আপনাকে আমি চিনি না। নিজের পরিচয় দেননা, আবার এসেছেন আমাকে শাসাতে।’
বলেই তাহনা কল কেটে দিল। অনু এতক্ষণ ধরে ওদের ফোনালাপ শুনছিল৷ ওপাশের ব্যক্তিটির আওয়াজও সে শুনতে পেয়েছে। অনু তাহনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহনার চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তির ছাপ। অনু তাহনাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে ফোন দিয়েছে তাহনা? বিরক্ত মনে হচ্ছে?’
তাহনা করুন চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি চিনিই না৷ কিসব আবোল তাবোল প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আর বলে আমার সাথে পাহাড়ে ছেলেটা কে?’
‘ওয়েট! ছেলেটা মানে ভাইয়ার কথা বলছ?
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, তোমার সাথে ভাইয়ার পিক সে দেখলো কিভাবে? কাউকে দিয়েছিলা পিক?’
তাহনা ভেবে বলল,
‘শুধু একটা ছোটবোনকে দিয়েছিলাম।’
অনু কিছু বলার আগেই তাহনা ওখান থেকে চলে গেল।
.
‘আপনি এখানে কিসের বাড়ি বানাবেন? এখানে প্ল্যাট/বাড়ি হওয়া অসম্ভব। এখানে বাড়ি করলে দেড় বছরের মধ্যেই তলিয়ে যাবে।’
ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলছিল রিদ। একটা প্ল্যাট বানানোর জন্য একজন তার জমিন দেখাতে এনেছিল। রিদ বলছে এ জমিতে বাড়ি সম্ভব নয়।
রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রচন্ড গরম সহ্য করে ক্লাইন্টের সাথে তর্কাতর্কি শুরু করে দিয়েছে।
‘আপনি কি পাগল? মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন তাও কিছু টাকার জন্যে? এ জায়গায় প্ল্যাট হবে না। আর যদি আমি দেখেছি আপনি অবৈধভাবে এখানে প্ল্যাট করছেন তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমি রিজোয়ান শেখ রিদ।’
কথাগুলো বলেই হন হন করে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লো রিদ। নিজের গাড়ির সামনে এসে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি স্টার্ট দিতে। গাড়ির ভিতরে ঢুকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে।
বাসায় এসে দেখে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শ্বাস-কষ্ট বেশি বেড়ে গেছে। রাইশা কান্নাকাটি করছে। রিদ দ্রুত তার মাকে কোলে নিয়ে বাহিরে ছুটলো৷ রাইশাও রিদের পিছনে গেল। ওরা গাড়ি করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
.
✨
মোহনীয় সন্ধ্যায় অনিকের বার্থডে সারপ্রাইজ প্ল্যান করা হয়েছে। বাসা ভর্তি লোকজন। আত্মীয় স্বজনের ভিড়। তাহনা একটা ভালো জামা পড়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। এতো অচেনা লোকের ভিড়ে অস্বস্তি লাগছে।
অনিক তার জন্মদিনের কেক কেটে তার বাবা, মা আর বোনকে খাইয়ে দিল। তাহনা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল বলে অনিক গিয়ে তাহনার সামনে যায়। তারপর তাহনাকে কেকের এক টুকরো খাইয়ে দেয়। অনুর এটা মোটেও ভালো লাগেনি।
অনিকের বাবা আর মা তাদের এক আত্মীয়র সাথে অনিকের জন্য একটা মেয়ের ব্যপারে কথা বলছিলেন। অনিক তা শুনে ফেলে। আর শুনেই সে তার মা বাবাকে বলে,
‘বাবা আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।’
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না অনিকের বাবা মা। তখনই অনু এসে বলে।
‘আর তাকে তোমরা ভালো করেই চিন।’
অনিক ভ্রু কুচকে বলে,
‘না, বাবা মা তাকে চিনেনা। এবংকি তুইও তাকে সরাসরি দেখিসনি।’
অনুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কালই তো অনিক বললো তাকে এসব। তাহলে এখন অন্য মেয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?
অনিকের বাবা বললেন,
‘এতো কথা না বলে মেয়েটির পরিচয় দাও। মেয়েটির পরিবারের সাথে আলাপ করি।’
‘ও এখন আমাদের বাসায় আসছে। আসলেই দেখবে। আর সাথে ওর মা বাবাকেও নিয়ে আসছে।’
অনু অনিকের হাত ধরে একপাশে নিয়ে গেল। অনিক যেতে যেতে বললো,
‘আরে, কই নিয়ে যাচ্ছিস।’
অনু অনিকের হাত ছেড়ে বললো,
‘ভাইয়া কি শুরু করেছ? কালই তো তুমি বললে যে তুমি তাহনাকে ভালোবাসো। আর আজ পাল্টি খেয়ে অন্য মেয়ের কথা বলছ?’
অনিক থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব কি বলছে অনু? সে আবার তাহনাকে? অনিক বলে,
‘তাহনা আমার ছোট বোন লাগে অনু। তুই আর তাহনা আমার কাছে এক। আর কাল তোকে আমি অন্য মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলেছিলাম তাকে আমি ভালোবাসি।’
‘তাহনার ছবি দেখেই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি হ্যাঁ বলেছিলে।’
‘তোর বুঝতে ভুল হচ্ছে, হয়তো পাশাপাশি ছিল ছবি লুকাতে গিয়ে পাল্টে গেছে আর তোর হাত লেগে সেটাও পাল্টে গেছে। তাহনাকে আমি শুধু বোনের চোখেই দেখি।’
অনিক এ কথা বলেই চলে গেল। অনু নিজের ভুল বুঝতে পারলো। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে আসলো তার মা বাবাকে নিয়ে। ভারী মিষ্টি মেয়েটা। তাহনার ভিষণ মনে ধরেছে মেয়েটাকে। অনিকের সাথে মেয়েটার এনগেজমেন্ট হয়ে যায়। অনিক তাহনার সাথে মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দেয়। মেয়েটির নাম রিমি। অনেক মিশুক। কয়েক মিনিটেই আপন করে নিয়েছে তাহনা আর অনুকে। এক সাপ্তাহর মধ্যে অনিক আর রিমির বিয়ের আয়োজন করা হবে। তাহনা কালই যেতে চেয়েছিল বাসায়। কিন্তু তার মামা তাকে বিয়ের জন্য যেতে দেননি।
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে রিদ। রিদের মায়ের এখন কন্ডিশন ভালো। মিসেস ফাবিহা হস্পিটালে থেকেই রিদকে বলছেন তার বিয়ের কথা। রিদ যেন তার জন্য বউমা নিয়ে আসে। ছেলেকে বিয়ে করিয়েই মুক্তি পেতে চান তিনি। রিদ পড়ে গেল চিন্তায়। সে কিছুই বললো না তখন। ডাক্তার দেখিয়ে মা আর বোনকে নিয়ে বাসায় ফেরে।
নিজের রুমে এসে রিদ তাহনাকে কল দেয়।
এদিকে সেই নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে তাহনার মাথা গরম হয়ে যায়। রাগে সে কল কেটেই দিল। এ নিয়ে তিনবার কল দিয়েছে রিদ। একবার কেটে দিল, ২য় বার ধরেনি। ৩য় বার সুইচ অফ করে রেখেছে তাহনা।
রিদের রাগও আকাশ সমান। সেও তার ফোন ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। ভাগ্য ভালো ফোনটা পাপসের উপর পড়েছিল। নাহলে দু খন্ড হয়ে যেত।
ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রিদ। সাথে সাথেই ঘুম চলে আসে তার।
🌼
পরদিন সকালে রিদ উঠে ফ্রেশ হয়ে যখন নিচে এলো, তখন দেখে পাশের এক প্রতিবেশী মহিলা তার মা’কে দেখতে এসেছেন। রিদ কপি নিয়েই পাশের এক সোফাতে বসে ফোন চাপছিল। রিদের মায়ের সাথে মহিলাটি মিসেস ফাবিহাকে বলেন,
‘ভাবি এখন কেমন আছেন?’
মিসেস ফাবিহা হেসে বলেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।’
মহিলাটি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
‘ভাবি, ওই যে আপনাদের বাড়িতে একটা মেয়ে ছিল না? তাকে দেখছিনা যে?’
মিসেস ফাবিহা মলিন হেসে বলেন,
‘সে তো আপনি আসার পরদিনই চলে গেছে।’
‘কি বলেন ভাবি। আপনি মেয়েটাকে তাড়ায় দিছেন না? ভালো করেছেন। নাহলে আপনার ঘরই পুঁড়তো। অচেনা একটা অবিবাহিত মেয়ে বদনাম ছড়িয়ে দিত।’
‘আমি তাড়িয়ে কেন দিব? সে নিজেই চলে গেছে। এখন এসব বাদ দিন।’
মহিলাটি আবারও বলতে লাগলেন,
‘যাই বলেন ভাবি, আপনিও চাইছিলেন না যে মেয়েটা থাকুক। ঠিকি করেছেন, ঘরে আপনার একটা ছেলে। আর এখন মেয়েদের বিশ্বাস নেই।’
পাশ থেকে রিদ সবই শুনছিল। এসব শুনে গায়ে আগুন জ্বলে উঠছে তার।
মহিলাটি চলে যাওয়ার পর মিসেস ফাবিহা ছেলের দিকে তাকাকেই ভয় পেয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়ে যান। ছেলের চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে আছে। ছেলেকে এমন অগ্নিমূর্তি হতে কখনো দেখেননি তিনি।
কাঁপাকাঁপা গলায় মিসেস ফাবিহা জিগ্যেস করেন,
‘কি হ-য়ে-ছে রি-দ?’
রিদ উচ্চকণ্ঠে বলে,
‘তাহনা কি এজন্যই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে মা?’
‘বিশ্বাস কর, আমি ওকে কিছুই বলিনি এসব।’
‘মা, একটা মেয়ের নামে এসব যখন কেউ বলে, তখন তার মনের অবস্থাটা ঠিক কেমন হয় তুমি বুঝতে পারছ? আর কাকে নিয়ে বলেছে? তোমার ছেলেকে নিয়ে। আঙুল শুধু ওই অসহায় মেয়েটির উপর উঠেনি মা, তোমার ছেলের উপরও উঠেছে। জানি না তাহনার কেমন লেগেছে এসব শুনে। তুমি ওকে একবার আটকাতেও পারলে না? আর এসব মহিলাকে তুমি আর এ বাড়িতে ঢুকতে দিবেনা বলে দিলাম।’
রিদ রাগে গজগজ করতে করতে উপরে চলে গেল। মিসেস ফাবিহা সোফায় বসে চিন্তা করতে লাগলেন। এই ছেলে এবার কি অঘটন ঘটাবে কে জানে!
চলবে..